তিনি এমন কোনো চরিত্র নন যাকে ক্রিকেটপ্রেমী বা ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা প্রতিনিয়ত স্মরণ করেন। কিংবা তিনি এমন কোনো রেকর্ড গড়ে যাননি যা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়। সংখ্যার হিসেবে তার ক্যারিয়ারটা নিতান্তই সাদামাটা। টেস্টে ২৬.১২ ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২.২২ গড়ের একজন ক্রিকেটারকে আলাদা করে মনে রাখার কোনো কারণ নেই। কিন্তু রমেশ কালুভিতারানাকে মনে রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট লোকাচারে তার নাম সবসময় সমস্বরে উচ্চারিত হবে মাঠে তার উদ্যমী ব্যক্তিত্ব ও টপ অর্ডারে সনাথ জয়াসুরিয়ার সাথে তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য। পরিসংখ্যান হয়তো তার পক্ষে কথা বলবে না, কিন্তু শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের নবজাগরণে ‘লিটল কালু’র ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কার শিরোপা জয়ের পেছনে কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়ার ব্যাটিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি ম্যাচে এ দুজন প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের ফায়দা উঠিয়ে শ্রীলঙ্কাকে দিয়েছিলেন উড়ন্ত সূচনা ও মজবুত প্ল্যাটফর্ম।
কৃতিত্ব অনেকখানি প্রাপ্য তখনকার লঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার, কারণ তিনিই কালুভিতারানাকে জয়াসুরিয়ার সাথে ইনিংস উদ্বোধন করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর আগে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে ৬ কিংবা ৭ নাম্বারে ব্যাটিং করতে হত। ১৯৯৫-৯৬ এর বেনসন এন্ড হেজেস সিরিজটা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট, বিশেষ করে কালুভিতারানার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ ছিল। এই সিরিজে কালুকে জয়াসুরিয়ার ওপেনিং সঙ্গীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলাফল? ঐ সিরিজে শ্রীলঙ্কার হয়ে সর্বোচ্চ ২৫০ রান করেন কালুভিতারানা। স্ট্রাইক রেট ছিল ৯১.২৪।
তার সঙ্গী জয়াসুরিয়া অবশ্য নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি সেই সিরিজে, ১০ ম্যাচে ৬১.১৩ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন মাত্র ১৭৩ রান। কিন্তু উড়ন্ত শুরু ঠিকই এনে দিয়েছিলেন কালু। বেনসন এন্ড হেজেস সিরিজের নবম ম্যাচে করেন ৭৫ বলে ৭৭ রান। পরের ম্যাচগুলোতেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তিনি। পার্থে করলেন ৫৪ বলে ৫০। মেল
বোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেললেন ৬৮ বলে ৭৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। জয়াসুরিয়া ব্যর্থ হলেও কালুভিতারানার নৈপুন্যে তিনটি ম্যাচই জেতে শ্রীলঙ্কা। তিন ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে নিজের সামর্থ্যের জানান দেন কালুভিতারানা।
যখন সনাথ ও কালু ব্যাট করত, তখন আমরা এক কাপ চা খাওয়ার জন্যও উঠতাম না। এতটুকু মনে আছে যে সবসময় এক জায়গায় বসে তাদের ব্যাটিং দেখতে চাইতাম। আমি কখনোই এমন ব্যাটিং দেখিনি
– লেগস্পিনার উপুল চন্দনা
শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট নয়, সকল ক্রিকেটপ্রেমীর কাছেই তাদের ব্যাটিং ছিল ‘ব্রেথ অফ ফ্রেশ এয়ার’।
সেই সিরিজটা শ্রীলঙ্কা জিততে পারেনি, জিততে পারেনি টেস্ট সিরিজটাও। তবে নিশ্চিতভাবেই তাদের চোখ ছিল বড় কিছুর দিকে। কালুভিতারানার মাঝে শ্রীলঙ্কা এখন নতুন নির্ভরযোগ্য উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে খুঁজে পেয়েছিল। রানাতুঙ্গার খেলা জুয়াটা বেশ ভালোভাবেই কাজে লেগে যায় এবং তার প্রত্যাশা ছিলো কালু আসন্ন বিশ্বকাপেও তার আস্থার প্রতিদান দেবেন।
তিরাশির ভারতের মতো ছিয়ানব্বইয়ের শ্রীলঙ্কাও আসর শুরু করে ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে। শ্রীলঙ্কায় তখনও ক্রিকেট কারো প্রধান জীবিকা নয়, বরং বিভিন্ন পেশার মানুষ ‘পার্ট টাইম জব’ হিসেবে ক্রিকেট খেলতেন। এটা ভালো করা বোঝা যায় তখনই, যখন আপনি জানতে পারবেন যে এর আগের ৫ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা সর্বসাকুল্যে ম্যাচ জিতেছিল চারটি। তার মাঝেই ছোটখাট একটা ধাক্কা খায় শ্রীলঙ্কা যখন অস্ট্রেলিয়ায় মুত্তিয়া মুরালিধরনের বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগে ‘নো বল’ ডাকেন আম্পায়ার। কিন্তু মুরালি পাশে পান অধিনায়ক রানাতুঙ্গাকে।
সাবেক লঙ্কান ক্রিকেটার ও তখনকার নির্বাচক সিদাথ ওয়েট্টিমুনির মতে, রানাতুঙ্গা ধারণা করতে পেরেছিলেন যে এই দলটা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সামর্থ্য রাখে।
ব্যাপারটা এমন ছিল যেন কেউ অর্জুনাকে আগেই বলে রেখেছিল যে শ্রীলঙ্কা এবার শিরোপা জিততে যাচ্ছে। কোনো জ্যোতিষী বলে থাকতে পারে। একে আমি আত্মবিশ্বাস বলব, নাকি অতি-আত্মবিশ্বাস বলব জানি না। তবে সে জানত শ্রীলঙ্কাই জিতবে।
– ওয়েট্টিমুনি
১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি কলম্বো সেন্ট্রাল ব্যাংকে বোমা হামলার কারণে নিরাপত্তার ভয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর জন্য শ্রীলঙ্কা যায়নি। আর এই দুই ম্যাচের মাঝে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে শ্রীলঙ্কা।
ক্রিকেটটা এখন যেভাবে খেলা হয়, ২০-২৫ বছর আগে এভাবে হত না। এখনকার চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল। শুরুর পনের ওভারে ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে দুজন ফিল্ডার থাকতে পারত। এতে ব্যাটসম্যানদের সুযোগ থাকত ফিল্ডাররা ছড়িয়ে যাওয়ার আগে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাউন্ডারি আদায় করে রান বাড়িয়ে নেয়ার। তবে এই সুযোগটা তখন পর্যন্ত খুব বেশি ব্যাটসম্যান নিয়েছিলেন বা নিতে পেরেছিলেন, ব্যাপারটা তেমন না। অধিকাংশ সময়ই দলগুলো মূলত হাতে উইকেট রেখে শেষ দশ ওভারে হাত খুলে খেলার পরিকল্পনা নিয়ে নামত। কিন্তু শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।
এটা সেই যুগ ছিলো যখন প্রথম ১৫ ওভারে ৫০-৬০ রানকে মনে হত পর্যাপ্ত। কিন্তু ‘৯৬ বিশ্বকাপে এই ধ্যানধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখাল শ্রীলঙ্কা। প্রথম ১৫ ওভারে শ্রীলঙ্কা ভারতের বিপক্ষে করেছিল ১১৭, কেনিয়ার বিপক্ষে ১২৩, কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিল ১২১। এবার সর্বশেষ সিরিজে ব্যর্থ হওয়া জয়াসুরিয়া ব্যাট হাতে ছড়ি ঘোরালেন, তবে খুব একটা সফল হতে পারলেন না কালু। কিন্তু সফল হল তাদের উদ্বোধনী জুটি। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতাটা যে তার ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়, সেটা কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলে দেয়া যায়।
অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা কালু হয়তো ছোটবেলায় কখনো ভাবেননি এত বড় অর্জনের সাক্ষী হতে পারবেন তিনি। বিশেষ করে পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তো নয়ই।
খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার বয়স তখন ছিল পাঁচ বছর, বোধহয় বাবার মৃত্যুর কষ্ট লাঘব করতেই মা আমি যা চাই তা করতে দিয়েছিলেন।
– কালু
স্কুলে ক্রিকেটের চর্চা করা খুবই কঠিন কাজ ছিল তার জন্য, কিন্তু ক্রিকেট যার রক্তে তাকে তো আটকে রাখা যায় না। স্কুল ক্রিকেটে ভালোই নাম করলেন কালু। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বেশ কিছু ম্যাচ খেলার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিংহলিজ স্পোর্টিং ক্লাবে ১৯৯২ সালে অভিষেক হয় তার। অভিষেকেই ক্রেইগ ম্যাকডারমট, মাইক হোয়াইটনি, শেন ওয়ার্নের মতো বোলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করলেন ‘লিটল কালু’।
শুরুতে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পরেও কালুকে একাদশে জায়গা ধরে রাখতে লড়াই করতে হয়েছিল। এরপর এলো সেই বেনসন এন্ড হেজেস সিরিজ, যেখানে পুরো বিশ্ব দেখেছিল কালুভিতারানা কী করতে পারেন। এমসিজিতে ম্যাকডারমট, পল রেইফেল ও ওয়ার্নকে একহাত নিয়েছিলেন। অফ স্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে সেই দুর্দান্ত পুল শট আর ম্যাকডারমটের বিরুদ্ধে বলের লাইন বরাবর তার দুর্দান্ত ব্যাট সুইং ছিল চোখের জন্য শান্তি। বলার অপেক্ষা রাখে না, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ভয়ডরহীনতার আবির্ভাব ঘটে উচ্চতায় খাটো এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের হাত ধরেই।
কালুভিতারানা আগ্রাসী একজন ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি ছিলেন একজন দুর্দান্ত উইকেটরক্ষক। মুরালির ‘বক্স অফ ট্রিকস’ খুব ভালোভাবে পড়ার দক্ষতা ছিল তার। ‘৯৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুরালির বলে ওয়ার্নকে করা তার বিদ্যুৎগতির স্টাম্পিং কে ভুলতে পারে!
১৯৯৯-২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে হাসান তিলকরত্নের বলে নাসের হুসেইনকে করা অবিশ্বাস্য স্টাম্পিং তার উইকেটরক্ষণ ক্ষমতার যথাযথ প্রমাণ দেয়। নাসের ডাউন দ্য উইকেটে আসার কারণে এক মূহুর্তের জন্য বলের গতিপথ বুঝতে পারেননি কালু। বল যাচ্ছিলো তার উল্টোদিকে। দুর্দান্ত দক্ষতায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে গতিপথ পরিবর্তন করে নাসেরকে আউট করেন। স্কোরকার্ডে হয়তো লেখা থাকবে হাসান তিলকরত্নের নাম, কিন্তু উইকেটটার আসল মালিক নিঃসন্দেহে কালুভিতারানা।
টেস্ট অভিষেকে শতকের পর দীর্ঘতম সংস্করণে ২য় শতকের জন্য কালুকে অপেক্ষা করতে হয় পাঁচ বছর। ডানেডিনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কঠিন পরিস্থিতিতে অবিচল থেকে শতক তুলে নেন তিনি। কালুভিতারানার প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল কিউইরা, ৪৫ গড়ে ৭ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৯৬ রান করেছিলেন তিনি।
কুমার সাঙ্গাকারার আগমন আর ভবিষ্যতের ভাবনায় শ্রীলঙ্কা দলে কালুর জায়গা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ২০০৪ সালে তিনি অবসর নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে।
উচ্চতা ছিল কম, কিন্তু টপ অর্ডারে ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের যে মন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, তার উচ্চতা মোটেই কম ছিল না। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা যাকে বলে তা তার ছিলো না কখনো, বরং প্রচন্ড পরিশ্রম, দৃঢ়চেতা মনোভাব আর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উইকেটরক্ষক পরিচয় ছাপিয়ে কালু হয়ে উঠেছিলেন একজন বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান। শুরুর ১৫ ওভারে খোদ গ্লেন ম্যাকগ্রার জন্যও তিনি ছিলেন ‘ডেঞ্জারাস কাস্টমার’। তার দুর্দান্ত ড্রাইভ আর পুল শট খেলার দক্ষতা ছিল বোলারদের মাথাব্যথার কারণ।
যে সময়টাতে উইকেটরক্ষকেরা শুধুমাত্র উইকেটরক্ষণ ক্ষমতার জন্য দলে সুযোগ পেতেন, সেসময় আগ্রাসী ব্যাটিং করেছেন, খেলেছেন ভয়ডরহীন ক্রিকেট। পরিসংখ্যান হয়তো কথা বলবে না তার পক্ষে, কিন্তু রমেশ শান্তা কালুভিতারানা ছিলেন একজন এন্টারটেইনার, একজন ম্যাচ উইনার।