ইয়ুর্গেন ক্লপ: শিরোপা প্রত্যাবর্তনের নেপথ্যের নায়ক

১৯৯০ সাল। ইংল্যান্ডের শীর্ষ বিভাগের ক্লাব লিভারপুল তখন অন্যতম পরাশক্তির নাম। ‘অল রেড’দের কোচ তখন কেনি ডালগ্লিশ। মূলত তখন তিনি খেলোয়াড়-ম্যানেজারের ভূমিকায় ছিলেন। তার পরামর্শে বেলজিয়ান ক্লাব স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজ থেকে ধারে লিভারপুলে যোগ দিয়েছিলেন রনি রোজেনথাল। লিগে আট ম্যাচে সাত গোল করেন তিনি। কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষের ম্যাচে লিগ নিশ্চিত করার পর রোজেনথাল খেয়াল করলেন, লিগজয়ী মেডেল তিনি পাচ্ছেন না। কারণ, এই মেডেল পেতে ন্যূনতম ১০ ম্যাচ খেলতে হয়, তিনি খেলেছেন মাত্র ৮ ম্যাচ।

লিভারপুলের মতো দলে খেলার মতো খেলোয়াড় রোজেনথাল ছিলেন কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাই এই মেডেল না পাওয়ার আক্ষেপ তার ভেতর জন্মেছিল। রোজেনথাল হয়ত লিগজয়ী মেডেল পাননি, কিন্তু শিরোপা জেতা দলের অংশ ছিলেন। কিন্তু লিভারপুলের গোটা ইতিহাসেরই অন্যতম পূজনীয় খেলোয়াড় স্টিফেন জেরার্ড তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে এই শিরোপাকে একবার ছুঁয়ে দেখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শিরোপার দেখা মেলেনি। 

২০১৪ সাল। প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জয়ে এগিয়ে আছে তিনটি ক্লাব – চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি এবং লিভারপুল। ব্রেন্ডন রজার্সের লিভারপুল শিরোপা জয়ের দৌঁড়ে সব থেকে এগিয়ে। লিগের একদম শেষ প্রান্তে, চেলসির বিপক্ষে ম্যাচ জিততে পারলেই লিভারপুল ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। অলরেডদের ২৪ বছরের আক্ষেপ বাদেও এই শিরোপা স্টিফেন জেরার্ডের জন্য স্বপ্ন। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ তুলে ধরলেও এই প্রিমিয়ার লিগ তার কাছে অধরা। 

জেরার্ডের মর্মান্তিক হোঁচট; Image Source: Getty Image

চেলসি বনাম লিভারপুল ম্যাচটি মাত্র দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়েছে। মাঝমাঠে থাকা জেরার্ডের কাছে অতি সাধারণ একটি পাস এলো। অথচ বিধি বাম, বল নিয়ে ছেলেখেলা করতে জানা জেরার্ড সেবার বল আয়ত্তে আনার আগেই হোচঁট খেয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়লেন। তার চোখের সামনে বল কেড়ে নিলে চেলসি স্টাইকার দেম্বে বা। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে সহজ গোল দিতে তিনি বিন্দুমাত্র ভুল করলেন না। সেই ম্যাচে লিভারপুল হারলো ২ গোলের ব্যবধানে। পরবর্তী ম্যাচে আবার ড্র। শিরোপা জেতার দৌঁড়ে সব থেকে এগিয়ে থাকা লিভারপুল, পিছিয়ে গেল মাত্র দুই ম্যাচের ব্যবধানে। ‘১৪-‘১৫ মৌসুম খেলে স্টিফেন জেরার্ড অ্যানফিল্ডকে বিদায় জানালেন। তার শেষ ম্যাচে স্টোক সিটির সাথে লিভারপুল হারল ৬-১ গোলে!

দলের গোলমেশিন সুয়ারেজ পাড়ি জমালেন বার্সেলোনায়, রহিম স্টার্লিংও ক্লাব ছাড়লেন। তাদের বিক্রি করা অর্থ দিয়েও ব্রেন্ডন রজার্স গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলোয়াড় কিনতে পারলেন না। ডিওক অরিগি, ক্রিশ্চিয়ান বেনটেকে বা রিকি ল্যাম্বার্ড চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যর্থ। পরাশক্তি থেকে অতি সাধারণ একটি ক্লাবে পরিণত হওয়া লিভারপুলের তখন একমাত্র ভরসার নাম তরুণ প্লেমেকার ফিলিপে কৌতিনহো। লিভারপুল প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কীভাবে ম্যাচ জিততে হয়। এভারটনের মাঠে ১-১ গোলে ড্র হবার পর মৌসুমের মাঝপথে বরখাস্ত হলেন রজার্স। ২০১৫ সালে অক্টোবর মাসে ‘অলরেড’দের নতুন কোচ হয়ে অ্যানফিল্ডে আসলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ।

অ্যানফিল্ডে প্রথম দিন; Feature Source : Liverpool FC

ক্লপ ডর্টমুন্ডের হয়েই নাম কামিয়েছিলেন। তবে, ইউরোপে আর সব বড় বড় কোচের তালিকায় তার নাম তখনও ছিল না। কিন্তু তার ট্যাকটিক্স ও ফুটবল সম্পর্কিত চিন্তা-চেতনা ডর্টমুন্ডে থাকাকালীন সময় থেকেই বিখ্যাত ছিল। ক্লপ ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন তারুণ্যের ফুটবল ও গেগেনপ্রেসিং। ইংল্যান্ডে এই নাম তখন একেবারেই অপরিচিত। ক্লপের গেগেনপ্রেসিং ট্যাকটিক্স লিভারপুলের মানানসই না, ইংল্যান্ডে এই ধরনের ফুটবল কাজে দেবে না, ফুটবলবোদ্ধাদের এই ধারণার জন্য অ্যানফিল্ডে পদার্পণের আগে ক্লপকে নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি।

মেরুদণ্ডহীন ও গোল করতে ভুলে যাওয়া মধ্যমসারির একটি দলকে নিয়ে টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে ক্লপের অভিষেক হয়। প্রথমবারের মতো সেই মৌসুমে লিভারপুলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় মাঠে প্রায় ৫ কিলোমিটারের মতো দৌঁড়াল। গোলশূন্য ড্র হলেও ক্লপ প্রথম ম্যাচেই তার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি তার গেগেনপ্রেসিং এবং হাই টেম্পো ঘরানার ফুটবলেই অনড় থাকবেন। লিভারপুলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে এই কৌশল রপ্ত করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। 

কিন্তু, একমাত্র ক্লপের ইচ্ছাতে কখনও দলে পরিবর্তন আসবে না। আসলে ক্লপের ট্যাকটিক্সের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারা ফুটবলারও দলে পর্যাপ্ত ছিল না। ড্যানি ইংস লিগামেন্টের চোটে জর্জরিত, টানা ইনজুরির কারণে ড্যানিয়েল স্টারিজ তার স্বাভাবিক খেলার দক্ষতা হারাতে বসেছেন। মাঝমাঠে থাকা লুকাস বা চ্যানদের নিয়ে গেগেনপ্রেসিং ফুটবল অসম্ভব। তাই দলে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। যে প্রয়োজনের কথা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন প্রাক্তন কোচ ব্রেন্ডন রজার্স। কিন্তু দলকে ঢেলে সাজাতে পর্যাপ্ত অর্থও লাগবে। ক্লাবকে আবার শীর্ষ পর্যায়ে ফেরত নিতে লিভারপুল বোর্ড কি প্রস্তুত?

অভিষেক মৌসুমে ক্লপ বড় কোনো দলবদল করেননি। লিভারপুল বিক্রি করে দেয় জো অ্যালেন, ক্রিশ্চিয়ান বেনটেকে ও জর্ডান আইবকে। নতুন কোনো খেলোয়াড় না আসলেও লিভারপুলের খেলায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাদে ম্যানচেস্টার সিটিকে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারানোর ম্যাচেই ক্লপ সমস্ত সমালোচনার জবাব দিয়ে দেন। ইউরোপের প্রত্যেক ফুটবলবোদ্ধা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন, ধীরে ধীরে ক্লপ তার ফুটবল দর্শন ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলছেন। ক্লপের একাদশের প্রত্যেকটা ফুটবলার অফুরান প্রাণশক্তির সাথে খেলছে। ফর্মেশন ধরে রেখে প্রেসিং, প্রতিপক্ষের পা থেকে দ্রুত বল কেড়ে নেওয়া, বা প্রতিপক্ষকে প্রতিনিয়ত চাপের মুখে রেখে খেলে যাওয়ার দর্শনের সাথে লিভারপুলের খেলোয়াড়রা অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। 

তবে, প্রথম মৌসুমে এই পারফরম্যান্স লিভারপুল টানা ধরে রাখতে পারেনি। এর কারণ, খেলোয়াড় স্বল্পতা ও সঠিক খেলোয়াড়ের অভাব। প্রত্যেকটা ম্যাচে ক্লপের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ফুটবল খেলার মতো শক্তিশালী খেলোয়াড় দলে নেই বললেই চলে। সেভিয়ার বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ফাইনাল হেরে বসা তার অন্যতম উদাহরণ। 

সেভিয়ার কাছে ইউরোপা লিগের ফাইনাল হার;  Image Credit: Getty Image

‘১৬-‘১৭ মৌসুমে ক্লপের একাদশে ফুলব্যাকের নিয়মিত দায়িত্ব পেলেন নাথানিয়েল ক্লাইন ও জেমস মিলনার। ক্লপের দর্শনে ফুলব্যাকরা আক্রমণে অংশ নেয়, আবার খুব দ্রুত প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় নেমে আসতে হয় রক্ষণভাগে। এ মৌসুমে ফুলব্যাক দু’জন রক্ষণে কাজে আসলেও তারা সাকুল্যে মাত্র ৫টি অ্যাসিস্ট করতে পেরেছিল। অর্থাৎ, ফুলব্যাকরা আক্রমণ বা আক্রমণে থাকা খেলোয়াড়দের ঠিক সহায়তা করতে পারছিলেন না। মধ্যমাঠ থেকে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট সরবরাহ করেছিলেন ভাইনালদুম, তবে তার পারফরম্যান্স নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। তালিকার শীর্ষে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে জয়ের ধারা বজায় রাখলেও ক্লপের দল ছয় ম্যাচ হেরেছিল তালিকার নিচের দিকে দলগুলোর বিপক্ষে। তবে শিরোপাহীন একটি মৌসুম পার করলেও ক্লপ দলের সীমাবদ্ধতাগুলো ঠিকই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।

প্রশ্নবিদ্ধ একটি মৌসুম পার করলেও লিভারপুলের আক্রমণভাগ যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল। ফিরমিনো ও অরিগির পাশে ১৪ গোল করা কৌতিনহো এক মৌসুমেই একাদশের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে ক্লপ একাদশ সাজাতেন। কিন্তু ক্যারিয়ারসেরা মৌসুম পার করে কৌতিনহো পাড়ি জমান বার্সেলোনায়। ৪-৩-৩ ছকে সালাহ-মানে-ফিরমিনো-কৌতিনহোর চারজনকে একই একাদশে খেলানোর যে কৌশল ক্লপ বের করেছিলেন, কৌতিনহোর চলে যাওয়ার সাথে সাথে তা ভেস্তে গেল। আক্রমণভাগ ভেঙে গেলে ক্লপ নতুন সাইনিং সালাহকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিন্তু এবার আর নির্দিষ্ট কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে আর ভাবতে গেলেন না। তার খেলা হবে দলগত, কাউকে কেন্দ্র করে নয়।

একটি ক্লাবের বড় দলের বিপক্ষে নিয়মিত গোল করা বা শিরোপাকে কেন্দ্র করে গোলের দাপট ছড়ানোর জন্য প্রয়োজন হয় একজন গোলমেশিনকে। মোহাম্মদ সালাহ এসে সেই স্থান পূরণ করেন। অভিষেক মৌসুমেই ৪৪ গোল, সালাহ-ফিরমিনো-মানে’র ত্রিফলা আক্রমণে বহু বছর পর লিভারপুলকে বিধ্বংসী রূপে দেখা যেতে থাকে। ক্লাবের দায়িত্ব নেবার দুই মৌসুমের বেশি সময় পর ক্লপ লিভারপুলের আক্রমণভাগকে চূড়ান্ত পর্যায়ের শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন । কিন্তু শিরোপা জেতার লড়াইয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবার জন্য শুধুমাত্র আক্রমণই মুখ্য নয়। 

ইউরোপের লড়াইয়ের মঞ্চে এসে ক্লপ কখনোই ভাবেননি, তাকে পরিবেশের সাথে বদলে যেতে হবে। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন, লিভারপুলকে তিনি তার দর্শনের সাথে অভ্যস্ত করাবেন। তার এই চিন্তাভাবনা থেকে তিনি কখনোই সরে যাননি। তাই পর্যাপ্ত ও সঠিক খেলোয়াড় না থাকার পরও তিনি ধৈর্য হারাননি। ক্লাইন ও মিলনারকে দিয়ে তিনি তার প্রেসিং ফুটবল মঞ্চায়ন করতে পারছিলেন না। অথচ এই ফুলব্যাক সমস্যা সমাধানে ক্লপ বড় অঙ্কের অর্থও খরচ করেনি। ক্লপের মতে,

“ফুলব্যাক দারুণ একটি পজিশন, কারণ আপনি সবসময় খেলার সাথে মিশে থাকতে পারছেন।”

ক্লাইন এবং মিলনারের পজিশন নিয়ে ক্লপ বলেন,

“এই ধরনের ফুলব্যাকরা মূলত মিডফিল্ডারের মতো কাজ করে। তারা হাফ-স্পেসে কাজ করে, আক্রমণভাগের উপরের দিকে কাজ করে। মাঝেমাঝে তারা উইঙ্গারের ভুমিকা পালন করে, আবার কখনো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার বনে যায়।”

ফুলব্যাকদের নিয়ে এমন মন্তব্যের প্রায় ১ বছর পর ক্লপের একাদশে ফুলব্যাকে একসাথে দেখা যায় দুই আনকোরা তরুণের মুখ। ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন। ১-১ গোলে ড্র করা সে ম্যাচে লিভারপুল আহামরি না খেললেও ক্লপ এমন কিছু লক্ষ্য করেছিলেন, যা অন্য কেউ করেনি। 

ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ও অ্যান্ড্রু রবার্টসন; Image Source : Liverpool FC

অল্প কয়েকটি ম্যাচের ব্যবধানে ক্লপের একাদশের ফুলব্যাক পজিশনে জায়গা করে নেন আর্নল্ড ও রবার্টসন। কৌতিনহোর বিদায়ের ফলে ততদিন ক্লপ তার কৌশলও বদলে ফেলেছেন। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনের বদলে ৪-৩-৩ কৌশলে লিভারপুলকে আরও ভয়ানক দেখাতে শুরু করে। আক্রমণভাগের সাথে ফুলব্যাকদের নিখুঁত পাস ও ক্রসে সম্পর্ক ফুটে ওঠে । মিলনার, ভাইনালদুম ও হেন্ডারসনের সাহায্যে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণের শক্তি ফিরে আসে। আর ফুলব্যাকদের নিয়ন্ত্রিত ক্রস, লাইনের পাশ থেকে ডিফেন্সচেরা পাস ও দুর্দান্ত গতির ফলে লিভারপুলের আক্রমণভাগ ক্রমাগত খুনে হয়ে ওঠে। ‘১৭-‘১৮ মৌসুমে আর্নল্ড ও রবার্টসন প্রিমিয়ার লিগে মোট অ্যাসিস্ট করেন ৪৯টি। আর নিজের ফুটবল দর্শন অনুযায়ী দল গঠনের পর ক্লপের গেগেনপ্রেসিং ফুটবলের কার্যকারিতার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।

আক্রমণ ধারালো বা মধ্যমাঠ গোছানো থাকলেও ক্লপের একাদশের রক্ষণ তেমন শক্তপোক্ত ছিল না। ‘১৬-‘১৭ মৌসুমের লিগের তালিকায় চতুর্থ হওয়ার পেছনে কারণ ছিল রক্ষণ সমস্যা। প্রতি মৌসুমে ধৈর্য্য ধরে ধীরে ধীরে দলকে গড়ে তোলা ক্লপ সব থেকে বড় দাও মেরেছেন এখানে। কোনো দলে একজন খেলোয়াড় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তার স্পষ্ট উদাহরণ ভার্জিল ভ্যান ডাইক। তিনি এসে লিভারপুলের ভোঁতা রক্ষণকে নিমিষেই পাল্টে দিলেন। গোল হজম করার প্রবণতা জ্যামিতিক হারে কমে গেল। ভ্যান ডাইকের প্রথম ১৪ ম্যাচের ভেতর ৭ ম্যাচে লিভারপুল কোনো গোল হজম করেনি। তাই অ্যানফিল্ডে ক্লপের আমলে সব থেকে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল এই ডিফেন্ডারকে দলে ভেড়ানো। ‘১৭-‘১৮ মৌসুমে, বহু বছর পর, লিভারপুল শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকে। কিন্তু ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে মাত্র এক ম্যাচে হার তাদের বাধ্য করে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকতে।

ভ্যান ডাইক বনাম আগুয়েরো;  Image Credit : forbes

ভ্যান ডাইকের ফলে রক্ষণের চেহারা পাল্টে গেছে, মিডফিল্ডাররা জানেন তাদের ভূমিকা কী, ফুলব্যাকদের সাথে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলেছে গোল করার প্রবণতাও। সালাহ, ফিরমিনো অথবা মানের বিশ্বমানের আক্রমণের ফলে শুধু লিগ নয়, একই বছর ক্লপের দল জায়গা করে নিল চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল মঞ্চে।

কিন্তু বেহুলার বাসরের মতোই তখনও ছোট্ট একটি খুঁত ছিল ক্লপের একাদশে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের মঞ্চে একজন বিশ্বমানের গোলরক্ষকের অনুপস্থিতি হারে হারে টের পেলেন ক্লপ। যেখানে শিরোপা নিয়ে উচ্ছাস করার কথা, সেখানে বের হয়ে গেল থলের বিড়াল। ফাইনালের মঞ্চে লিভারপুলকে ডুবিয়ে লরিস ক্যারিউস বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, বিশ্বমানের গোলরক্ষক হওয়ার সামর্থ্য তার নেই। বহুদিন ধরে দলের গোলরক্ষক কোচ জন আকটেরবার্গ রোমার গোলরক্ষক আলিসন বেকারকে কেনার ব্যাপারে ক্লপকে বলছিলেন। কিয়েভের সেই ফাইনালের পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন ক্লপ। মূলত, বারো মাস পর অ্যালিসন বেকারের অ্যানফিল্ডে আগমন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই।

প্রথম মৌসুমে ইউরোপা লিগের ফাইনালে হার, চ্যাম্পিয়নস লিগেও একই পরিণতি, মাত্র একটি ম্যাচে হারের জন্য লিগ হাতছাড়া – কিন্তু এরপরও ক্লপ ধৈর্য হারাননি। তার স্থিতিশীলতার চমৎকার উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। তিনি জানতেন, যে পথে ও যে কৌশলকে সাথে নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, সাফল্য একদিন না একদিন ধরা দেবেই। ৩০ বছর পর লিভারপুল লিগ শিরোপা জিতে আক্ষেপ ঘুচিয়েছে, ১৪ বছর পর আবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি অ্যানফিল্ডে এসেছে। এ সবই ৫ বছরের বিশ্বাস ও প্রেরণার পুরস্কার।

আজকে লিভারপুলের এই সাফল্যের পেছনে ইয়ুর্গেন ক্লপ নামক জার্মান কোচের মেধা ও কৌশলের অবদান সর্বোচ্চ। তিনি লিভারপুল বোর্ডের উপর আস্থা কাড়তে পেরেছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরে তাদের কোচকে তারা বিশ্বাস করে এসেছে। বর্তমান ফুটবলে এমন দৃশ্য প্রায় বিরল। 

চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি হাতে ক্লপ;  Image Credit : Liverpool FC

হয়তো ভাগ্যের সহায়তা ছিল, কিন্তু দলবদলের ক্ষেত্রে ক্লপের প্রত্যেকটা পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে। কৌতিনহোর মতো খেলোয়াড়ের বিদায়ের পর দলের আক্রমণে ধ্বস নামার কথা। ক্লপ তা হতে দেননি। উল্টে কৌতিনহোকে বিক্রির মোটা অঙ্ক তিনি কাজে লাগিয়েছেন অ্যালিসন ও ভ্যান ডাইককে কিনতে। যারা বর্তমান লিভারপুলের সাফল্যের পেছনে অন্যতম সফল নায়ক। ক্লপ জানতেন তার কেমন খেলোয়াড় লাগবে। তিনি সবসময় চেষ্টা করে গেছেন সেই মোতাবেক খেলোয়াড় কিনতে। ফ্যাবিনহো তার স্পষ্ট উদাহরণ। হোল্ডিং মিড পজিশনে খেলা এই ব্রাজিলিয়ান লিভারপুলের মাঝমাঠের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন। 

ক্লপ সবসময়ই যে তার কৌশলমতো খেলোয়াড় কিনেছেন, তেমনও নয়। খেলোয়াড়দের বিশ্বাস অর্জনের পাশাপাশি তিনি তার একাদশের খেলোয়াড়দেরও বিশ্বাস করেছেন। ২০১১ সালে লিভারপুলে যোগ দেবার পর হেন্ডারসন কখনোই নিজের প্রতিভাকে চেনাতে পারেননি। কিন্তু ক্লপের অধীনে হেন্ডারসন পুরোদস্তুর প্লেমেকার, সত্যিকারের দলনেতা। ভাইনালদুমের মতো মধ্যমমানের খেলোয়াড় আজ বিশ্বসেরা। কেন? কারণ, ক্লপ তার ভেতর প্রতিষ্ঠিত করেছেন আত্মবিশ্বাস। জো গোমেজ বা জোয়েল মাতিপের মতো মধ্যমমানের ডিফেন্ডার জোট বেঁধেছেন ভ্যান ডাইকের সাথে। কারণ, ক্লপ বিশ্বাস রেখেছেন। এমন জেতার মানসিকতা সব কোচ খেলোয়াড়দের ভেতর প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। 

ক্লপের সাথে লিভারপুলে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সম্পর্ক ভালো;  Image Source : Iiverpool FC

২০১৫ সালে ক্লপ উঠতি কোচ হিসেবে মধ্যমমানের একটি দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বর্তমানে ক্লপ বিশ্বের সেরা কোচদের একজন, লিভারপুল ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী পরাশক্তি।

তবে, আজ এত সাফল্যের ভিড়েও ক্লপ ও ‘অল রেড’ সমর্থকদের মনে ক্ষুদ্র একটি হতাশা না থেকেই পারে না। অবশেষে ৩০ বছরের আক্ষেপের অবসান হয়েছে, প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা এসেছে ঘরের মাঠে। কিন্তু অ্যানফিল্ডে নির্জনতা কাটছে না। কানায় কানায় পূর্ণ উল্লসিত ও ক্রন্দনরত সমর্থকদের সামনে শিরোপা তুলে ধরে ক্লপবাহিনী গাইতে পারছে না, “You’ll never walk alone, You’ll never walk alone…” এমনটা তো কস্মিনকালেও কেউ চাননি!

This article is in Bangla language. It is about football club Liverpool FC and their revolution under Jurgen Klopp.  

Feature Image Source: John Powell / Contributor

Feature Source:
1.https://www.telegraph.co.uk/football/2019/04/12/ronny-rosenthal-interview-cult-hero-never-got-winners-medal/
2.https://www.skysports.com/football/story-telling/11669/12015090/liverpools-evolution-under-jurgen-klopp-into-premier-league-champions?fbclid=IwAR1D9PGgTaYauEaYUbBzUswEjf-IuI4fa2G3yJBBUt-ZTb-A4xJg7we-qjE
3.https://www.fourfourtwo.com/features/liverpool-premier-league-title-win-jurgen-klopp-how-he-guided-reds-glory-anfield
4.https://www.youtube.com/watch?v=fHrH6Tg4GfI

Related Articles

Exit mobile version