ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ৪ জুন ১৯৯৩। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার করা ২৮৯ রানের জবাবে ব্যাট করছে ইংল্যান্ড। অধিনায়ক গ্রাহাম গুচ ও মাইক আথারটনের ব্যাটে শুরুটা ভালোই পায় স্বাগতিকরা। আথারটনকে আউট করে অজিদের যখন ব্রেক থ্রু এনে দেন পেসার মার্ভ হিউজ, ইংল্যান্ডের রান তখন ১ উইকেটে ৮০। এমন সময়েই ২৪ বছর বয়সী লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নকে বোলিংয়ে আনলেন অসি অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার। ব্যাটিং প্রান্তে ছিলেন মাইক গ্যাটিং, যিনি এর আগে কখনোই এই বোলারের মুখোমুখি হননি। সেটাই যে ছিল তরুণ ‘ওয়ার্নি’র প্রথম অ্যাশেজ।
অ্যাশেজের মতো মহাযজ্ঞে প্রথমবার মাঠে নামার আগে নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে স্পিন বিষ ছুড়ে এসেছেন ওয়ার্ন। তবে পূর্বে যা কিছুই হোক না কেন, অ্যাশেজ বলে কথা! সেখানে প্রথমবার খেলতে নামা কোনো ক্রিকেটারের নার্ভাসনেস হওয়াটা স্বাভাবিকই।
কিন্তু ওয়ার্ন নিজের সহজাত বোলিংয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আর সেটা প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না। স্লিপ নিয়ে এলেন, এরপর চার-পাঁচ কদম হেঁটে হাত দিয়ে প্রথম ডেলিভারিটি ছুঁড়ে মারলেন ওয়ার্ন। আউটসাইড লেগ স্ট্যাম্পের পাশ দিয়ে ফুল লেংথে পিচ করে বল। স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের মতোই ব্যাট-প্যাড এগিয়ে দেন মাইক গ্যাটিং। কিন্তু তাবৎ বিশ্বকে হতভম্ব করে বলটি অবিশ্বাস্যভাবে বাঁক নিয়ে উপড়ে ফেললো গ্যাটিংয়ের অফ স্ট্যাম্প!
আউট হওয়ার পর গ্যাটিংয়ের বিস্ময়ভরা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কিছুক্ষণ আগে যা ঘটেছে, তা ছিল তার ভাবনারও বাইরে। পুরো বিশ্বও তখন হতবাক, এ-ও কি সম্ভব? তাই তো ডেলিভারিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’, অর্থাৎ শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি ছিল এটাই।
এরপর থেকে ওয়ার্ন রীতিমতো ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। ১৪৫ টেস্টে ৭০৮ উইকেট নিয়ে থেমেছেন সবচেয়ে উঁচু স্থানে থেকে, যদিও উইকেট-সংখ্যায় তাকে ছাড়িয়ে গেছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। শতাব্দীর সেরা না হোক, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস-হার্শেল গিবস-শিবনারায়ণ চন্দরপলদেরকে আউট করা ডেলিভারিগুলো এখনও মানুষের মুখে মুখে। তবে সেসবের মাঝে একটি উইকেটও কি ইতিহাসের সেরা উইকেট হিসেবে বিবেচনা করা যায়? যতই দুর্দান্ত বল হোক না কেন, সেগুলো কি ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী মূল্যবান উইকেট?
আভিজাত্যের টেস্ট ক্রিকেট, যার পরতে পরতে রোমাঞ্চের ছড়াছড়ি। ব্যাটসম্যানদের যেখানে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় সময়ের পর সময়, সেখানে বোলাররা অপেক্ষায় থাকে ১০টি ভালো বলের। সেই বলগুলো থেকে পরিস্থিতি বিবেচনায় টেস্ট ইতিহাসের সেরা তিনটি উইকেট বের করেছেন জনপ্রিয় ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর লেখক ও পরিসংখ্যানবিদ অনন্ত নারায়ণন।
ক্রেইগ ম্যাকডারমট, হন্তারক কোর্টনি ওয়ালশ, ১৮ (৫৭)
অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্রিসবেন (১৯৯৩)
সিরিজের প্রথম টেস্ট কোনোমতে ড্র করে বাঁচায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ম্যাচে হেসে-খেলেই ১৩৯ রানের জয় পায় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। সিডনিতে রানবন্যার ম্যাচে জয়-পরাজয়ের দেখা পায়নি কেউই। তাই বাকি দুই ম্যাচের মধ্যে একটিতে জিতলেই সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলবে অ্যালান বোর্ডারের দল।
ব্রিসবেনে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে ২৫২ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় ক্যারিবিয়ানরা। কার্টলি অ্যামব্রোসের ৭৪ রানে ৬ উইকেটের কল্যাণে ৩৯ রানের লিড পায় দলটি। কিন্তু সেটা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারেনি তারা। ১২৪ রানে ৫ উইকেটের পর টিম মে-র বোলিং তোপে ১৪৬ রানেই গুঁড়িয়ে যায় তারা। ফলে চতুর্থ দিনে ১৮৬ রানের লক্ষ্য পায় অস্ট্রেলিয়া। জবাবে শুরু থেকেই ক্যারিবিয়ান পেসারদের বিরুদ্ধে ভুগতে থাকে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা। একপর্যায়ে দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ১০২ রান।
নবম উইকেটে টিম মে’কে সঙ্গে ৪২ রানের জুটি গড়ে জয়ের আশা জাগিয়ে তোলেন জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ইয়ান বিশপের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে যখন সাজঘরে ফিরছেন এই ব্যাটসম্যান, তখনও ৪২ রানে পিছিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া। জয়ের পাল্লাটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকেই ঝুঁকে ছিল বেশি। মাত্র একটি ভালো বলেই জয়ের উল্লাসে মেতে উঠবে তারা। কিন্তু সেদিন যেন ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাট করছিলেন মে। শেষ ব্যাটসম্যান ক্রেইগ ম্যাকডারমটকে সঙ্গে নিয়ে কাটিয়ে দেন প্রায় দেড় ঘণ্টা। এর মাঝে যোগ করেন আরো ৪০ রান।
হারতে থাকা সেই ম্যাচটিতে জয় থেকে তখন মাত্র ২ রান দূরে দাঁড়িয়ে আছে অজিরা। শতকরা ৮৬.৭ ভাগই বলছে, দুই রান নিয়ে সিরিজ বাগিয়ে নেবে বোর্ডারের দল। ঠিক তখনই ওয়ালশের লাফিয়ে ওঠা বল কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুঁয়ে যায় ম্যাকডারমটের গ্লাভসে। উইকেটে পেছনে থাকা মারে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই তালুবন্দী করেন ক্যাচটি। ক্যারিবিয়ানরা তখন মেতে ওঠে ১ রানের নাটকীয় জয়ের বুনো উল্লাসে। যদি কোনোমতে ক্যাচটি ছেড়ে দিতেন মারে, তাহলে হয়তো টাই কিংবা জিতে যেত অস্ট্রেলিয়া। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজও আগেই হারিয়ে ফেলত জয় পাওয়া সেই সিরিজটি। তাই লেখকের বিচারে এটিই ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান উইকেট।
ডেভিডসন – রানআউট – ৮০
অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্রিসবেন (১৯৬০)
আবারও ব্রিসবেন, আবারও অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
টেস্ট ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত মাত্র দুটি ম্যাচে টাইয়ের দেখা পাওয়া গেছে। যার প্রথমটি হলো ১৯৬০ সালে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হওয়া অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার এই টেস্টটি। টস জিতে আগে ব্যাট করে স্যার গ্যারি সোবার্সের সেঞ্চুরিতে ৪৫৩ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে নর্ম ও’নিলের ১৮১ রানের ইনিংসে ৫২ রানে এগিয়ে থেকে প্রথম ইনিংস শেষ করে স্বাগতিকরা। অ্যালান ডেভিডসনের বোলিং তোপে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস ২৮৪ রানে অলআউট হয় সফরকারী দল। ফলে জয়ের জন্য অজিদের দরকার পড়ে ২৩৩ রান। আর সেটা পার করতে হবে ম্যাচের শেষ দিনেই।
জবাবে মাত্র ৯২ রানেই ৬ উইকেট খুইয়ে ফেলে হারের পথে এগোতে থাকে তারা। বড় ব্যবধানে জয়ের জন্য তখন অপেক্ষা করছে ক্যারিবিয়ানরা। তবে সপ্তম উইকেটে অধিনায়ক রিচি বেনোর সঙ্গে ১৩৪ রানের জুটি গড়ে ম্যাচের মোড় পাল্টে দেন ডেভিডসন। ৯২ রানে ৬ উইকেটে থাকা অস্ট্রেলিয়ার রান এখন সমান উইকেটে ২২৬। জয়ের জন্য দরকার মাত্র ৭ রান, হাতে আছে ৪ উইকেট। শতকরা হারের ৯১.২ ভাগই বলছে, জিততে চলেছে স্বাগতিকরা। কিন্তু তখনই বোলারদের দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নেন ক্যারিবিয়ান ফিল্ডাররা।
অধিনায়ক বেনোর সিঙ্গেল নেয়ার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বড় ভুলই করে ফেলেন ডেভিডসন। ক্রিজ থেকে তার বের হওয়ার সুযোগটা ভালোভাবেই নিয়ে নিলেন জো সলোমন, সরাসরি থ্রোতে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন তিনি। তবে রিচি বেনো থাকায় অসিদের জয়ের আশা তখনও শতকরা ৯০ ভাগের উপরে ছিল।
কিন্তু ৫২ রান করে হলের বলে বিদায় নেন অসি অধিনায়কও। শেষ দুই ব্যাটসম্যানকে সেই ডেভিডসনের মতোই রান আউটের ফাঁদে ফেলে ক্যারিবিয়ান ফিল্ডাররা। আর ২৩২ রানে অলআউট হয়ে টেস্ট ইতিহাসে প্রথম টাই ম্যাচ উপহার দেয় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বেনোর ডাকে ডেভিডসন সাড়া না দিলে হয়তো তেমনটা দেখাই যেত না।
৩. মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ, হন্তারক স্টিভ হার্মিসন ২০ (৩১)
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, এজবাস্টন (২০০৫)
২০০৫ সালের অ্যাশেজকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা সিরিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে ১৮ বছর পর ছোট্ট ছাইদানিতে চুমু দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ইংল্যান্ড। আর সেই সিরিজের সেরা ম্যাচ হিসেবে গণ্য করা হয় এজবাস্টন টেস্টটিকে।
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে তিন ব্যাটসম্যানের ফিফটিতে ৪০৭ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় স্বাগতিকরা। জবাবে ৯৯ রানে পিছিয়ে থেকে প্রথম ইনিংস শেষ করে অজিরা। তবে নিজেদের দ্বিতীয় দ্বিতীয় ইনিংসে শেন ওয়ার্নের স্পিন বিষের সামনে দাঁড়াতে না পেরে ১৮২ রানেই অলআউট হয় মাইকেল ভনের দল। ফলে, আড়াই দিনে ২৮২ রান করার লক্ষ্য পায় সফরকারীরা।
জবাবে শুরুটা বাজে হয় তাদের। ১৩৭ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে দলটি। তৃতীয় দিনের শেষ প্রহরে অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইকেল ক্লার্ক যখন আউট হন, তখনও জয় থেকে ১১৭ রান দূরে রয়েছে অজিরা। হাতে আছে মাত্র দুই উইকেট। নাটকীয়তার তখন ঢের বাকি।
চতুর্থ দিনের শুরুতে জুটি গড়ে তোলেন শেন ওয়ার্ন ও ব্রেট লি। নবম উইকেটে ৪৫ রান যোগ করে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের বলে ফিরে যান ওয়ার্ন। এক উইকেট হাতে নিয়ে ৬০ রানেরও বেশি অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভবের কাজ। সেই অসম্ভব কাজটাই সম্ভবের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন লি। সঙ্গে ছিল মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ।
তিলে তিলে রান যোগ করে জয়ের একদম কাছাকাছি চলে এসেছিল তারা। জয়ের জন্য বাকি আর মাত্র ৩ রান। শতকরা হার দেখাচ্ছে, ৮৭.৫ ভাগ জয়ের সুযোগ আছে অসিদের। ঠিক তখনই স্টিভ হার্মিসনের বাউন্সার সামলাতে না পেরে উইকেটের পেছনে থাকা জেরাইন্ট জোন্সকে সহজ ক্যাচ দিয়ে দেন ক্যাসপ্রোভিচ। টান টান উত্তেজনায় জমে ওঠা সেই ম্যাচের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই। ২ রানের জয় পেয়ে ক্যাসপ্রোভিচের উইকেটটিই শেষ অবধি ইংল্যান্ডের কাছে হয়ে ওঠে মহামূল্যবান।