প্রকৃতির দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঋতুরাজ বসন্ত। চারশ’ বছর আগে, সেই ১৫৫৬ সালে বসন্তের এক দিনে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের। ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ধরা হয় তাকে। মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর এই ফেব্রুয়ারি (১১ ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ থেকে ২৭ অক্টোবর ১৬০৫) মাসেই মসনদে আসীন হয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহভাগের শাসনকর্তা হওয়া এই শাসকের নামের পাশে জুড়ে যায় ‘আকবর দ্য গ্রেট’ তকমা।
কে জানতো, এত শত বছরের পর সেই বসন্তের মধুমাসের আগমনী দিনে বাংলাদেশের দরজায় হাজির হবে বিশ্বজয়ের গৌরব! কে জানতো, ইতিহাসের পাতায় দীপ্যমান আকবর আরেকবার অকস্মাৎ হাজির হবেন এই বাংলায়, জিতবেন বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট! একের পর এক দুঃখগাঁথার ভার বইতে বইতে ক্লান্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটকে জাগিয়ে তুলবেন স্বপ্নীল আবেশে, ভুবনজয়ী হাসির ফোয়ারায়, ভরা পূর্ণিমার আলোয়!
মুঘল সালতানাতের সম্রাট না হলেও আকবর আলী নামের এক দুর্দমনীয় প্রতিভার নেতৃত্বের হাত ধরে বিশ্ব জয়ের গৌরব অর্জন করলো বাংলাদেশ। রংপুরের এই তরুণের নামের পাশে ‘আকবর দ্য এমপেরর’ এখন বেশ মানিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বাধীন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মাধ্যমে ক্রিকেট দুনিয়ায় রাজার আসন পেয়েছে বাংলাদেশ।
সম্রাট আকবর ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। আর বাংলার অকুতোভয়, সাহসী তরুণ আকবর ভারতকে হারিয়েই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বসেরার কাতারে নাম উঠেছে বাংলাদেশের। লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছে যুব ক্রিকেটে এক নম্বর দলের স্বীকৃতি।
দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে গত ৯ ফেব্রুয়ারি আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেট পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে রচনা করেছে নতুন ইতিহাস। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর যেকোনো পর্যায়ে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে এটিই বাংলাদেশের প্রথম ট্রফি জয়। সন্দেহাতীতভাবেই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন।
অনেক অপ্রাপ্তি, হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করা গল্প পেরিয়ে এসেছে স্বপ্নের ট্রফি। জগৎবিখ্যাত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দু’হাত ভরে দিয়েছে বাংলাদেশকে। পূর্ণতার তৃপ্তি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরছে বাংলাদেশের যুব ক্রিকেট।
অবশেষে ভারতের দেয়াল ভাঙার তৃপ্তি
বাংলাদেশের ক্রিকেট হৃদয়ে ‘পাষাণভার’ হয়ে বসেছিল বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের প্রতিপক্ষ ভারত। সিনিয়র-জুনিয়র সব ধরনের ক্রিকেটেই প্রতিবেশী দেশটির সামনেই বারবার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে বাংলাদেশের। পচেফস্ট্রুমে সেই দেয়াল ভাঙতে পেরেছে যুব দল। শৃঙ্খল ছিঁড়ে বাংলাদেশকে বড় অর্জনের সন্ধান এনে দিয়েছে আকবর আলীর দল।
এই যুব দলটাই গত বছর দু’টি ফাইনালে ভারতের কাছে হেরেছিল। বুকের ভেতর জগদ্দল পাথর হয়েছিল একের পর এক হারের করুণ দৃশ্য। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ভারতের দেয়ালে আটকে যায় আকবরদের শিরোপার স্বপ্ন। পরে শ্রীলঙ্কার মাটিতে এশিয়া কাপের ট্রফিটাও নাগালে চলে এসেছিল। দুর্দান্ত বোলিংয়ে ভারতকে ১০৬ রানে আটকে দিয়েছিল টাইগার জুনিয়ররা। কিন্তু ব্যাটিংয়ে তালগোল পাকিয়ে স্নায়ুর লড়াইটা চালিয়ে যেতে না পারায় ৫ রানের অবিশ্বাস্য পরাজয়ে রানার্সআপ হয়ে যায় বাংলাদেশ যুব দল।
নিউ জিল্যান্ডে যুব বিশ্বকাপের আগের আসরেই কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল সাইফ হাসানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল।
বড় মঞ্চে ভারতের কাছে টানা হারের গল্প জমে ভারী হচ্ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের আকাশ। যুব বিশ্বকাপে আবারও সেই ভারতকেই সামনে পায় যুবারা। এবারও টানটান উত্তেজনার ফাইনালের মঞ্চ, যেখানে প্রথমবার পা রাখে বাংলাদেশ। এবং চারবারের চ্যাম্পিয়নদের রাজ্যের হতাশায় ডুবিয়ে ট্রফি জিতে নেয় আকবর বাহিনী। ভারতের কাছে ট্রফি হারানোর অধ্যায়টা আপাতত চাপা দিতে পেরেছে যুব দল। বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখলো সাফল্যের নতুন সূর্যোদয়।
যেভাবে ফাইনালে বাংলাদেশ
বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগেই অধিনায়ক আকবর আলীসহ দলের অনেক ক্রিকেটার বলে গেছেন, এই দলটার সামর্থ্য আছে বিশ্বকাপ জেতার। ট্রফি জিততেই যাচ্ছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। আকবর বলেছিলেন, দলের সবার বিশ্বাস আছে ট্রফি জেতার। এবং তা সবাই বিশ্বাস করে।
বিশ্বকাপের আগে গত দুই বছরে ৩০টি ওয়ানডে খেলেছিল বাংলাদেশ যুব দল, যা দলটাকে এই ফরম্যাটের সর্বোচ্চ প্রস্তুতির সুযোগ করে দিয়েছিল। ‘সি’ গ্রুপ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ৯ উইকেটে, দ্বিতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডকে ৭ উইকেটে পরাজিত করে জুনিয়র টাইগাররা। গ্রুপপর্বের তৃতীয় ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলতে নামে বাংলাদেশ। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। তবে বৃষ্টির আগে ব্যাট হাতে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ১০৬ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। সেই ধাক্কা বড় হতে পারেনি বৃষ্টির কারণে।
কোয়ার্টার ফাইনালে নতুন শুরু পায় বাংলাদেশ। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে রীতিমতো উড়িয়ে দেয় আকবরের দল। ১০৪ রানের জয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয় যুবারা। এবার প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ড। কয়েক মাস আগে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজ হারা নিউ জিল্যান্ড বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে অনায়াসে হারিয়েছিল বাংলাদেশকে। তাই সেমিকে ঘিরে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। মাহমুদুল হাসান জয়ের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে উবে যায় সেই সব শঙ্কা। চাপের মুখে ১২৭ বলে ১০০ রানের দৃষ্টিনন্দন এক ইনিংস খেলেন জয়। ৬ উইকেটের জয়ে ফাইনালের চৌকাঠে পা রাখে বাংলাদেশ।
যুবাদের হাত ধরে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে প্রথমবার ফাইনালে উঠার ইতিহাস গড়ে লাল-সবুজের পতাকা। সাকিব-মুশফিকদের সোনালী প্রজন্ম, বিজয়-সৌম্যদের প্রতিভার ঢল যা পারেনি, আকবরের দলটা সেটিই করে দেখালো বিপুল বিক্রমে।
পচেফস্ট্রুমের পয়মন্ত মাঠেই ট্রফির মিশন
বিশ্বকাপের আগে পচেফস্ট্রুমেই প্রস্তুতি ক্যাম্প করেছিল বাংলাদেশ দল। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এই শহর থেকেই বিদায় নিয়ে আকবর বাহিনী। বিশ্বকাপের ছয়টি ম্যাচই পচেফস্ট্রুমে খেলেছে বাংলাদেশ, যার মধ্যে পাঁচটি ম্যাচই সেনওয়েস পার্কের মাঠে। একটি ম্যাচ শুধু উইটর্যান্ড ওভালের মাঠে খেলেছিল জুনিয়র টাইগাররা। সেটি গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচ, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। এছাড়া সেনওয়েস পার্কের বাইরে যেতে হয়নি বাংলাদেশকে।
অবশ্য এমনটি হয়েছে বাংলাদেশ গ্রুপপর্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়। আগেই জানা ছিল, গ্রুপপর্বের শীর্ষে থাকলে ফাইনাল অব্দি বাকি সব ম্যাচই খেলতে হবে পচেফস্ট্রুমে। গ্রুপপর্বে রানার্সআপ হলেই ভেন্যু বদলে যেত। গ্রুপপর্বে পাকিস্তানের ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়া ছাড়া এই মাঠে সব ক’টি ম্যাচই জিতেছে বাংলাদেশ। চেনা কন্ডিশনে ফাইনালটাও খেলেছেন শরীফুল-রাকিবুলরা। কার্যত একই ভেন্যুতে সব ম্যাচ খেলার সুযোগ শাপেবর হয়েই ধরা দিয়েছিল বাংলাদেশ শিবিরে।
ধ্রুপদী ফাইনাল: ট্রফির ভিত গড়েন বোলাররা
পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ফাইনালে টস জিতেও ফিল্ডিং নিয়েছিল বাংলাদেশ। চাপের মঞ্চে রান তাড়া করার চ্যালেঞ্জটা নেয় টাইগার জুনিয়ররা। ম্যাচে বাংলাদেশ দলের এগিয়ে যাওয়ার গতিপথ ঠিক করে দেয় ইনিংসের শুরুতে নতুন বলে শরীফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিবের বোলিং। যেন বারুদ ঠিকরে বের হচ্ছিল ওদের বোলিং ও শরীরী ভাষায়। অসাধারণ বোলিং এবং আগ্রাসনে ভারতীয় ওপেনারদের চমকে দেন শরীফুল-সাকিব।
প্রথম ওভারেই জসওয়ালকে কয়েক কথা শুনিয়ে দেন মেডেন নেয়া শরীফুল। পরের ওভারে মেডেন নেয়া সাকিব যেন আরেক কাঠি সরেস। ফলো-থ্রুতে এসে বল ছুঁড়লেন স্ট্যাম্পের দিকে। উইকেট ছেড়ে বের হয়ে আসা সাক্সেনার মাথার পাশ দিয়ে চলে যায় বল। তাদের ভীতির চাদরের ফলটা পায় বাংলাদেশ সপ্তম ওভারে। নিজের প্রথম ওভারেই অভিষেক দাস ফেরান সাক্সেনাকে। ফাইনালে থার্ড সিমার হিসেবে অভিষেকের অন্তর্ভুক্তিটা ছিল বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের দারুণ মুন্সিয়ানার অংশ। স্পিনার হাসান মুরাদকে বসিয়ে পেসার অভিষেককে একাদশে আনার সিদ্ধান্ত ছিল কার্যকর।
জসওয়াল ও তিলক ভার্মার ইনিংস বিনির্মাণের প্রচেষ্টা থামান সাকিব। দ্বিতীয় স্পেলে এসে ফেরান তিলক ভার্মাকে। দলীয় ১০৩ রানে তিলক আউট হন ৩৮ রান করে। ভারতীয় অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ (৭) থিতু হতে পারেননি উইকেটে। ধ্রুব জুরেলকে নিয়ে স্কোরটা দুইশ পার করার মিশনে ছিলেন জসওয়াল। ৪০তম ওভারে এই বাঁহাতি মিড উইকেটে ক্যাচ দেন শরীফুলের বলে, আউট হওয়ার আগে ৮৮ রান তোলেন স্কোরকার্ডে। তারপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারায় ভারত। ২২ রান করে জুরেল রানআউট হলে আর কেউ দু’অঙ্কের ঘরেই যেতে পারেননি। ২১ রানে শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে ১৭৭ রানে থামে ভারত। অভিষেক দাস ৩টি, শরীফুল-সাকিব ২টি করে, রাকিবুল ১টি উইকেট নেন।
ধ্রুপদী ফাইনাল: আকবরের ব্যাটে সিংহাসন জয়
লো স্কোরিং ম্যাচ, তাও পেন্ডুলামের মতো দুলছিল। ১৭৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশকে স্বপ্নের শুরু এনে দেন দুই ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম ও পারভেজ হোসেন ইমন। নবম ওভারেই ৫০ রান তুলে ফেলেন তারা। তারপরই আসলে ম্যাচে বাঁক বদলের শুরু। আইপিএলের দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবে সুযোগ পাওয়া লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণয় ২২ গজে ধরা দিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে।
শুরুটা হয় তামিমকে দিয়ে। বিষ্ণয়ের প্রথম ওভারেই ছক্কা হাঁকানো তামিম (১৭) আবারও একই শট খেলতে গিয়ে জসওয়ালের হাতে ক্যাচ দেন। বিষ্ণয়ের ঘূর্ণিতে মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন। তার লেগ স্পিনে ৬৫ রানেই নেই ৪ উইকেট, সঙ্গে ওপেনার ইমন মাসল ক্র্যাম্প নিয়ে ফিরেন সাজঘরে।
তখন থেকেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের মন্ত্র দেখায় অধিনায়ক আকবর আলীর ব্যাট। একপ্রান্তে উইকেট পড়লেও একটুও বিচলিত হতে দেখা যায়নি এই তরুণকে। শান্ত, ধীর-স্থিরভাবে এগিয়েছেন। তবে যোগ্য সঙ্গী পেয়েছেন কমই। ৭ রান করে শামীম হোসেন ও ৫ রান করে অভিষেক দাস আউট হন।
প্রাথমিক চিকিৎসা, মেডিসিন নিয়ে ২২ গজে ফিরে আসেন ইমন। বাংলাদেশ দল তখন কার্যত অকূল পাথারে, ১০২ রানে নেই ৬ উইকেট। সপ্তম উইকেটে আকবর-ইমনের ব্যাটে ধীরে ধীরে ফিরছিল জয়ের আশা। তারা ৪১ রান যোগ করেন। পার্টটাইম লেগ স্পিনার জসওয়ালের বলে ক্যাচ তুলে ফেরেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ইমন। তিনি ৪৭ রান করেন। ট্রফির স্বপ্নের অপমৃত্যু যেন আবারও ডাকছিল বাংলাদেশকে।
তবে দৃঢ়চেতা আকবর ভারতকে হতাশা উপহার দেয়ার কাজটা চালিয়ে গেছেন ঠাণ্ডা মাথায়। রাকিবুলের সঙ্গে অষ্টম উইকেটে ধীরে ধীরে দলকে জয়ের দিকে এগিয়ে নেন বাংলাদেশ যুব দলের অধিনায়ক। তাদের জুটি ২০ রান যোগ করতেই নামে বৃষ্টি। বাংলাদেশের স্কোর তখন ৭ উইকেটে ১৬৩। হাতে ছিল আরো ৯ ওভার। জয় থেকে তখন মাত্র ১৫ রান দূরে বাংলাদেশ।
পচেফস্ট্রুমের আকাশে মেঘের ঘনঘটা স্থায়ী হয়নি। মিনিট বিশেক পরই আবারও শুরু হয় খেলা। নতুন করে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৬ ওভারে ১৭০। অর্থাৎ, শেষ ৩০ বলে তুলতে হবে ৭ রান। সুশান্তের প্রথম বলে সিঙ্গেল, পরের দু’টি বলে ডট। চতুর্থ বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে চার মারেন রাকিবুল। নেমে আসে উত্তেজনার পারদ। এরপর শেষ বলেও একটি সিঙ্গেল নেন এই বাঁহাতি।
অথর্ব আনকোলেকারের করা পরের ওভারের প্রথম বলে কোনো ভুল করেননি রাকিবুল। মিড উইকেটে তুলে মেরে দুই ব্যাটসম্যান প্রান্তবদল করেন। ২৩ বল হাতে রেখেই ফাইনাল জিতে যায় বাংলাদেশ। ৪২.১ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭০ রান তুলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় বাংলাদেশ। ইয়ান বিশপের ভাষায়, অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংস খেলে ট্রফি জয়ের মিশনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন আকবর আলী। রাকিবুল ৯ রানে অপরাজিত থাকেন। বলা বাহুল্য, এই নয় রানের মাহাত্ম্যও কিছু কম নয়!
সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজয়ের দিগন্ত জোড়া উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে পচেফস্ট্রুমের বাংলাদেশ যুব দল, গ্যালারির প্রবাসী টাইগার সমর্থকরা এবং গোটা বাংলাদেশ। ডাগআউট থেকে শরীফুলরা রুদ্ধশ্বাসে ছুটে আসেন ২২ গজের পানে। বিজয়ের নায়ক আকবর ও রাকিবুলকে আলিঙ্গনে বাঁধেন। শিরোপা জয়ের বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতেন সবাই। লাল-সবুজ পতাকায় ছেয়ে যায় মাঠ। পচেফস্ট্রুমের সেনওয়েস পার্ক তখন যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।
বিশ্বজয়ের আনন্দ তো এমনই হয়!
আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে: আকবর
বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়েই দেশ ছেড়েছিল বাংলাদেশ যুব দল। টুর্নামেন্টের মাঝপথে বড় বোনকে হারানোর শোক সামলাতে হয়েছে অধিনায়ক আকবরকে, যে খবর নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দলকে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে আকবর দলকে নিয়ে এগিয়ে গেছেন ট্রফির নেশায়। অদম্য প্রচেষ্টায় স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আকবর বলেছেন,
‘আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। সর্বশেষ দুই বছরের কষ্ট সার্থক হয়েছে। আমাদের দলের কোচ, সাপোর্টিং স্টাফ এবং নির্বাচকরা আমাদের যে সাপোর্ট দিয়েছেন মাঠে এবং মাঠের বাইরে, তাদের ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা নেই।’
এই বিশ্বসেরার স্বীকৃতি থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের বদলের আশা করছেন আকবর। বিশ্বকাপজয়ী এই অধিনায়ক বলেছেন,
‘আমি আশা করছি, এই বিশ্বকাপ জয় সামনে আমাদের ক্রিকেটকে বদলে দিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। আমি বলব, এটা মাত্র শুরু। আমাদের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। আমাদের এই ক্ষুধাটা ধরে রাখতে হবে সিনিয়র সাইডদের জন্য। আমরা যখন বড়দের দলে যাব, এই ক্ষুধা, মানসিকতা এবং শক্তি তখন কাজে আসবে।’
মাসল ক্র্যাম্প করার পরও ওপেনার ইমন ব্যাটিংয়ে এসেছেন দলের প্রয়োজনে। ৪৭ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলা এই বাঁহাতি বলেছেন,
‘এটা দারুণ একটি অভিজ্ঞতা ছিল। এখন আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমি খুবই আনন্দিত। লক্ষ্য তাড়া করা খুব কঠিন ছিল। আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।’
অথচ ম্যাচের সংবাদ সম্মেলনে আকবরের দেয়া তথ্য মতে, দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নামার সময় ৩০ ভাগও ফিট ছিলেন না ইমন। ট্রফির নেশায় বুঁদ যুবারা এভাবেই স্বর্বস্ব নিংড়ে দিয়েছে পচেফস্ট্রুমে। শেষ বিন্দু দিয়ে করা লড়াইয়ের পর এসেছে বহুল কাঙ্খিত ট্রফি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের তৃষিত হৃদয় পেয়েছে ট্রফি নামক সুধার সন্ধান।