রিয়াল মাদ্রিদের রেকর্ড চৌদ্দতমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপো জয়ের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিতভাবেই সবার প্রথমে উঠে আসবে একের পর এক গোলের পসরা সাজিয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো করিম বেনযেমার নাম। চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউটের ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষের মুহূর্মুহূ আক্রমণে যখন মাদ্রিদের রক্ষণভাগ ক্রমাগত খাবি খাচ্ছিল, তখন একা হাতে একের পর এক দুর্দান্ত সেভ করে দলের বিপদে ত্রানকর্তা হয়ে হাজির হওয়া থিবো কোর্তোয়াও বেনজেমার কাছাকাছিই থাকবেন।
কিন্তু এদের পাশাপাশি আরেকজনের নামও উঠে আসবে, এক মৌসুম আগেও যিনি খোদ মাদ্রিদ ভক্তদের কাছেই শিশুসুলভ গোল মিসের কারণে সমালোচনা আর হাসি তামাশার পাত্র ছিলেন। হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই ধরেছেন; কার্লো আনচেলত্তির পরশ কাঠির ছোঁয়ায় গত মৌসুমে বদলে যাওয়া ভিনিসিয়াস জুনিয়রের কথাই বলছি, ফাইনালে যার একমাত্র গোলেই মাদ্রিদ জিতে নিয়েছে ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার আসর।
গত মৌসুমটা দুর্দান্ত কেটেছে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের, ৫২ ম্যাচে ২২ গোলের পাশাপাশি করেছেন ২০টি অ্যাসিস্ট। এই মৌসুমের শুরুটাও করেছেন গত মৌসুমে যেখানে শেষ করেছিলেন ঠিক সেখান থেকেই। লিগে ৩ ম্যাচে ২ গোল এবং ১ অ্যাসিস্ট করে গত মৌসুমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখারই আভাস দিচ্ছেন।
এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, যে ভিনিসিয়াস জুনিয়র জিদানের অধীনে নিজের পারফরম্যান্সের জন্য এতটা সমালোচিত হচ্ছিলেন, আনচেলত্তির অধীনে তার এমন বদলে যাওয়ার রহস্যটা কী! আজকে আমরা সেটা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
খালি চোখে জিদানের অধীনে খেলা ভিনিসিয়াস আর আনচেলত্তির অধীনে খেলা ভিনিসিয়াসের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা যাবে না। জিদানের অধীনে ভিনিসিয়াস একের পর এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলের সামনে গিয়ে হাস্যকর সব মিস করতেন। আনচেলত্তির অধীনে তার ড্রিবলিংয়ের ধার একরত্তিও কমেনি, বরং গোলের সামনে এক অন্য ভিনিসিয়াসকে দেখা যাচ্ছে।
প্রথমত, আনচেলত্তি ভিনিসিয়াসের বেসিক খেলার ধরনে খানিকটা পরিবর্তন এনেছেন। জিদানের অধীনে দেখা যেত ভিনিসিয়াস বেশিরভাগ সময়ই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার এবং মিডফিল্ডারদের মধ্যকার ‘বিটুইন-দ্য-লাইনে’ অবস্থান করতেন। সেখান থেকে বল পায়ে ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে যেতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় একটা সমস্যা ছিল প্রতিপক্ষের ২-৩ জন খেলোয়াড়কে কাটাতেই তার স্ট্যামিনা শেষ হয়ে যেত অনেকাংশেই, যে কারণে বক্সের ভেতরে গিয়ে আসল কাজ করতেই গড়বড় পাকিয়ে ফেলতেন। এজন্য আনচেলত্তি ভিনিসিয়াসের কাজকে আরো অনেক সহজ করে দিয়েছেন।
আনচেলত্তির অধীনেও ভিনিসিয়াসকে প্রতিপক্ষ অর্ধের বামপাশের বিটুইন দ্য লাইনে অপারেট করতে দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে আনচেলত্তি তার ড্রিবলিং স্কিলের চেয়েও তার গতিকে কাজে লাগানোর দিকে বেশি জোর দিয়েছেন। ভিনিসিয়াসকে ব্যবহার করেছেন ‘ওল্ড স্কুল’ স্ট্রাইকারদের মতো, যে কি না প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পেছনের ফাঁকা জায়গা বরাবর রান নিয়ে আক্রমণে উঠে গোল করার চেষ্টা করবে।
আনচেলত্তি কাগজে কলমে রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলালেও মাঠের খেলায় তাদের ফর্মেশন ছিল অনেকটাই ৪-৪-২ এর মতো। তাদের মূল স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা প্রতিনিয়তই মিডফিল্ডে নেমে এসে পাস রিসিভ করতেন, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করতেন এবং তারপর সেই ফাঁকা জায়গায় ভিনিসিয়াসকে উদ্দেশ্য করে লং বল বাড়াতেন।
উপরের ছবিটিতে গত মৌসুমে ভিনিসিয়াসকে লক্ষ্য করে বেনজেমার দেওয়া লং বলগুলো দেখানো হয়েছে। বেনজেমা মিডফিল্ড থেকে লেফট উইংয়ে ভিনিসিয়াসকে লক্ষ্য করে প্রচুর লং পাস বাড়িয়েছেন, যেগুলোর বেশিরভাগই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে পৌছে গেছে ভিনিসিয়াসের পায়ে। এতে করে তাকে বাড়তি পরিশ্রম করে ২-৩ জন ডিফেন্ডারদের মুখোমুখি হতে হয়নি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিনিসিয়াসকে প্রতিপক্ষের রাইটব্যাকের মুখোমুখি হতে হয়েছে। গত মৌসুমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিনি ৬৮.৯ শতাংশ সময়ই প্রতিপক্ষের রাইটব্যাককে ড্রিবলিংয়ে পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে পড়তে পেরেছেন। ভিনিসিয়াসের এভাবে লেফট উইং থেকে বক্সে কাটইন করার মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদ গত মৌসুমে মোট ১৫ বার প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
রিয়াল মাদ্রিদের লেফটব্যাক মেন্ডি যখন বল রিসিভ করেন, তখন লিভারপুলের রাইটব্যাক অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ভিনিসিয়াসকে মার্ক করে রেখেছেন। কিন্তু মেন্ডি বেনজামাকে পাস বাড়ানোর সাথে সাথেই আরনল্ড বেনজামার দিকে অগ্রসর হন। এতে করে তার পেছনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়। বেনজেমা বল রিসিভ করার আগেই ভিনিসিয়াস সেই স্পেস ধরে রান নেয়। বেনজেমা বল রিসিভ করে কুইক টাচে ভিনিসিয়াস বরাবর পাস বাড়ান। ফলে ভিনিসিয়াসের সামনে কাউন্টার অ্যাটাকে যাওয়ার চমৎকার একটি সেটআপ তৈরি হয়।
সাক্সেসফুল ড্রিবলিং এবং ড্রিবল করে সরাসরি বক্সে চলে যাওয়া – উভয় ক্ষেত্রেই ভিনিসিয়াস ছিলেন দুর্দান্ত। বর্তমান সময়ে ভিনিসিয়াস বল পায়ে থাকা অবস্থায় সবচেয়ে ভয়াবহ উইঙ্গারদের একজন। পরিসংখ্যানও তাই বলে, গত মৌসুমে তার ড্রিবলিংয়ের কারণে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ক্রমাগতই নাজেহাল হতে হয়েছে। ইউরোপের টপ লিগগুলোর সেরা উইঙ্গারদের সাথে তুলনাতেও ভিনিসিয়াস ছিলেন অনেকটা এগিয়ে।
ভিনিসিয়াসের প্রোগ্রেসিভ পাস রিসিভের হিটম্যাপের দিকে যদি খেয়াল করি, তার সতীর্থরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে প্রতিপক্ষ অর্ধে ফাঁকা জায়গা বের করে পাস বাড়িয়েছেন। ফলে ভিনিসিয়াস বল রিসিভ করার সাথে সাথেই তাকে প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়নি, বল রিসিভ করে কন্ট্রোলে নেওয়ার জন্য বেশ খানিকটা সময় পেয়েছেন। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় যখন তাকে প্রেস করতে শুরু করেছে ততক্ষণে তিনি পুরোদমেই তাদের ড্রিবল করে সামনে এগিয়ে গেছেন।
ভিনিসিয়াস গত মৌসুমে বল পায়ে প্রতিপক্ষের বক্সের দিকে প্রতি ম্যাচে গড়ে ২৬১.৮০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছেন, যা কিনা লা লিগার অন্যান্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়েই অনেক বেশি। তার প্রোগ্রেসিভ ক্যারির বেশিরভাগই দলের আক্রমণে গড়তে অনেক সাহায্য করেছে৷
ভিনিসিয়াসের বল ক্যারি শেষ হওয়ার হিটম্যাপের দিকে খেয়াল করা যাক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বল পায়ে অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর থেমেছেন প্রতিপক্ষের বক্সের বাম প্রান্তে এসে; অনেক সময় সরাসরি বক্সেই ঢুকে পড়েছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি বক্সে ঢুকে শট নেবার চেষ্টা করেননি; হয় কাছাকাছি থাকা সতীর্থের সাথে ওয়ান-টু পাস খেলে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের বিভ্রান্ত করে তারপর নিজেই গোল বরাবর শট নিয়েছেন, অথবা পাস বাড়িয়েছেন আরো ভালো জায়গায় অবস্থান নেওয়া সতীর্থ্য বরাবর।
পেনাল্টি এরিয়ায় তার ডেলিভারিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল তার প্রোগ্রেসিভ ক্যারি। ভিনিসিয়াস লেফট উইং থেকে ড্রিবলিং করে আড়াআড়িভাবে বক্সে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করতেন। গত মৌসুমে লা লিগায় এভাবে ৪৮ বার বল পায়ে বক্সে ঢুকে পড়েছেন, আগের মৌসুম থেকে যা কি না অনেকটাই বেশি। তবে নিজে সরাসরি বক্সে ঢুকতে না পারলে তার ডান পা দিয়ে হাফস্পেস থেকে ইনসুইং ক্রস কিংবা কাটব্যাক পাস বাড়িয়েছেন। লিগে তার ১২ অ্যাসিস্টের সবগুলোই এসেছে এই ধরণের পরিস্থিতিতেই।
করিম বেনজেমা যেমন ভিনিসিয়াসকে লং বল বাড়িয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পেছনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে রান নিতে সহায়তা করেছেন, তেমনি বক্সের কাছাকাছি গিয়ে ভিনিসিয়াসও খুঁজে নিয়েছেন বেনজেমাকে। ভিনিসিয়াসের পাস থেকে বেনজেমা মোট ২৯ বার গোল বরাবর শট নিয়েছেন, যেখান থেকে গোলও পেয়েছেন ৯ বার!
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিনিসিয়াস প্রতিপক্ষের বক্সের দিকে ড্রিবলিং করে ঢুকে গিয়েছেন, সেখান থেকে বেনজেমার লেট রানকে লক্ষ্য করে কাটব্যাক পাস বাড়িয়েছেন। বেনজেমাও দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দিয়েছেন।
উপরের ছবিতে ভিনিসিয়াসের গত ৩ মৌসুমের গোল এবং এক্সপেক্টেড গোলের তুলনার দিকে যদি খেয়াল করি, ভিনিসিয়াস আগের দুই মৌসুমেই তার এক্সপেক্টেড গোলের তুলনায় অনেক কম গোল করেছেন। কিন্তু গত মৌসুমে গোলের সামনে এক অন্য ভিনিসিয়াসকেই দেখা গেছে; প্রথমবারের মতো গোলের ট্যালিতে ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজের এক্সপেক্টেড গোলকে। অর্থাৎ নিজের ফিনিশিং দুর্বলতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ গোলস্কোরারে পরিণত হচ্ছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র।
আক্রমণের দিক থেকে ভিনিসিয়াসকে নিয়ে অনেক কিছুই বলা হলো। এবার রক্ষণভাগে তার কার্যকারিতা কতটুকু বেড়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
জিদানের অধীনে ভিনিসিয়াস বেশ ভালোভাবেই প্রেসিংয়ে অংশ নিতেন, ডিফেন্সে সাহায্য করতে নিচে নেমে আসতেন। আনচেলত্তির অধীনেও তার প্রেসিংয়ের ধরন অনেকটা একই। কিন্তু তিনি প্রতিপক্ষ অর্ধে প্রেসিংয়ে এখন অনেক বেশি কার্যকর।
উপরের ছবিতে গত মৌসুমে ফাইনাল থার্ডে ভিনিসিয়াসের বল রিকভারি ম্যাপ দেখানো হয়েছে। তার সফল প্রেসিংয়ের কারণে মাদ্রিদ যে শুধুমাত্র বলের দখলই ফিরে পেত তা নয়, মাদ্রিদের কাউন্টারপ্রেসিংয়ে তার বল রিকভারি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতো। গত মৌসুমে ফাইনাল থার্ডে ভিনিসিয়াস মোট ৭৩ বার বল রিকভার করেছে। এর মধ্যে ২০ বার তার রিকভারি থেকে সরাসরি গোলে শট নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যেখান থেকে তারা ৪টি গোলও পেয়েছে। প্রেসিংয়েও আনচেলত্তি ভিনিসিয়াসকে কতটা কার্যকরী বানিয়ে দিয়েছেন এতে করেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
গত মৌসুমের আগেও ভিনিসিয়াসের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল খোদ মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছেই৷ একের পর এক সহজ গোলের সুযোগ মিস করে চক্ষুশূল হয়ে উঠছিলেন সবার। সেখান থেকে গত মৌসুমে নিজেকে আমূল পাল্টে ফেললেন। গত মৌসুমের শুরুর আগে তবুও তার সাথে এডেন আজারের সাথে কিছুটা প্রতিযোগিতা হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু ধারাবাহিক পারফর্ম করে আজারকে দল থেকে একেবারেই ছিটকে দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী এ ব্রাজিলিয়ান।
তবে, এরপরও তার অনেক উন্নতির জায়গা রয়েছে। তবে তার পারফরম্যান্সের গ্রাফ দিনদিন যেভাবে উর্ধ্বমুখী হচ্ছে, তাতে এই ফুটবলতারকা তার ক্যারিয়ারে আরো অনেক বড় কিছু অর্জন করবেন সেটা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়।