এই মৌসুমের শুরুতে ৫৮ পাউন্ড ইউরোর বিনিময়ে লীডস ইউনাইটেড থেকে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রাফিনহাকে কিনে আনে বার্সেলোনা। রাফিনহার বার্সেলোনায় আসার অর্ধেক মৌসুম পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ব্লাউগ্রানা জার্সিতে নিজের নামের প্রতি খুব একটা সুবিচার করতে পারেননি এ ব্রাজিলিয়ান। যদিও পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে তিনি যে খুব একটা খারাপ পারফর্ম করছেন, সেটাও বলা যাবে না। এই মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে ৩১ ম্যাচে মাত্র ১,৬৭২ মিনিট খেলেই ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন ৭ গোল এবং ৯ টি অ্যাসিস্ট; এই মৌসুমে তার চেয়ে বেশি গোল কন্ট্রিবিউশন রয়েছে কেবলমাত্র রবার্ট লেওয়ানডফস্কির।
কিন্তু এরপরেও কি কারণে বলা হচ্ছে রাফিনহা বার্সেলোনার হয়ে এখনো খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না? এ কথা বলা হচ্ছে কেবলমাত্র তার খেলার ধরনের কারণেই। মাঝেমধ্যেই তার বলের দখল হারানোর কারণে বার্সেলোনার গোছানো আক্রমণগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের সামনে তাকে কখনো কখনো একেবারেই অসহায় ঠেকছে।
জাভির দলে খেলা উইঙ্গারের সবচেয়ে আদর্শ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাকে মাঠের যতটা সম্ভব ওয়াইড এরিয়ায় খেলতে হবে, প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের ওয়ান-ভার্সেস-ওয়ান পরিস্থিতিতে পরাস্ত করে গোলের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ক্রমাগত বাজে খেলার পরও উসমান দেম্বেলেই রাইট উইঙ্গার হিসেবে জাভির প্রথম পছন্দ। পাসিং দক্ষতার দিক থেকে রাফিনহা ডেম্বেলের চেয়ে বেশ এগিয়ে থাকলেও প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকদের ড্রিবল করে পরাস্ত করায় বেশ দুর্বল হওয়ায় তিনি এখনো জাভির আস্থা অর্জন করতে পারেননি।
রাফিনহা এই মৌসুমে প্রতি ম্যাচে গড়ে সাতবার ড্রিবল করে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করার চেষ্টা করেছেন, যে পরিসংখ্যান যেকোনো উইঙ্গারের জন্যই বেশ ইর্ষণীয়। কিন্তু তিনি মাত্র ৩৫.৮২ শতাংশ সময় ড্রিবল করে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করতে পেরেছেন, যেখানে ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে তার দৈন্যদশাই ফুটে উঠছে।
তবে রাফিনহার এই দুর্বলতার পেছনে বার্সেলোনার খেলার ধরনও অনেকটাই দায়ী। সেটা ভালোভাবে বোঝার জন্য লীডসের হয়ে রাফিনহার খেলার ধরন সম্পর্কে জানাটা জরুরি। তাই আমরা প্রথমে লীডসের হয়ে রাফিনহা কোন ভূমিকায় খেলতেন, সেটা নিয়ে আগে জানার চেষ্টা করব।
লীডস ইউনাইটেডের কোচ মার্সেলো বিয়েলসা তার খেলোয়াড়দের শক্তিমত্তা এবং দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী তাদেরকে মাঠে খেলার সুযোগ করে দিতেন। এজন্য তিনি খুব সহজেই তার খেলোয়াড়দের খেকে সেরাটা বের করে আনতে পেরেছেন। দলগত সাফল্য না পেলেও লীডসের হয়ে রাফিনহার দু’টি মৌসুমই কেটেছে একেবারে স্বপ্নের মতো।
বিয়েলসা রাফিনহাকে সাধারণত রাইট উইঙ্গার পজিশনে খেলালেও প্রতিপক্ষের খেলার ধরন অনুযায়ী মাঝেমধ্যে বামপাশেও খেলিয়েছেন। তবে রাফিনহা যেখানেই খেলুক, তারপাশে সবসময়ই এমন একজন ফুটবলার রেখেছেন যিনি রাফিনহার পায়ে বল এলেই রান নিয়ে রাফিনহার মার্কারকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নিয়ে যেতেন। লীডসে এই ভূমিকায় সাধারণত লুক আয়লিং, স্টুয়ার্ট ডালাস কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে মাতিয়াস ক্লিককে দেখা গেছে। এতে করে বল পায়ে আসার সাথে সাথে রাফিনহা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের প্রেসিংয়ের সম্মুখীন হননি। যে কারণে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে বল পায়ে কাট-ইন করে গোলের সুযোগ তৈরি করার সুযোগ করে নিতে পেরেছেন।
ডালাসের পাস রিসিভ করার সাথে সাথে ওয়েস্টব্রমের উইঙ্গার রাফিনহাকে প্রেস করতে শুরু করেন। রাফিনহা এক টাচেই আবার ডালাসকে রিটার্ন পাস বাড়িয়ে ‘ইন-বিহাইন্ড’ রান নেন।
লীডসের মিডফিল্ডার স্যাকেলটন তার পজিশন থেকে নিচে নেমে তার মার্কারকে ‘আউট অব পজিশনে’ আসতে বাধ্য করেন।
ডালাস-স্যাকেলটনের নিজেদের মধ্যকার কুইক ওয়ান-টু পাসের কারণে বলের কাছাকাছি থাকা ওয়েস্টব্রমের তিনজন খেলোয়াড়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। একইসময় রাফিনহা ওয়েস্টব্রমের রক্ষণের পিছনের ফাঁকা জায়গা লক্ষ্য করে থার্ড ম্যান রান নেয়।
ডালাস-স্যাকেলটনের ওয়ান-টু পাসিং কম্বিনেশন ওয়েস্টব্রমের তিনজন ফুটবলারকে পাশ কাটিয়ে বল রাফিনহার কাছে পৌছে যায়।
এবার রাফিনহা বল পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে শুরু করেন। এসময় ডালাস হাফস্পেস ধরে ‘আন্ডারল্যাপিং’ রান নিলে একজন ডিফেন্ডার তার দিকে ছুটে যায়।
ফলে রাফিনহা সহজেই ওয়েস্টব্রমের লেফটব্যাককে পরাস্ত করে কাট-ইন করে গোল লক্ষ্য করে শট নেন এবং গোল করে ফেলেন।
এবার ওয়াইড এরিয়ার জটলার মধ্যে রাফিনহা এক টাচেই আয়লিংয়ের রানকে লক্ষ্য করে দ্রুত পাস বাড়ান।
আয়লিং বল পায়ে প্রতিপক্ষ থার্ডে পৌছে যান। এক্ষেত্রে আয়লিং রাফিনহাকে রিটার্ন পাস বাড়াননি। তবে এই ধরনের পরিস্থিতিতে রিটার্ন পাস পেলে রাফিনহা অনেকটাই ফাঁকা জায়গা সামনে রেখে বল রিসিভ করার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে তিনি আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন।
রাইট হাফস্পেসে রাফিনহার পায়ে বল আসার সাথে সাথেই টটেনহ্যামের তিনজন ফুটবলার তাকে প্রেস করতে তার দিকে এগিয়ে আসেন। এসময় ডালাস ‘ওভারল্যাপিং’ রান নিতে শুরু করেন।
ডালাসের ওভারল্যাপিং রানের কারণে টটেনহ্যামের লেফটব্যাক রেগুইলন তার দিকে ছুটে যায়।
ফলে রাফিনহা এবার ওয়ান-ভার্সেস-ওয়ান পরিস্থিতিতে বডি টার্ন করে কাটইন করার সুযোগ পান।
সেই স্পেস কাজে লাগিয়ে বক্সের ভেতরে ব্যামফোর্ডের রান লক্ষ্য করে ইনসুইং ক্রস করেন যেখান থেকে দুর্দান্ত একটি গোলের সুযোগ তৈরী হয়।
রাফিনহা যে শুধু কাটইন করে ইনসুইং ক্রস বা বক্সের বাইরে থেকে শট নেওয়াতেই দুর্দান্ত তা নয়, টিমমেটের জন্য জায়গা তৈরি করে গোলের সুযোগ তৈরি করা কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পাস দিয়ে আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও রাফিনহা দুর্দান্ত। এই মৌসুমে তিনি ইতোমধ্যেই ২টি সেকেন্ড অ্যাসিস্ট এবং ২টি থার্ড অ্যাসিস্ট করেছেন, যা আনসু ফাতির পর বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এখানে ডালাসের পাস রিসিভ করার জন্য রাফিনহা তার পজিশন ছেড়ে নিচে নামেন, একইসাথে তার মার্কারকেও নিজের দিকে টেনে আনেন।
ফলে ক্রিস্টাল প্যালেসের বক্সের বাইরের ওয়াইড এরিয়ায় অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়৷ সেদিকে ডালাস রান নেন এবং রাফিনহার পিনপয়েন্ট পাস থেকে ডালাসের ক্রসের মাধ্যমে দারুণ একটু গোলের সুযোগ তৈরি হয়।
টটেনহ্যামের বিপক্ষে রাইট উইংয়ে জটলার মধ্যে পাস রিসিভ করে ওয়ান টাচেই বামপায়ে রদ্রিগোকে পাস বাড়ান রাফিনহা।
এবার দ্রুতগতিতে রাফিনহা টার্ন করে রদ্রিগোর ওয়ান টাচ পাস রিসিভ করেন।
এতে করে রাফিনহা ‘বিটুইন দ্য লাইনের’ স্পেসের মধ্যে বল পেয়ে যান। ফলে তিনি বল রিসিভ করে পাস বাড়ানোর জন্য অনেকটা সময় পান এবং দুর্দান্ত একটি ডিফেন্সচেরা পাস বাড়াতে সক্ষম হন।
এবার আসা যাক বার্সেলোনার হয়ে রাফিনহা কেন ঠিক জ্বলে উঠতে পারছেন না সেটা নিয়ে। বার্সেলোনার রাইটব্যাক কৌন্দেকে সাধারণত ওভারল্যাপিং কিংবা আন্ডারল্যাপিং রান নিতে দেখা যায় না – যে কারণে রাফিনহাকে বারবার ওয়াইড এরিয়ায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বিপক্ষে ওয়ান-ভার্সেস-টু লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এজন্য তাকে বল নিয়ে বক্সে ঢুকতে প্রতিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়কে ড্রিবল করার চেষ্টা করতে হচ্ছে, যে কাজে রাফিনহা তেমন দক্ষ নন। তিনি ডান পায়ে দুর্বল হওয়ায় রান নিয়ে কর্নার দাগের কাছাকাছি গিয়ে ডান পায়ে ক্রস করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। যে কারণে তিনি বারবার প্রতিপক্ষের দুইজন মার্কারকে ড্রিবল করে কাটইন করতে গিয়ে বলের দখল হারাচ্ছেন, যা কি না তাকে আরো বেশি ‘প্রেডিক্টেড’ করে দিচ্ছে।
রাফিনহা যখন রাইট উইংয়ে বল রিসিভ করেছেন তখন কৌন্দে রান না নিয়ে তার অনেকটা নিচে পজিশন নিয়ে রয়েছেন।
ফলে সোসিয়েদাদের উইঙ্গারও লেফটব্যাকের সাথে তাকে মার্ক করতে নেমে এসেছে। ফলে রাফিনহা ওয়ান-ভার্সেস-টু পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছেন।
এবারও রাফিনহা বল রিসিভ করার সময় কৌন্দে তার সাপোর্টে আসেননি। রাফিনহার সামনে কোনো পাসিং অপশন না থাকায় বাধ্য হয়েই তাকে ড্রিবলিংয়ের চেষ্টা করতে হয় এবং তিনি বলের দখল হারিয়ে ফেলেন।
এবারও কৌন্দে যথারীতি হাফস্পেস ধরে রান না নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
এবার গাভি রাফিনহার সাপোর্টে আসলে উইংয়ে টু-ভার্সেস-থ্রি পরিস্থিতির তৈরী হয়। ফলে রাফিনহার সামনে কৌন্দেকে ব্যাকপাস দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এরপরও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে রাফিনহা ব্লাউগ্রানা জার্সিতে নিজের সেরা ম্যাচটি খেলেছেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, এত কিছুর মধ্যেও তাহলে এই ম্যাচে রাফিনহার ভালো খেলার রহস্য কী?
ইউনাইটেড ম্যাচের প্রথমার্ধে রাফিনহা খুব একটা ভালো খেলেননি। ইনজুরির পর পেদ্রি উঠে যাওয়ার পর সার্জি রবার্তো নামায় বার্সেলোনা মিডফিল্ডের দখল অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু রবার্তো হাফস্পেস ধরে ক্রমাগত রান নেওয়াতে রাফিনহার সামনে ডানপাশে স্পেস ক্রিয়েট হচ্ছিল। সে কারণে ওই ম্যাচে রাফিনহা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন।
বার্সার দ্বিতীয় গোলটার দিকে খেয়াল করা যাক। রাফিনহা পায়ে বল আসার সময় রবার্তো হাফস্পেস ধরে রান নেন। ফলে রাফিনহার সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। সেখানে রাফিনহার দুর্দান্ত বাঁকানো ক্রস লেওয়ানডফস্কির ডামিতে গোলে পরিণত হয়।
পরিসংখ্যানকে যদি একপাশে রাখি তাহলে আমরা এখনো লীডসের সেই ভয় জাগানো রাফিনহাকে বার্সেলোনার জার্সিতে দেখতে পাইনি। জাভি যদি রাফিনহার পাশে একজন ‘ইন-বিহাইন্ড রানার’ খেলান, তবে রাফিনহা বল রিসিভ করার সাথে সাথেই প্রেসিংয়ের মুখে পড়বেন না। এতে করে তার পক্ষে বল রিসিভ করে সময় নিয়ে পাস বাড়ানো বা ড্রিবল করা সম্ভব হবে।
এখন দেখার বিষয় জাভি কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করেন এবং রাফিনহা দলে মানিয়ে নিতে নিজের খেলার ধরনে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেন।
(সকল তথ্য ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ পর্যন্ত)