জীবন নদীর খেয়াপথ কখনোই একভাবে যায় না। জীবনের কিছু সময় স্রোতের অনুকূলে খুব সহজেই পাড়ি দেওয়া যায়, আবার কিছু সময়ে প্রচণ্ড ঝড়ে খেয়া নিয়ে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। তবে যারা এসব ঝড়ে ভয় না পেয়ে সব ধরনের প্রতিকূলতাকে জয় করে সামনে এগিয়ে যায়, তারাই প্রকৃত যোদ্ধা। এমনই এক যোদ্ধা হচ্ছেন পাউলিনহো। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাউলিনহোর নামটা সস্তা ট্রলেই বেশি দেখা যায়। অথচ এই পাউলিনহোর জীবনেই এমন কিছু গল্প আছে যা শুনলে আপনার চোখে পানি চলে আসতে পারে। খাদের কিনারা থেকে পাউলিনহো যেভাবে ফিরে এসেছে সেই গল্প শুনলে অনেক আশাহত মানুষও আশা ফিরে পেতে পারেন। দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে নিজের জীবনের সেসব কঠিন লড়াইয়ের কথাই বলেছেন পাউলিনহো।
গত বছর জুনে অস্ট্রেলিয়ায় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে ফ্রি কিক নেওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময়ে হঠাৎ মেসি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,“আমরা কি একসাথে বার্সেলোনা যাচ্ছি?” ব্যাস এতটুকুই! বিস্তারিত কিছু না বলেই মেসি নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছিলেন। কিছু ভাবার জন্য যে সময়টুকু দরকার সেটাও আমি পাইনি, আমি তৎক্ষণাৎ মেসিকে বলেছিলাম, “তুমি যদি আমাকে নিতে চাও, আমি নিশ্চই যাবো!”
একটা ফুটবল ম্যাচে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্যে আমার বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মেসির ওই কথাটার পর আমি শুধু ভাবছিলাম,“কেন মেসি আমাকে এমন একটা কথা বললেন? সত্যিই কি এমন কিছু হতে পারে! ওহ ঈশ্বর, কী সব হচ্ছে!” সেই সময়ে আমি গুয়াংজু এভারগ্রান্দের হয়ে চাইনিজ সুপার লিগে খেলতাম। চাইনিজ লিগে খেলা একজন খেলোয়াড়ের প্রতি বার্সেলোনা আগ্রহ দেখাতে পারে এমন কথা তখন কেউই বিশ্বাস করতে পারতো না। আমি একবার ভেবেছিলাম হয়তো ম্যাচে আমার মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যই মেসি মজা করে এমন কথা বলেছিলেন। কিন্তু সামান্য একটা প্রীতি ম্যাচে মেসি এমন কিছু করতে পারে সেটাও বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
ম্যাচ শেষে আমি একজন নিরাপত্তা কর্মীর মাধ্যমে আমার জার্সি মেসির কাছে পাঠালাম। মেসি সেই জার্সি গ্রহণ করে ওই নিরাপত্তা কর্মীর মাধ্যমে তার নিজের জার্সিটা আমার জন্য পাঠালেন। এটা দেখে আমি ভাবলাম,“আসলেই কি এমন কিছু ঘটছে?” কিন্তু অস্ট্রেলিয়া থেকে চীনে যাওয়ার পর এই দলবদলের ব্যাপারে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। এরপর এক মাস কেটে গেলো। এই ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে চাইনিজ সুপার লিগে আমি নিজের খেলাটা উপভোগ করছিলাম। কিন্তু জুলাইয়ে আবার গুজব রটে গেলো যে বার্সেলোনা নাকি আমাকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী!
আমি আমার প্রতিনিধিকে ডেকে বললাম, “ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি, আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো। আপনি শুধু আমাকে বলুন যা শুনছি সেগুলো সত্যি কিনা?” উত্তরে তিনি বললেন,“ব্যাপারটা বেশ জটিল, সত্যি হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে!” আমি নেইমারকে মেসেজ দিয়ে এ ব্যাপারে জানার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু নেইমার তখন নিজের দলবদল নিয়েই ব্যস্ত। তাই সে আমাকে নিশ্চিত হয়ে কিছু জানাতে পারলো না। দলবদলের সময়টা ঠিক কতটা অনিশ্চিত এ ব্যাপারে আপনারা সবাই জানেন। এটা এমন একটা সময় যখন কোনো কিছুই বিশ্বাস করা যায় না। সত্যি কথা বলতে গেলে চীনে আমি আমার সময়টা বেশ উপভোগ করছিলাম। ভালো খেলার সাথে আমার পরিবারও সেখানে খুশি ছিল। এই দলবদলের গুজব শুরু হওয়ার আগে আমি সেখানে বেশ শান্তিতে ছিলাম।
আগস্টের দিকে দলবদলের সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো আমার বার্সায় যাওয়াটা আর হচ্ছে না। সেই সপ্তাহে আমরা চাইনিজ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য খেলছিলাম। ব্রাজিল থেকে আগত বন্ধুরা আমার বাড়িতেই ছিল। সেই রাতে হুট করে আমার প্রতিনিধি আমাকে ফোন করে বললেন, “চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। চুক্তিতে সই করার জন্য আপনাকে বার্সেলোনা আসতে হবে।” আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এরকম কিছু ঘটতে পারে।
আমি আমার প্রতিনিধিকে বললাম “এটা কি সত্যি হয়েছে? বার্সেলোনা রিলিজ ক্লজের সব টাকা দিতে রাজি হয়েছে? আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন না তো?” জবাবে সে বললো “না না না, আমি মিথ্যা বলছি না। আপনাকে কালকেই বার্সেলোনা যেতে হবে।” ওহ বলতে ভুলে গিয়েছি, তিনি যখন আমাকে ফোন করেছিলেন তখন ভোর চারটে বাজে! আমি তাকে বললাম “আমি আসতে পারবো না। ব্রাজিল থেকে আমার বন্ধুরা এসেছে। এখন ভোর চারটা বাজে!” জবাবে তিনি বললেন “বার্সেলোনা থেকে প্রস্তাব এসেছে পাউলিনহো। তুমি তোমার বন্ধুদের নিয়েই পরবর্তী প্লেনে উঠে পড়ো।”
আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা করলাম। হাইওয়েতে চলার সময়ে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম সত্যিই মেসির সাথে বার্সেলোনায় খেলার সুযোগ পাচ্ছি আমি! আপনি যদি আমার বার্সেলোনায় যোগদানের ঘটনাকে রূপকথা বলেন তাহলে বলতেই হচ্ছে আপনি আমার জীবনের সব গল্প জানেন না। এটা ছিল আমার জীবনের দশম অধ্যায়, জীবনের আগের অধ্যায়গুলো আরো বেশি চমকপ্রদ ছিল।
১৯ বছর বয়সে আমি ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার কথাই ভেবেছিলাম! জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে টানা একমাস আমি নিজেকে ঘরে বন্দী করে রেখেছিলাম। ২০০৮ সালের যে সময়ে মেসি বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবল জিতেছিলেন সেসময় আমি ভাবছিলাম কী করে আমি জীবনের বাকিটা সময় কাটাবো! লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডে খেলতে গিয়ে এমন সব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে সেগুলো আমাকে বারবার তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো।
প্রথম যখন লিথুয়ানিয়ায় পৌঁছলাম সবকিছু বেশ ভালোই লাগছিলো। ভিনিয়াসের মতো একটা প্রাচীন শহরে আমি খেলতাম। ব্রাজিলের শহরগুলোর তুলনায় ভিনিয়াস কিছুটা অন্যরকম ছিল, আমি সেখানকার ভাষাও জানতাম না। তবুও আমি সেখানে বেশ শান্তিতেই ছিলাম। এরপর সেই দিনটা এলো, আমি আর আমার ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ রোডনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হুট করে কিছু মানুষ আমাদের বানর বলে ক্ষেপাতে শুরুর করলো! বিশ্বাস করুন, আমরা কারো কোনো ক্ষতি করিনি, আমরা দুই বন্ধু নিজেদের মতোই বেকারিতে যাচ্ছিলাম। হুট করে আমাদের দিকে এভাবে তেড়ে আসার সত্যিই কি কোনো কারণ ছিল?
সেদিনই আমি প্রথমবারের মতোন বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলাম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এরকম ঘটনা পরে আরো ঘটেছে! রাস্তায় আমাদের দেখলেই লোকজন নানা ধরনের কটুক্তি করে আমাদের ক্ষেপাতো। ম্যাচ চলাকালীন সময়েও এদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যেত না। বিপক্ষ দলের সমর্থকরা আমাদের বানর বলে ডাকার সাথে আমাদের দিকে কয়েনও ছুঁড়ে দিতো! সত্যিই এটি ছিল এক বাজে অভিজ্ঞতা।
আমরা জানতাম যে এটা আমাদের দেশ নয়, তাই অনেক কিছুর সাথেই মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এত খারাপ ব্যবহারের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা প্রায় অসম্ভব ছিল। এক মৌসুম পরেই আমি পোল্যান্ডে চলে এলাম। কিন্তু সেখানেও এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো। নিজের পরিবারের জন্য কিছু একটা করার জন্য মাত্র ১৭ বছর বয়সেই আমি ব্রাজিল ছেড়েছিলাম। কিন্তু দুই বছর পর যখন দেশে এলাম তখন আমি ফুটবল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার পরিবার, আমার সাবেক স্ত্রী, আমার প্রতিনিধি সবাইকে বলেছিলাম, “আমি শেষ, আমার দ্বারা আর ফুটবল খেলা হবে না।”
এ কথা শুনে আমার সাবেক স্ত্রী আমাকে বললো, “তুমি ফুটবল ছেড়ে দিবে! কিন্তু ফুটবল ছাড়া তুমি তো আর কিছুই পারো না। একটা কুপি কিভাবে পরিবর্তন করতে হয় সেটাও তুমি জানো না।” জবাবে আমি বললাম, “দরকার হলে আমি সবকিছু শিখবো। চেষ্টা করলে নিশ্চই পারবো।” আমার সাবেক স্ত্রী আমাকে আবার বোঝালো এবং বললো, “তুমি তোমার বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করো। তোমার জন্য তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তুমি এভাবে মাঝপথে হার মেনে নিলে সেটা তাদের জন্যও অসম্মানজনক হবে।”
সে ঠিকই বলেছিলো। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে যখন ফুটবল খেলাটা শুরু করলাম তখন থেকেই সব ব্যাপারে মা আমাকে সাহায্য করে আসছিলেন। ছোটবেলায় আমি ফুটবল খেলতে এতটাই ভালোবাসতাম যে রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমি দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, “ইশ! কখন সকাল হবে আর কখন আমি আবারো ফুটবল খেলতে পারবো।” ইউরোপে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তাতে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এভাবে ফুটবল ছেড়ে দিলে আমার বাবা-মা খুব কষ্ট পেতেন, এ কারণে আমি আরেকটা মৌসুম ফুটবল খেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি একদম নিচের সারি থেকে শুরু করলাম, পাও ডি অ্যাকুয়ার নামের চতুর্থ বিভাগের এক ক্লাবে আমি যোগ দিলাম। সময়টা বেশ কঠিন ছিল, একটা ম্যাচ খেলার জন্য প্রায় আট ঘণ্টা বাসে করে ভ্রমণ করতে হতো। খেলার সময়ে তাপমাত্রা থাকতো প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুরুর দিকে আমি নিজেকে বারবার বোঝাতাম, “ফুটবলটা তোমার দ্বারা আর হবে না। এর চেয়ে বাড়ি কিভাবে বানাতে হয় সেটা জানাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”
কিন্তু আস্তে আস্তে সব ধরনের নেতিবাচক প্রভাব মুছে যেতে শুরু করলো, প্রতিদিনকার অনুশীলন ও খেলার ফলে আমি ধীরে ধীরে আবারো ফুটবলের প্রতি নিজের ভালোবাসাটা ফিরে পেলাম। পরের মৌসুমে আমি দ্বিতীয় বিভাগের একটি দলে যোগ দিলাম আর এরপরের মৌসুমে আমি প্রথম বিভাগের দল করিন্থিয়াসে যোগ দিলাম। করিন্থিয়াসে গিয়ে আমি এমন একজন মানুষের দেখা পেলাম যিনি আমার পুরো জীবনটাকেই বদলে দিয়েছিলেন। তিনি প্রফেসর তিতে, যিনি নিজের সন্তানের মতো আমাকে আগলে রেখেছিলেন। ফুটবলের বাইরেও তিতের সাথে আমার সম্পর্কটা অন্যরকম, এ কারণেই তিতের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। তিতে আমার ব্যাপারে এতটাই জানেন যে আমার চোখের দিকে তাকিয়েই তিনি আমার ব্যাপারে সবকিছু বুঝে নিতে পারেন। মুখ ফুটে উনাকে কিছু বলতে হয় না।
আমার আর তিতের মধ্যকার কিছু মজার ঘটনা শুনলেই আপনারা আমাদের সম্পর্কটা বুঝতে পারবেন। ২০১১ সালে করিন্থিয়াসের হয়ে অসাধারণ এক মৌসুম পার করার পর করিন্থিয়াসের অনেক খেলোয়াড়ের ব্যাপারেই বড় বড় ক্লাবগুলো আগ্রহ প্রকাশ করছিলো। এমনই একদিন অনুশীলনের ঠিক আগমুহুর্তে আমার প্রতিনিধি আমাকে ফোন করে জানালো যে ইন্টার মিলান আমাকে দলে নিতে চায় এবং আমার সিদ্ধান্ত ১৫ মিনিটের মধ্যে তাদের জানাতে হবে। আমি দৌড়ে তিতের অফিসে গেলাম এবং তাকে সবকিছু জানালাম। সবকিছু শুনে তিতে বললেন, “আমি অবশ্যই চাইবো যাতে আমার দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় দলের সাথে থাকে। কিন্তু জীবনটা তোমার, তাই সিদ্ধান্তটাও তোমাকেই নিতে হবে। তুমি লকার রুমে যাও আর এ ব্যাপারে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে মাঠে আসো। তুমি যদি করিন্থিয়াসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নাও তাহলে বৃদ্ধাঙ্গুল উঁচু করে করে আমাকে দেখাবে। আর ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আঙ্গুল নিচু করে দেখাবে।”
আমি সবকিছু ভেবে আমার প্রতিনিধিকে ফোন দিলাম এবং তাকে আমার উত্তর জানালাম। আমার প্রতিনিধি আমাকে আরেকবার ভাবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম আমি কী করতে যাচ্ছি। আমি মাঠে গেলাম এবং সেখানে পৌঁছানোর পর তিতে আমার সিদ্ধান্ত জানার জন্য আমার দিকে তাকালেন। কিছুটা নাটক করার জন্য আমি দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম এরপর বৃদ্ধাঙ্গুল উঁচু করে আমার সিদ্ধান্ত তাকে জানালাম। তিতে সাথে সাথে বলে উঠলেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি চলেই যাচ্ছো।”
করিন্থিয়াসে তিতের সাথে কাটানো চারটি বছর ছিল আমার জীবনের সেরা সময়। প্রিমিয়ার লিগে টটেনহ্যামের হয়ে খেলতে গিয়ে আমি খুব খারাপ সময় কাটাচ্ছিলাম। সেসময়ে অনেক মানুষই আমার ব্যাপারে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু একজন মানুষ সেই কঠিন সময়েও আমার ব্যাপারে বিশ্বাস হারাননি, তিনি প্রফেসর তিতে। স্পার্সে কাটানো সময়গুলো এতটাই খারাপ ছিল যে আমি সেই সময়গুলো আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই। আমি স্পার্সের কারো ব্যাপারেই কোনো খারাপ কথা বলতে চাচ্ছি না। লন্ডনে আমার সময়গুলো এতটাই খারাপভাবে কাটছিলো যে আমি আমার বাড়ি থেকে পারতপক্ষে বের হতাম না। পানি ছাড়া একটা মাছের জীবন আর ফুটবল ছাড়া একজন ফুটবলারের জীবনে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমি সেসময়ের স্পার্স কোচ মারিসিও পচেত্তিনোর পরিকল্পনায় ছিলাম না। তাই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে স্পার্সে যতদিন থাকবো এভাবে ফুটবল থেকে দূরেই থাকতে হবে।
বাধ্য হয়ে একদিন আমি ক্লাব সভাপতির কাছে গিয়ে দলবদলের ব্যাপারে তাকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা বেশ পেশাদার ছিলেন, আমাকে যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে তারা দলে এনেছিলেন তার কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ না পেলে তারা আমাকে ছাড়তে চাইবে না তা আমি ভালোভাবেই জানতাম। পরের গ্রীষ্মে চাইনিজ ক্লাব গুয়াংজে এভারগ্রান্দে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে আমাকে দলে নিতে রাজি হলো। তখন আমি নিয়মিত খেলার ব্যাপারে এতটাই ব্যাকুল ছিলাম যে চীনে ফুটবল খেলতে যাওয়ার ব্যাপারেও আমি কোনো অমত করিনি। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমার এই সিদ্ধান্ত শুনে হতবাক হয়ে গেলো। তারা আমাকে বারবার বুঝাতে লাগলো, কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।
এই কঠিন সময়ে দানি আলভেজের একটা কথা আমার বারবার মনে পড়তো। আলভেস বলেছিলেন, “বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা বাচ্চাদের দিকে তাকাও। খেলার ফলাফল যা-ই হোক, তাতে কি বাচ্চাদের খুব বড় কোনো ক্ষতি হবে? নাহ, কিছুই হবে না, তারা পরের দিন আবারো অন্য কোথাও খেলতে শুরু করবে। আমাদের জীবনটাও অনেকটাই এরকম, ফলাফল যা-ই হোক, জীবন কিন্তু থেমে থাকবে না।”
আমি আমার সারাজীবনে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ফুটবল খেলেছি। এতদিন ফুটবল খেলে একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছি, কী কাজ করছি সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে কাজটি করছি সেটা উপভোগ করা। সেরা ফুটবল লিগে খেলেও যদি আপনি আপনার খেলাটা উপভোগই না করতে পারেন তাহলে সেরা লিগে খেলে কী লাভ? আমি যখন গুয়াংজু এভারগ্রান্দেতে যোগ দিলাম তখন অনেকেই আমার ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি দেখে ফেলেছিলো। তারা এটা জানতো না যে আমি এরচেয়েও খারাপ সময় পার করে এসেছিলাম। আমি সেই পাউলিনহো যে কিনা একটা সময়ে বাসে চড়ে চতুর্থ বিভাগের ফুটবল খেলেছি। তখন বিশ্ববাসী জানতো না পাউলিনহো কোথায় আছে। আমি সত্যিকার অর্থেই কবরে ছিলাম, সবার কাছে আমি ছিলাম মৃত এক মানুষ।
চীনে গিয়ে আমি লুই ফিলিপ স্কলারির অধীনে খেলা শুরু করলাম। উনার মতো একজন মানুষকে কোচ হিসেবে পাওয়ায় আমার কাজটা কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। সত্যি কথা বলতে, সেসময়ে আমি আরেকটা বিশ্বকাপ খেলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। বার্সেলোনায় খেলার কথা আরো দূরের স্বপ্ন। সেসময়ে আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, গুয়াংজু এভারগ্রান্দের হয়ে ভালো ফুটবল খেলা। ২০১৬ সালে তিতে ব্রাজিল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। তিতের এই প্রাপ্তিতে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, কারণ এমন একটা সম্মান তিতের প্রাপ্য ছিল। আমি প্রায়ই তিতেকে ফোন করে বলতাম, “প্রফেসর, আপনি সবসময়ে খেলোয়াড়দের প্রাপ্য নিয়ে কথা বলেন। আমার সবসময় মনে হয় জাতীয় দলের কোচ হওয়াটাও আপনার প্রাপ্য আর আমি এটাও বিশ্বাস করি আপনি আপনার প্রাপ্য সম্মান ঠিকই একদিন পাবেন।”
কিন্তু তিতে কোচ হওয়ার পরেই তিনি আমাকে দলে ডাকবেন সত্যি বলতে এমন কথা আমি তখন ভাবিনি। তিতে যখন কোচ হলো তখন আমি গুয়াংজুর হয়ে বেশ ভালো ফর্মে ছিলাম। একদিন তিতে আমার খেলা দেখার জন্য তার ছেলে ম্যাথিউসকে চীনে পাঠালো। আমি চীনে ঠিক কী করছি এটা জানার ব্যাপারে সম্ভবত তিতেও সেসময়ে আগ্রহী ছিল। ম্যাথিউস যে ম্যাচ দেখতে এসেছিলো সেই ম্যাচে আমি অসাধারণ কিছু করার চেষ্টা করিনি। আমি নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলার চেষ্টা করেছিলাম। কারণ আমি আমি কেমন খেলোয়াড় সেটা তারা ভালোভাবেই জানতেন। তাই নতুন করে প্রমাণ করার কিছু ছিল না।
সেই ম্যাচের পর আমি কোনো আশা ছাড়াই অপেক্ষা করছিলাম। এর কয়েক সপ্তাহ পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জন্য ঘোষিত দলে আমাকে ডাকা হলো! আমাকে দলে ডাকায় মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হলো। সবাই একটা কথাই বারবার বলছিলো, “চাইনিজ লিগে খেলা পাউলিনহোকে তিতে কোন যুক্তিতে দলে ডাকলো?”
চাইনিজ লিগে গেলেও আমি যে হারিয়ে যাইনি এটা প্রমাণ করার সুযোগ তিতে আমাকে দিয়েছিলেন, আর আমার ধারণা বাছাইপর্বে বেশ কয়েকবার আমি নিজেকে প্রমাণ করেছি। ফুটবল এমন একটা খেলা যেখানে কয়েক সেকেন্ডে সবকিছু পাল্টে যেতে পারে। আমি জানি, কৌশলগত দিক থেকে অনেকের চেয়েই আমি বেশ পিছিয়ে, কিন্তু সুযোগ এলে কিভাবে সেটা কাজে লাগাতে হয় আমি এটা বেশ ভালোভাবে জানি। সুযোগ যখন আসবে তখন চিন্তা করারও অবকাশ থাকবে না, আপনাকে সেখানে সময়মতো উপস্থিত থাকতে হবে আর সেটার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
অনুশীলনের সময়ে তিতে বেশ কয়েকবার মজা করে একটা কথা বলেছিলেন। নেইমার, কৌতিনহো, জেসুস, মার্সেলোদের মতো অসাধারণ খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আক্রমণের সময়ে তোমাদের সবাইকে তৈরি থাকতে হবে। যদিও আমরা সবাই জানি প্রতিক্ষিপ্ত হয়ে বলটা সবসময় পাউলিনহোর কাছেই আসবে।” জবাবে আমি বলেছিলাম, “প্রফেসর, আপনি সবসময় প্রত্যেকের প্রাপ্য নিয়ে কথা বলেন। প্রতিক্ষিপ্ত হয়ে বলটা আমার কাছে আসে, কারণ আমি সময়মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারি।“
বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত দলে যখন আমার নামটা দেখতে পেলাম তখন শুধু আমি না, আমার পরিবারও ভীষণ খুশি হয়েছিলো। আজ আমি আপনাদের এমন কিছু কথা বলতে চাই যা অধিকাংশ মানুষই জানে না। আমার এই প্রত্যাবর্তনকে বাইরে থেকে দেখে অনেকেই বলে, “বাহ! তুমি চীন থেকে বার্সেলোনায় খেলতে এসেছো! কী অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তন! সত্যিই এটা একটা অলৌকিক ঘটনা।”
বার্সেলোনার হয়ে খেলতে পারাটা আমার জীবনের অন্যতম অলৌকিক ঘটনা- এটা সত্যি, কিন্তু এরচেয়েও বড় অলৌকিক ঘটনা বার্সেলোনায় আসার পর ঘটেছে। বার্সায় যখন আসি তখন আমার স্ত্রী বারবারা সন্তান সম্ভবা ছিল। ডিসেম্বরে আমাদের জমজ সন্তান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অক্টোবরে হুট করে বারবারা পেটে ব্যথা অনুভব করলো! আমি দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তাররা কিছু পরীক্ষা করলেন এবং সাথে সাথে বারবারাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। ডাক্তাররা আমাকে জানালো যে আমাদের বাচ্চারা তখুনি মায়ের পেট থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে! কিন্তু তখন আমার বাচ্চাদের বয়স ছিল মাত্র ২৮ সপ্তাহ, এত দ্রুত বাচ্চাদের পৃথিবীতে আসাটা ভীষণ বিপজ্জনক ছিল। বাচ্চাদের শ্বাসনালীটা যাতে পরিপূর্ণভাবে গঠিত হতে পারে এজন্য ডাক্তাররা আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন।
আমি কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি আমার বাবা-মাকে ফোন করে বললাম, “কী হবে শেষপর্যন্ত? আমার বাচ্চারা বাঁচবে তো?” সত্যিই খুব খারাপ ছিল সেই সময়টা। কিন্তু আমার স্ত্রী অসাধারণ এক যোদ্ধা, সে বহু কষ্ট সহ্য করে আস্তে আস্তে নিজেকে ধরে রাখছিলো। সেই সময়ে বহু রাত আমি চেয়ারে বসেই ঘুমিয়েছি। কিন্তু জীবনে তো থেমে থাকার উপায় নেই, সেই কঠিন সময়েও দুপুরে আমাকে ফুটবল খেলতে হয়েছে। অক্টোবরের ৩০ তারিখে অলিম্পিয়াকোসের বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ খেলতে আমাকে গ্রিসে যেতে হয়েছিলো। সেই রাতেই আমি বারবারার কাছ থেকে একটা ফোনকল পেলাম। সে আমাকে ফোনে জানালো যে আমাদের মেয়ে সোফা আর ছেলে জে পেদ্রো পৃথিবীতে এসেছে।
খবরটা পেয়ে খুশিতে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ কিছুদিন আগে পৃথিবীতে চলে আসায় আমার দুই সন্তানকে প্রায় দুই মাস হাসপাতালের অণ্ডস্ফুটন যন্ত্রে রাখতে হয়েছিলো। সেই সময়ে ফুটবল খেলাটাকে আমার কাছে বেশ কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিলো। আমি বার্সেলোনায় কতটা ভালো খেলছিলাম এই নিয়েই তখন সবাই আলোচনা করছিলো। কিন্তু আমি নিজে তখন আমার বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে খুব কঠিন সময় পার করছিলাম। সেই সময়ে অনুশীলনে থেকেও আমি সবসময় আমার বাচ্চাদের কথাই ভাবতাম।
এই ঘটনার সমস্ত কৃতিত্ব আমার স্ত্রীকে দিতে হবে। সেই সময়ে আমাকে ফুটবল নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিলো। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার সন্তানদের বাঁচানোর জন্য কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছিলো। সন্তানকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একজন মা যেসব ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে সোফা আর জে হাসপাতাল থেকে বাসায় এলো। বিশ্বাস করুন, সেটাই আমার জীবনের সেরা বড়দিনের উপহার।
মানুষ আমার গল্প শুনে বলে, “তুমি চীন থেকে বার্সেলোনার মতো ক্লাবে এসেছো, বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছো। কিভাবে এই ঘটনাগুলোকে তুমি ব্যাখ্যা করবে?” এটা সত্যি, ফুটবলে অনেক উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমার এখনো মনে হয় আমি গুয়াংজুতে থাকাকালীন যে খেলোয়াড় ছিলাম, বার্সেলোনায় এসেও সেই খেলোয়াড়ই রয়েছি। অলৌকিক কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। দিনশেষে ফুটবল তো একটা খেলাই, এটা জীবন-মরণের কোনো ব্যাপার নয়। ফুটবলে ফলাফল যা-ই হোক, আমি বাসায় ফেরার পর আমার সন্তানরা যেভাবে বাবা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেটাই আমার কাছে অলৌকিক ঘটনা।
ফিচার ইমেজ: sportsnet.ca