বাউরাল, নিউ সাউথ ওয়েলসের এক মফস্বল শহর। সিডনি থেকে আশি মাইল দক্ষিণে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুইশ ফুট ওপর গড়ে ওঠা কৃষিপ্রধাণ এই শহরে বসতি গেড়েছেন জর্জ-এমিলি দম্পতি। তাদের বাড়ির পেছনে সিমেন্ট দিয়ে বাধানো আটশ গ্যালনের গোলাকার এক বিশাল পানির ট্যাংক। বৃষ্টিমুখর দিনে সেই পানির ট্যাংকের বিপক্ষে নিজের তৈরি নিয়মে ক্রিকেট খেলে জর্জ-এমিলি দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান ডোনাল্ড। সরঞ্জাম হচ্ছে একটা স্টাম্প আর গলফ বল। ট্যাংকের সামনেই ছিল একটা ইটের স্ট্যান্ড। সেই স্ট্যান্ডে ছুটে যেত গলফ বল, ফিরে আসতেই সপাটে হাঁকাত ছোট্ট ডোনাল্ড। গলফ বল হওয়ায় তুলনামুলক বেশি গতিতেই ফিরে আসতো ডোনাল্ডের দিকে। কিন্তু তাতে দমে গেলে তো! সেই খেলায় দমে না গেলেও মায়ের বকুনিতে অনেক খেলাতেই ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়েছে তাকে।
প্রশ্ন জাগতে পারে পাঠক মনে, ট্যাংকের সাথেই কেন ক্রিকেট খেলতে হবে? উত্তরটা দিয়ে দিই। বাউরালেই বেড়ে ওঠা ডোনাল্ডের। পড়াশোনার হাতেখড়ি বাউরাল ইন্টারমিডিয়েট হাইস্কুলে, যেখানে খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা ছিল না বললেই চলে। স্কুলে বন্ধুবান্ধবও ছিল বটে, কিন্তু সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে সমবয়সী কাউকেই না পাওয়ায় ডোনাল্ডের খেলার সঙ্গী হয়ে ওঠে সেই আটশ গ্যালনের পানির ট্যাংক। ফুটবল কিংবা টেনিসও খেলা হতো সেই একই নিয়মে, একই জায়গায়।
স্কুলের মাঠে খেলতেন ডোনাল্ডের সিনিয়ররা। ধুলোভরা মাঠে খড়ি দিয়ে উইকেট আঁকা হতো স্কুলের থামে। গাম গাছের ডালে তৈরি ব্যাট, প্যাডের বালাই নেই। সেদিকে কারো ‘থোড়াই কেয়ার’। স্কুলের বড় ভাইদের বদান্যতায় ধুলোভরা সেই মাঠে কালেভদ্রে ব্যাট ধরার সুযোগ মিলত ডোনাল্ডের। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমবার ম্যাচ খেলার সুযোগ পেল ডোনাল্ড, বয়স তখন ১১।
ভেন্যু বাউরাল গ্লোব পার্ক। টস জিতে ডোনাল্ডদের দল ব্যাটিংয়ে। প্রতিপক্ষের এক বাঁহাতি বোলারের প্রথম দুই বলেই নেই দুই উইকেট। হ্যাটট্রিক বলের সামনে ব্যাট হাতে ডোনাল্ড। বলটা কীভাবে যেন আটকে দিল ১১ বছর বয়সী কিশোর, পরে আউট হলো ৫০ রান করে। সেখান থেকেই শুরু।
বছরখানেক পর সুযোগ এলো স্কুলের মাধ্যমিক স্তরের ক্রিকেট দলে খেলার। ডোনাল্ডদের প্রতিপক্ষ মিটাগং হাইস্কুল। বাউরাল সেই ম্যাচে করেছিল ১৫৬, যার মধ্যে ১১৫*-ই ডোনাল্ডের। ১২ বছর বয়সে জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি। বেশ গর্ব হচ্ছিল ডোনাল্ডের। সেই গর্বের সুবাতাস টিকে রইল মাত্র একদিন, কারণ সেঞ্চুরি করে ব্যাটটা মাঠে ফেলে আসার ‘অপরাধে’ পরদিন বেশ বকুনি শুনতে হয়েছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। সেই প্রথম আর শেষ, এরপর আর কখনো ওমন ‘অপরাধ’ হয়নি ডোনাল্ডের। পরের ম্যাচেও হাসে তার ব্যাট। স্কোর এবার অপরাজিত ৭২। খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা খুব বেশি না থাকলেও ক্রিকেটের সাথে রাগবি, টেনিস, অ্যাথলেটিক্সেও পারদর্শিতা ছিল তার।
বাউরালের আর দশটা বাড়ন্ত ছেলের মতোই ছিল ডোনাল্ডের শৈশব। ভাইকে সাথে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে শিকার। এলাকার নালায় মাছ শিকার। সাঁতারে অবশ্য খুব বেশি সুবিধা হয়নি। দু’বার ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়ায় আর ওমুখো হয়নি ডোনাল্ড। পড়াশোনাতেও খারাপ নয়। অঙ্ক ভালোবাসত, এরপর আগ্রহ বিজ্ঞানে। কিন্তু স্কুলের ল্যাবে এক ছেলে নিয়মের বাইরে গিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে ঘটায় বিস্ফোরণ। ব্যস! সাঁতারের মতো বিজ্ঞানকেও বিদায়।
১৩ নাকি অপয়া!
বিশ-পঁচিশ মাইল রেডিয়াসে যে কয়টা ক্রিকেট দল আছে, বাউরালের হয়ে প্রতি শনিবার পালাক্রমে তাদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন ডোনাল্ডের মামা জর্জ হোয়াইটম্যানরা। বাউরাল ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তিনিই। তার নেতৃত্বে রাবারের তৈরি চাকার বিশেষ এক ধরনের গাড়িতে চড়ে খেলতে যেত বাউরালের ছেলেরা। ডোনাল্ডের জায়গা হতো কেরোসিনের বাক্সের ওপর। এত কষ্ট করে মাঠে গিয়ে তার ভূমিকা ছিল স্কোরারের। একদিন সুযোগ মিলল ব্যাট করার। তখনও ফুলপ্যান্ট পরা হয়নি ডোনাল্ডের। ব্যাট প্রায় নিজের উচ্চতার সমান। তাতে কী আসে যায়! মাথা ছুঁইছুঁই সেই ব্যাট দিয়ে রান করল ৩৭*। পরের শনিবারে আবারো সুযোগ এলো ব্যাটিংয়ের। এবার স্কোর ৩৯*।
১৩ বছর বয়সে বড়দের সাথে ক্রিকেট খেলা, তাও সাহসী দুটো ইনিংস। বড় ব্যাট দিয়ে খেলতে সমস্যা হচ্ছিল দেখে ডোনাল্ডের পাশে দাঁড়ালেন তারই সিনিয়র এক সতীর্থ মি. সিড কিউপিট। অমন দুটো ইনিংস খেলে কিউপিটের কাছ থেকে একটা ব্যাট উপহার জুটে যায়। ব্যাটের এক জায়গায় ফাটল ছিল। এবার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় বাবা জর্জ। ছেলের ব্যাটটা তিন ইঞ্চি কেটে খানিকটা ব্যালেন্স এনে দেন তিনি।
জর্জও ছিলেন ক্রিকেটের বড় সমঝদার। গ্যালারিতে বসে দেখতেন দেশের খেলা। সেবার ইংল্যান্ড গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে। সফরের পাঁচ নম্বর টেস্টটা ছিল সিডনিতে। সেই টেস্ট দেখতে যাচ্ছিলেন জর্জ, তার সাথে যাওয়ার কঠিন বায়না ধরেছিল ডোনাল্ড। অনেক অনুরোধ-অনুনয়ের পর বাবা জর্জের মন গলে। গ্যালারিতে বসে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের স্বাদ নেওয়া সেই প্রথম। প্রথম দুইদিনের খেলা দেখে বাড়ি ফেরে বাবা-ছেলে। ফেরার সময় ডোনাল্ড তার বাবাকে বলে বসে,
‘এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছে না।’
জর্জ তো তখনও জানতেন না, এই মাঠেই তার ছোট ছেলেটা দুটো সেঞ্চুরি, দুটো ফিফটি আর একটা ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকাবে!
১৩ নাকি অপয়া, জ্যোতিষীর বাণী। ডোনাল্ডকে কেউ এই কথাটা বলেই দেখত! মুচকি হাসির সাথে হয়তো উত্তর আসত, ‘এসে দেখেই যাও!’
স্যাটারডে ফান ক্রিকেট
ডোনাল্ড তখন গায়ে-গতরে বেশ বেড়ে উঠেছেন। বাউরালের ক্রিকেট দলের নিয়মিত মুখ। জেলার ক্রিকেট খেলা চলছে সেই আগের নিয়মেই। প্রতি শনিবারের রুটিনে। বেলা দুটো থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। ডোনাল্ডদের প্রতিপক্ষ এবার উইঞ্জেলো, যারা আগের ম্যাচেই হারিয়েছে বাউরালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মস ভেল’কে। উইঞ্জেলোতে এক দারুণ লেগ স্পিনার খেলে, নাম বিল ও’রাইলি। তারই চৌকস লেগ স্পিনে নাজেহাল হয়েছিল মস ভেল।
ম্যাচগুলো চলতো হোম-অ্যাওয়ে ভেন্যুতে। প্রথম শনিবার বাউরালে, তো পরের শনিবারে খেলা হতো প্রতিপক্ষের মাঠে। উইঞ্জেলোর বিপক্ষে প্রথম শনিবারের খেলা পড়ল বাউরালে। ডোনাল্ডের ব্যাট যেন হয়ে উঠল খোলা তরবারি। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে প্রথমদিন অপরাজিত রইলেন ২৩৬ রানে। পরের শনিবারে ডোনাল্ডকে থামালেন সেই লেগ স্পিনার ও’রাইলি। সেই ইনিংসের পর ডোনাল্ডের নাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো জেলায়। তবে চমক তখনও বাকি। জেলার ক্রিকেটের ফাইনালে প্রতিপক্ষ মস ভেল। টস জিতে ব্যাট করতে নামে বাউরাল। দুই শনিবার ব্যাট করে ডোনাল্ডের রান ২৭৯*। মামা-ভাগ্নের জুটিতে বাউরাল পায় ৩৫০ রান। ডোনাল্ড থামেন ৩০০’তে। দলের সংগ্রহ নয় উইকেটে ৬৭২। ওদিকে মস ভেল টিকতেই পারেনি। প্রথম ইনিংস থামে ১৩৪ রানে। ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয়টা থামে ২০০ রানে। পাঁচটা শনিবার খেলার পর এক ইনিংস ও ৩৩৮ রানে ম্যাচ জিতে নেয় ডোনাল্ড-জর্জদের বাউরাল।
এই ফাইনালের আগে মা এমিলি বলেছিলেন, সেঞ্চুরি করতে পারলে একটা নতুন ব্যাট দেবেন তিনি। সেই অনুযায়ী ট্রিপল সেঞ্চুরির জন্য মায়ের কাছে তিনটা ব্যাট দাবি করে ডোনাল্ড। সেই দাবি টিকলে তো!
চারপাশে সুখ্যাতি ছড়ানোর পর ডোনাল্ডের ব্যাটের অভার রইল না। উইলিয়াম-সাইকস কোম্পানি থেকে ব্যাট এলো তার জন্য। পরবর্তীতে ওই কোম্পানির ব্যাটেই খোদাই করা থাকত তার নাম – ‘ডন ব্র্যাডম্যান’।
এতক্ষণ বলছিলাম অবিসংবাদিতভাবে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের শৈশব, কৈশোর মিলিয়ে ক্রিকেটের দারুণ এই যাত্রার কথা। স্যার ডনের কথা মাথায় আসলে সবার আগে কোন চিন্তাটা আপনার মনে দাগ কাটে? সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান, নয়তো টেস্ট ক্রিকেটে তার সেই অবিশ্বাস্য গড়, অথবা ১২টা ডাবল সেঞ্চুরি। সেই রেকর্ড, পরিসংখ্যানের গল্পগুলো তো সবাই-ই কমবেশি জানি। ছায়াসঙ্গী ইন্টারনেট আর গুগলের বদৌলতে সেসব এখন হাতের একদম মুঠোয়।
১৯২১ সালে বাউরালের মাঠে খেলছিলেন কিশোর ব্র্যাডম্যান। বোলারের বাউন্সারে হুক করে লেগ সাইডের বেড়া পার করে ফেলেছিলেন বল। সেই শটটা নিয়ে জন নামের এক সাংবাদিক নিউ সাউথ ওয়েলসের সাপ্তাহিক একটা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। সেই সংবাদের পর থেকেই ব্র্যাডম্যানের ডাকনাম হয়ে যায় ‘দ্য বয় ফ্রম বাউরাল’ — যার বাংলাটাও খারাপ নয়, ‘বাউরালের ছোকড়া’।
এক অনুচ্ছেদ আগে যা বলছিলাম, ব্র্যাডম্যানের রান, সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য ইন্টারনেটের বদৌলতে আমাদের হাতবন্দী। কিন্তু বাউরালের সেই ‘ছোকরা’ থেকে যেভাবে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান, সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক একটা চরিত্রে পরিণত হলেন, তার বিপরীতে কত ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অ্যাডভেঞ্চার আছে, আক্ষরিক অর্থেই যেভাবে ক্রিকেটের ‘ডন’ হয়ে উঠলেন — সেই গল্পগুলোই এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করব আজ।
লাইফ অ্যাট এইটিন অ্যান্ড কাউন্টি
তারুণ্যের মাধুর্য আর শক্তির জন্য আদর্শ — এই দুটো জিনিস বোঝাতে বেশি ব্যবহৃত হয় ‘আঠারো বছর বয়স’। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও আঠারো বছর বয়সে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্রেক-থ্রুটা পেয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের ১১ই নভেম্বর। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ডাক পড়ল ব্র্যাডম্যানের। নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট সংস্থা উদীয়মান ক্রিকেটারদের খোঁজ করছিল। রীতিমতো চিঠি দিয়ে ব্র্যাডম্যানকে ডেকে পাঠান তারা। বাছাইপর্বের অনুশীলনে ভালো করায় তাকে মনে ধরে নির্বাচকদের। প্রস্তাব দেন রাজ্যের কোনো ক্লাবের হয়ে খেলতে চান কি না। উত্তর ‘হ্যাঁ’ হওয়ায় দল জুটে যায় ব্র্যাডম্যানের।
সেন্ট জর্জ ক্লাব। খেলতে হবে প্রতি শনিবার। কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচের জন্য দল বাছাই করতে চায় সেন্ট জর্জ। সেই বাছাই ম্যাচে ব্র্যাডম্যান করলেন ৩৭। নির্বাচকরা অত খুশি হলেন না। মেলবোর্নে পরের ম্যাচে করলেন ৬২, সাথে নিলেন চার উইকেট। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন।
সপ্তাহান্তের এই ক্লাব ক্রিকেট ‘কান্ট্রি উইক’ থেকেই শেফিল্ড শিল্ডের জন্য ক্রিকেটার খুঁজত নিউ সাউথ ওয়েলস। কান্ট্রি উইকের বাছাইকৃত ক্রিকেটাররা খেলতেন মফস্বলের কোনো একটা দলের বিপক্ষে। সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নির্বাচকদের নজর বেশ ভালো করেই ছিল ব্র্যাডম্যানের ওপর। তখন পর্যন্ত তার সর্বোচ্চ রান ৪৬।
সুযোগ এলো। কাজেও লাগালেন। প্রতিপক্ষ পিটারস্যাম ক্লাব। সেই ক্লাবের হয়ে খেলেন অস্ট্রেলিয়ার বেশ ক’জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারও। তাদের দর্শক বানিয়ে ব্র্যাডম্যান করলেন ১১০। পরের সপ্তাহের ম্যাচে থামলেন ৯৮ রানে, প্রথম স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। সেঞ্চুরি করতে না পারলেও শেফিল্ড শিল্ডে জায়গা নিতে আর দেরি হয়নি।
ভেন্যু সেই সিডনি। ১২৮৭ সালের প্রথম দিন। ব্র্যাডম্যানের সবচেয়ে প্রিয় মাঠ। নববর্ষে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে শেফিল্ড শিল্ডে অভিষেক, প্রতিপক্ষ ভিক্টোরিয়া। টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৭ রানে নেই সাউথ ওয়েলসের তিন উইকেট। ডাডলে সেডনকে নিয়ে পিচে দাঁড়িয়ে যান ব্র্যাডম্যান। দু’জনের জুটি ৫৮ রান। ব্র্যাডম্যানের রান ৪৩, যা দলীয় সর্বোচ্চ প্রথম ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাপ্তি আট রান। বাউন্ডারি মারতে গিয়ে ডান পা লেগে যায় স্টাম্পে। ‘হিট উইকেট’ হয়ে মাঠ ছাড়েন ব্র্যাডম্যান।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাউথ ওয়েলসের একাদশে ব্র্যাডম্যানের এন্ট্রির পর চারপাশে বেশ সমালোচনা শুরু হয়। তুমুল লেখালেখি হয় স্থানীয় পত্রিকাগুলোতেও। অবশ্য তাদের এই তীব্র সমালোচনাগুলো পরবর্তীতে স্তুতিবাক্যে পরিণতি দেন ব্র্যাডম্যান।সেই মৌসুমের প্রতি ম্যাচ ডে কিংবা অনুশীলনে বাউরাল থেকে সিডনি যেতেন ব্র্যাডম্যান। প্রতি শনিবার ভোর পাঁচটায় উঠে ছয়টার ট্রেন ধরতেন। সেন্ট জর্জের হয়ে সারাদিন খেলেটেলে বাড়ি ফেরার ট্রেনে চড়তেন সন্ধ্যায়। বাউরালে পৌছাতেন রাত নয়টায়। ঘুমোতে ঘুমোতে মধ্যরাত্রি পার।
সেই মৌসুমে এভাবেই চলছিল ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট। সেন্ট জর্জের হয়ে সেবার ম্যাচ খেললেন প্যাডিংটনের বিপক্ষে। প্রতিপক্ষে ছিলেন ব্র্যাডম্যানের শৈশব হিরো ম্যাক গ্রেগরি। তার সামনেই ১৩০ করেন ডন। সেই ইনিংস খেলেও সাউথ ওয়েলসের দলে জায়গা পাননি তিনি। ওদিকে সাউথ অস্ট্রেলিয়া আর ভিক্টোরিয়া সফরের জন্য দল ঘোষণা করে দিয়েছে সাউথ ওয়েলস। ভাগ্য খুলল দুই সতীর্থ বাদ পড়ায়। দলের সাথে চড়ে বসলেন অ্যাডিলেইডের ট্রেনে। ব্রোকেন হিল হয়ে সেই ট্রেন পৌঁছে এডিলেডে। সেই প্রথম নিজ রাজ্যের বাইরে পা রাখা ব্র্যাডম্যানের। সফরের প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি পেলেও, বাকিগুলোতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি তিনি।
বাউরাল টু সিডনি
ব্র্যাডম্যান স্থায়ীভাবে থাকতেন বাউরালে। তবে প্রতি সপ্তাহে আসা-যাওয়ার ধকলটা পড়ছিল শরীরে। এছাড়া ক্রিকেটে উন্নতির সুযোগটাও তিনি নিতে চাচ্ছিলেন। লক্ষ্য ছিল অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দল। তাই বাউরালের মায়া ছেড়ে পাকাপাকিভাবে স্থায়ী হলেন সিডনিতে। পুরোদমে চললো ক্রিকেট খেলা। ইংল্যান্ডও সেবার অস্ট্রেলিয়া সফরে।
ওদিকে অজিদেরও দরকার নতুন মুখ। ব্র্যাডম্যান সেই অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন। অজিদের জাতীয় দল খেলছিল, বাছাই একাদশের বিপক্ষে। ভিক রিচার্ডসের নেতৃত্বে ব্র্যাডম্যান খেলেন বাছাই একাদশে। দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১৪ ও ৫ রান করেন তিনি। পরের সপ্তাহেই অবশ্য রানের ফোয়ারা ছোটান। শেফিল্ড শিল্ডে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে দুই অপরাজিত সেঞ্চুরি — ১৮১ ও ১৩৩। এমসিসি একাদশের বিপক্ষে ৫৮ রান করেছিলেন ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে। উইকেট আঁকড়ে পড়ে ছিলেন তিন ঘন্টা বিশ মিনিট।
নতুন মুখদের প্রাধান্য দিয়েই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দল ঘোষণা করে অস্ট্রেলিয়া। নাম এলো ব্র্যাডম্যানের। অভিষেক হলো ব্রিসবেনে। ইংলিশদের কাছে পাত্তাই পায়নি অস্ট্রেলিয়া। ৬৭৫ রানে হারেন ব্র্যাডম্যানরা, তার সংগ্রহ মোটে ১৮। পরাজয়ের ব্যবধান নিজের ব্যর্থতা খুব বেশি ভাবায়নি তাকে।
দ্বিতীয় টেস্টে জায়গা হারালেও পরেরটাতে ফিরে আসেন একাদশে। অজিদের আঠালো উইকেটে দুই ইনিংসে ৭৯ ও ১১৮ রান ব্র্যাডম্যানের। ধারাবাহিকতা রইল চতুর্থ টেস্টেও — ১২৭ ও ৩৭*। সেভাবেই দলে জায়গা পাকা হয় তরুণ ব্র্যাডম্যানের।
বিলেতে প্রথমবার
হাজার হাজার অস্ট্রেলিয়ান যুবকের কাছে যা স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে এলো ব্র্যাডম্যানের দুয়ারে। দেশের হয়ে প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর। গন্তব্য ইংল্যান্ড। পেছনে অনেক সংবর্ধনা, আয়োজন রেখে জাহাজে চড়লো অস্ট্রেলিয়া। জাহাজের নাম ‘নাইরানা’। সি-সিকনেস জেঁকে ধরল ব্র্যাডম্যানসহ বাকি যারা প্রথমবারের মতো জাহাজে চড়েছেন। প্রথম বিরতি ছিল তাসমানিয়া দ্বীপে। সেখানে জুটল রাজসিক অভ্যর্থনা। কয়েকটা প্রদর্শনী ম্যাচও খেলল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আবারও জাহাজে সওয়ার তারা। সি-সিকনেসটাও ততদিনে গা সওয়া। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুয়েজ, কায়রো, পোর্ট সৈয়দ, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ঘুরে শেষ অবধি বিলেত। চারপাশের মুগ্ধতা, নতুন জায়গা দেখার রোমাঞ্চ, দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার সংকল্প নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মতো পা রাখেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। চোখ ভরে দেখলেন ইংল্যান্ড। লর্ডস!
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার বিস্তর ফারাক। এতদিন খেলেছেন রোদ ঝলমলে দিনের শক্ত পিচে। বিলেতে এসে নামতে হলো ঠান্ডা আবহাওয়ার স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে। বেশ অস্বস্তিতেই ভুগতে হয়েছে তাদের। আলাদা করে বলতে হবে সেই সফরের লর্ডস টেস্টের কথা। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড করে ৪২৫ রান। জবাবে অজিরা করল ৭২৯, ছয় উইকেটে। ব্র্যাডম্যান হাঁকালেন ডাবল সেঞ্চুরি, লর্ডসের মাঠে — ২৫৪। সাত উইকেটে সেই টেস্ট জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই সিরিজের শেষ টেস্টেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন স্যার জ্যাক হবস। এবং সেই টেস্টের ফলাফল হয়েছে টাই — প্রথম ও শেষবার।
ইংল্যান্ডের সব কিংবদন্তির কথা ততদিন কেবল পত্রিকাতেই পড়েছেন। স্বচক্ষে দেখা, তাদের বিপক্ষে খেলার সৌভাগ্যটাও এসেছিল সেই ইংল্যান্ড সফরে। উইলফ্রেড রোডসের বিপক্ষে খেলেছিলেন স্কারবরাতে। সেবারের বিলেত সফরে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে ব্র্যাডম্যান ছিলেন আপন আলোয় উজ্জ্বল। ৯৭৪ রান কেবল টেস্টেই। আর অন্য ম্যাচগুলোতে সব মিলিয়ে করেন ২,৯৬০ রান।
মাল্টিটাস্কার ডন, ডগলাস জার্ডিন ও বডিলাইন
সদ্যই আমেরিকা ও কানাডা সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ব্র্যাডম্যান। ওদিকে ১৯৩২ মৌসুমের অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য তৈরি হচ্ছে ইংল্যান্ড। আমেরিকা সফরে গিয়ে পায়ে লেগেছে চোট। সেটা থেকে সেরে উঠতে যে বিশ্রাম দরকার, তার সিকিভাগও মেলেনি। কাজ নিলেন রেডিও ঘোষকের। সাথে পত্রিকায় সাংবাদিকতা। দুটোই চললো সমানে। বাদ সাধলেন ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা। সাফ জানিয়ে দিলেন, কাজ আর খেলা — একসাথে চলবে না। ডনও নিজের জায়গায় অনড়, ‘পারলে টেস্ট দল থেকে বাদ দিয়ে দিন।’
আসন্ন সিরিজ তো বটেই, এমনকি বছরখানেক পরের ইংল্যান্ড সফর থেকেও বাদ পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলা, টানাপড়েনও বেড়ে চলল। শেষ অবধি পত্রিকার মালিকদের সাথে বসে বিষয়টার মীমাংসা করে ক্রিকেট বোর্ড। সেই যাত্রায় রক্ষা।
কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্টটা ডন খেলেননি। দীর্ঘদিনের বিশ্রামহীন শরীর আর আমেরিকা থেকে পায়ে নিয়ে আসা চোটের কারণে। প্রথম টেস্ট কাটল দর্শক হয়ে। নিজের দলের খেলা দেখলেন, আর দেখলেন প্রতিপক্ষের হ্যারল্ড লারউডের গতির ক্যারিশমা। সাথে বডিলাইন বোলিং তো আছেই।
দ্বিতীয় টেস্টে ডাক পড়ল ডনের। প্রথম ইনিংসে রান পাননি, দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৩। জার্ডিন তার বডিলাইন দিয়ে সেই ম্যাচে সুবিধা করতে পারেননি, কারণ পিচ অনুকূলে ছিল না একেবারেই।
ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অপ্রিয় বোধহয় এই বডিলাইন সিরিজই। ডগলাস জার্ডিন তার পেসারদের যেভাবে লেলিয়ে দিয়েছিলেন অজিদের মাথা-কাঁধ-কোমর আর বুক বরাবর, এতে করে কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বডিলাইন বোলিংয়ের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ব্র্যাডম্যানই। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর লেখা হয়েছে। জার্ডিন-লারউড নিজেদের লেখা বইয়েই সাফাই গেয়েছেন এর পক্ষে। সেসব আজ একেবারেই যুক্তিহীন। ক্রিকেটের পরিবর্তিত নিয়মে বডিলাইন নিষিদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে।
বডিলাইন বল কি সামলানো যেত ভালোমতো? এ ব্যাপারে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বয়ং ব্র্যাডম্যান। লারউড কিংবা বিলি বাওয়েসের হাত থেকে পাঁজর লক্ষ্য করে ছুটে আসা বলগুলো ব্র্যাডম্যান খেলতেন অফ স্টাম্পের বাইরে সরে গিয়ে। ব্লক করতে গেলেও আউট হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। লেগ সাইড ভিত্তি করে সাজানো ফিল্ডিং কর্ডনে ধরা পড়তেই হতো। পুল কিংবা হুক করেও রেহাই মিলত না। বডিলাইন বোলিংয়ের প্রভাবে ডনের সমসাময়িক অনেক ক্রিকেটাররাই বিরক্ত হয়েছেন। হয়েছে মনোমালিন্য, তিক্ত অভিজ্ঞতা। যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে বড়সড় রকমের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছিলেন সবাই-ই।
বডিলাইন সিরিজেও খুব একটা খারাপ করেননি ব্র্যাডম্যান। ৫৬ গড়ে আট ইনিংসে করেছিলেন ৩৯৬ রান।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম ক্রিকেটের বাইরে ব্র্যাডম্যানের অন্য দুই পেশার কথা। এবার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, আম্পায়ার ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে। বডিলাইন সিরিজের পর ক্রিকেটের নিয়মকানুন নিয়ে আরো জানার ইচ্ছে জাগল তার। ক্রিকেটের সাথে রেডিওর কাজের ধকল। ফলাফল — শারীরিক, মানসিক সকল চাপ নিয়েই দিন কাটছিল তার। তবুও রাজ্য লেভেলে আম্পায়ারিংয়ের পরীক্ষা দিয়ে কোর্স করে ফেললেন।
বিলেতে ‘সলিল সমাধি’!
১৯৩৪ সালে আবারও ইংল্যান্ডের জাহাজে অস্ট্রেলিয়া। সেই সফরের ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। শেষদিকে এক ভয়ানক গুজব চাউর হয়ে চারপাশে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ায় ডনের স্ত্রীর কাছেও পৌঁছে যায় সেই খবর — ডন ব্র্যাডম্যান নাকি মারা গেছেন!
সফরের শেষ টেস্টটা খেলে অস্ট্রেলিয়া দল তখন লন্ডনে। এরই মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন ব্র্যাডম্যান। হোটেল বাউরালের এক বাল্যবন্ধুর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন ডন। টানা কদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার রবার্ট লি জানান, অ্যাপেণ্ডিসাইটিসের ব্যথায় ভুগছেন ডন। মুক্তি পেতে চাইলে যেতে হবে অপারেশনের টেবিলে। অপারেশন করেন শল্য চিকিৎসক ডগলাস শিল্ডস।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাটে বেশ কিছু সময়। ওদিকে ডনের স্ত্রী তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা দেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বিমান ও জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ড পৌঁছার পর, স্বামীকে জীবিত দেখেই তার শান্তি মেলে।
ইনজুরিতে বসবাস
এর বছরচারেক পর ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে বড়সড় একটা ইনজুরিতে পড়েন ব্র্যাডম্যান। বলের আঘাতে বাম পায়ের মাংসপেশিতে খুবই মারাত্মক একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। সেই সফরে বল করেছেন পায়ে শক্ত করে কাপড় পেঁচিয়ে। এক্সরে’র ফলাফল আরো ভয়াবহ। পায়ের হাড়ও অক্ষত নেই।
সেই চোট নিয়ে দেশে ফিরে কিছুদিন ক্রিকেট খেলেছেন। ওদিকে থেকে থেকে বেজে উঠছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। দেশের জন্য কিছু করার তাগিদে নাম লেখান অস্ট্রেলিয়ান বিমানবাহিনীতে। বিমানবাহিনীতে যে পরিমাণ কাজ ছিল, সে তুলনায় লোকবল অনেক বেশি হওয়ায় ক্যাম্পে বেশিরভাগ সময় অবসরই কাটাতেন ব্র্যাডম্যান। সেই ফাঁকে চোখের সমস্যাও দেখা দিল নতুন করে। পুরনো সব রোগই ফিরে এসেছিল তখন। বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছিলেন। ডাক্তার রায় দিলেন পূর্ণ বিশ্রামের পক্ষে। ক্রিকেট খেলা একেবারেই বন্ধ। অসুখ এমন মারাত্মক পর্যায়ে গিয়েছিল যে তর্জনী-বুড়ো আঙুলে কোনো অনুভূতিই ছিল না তার। গোটা ক্যারিয়ারে শরীরে ওপর ক্রিকেট আর ভ্রমণের যে ধকল পড়েছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল সেই দিনগুলো। আর কোনোদিন ক্রিকেটই খেলতে পারবেন না, এমন শংকাও জেগেছিল চারপাশে।
ব্র্যাডম্যানের প্রেতাত্মা!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রিকেট ফিরল তার স্বাভাবিক চেহারায়। দীর্ঘদিন বিশ্রামে ছিলে ব্র্যাডম্যান। তবুও মাঠে নামতে ডাক্তারের ছিল প্রবল আপত্তি। সেই আপত্তির মুখেই ১৯৪৬ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নামেন ব্র্যাডম্যান। অ্যাডিলেডে সিরিজের প্রথম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে পিটিয়ে ইংল্যান্ড করলো ৫০৬ রান। জবাবে ব্র্যাডম্যান করলেন প্রথম ইনিংসে ৭৬, পরের ইনিংসে তিন রান।
রান কিছু করেছেন ঠিকই, কিন্তু আপন ছন্দে ছিলেন না মোটেই। দীর্ঘ এই বিরতির পর এমন হতশ্রী ব্যাটিংয়ে ব্র্যাডম্যান নিজেই হতাশ। নিজেই নিজেকে ভাবলেন, ‘ব্র্যাডম্যানের ছায়া’। স্থানীয় এক পত্রিকা লিখল,
‘আজ বিখ্যাত এক ক্রিকেটারের প্রেতাত্মা দেখার সুযোগ হয়েছে, আর প্রেত কখনোই তার জীবন ফিরে পায় না।’
এক কথায় ব্র্যাডম্যানকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল মিডিয়া। পরের খেলা ছিল মেলবোর্নে। সেই টেস্টে করলেন সেঞ্চুরি। কিন্তু বিধি বাম! পায়ের সেই চোট আবার ফিরে এসেছে। ব্র্যাডম্যান তখন অধিনায়ক। হারাতে চলেছেন দীর্ঘদিনের সতীর্থ কিংবদন্তি লেগ স্পিনার বিল ও’রাইলিকে। দ্বিতীয় টেস্টের পর ও’রাইলি জানিয়ে দেন, খেলা ছেড়ে সাংবাদিকতা শুরু করবেন তিনি। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই তৃতীয় টেস্টে নামেন ব্র্যাডম্যান, তাও পায়ের চোট না সারিয়েই।
সেই ম্যাচেই খেললেন ‘ক্যাপ্টেন্স নক’ — ১৮৭ রান। সিরিজের আরেকটা ম্যাচে করেছিলেন ২৩৪*। সেই ম্যাচে ব্যাটিং করেছিলেন পায়ে কাপড় জড়িয়ে। ফ্রন্টফুটে একদমই খেলতে পারেননি বাম পায়ের পেশি জখম হওয়াতে। পুরোটা ইনিংসই খেলেছেন ব্যাকফুটে। প্রেত তো জীবন ফিরে পেয়েছিল এভাবেই!
লাস্ট রাইড অ্যাট ওভাল
টেস্ট ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের পথচলা শুরু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজ দেশে। শেষটাও সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। ভেন্যু ছিল ওভাল। লিডসে আগের টেস্টেই অবিস্মরনীয় জয় পেয়েছে অজিরা। তবে অ্যাশেজ জেতার আনন্দে মাতোয়রা হওয়ার সুযোগ পায়নি তারা। ম্যাচের মাত্র ৪৫ মিনিট পরই ডার্বির ট্রেন ধরতে হয়েছিল গোটা দলকে। ডার্বিশায়ার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে দুটো ম্যাচ খেলে সিরিজের চার নম্বর টেস্টটা খেলতে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমায় লন্ডনে। ডার্বির হয়ে খেলার সময়ই আলাদা করে ডনের নজর কাড়েন লেগ স্পিনার এরিক হোলিস। নামটা মনে রাখুন, ওভাল টেস্টে জিম লেকারের জায়গায় ডাক পেয়েছিলেন তিনি।
ওভাল টেস্টের আগেরদিন লন্ডনের আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। ভেজা-স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে খেলার একটা জোর সম্ভাবনা রইল। সবার চিন্তা অজিদের নিয়ে, কীভাবে সামলাবে তারা। অথচ ঘটনা হলো উল্টো — ‘হেড’ ডেকে টস হারলেন ব্র্যাডম্যান। নরম্যান ইয়ার্ডলি ইংল্যান্ডকে পাঠালেন ব্যাটিংয়ে। করতে পারল মাত্র ৫২। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের সর্বনিম্ন টেস্ট স্কোর। লেন হাটনের ৩০-ই সর্বোচ্চ, বাকিরা সবাই মিলে করেছেন সাকুল্যে ৯!
দেশকে শেষবারের মতো নেতৃত্ব দিতে নেমে এমন মুহূর্ত তো ব্র্যাডম্যানের কাছে রঙিন-ই হবার কথা। অধিনায়কের শেষ ম্যাচে শুরুটাও রাঙান দুই ওপেনার সিডনি বার্নস ও আর্থার মরিস। দু’জনের ১১৭ রানের জুটি ভাঙে বার্নস আউট হলে।
এরপর হয় অপেক্ষার অবসান। টেস্ট ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যানকে দেখার অপেক্ষা। তুমুল হাততালির মধ্যে দিয়ে তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে যাচ্ছেন ওভালের প্রান্তর পেরিয়ে। এই তিন নম্বর পজিশনেই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তিনি। সেন্টার উইকেটে পৌঁছানোর আগেই নরম্যান ইয়ার্ডলি আর তার সতীর্থরা মিলে টুপিখোলা অভিবাদনের সাথে ডনের উদ্দেশ্যে ‘থ্রি চিয়ার্স’ করেন। এমন সম্মাননা আর ক’জনের জোটে!
বোলিংয়ে ছিলেন এরিক হোলিস, ডার্বিতে যাকে আলাদা করে দেখেছিলেন ডন। তিনি তখনও ওই সম্মাননার আবেগের ঘোরে আছেন। ২২ বছরের ক্যারিয়ার পেছনে। হোলিসের প্রথম বলটা খেললেন, ব্যাটেই লাগল। দ্বিতীয় বলটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি। দারুণ গুগলিটা ব্যাটের কানা ছুঁয়ে উড়িয়ে দেয় স্টাম্প। জীবনের শেষ টেস্টে শূন্য হাতে ফেরা। পরের ইনিংসে ইংল্যান্ড একটু ফাইট করলে ব্র্যাডম্যানকে হয়তো আরো একবার ব্যাট হাতে দেখতে পেতেন দর্শকরা।
শেষ টেস্টের ওই শূন্য নিয়ে ব্র্যাডম্যান তার বই ‘Farewell Cricket’ ‘এ লিখেছেন,
‘হোলিসের প্রথম যে বলটা খেলেছিলাম সেটা আদৌ দেখতে পেয়েছিলাম কি না, মনে নেই। দ্বিতীয় বল এলো, নিখুঁত লেন্থের গুগলি। বোকা বনলাম এবার। ব্যাটের ভেতরের দিকটা ছুঁয়েছিল বল। এরপরই অফের বেল ফেলে দেয়। প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছি, মাথা নিচের দিকে। শেষ টেস্টে শূন্য হাতে ফেরা।’
শেষটা অমন না হলে ক্রিকেটের অনেক হিসাব-নিকাশ হয়তো বদলে যেত। অল্পের জন্য গড়টা ১০০ হয়নি ব্র্যাডম্যানের, আটকে আছেন ৯৯.৯৪তে। তাকে আটকে দিয়েছেন এরিক হোলিস। বাউরালের সেই ছোকরা অবসর নিয়েছেন ক্রিকেটের উচ্চতম শৃঙ্গে উঠে, বাড়ির পেছনে আটশ গ্যালনের সেই পানির ট্যাংকের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলে যার শুরু। সেই ট্যাংকের একটা পাশ খোলা ছিল বলে শট খেলতেন শুধু সেই পাশেই। সেটা ছিল ডানহাতি ডনের অনসাইড, যে কারণে পুল-হুকে এত এলেম ছিল তার।
শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে ব্যর্থ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন মানুষটা। রাজ্যের বিষাদ, অর্জন, সকল পাওয়া, রেকর্ডের বোঝা আর শেষ অধ্যায়ে অল্প একটুখানি না পাওয়ার দুঃখটুকু নিয়ে। একটা ঘোরের মধ্যে মোহাবিষ্ট হয়ে ড্রেসিংরুমের বাকি পথটুকু পাড়ি দিলেন। সব শোরগোল, আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছিল ড্রেসিংরুমের দরজার দিকে। ব্র্যাডম্যানও চিরদিনের জন্য মিলিয়ে গেলেন টেস্ট থেকে।
‘স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান’ নামের প্রয়াত মানুষটি গত শতকের কোনো এক ২৭ আগস্ট পৃথিবী নামের গ্রহে এসেছিলেন বলেই এত স্তুতিগাঁথা, প্রশংসা আর বিশেষণের ঠাসবুনোট।