বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন

না উন্নতি, কিংবা অবনতি – বদলটা আসলে রাতারাতি হওয়ার কোনো বিষয় নয়। সব কিছুর কার্যকারণই তো একটা লম্বা সময় ধরে গড়ে তোলা প্রক্রিয়ার ফল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ হারেই তাই ‘গেল, গেল, সব গেল’ রব তোলার কারণ নেই। 

তবে টানা দুই ম্যাচে হার যেহেতু, কিছু না কিছু গড়বড় তো পাওয়া যাবেই। এবং, ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েক বছর বাদে ঘরের মাঠে সিরিজ হার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং কারণ হিসেবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে গত কিছুদিনের নিয়মিত সমস্যাকেই। আরও একটা সিরিজ গেল, যেখানে ব্যাটিংটা মনমতো হলো না বাংলাদেশের।

সিডন্স-তামিমকে ভাবতেই হচ্ছে ব্যাটিং নিয়ে। Image credit: BCB

কবে থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে গণ্ডগোল, তার সন্ধান করতে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে ২০২১ সালে। আর কাকতালীয়ভাবেই বোধ হয়, সময়কালটা মিলে যাচ্ছে ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিল ম্যাকেঞ্জির প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে। এরপর থেকে লম্বা সময় বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া দু’জনই ব্যর্থ হয়েছেন ম্যাকেঞ্জির ঊর্ধ্বমুখী উন্নতির গ্রাফটা ধরে রাখতে। মাঝে অ্যাশওয়েল প্রিন্সের সময়টা ভালো দেখালেও তিনি প্র‍তিপক্ষ পেয়েছিলেন ক্ষয়িষ্ণু জিম্বাবুয়েকে, সেটাও মাত্র তিন ম্যাচের জন্যই। আরও বড় পরীক্ষায় পড়লে তিনি কী করতেন, প্রশ্নটা তাই থাকবেই।

কোচম্যাচগড়স্ট্রাইক রেট
জেমি সিডন্স১৭৩২.৫৮৪.৯৮
অ্যাশওয়েল প্রিন্স৩৯.০৪৫.৫৭
জন লুইস২৭.৯৮৪.৬৩
নিল ম্যাকেঞ্জি৩৬৩৫.৮১৫.৫৪
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে৫২৩১.৮৩৫.৩৩
কোন কোচের অধীনে কেমন বাংলাদেশ

তবে, প্রিন্স তো চলে গেছেন। বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাবনার কারণ বর্তমানটাই এবং কোচিং প্যানেলে প্রত্যাবর্তনের পর জেমি সিডন্সের কাজকর্মও পড়ছে আতশকাঁচের তলায়। তার সময়ে বাংলাদেশ যে ১০টা ম্যাচ জিতেছে, এর কৃতিত্ব নিশ্চিতভাবেই তিনিও পাবেন; কিন্তু বাকি যে ৭ ম্যাচ হারল দল, সেখানে ব্যাটিং-ব্যর্থতাই ফুটে উঠছে প্রকট হয়ে।

হুটহাট অল্প রানে গুটিয়ে যাওয়ার স্বভাবটা বাংলাদেশের পুরনো, তবে চান্দিকা হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদ থেকেই এই অভ্যাসটা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ। অন্তত, ঘরের মাঠে ২০০-এর কমে বোতলবন্দী হওয়ার নজির খুব একটা ছিল না গত কয়েক বছরে। তবে সিডন্স ব্যাটিং কোচ হয়ে ফিরে আসার পরে যেন ফিরে এলো সেই রোগটাও। সিডন্সের অধীনে ১৭ ম্যাচে চারবার ২১০ রানের কমে গুটিয়ে গেছে দল। ঘরের মাঠে গত ১০ বছরে যে ঘটনা ঘটেছিল আর মাত্র সাতবার।

প্রতিপক্ষরানসাল
ভারত৫৮২০১৪
শ্রীলঙ্কা৮২২০১৮
শ্রীলঙ্কা১৪২২০১৮
দক্ষিণ আফ্রিকা১৬০২০১৫
শ্রীলঙ্কা১৬৭২০১৪
ভারত১৮২২০২২
শ্রীলঙ্কা১৮৯২০২১
আফগানিস্তান১৯২২০২২
ইংল্যান্ড১৯৪২০২৩
আফগানিস্তান২০৮২০১৬
ইংল্যান্ড২০৯২০২৩
২০১৪ থেকে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন সংগ্রহগুলো

সংখ্যাটা যে আরও বাড়েনি, এর জন্য লোয়ার-অর্ডার ব্যাটারদের একটা বাড়তি ধন্যবাদ প্রাপ্য। ২০২২ সালের গোড়া থেকে ধরলে বাংলাদেশের ৭-১০ নম্বর জুটি পারফর্ম করছে বিশ্বসেরার মতোই। তবে, শুরুর ছয় জুটি যা খেলছে, তাতে এই রেকর্ড সম্ভাবনার বদলে শঙ্কাই জাগাচ্ছে।

সমস্যার শুরু টপ-অর্ডার থেকেই। দ্রুত রান তোলাটা বাংলাদেশের শক্তির জায়গা ছিল না কখনোই। তামিম ইকবাল এবং লিটন দাসের রান করার ধরন মিলে যায় এখানে, দু’জনই চান ধীরেসুস্থে ইনিংস শুরু করে পরে পুষিয়ে দিতে। যে কাজটা তারা করেছেনও বেশ কিছুদিন। তবে সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, যে দিনগুলোতে তারা পারছেন না হুইসেল বাজিয়ে দেওয়া ট্রেন ধরতে।

সর্বশেষ উদাহরণটা সাম্প্রতিকই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে যেখানে বাংলাদেশকে তাড়া করতে হতো ৩২৬ রানের পাহাড়, তামিম সেদিন ফিরেছিলেন ৬৫ বলে ৩৫ রান করেই। আর বাংলাদেশ হেরেছে ১৩২ রানে

লিটন-তামিম, একটু ধীরেসুস্থেই শুরু করতে চান ইনিংসটা। Image credit: BCB

পাল্টা যুক্তি হতে পারে, শুরুতেই ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া তামিমের এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল! যুক্তি খণ্ডনের জন্য তাই ফিরে যাওয়া যেতে পারে জিম্বাবুয়ে সফরের প্রথম ওয়ানডেতে। সেদিন প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ তুলেছিল ৩০৩ রান, ওপেনে নেমে তামিম করেছিলেন ৮৮ বলে ৬২ রান। কিন্তু ম্যাচশেষে বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল পরাজিত দলেই – যার নেপথ্যে তামিমের রানের গতি বাড়াতে না পারার ভূমিকা না থেকে পারেই না।

শুধু তো ওপেনাররা নন, দলের মিডল-অর্ডার ব্যাটাররাও সেট হয়ে রান করতে পারার দোষে দোষী। ওয়ানডে দলের টু-ডাউন পজিশনকে একরকম নিজের করে নেওয়া মুশফিকুর রহিম সর্বশেষ সেঞ্চুরি পেয়েছেন ১৫ ম্যাচ আগে। মাঝের এই সময়টায় ২২.৮৩ গড়ে রান করেছেন ২৭৪, স্ট্রাইকরেটটাও প্রাগৈতিহাসিক আমলের, মাত্র ৬৬.৯৯। আর তিনি যে সেট হয়েও রান করতে পারছেন না, তা বোঝা যাবে তার ইনিংসপ্রতি বলের মধ্যকের* (২৭.৫) দিকে তাকালেই।

ম্যাচ১৫
রান২৭৮
গড়২১.৩৮
স্ট্রাইক রেট৬৭.১৪
ফিফটি
সেঞ্চুরি
মুশফিকের সর্বশেষ ১৫ ম্যাচের খতিয়ান

একই সমস্যায় আক্রান্ত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। তার ‘সেট হয়ে আক্রমণ করব’ পরিকল্পনাটা বুমেরাং হয়ে ফেরত আসছে বেশিরভাগ দিনেই। গত সাত সিরিজে যে ১৮টা ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি, তার ১১ বারেই তাকে ফিরতে হয়েছে ২০ থেকে ৩৯ রানের মাঝে।

রানকতবারঅপরাজিত
০-১৯
২০-৩৯১১
৪০-৫৯
৬০-৭৯
৮০-৯৯
মাহমুদউল্লাহর সর্বশেষ সাত সিরিজ

মুশফিক-মাহমুদউল্লাহকে ‘ধ্রুবক’ ধরে মিডল-অর্ডারে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ইয়াসির আলী রাব্বি কিংবা নুরুল হাসান সোহানকেও। তাদের কাছে ম্যানেজমেন্টের প্রত্যাশা কী ছিল, জানার উপায় নেই; তবে দু’জনের কেউই যেহেতু সুযোগ পাননি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে, অনুমান করাই যায় যে প্রত্যাশা পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেননি তারা। তিন নম্বরে দুর্দান্ত পারফর্ম করতে থাকা সাকিব আল হাসানকে মিডল-অর্ডারে নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে সর্বশেষ, তাতে লাভের লাভ কতটা হবে সময়ই বলবে।

এমন আকালের দিনেও বাংলাদেশ যে স্মরণীয় কিছু জয় পেয়ে গেল আফগানিস্তান আর ভারতের বিপক্ষে, তার কৃতিত্বটা পুরোপুরিই লোয়ার-অর্ডারের ব্যাটারদের। সিডন্স কোচ হয়ে আসার পরে নিশ্চিত করেই কিছু কাজ করেছেন মিরাজ-আফিফ-তাসকিনদের নিয়ে, তাতে ফলও পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু ‘চিন্তা নেই, লেজের ব্যাটিং বাঁচাবে’ পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বকাপে গেলে বড় একটা ফাটকাই খেলা হবে।

বহু বছর আগে, ভেজা উইকেটের কারণে ব্যাটিং-অর্ডার পুরোপুরি উল্টে বোলারদের দিয়ে ইনিংস উদ্বোধন করিয়েছিলেন স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান। পরে উইকেট শুকিয়ে গেলে নিজেই ২৭০ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে সিদ্ধান্তটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট লোককথার পাতায়। কে বলতে পারে, লোয়ার-অর্ডার দিয়ে তেমন কোনো মাস্টারস্ট্রোক খেলার চিন্তা বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্টের মাথাতেও ঘুরছে কি না।

* মধ্যক: কোনো পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্তগুলোকে মানের ক্রমানুসারে সাজিয়ে মোট উপাত্তসংখ্যাকে দুই দিয়ে ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায়।

This article is in Bangla language. This article is on Bangladesh's shambolic batting display in the recent past. Necessary hyperlinks, images and tables are attached inside.

Featured image © Getty Images

Related Articles

Exit mobile version