স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনা। গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার মৌসুম শুরু হবার সাথে সাথেই নতুন মৌসুমের জন্য দল গোছাতে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। নতুন সিজনে তারা নিয়ে এসেছে আর্থার ও ক্লেমেন্ত লেনগেতকে। পরিকল্পনা আছে আরো খেলোয়াড় কিনবে তারা। উদ্দেশ্য মিডফিল্ড ও আক্রমণ আরও শক্তপোক্ত করা। অন্যপাশে, ইতালির ক্লাব রোমা। এ মৌসুমে অ্যালিসন ও নাইঙ্গোলানকে বিক্রি করে বেশ অর্থ হাতে এসেছে তাদের।
তারাও খেলোয়াড় কিনছে চুপিসারে। জাস্টিন ক্লুইভার্টকে এনেছে খুবই সস্তায়, আরও এনেছে হাভিয়ে পাস্তোরে এবং বেশকিছু তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়। তৃতীয় দল, ফ্রান্সের বেশ নিচের দিকের ক্লাব বোর্দে। তারা তাদের দলের সেরা খেলোয়াড়কে বেশ মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত।
গত ২৪ ঘণ্টায় এই তিন ক্লাব আর ম্যালকম রচনা করেছে ফুটবলের অদ্ভুত এক দল বদলের গল্প। যা ফুটবলে গত ১ যুগেও কেউ দেখেনি।
ফ্রান্স এবং ব্রাজিলের ফুটবল সমর্থকেরা ম্যালকমকে বেশ ভালোভাবেই চেনেন। ফরাসি ক্লাব বোর্দেতে খেলা এই উইঙ্গার গত দুই মৌসুম ধরে ধারাবাহিক পারফরমেন্সে নজর কেড়ে নিয়েছেন। বোর্দেতে ম্যালকমই তারকা খেলোয়াড়। তাই তাকে বিক্রি করতে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থের দাবি ছিল তাদের। তাই গতবার টটেনহ্যাম হটস্পার এবং আর্সেনালের কাছেও বিক্রি করেনি ম্যালকমকে। এ মৌসুম শুরু থেকে তাকে নিয়ে মিডিয়াতে আবার নতুন করে গুজব ওঠে।
এটা নিশ্চিত ছিল যে, বোর্দে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ম্যালকমকে এবারই তারা বিক্রি করবে। এ সপ্তাহে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ম্যালকম প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব এভারটনে যাচ্ছে। কিন্ত কিছুদিন আগে দৃশ্যপট হুট করে বদলে যায়। তাকে দলে নিতে ইচ্ছা পোষণ করে ইতালির ক্লাব রোমা। তাকে দলে নিতে এভারটনের চেয়ে বেশি অর্থ ঢালবে রোমা। ম্যালকম বেতনটাও পাবেন বেশি। তাই রোমা ও বোর্দের মধ্যকার চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। দু’পক্ষ ফেসবুক ও টুইটারে জানিয়ে দিয়েছিল বোর্দে থেকে ম্যালকম পাড়ি জমাচ্ছে ইতালিতে। গত ২৩ জুলাই ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে ম্যালকম এমনটাও জানিয়েছিল স্কাই স্পোর্টস।
ওদিকে বার্সেলোনা আর্থার মেলো ও ক্লেমেন্ট লেনগেতকে কিনে বেশ খুশি। তাদের নিয়ে খুশি ছিল বার্সা সমর্থকেরাও। কিন্ত গত কয়েক সপ্তাহজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে বার্সেলোনা নাকি চেলসির উইঙ্গার উইলিয়ানকে দলে আনতে চায়। তার জন্য পঞ্চমবারের মতো প্রস্তাব দিয়ে ৭৫ মিলিয়ন ইউরোতে দু’পক্ষের মধ্যে নাকি সমাঝোতা হয়েছে।
কিন্ত আসলে তা হয়নি। বার্সেলোনার পরপর তিনটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় চেলসি। এছাড়াও বার্সেলোনার দলে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছিল পিএসজির রাবিও ও আয়াক্সে ডি ইয়ংকে। কিন্ত ‘ম্যালকমকে বার্সেলোনা কিনতে চায়’ এমন সংবাদ কোনো সাংবাদিক দেননি কিংবা কোনো পত্রিকা ফলাও করে ছাপেনি।
রোমার সাথে বোর্দের যখন আলোচনা শেষে চুক্তি চূড়ান্ত, শুধুমাত্র ম্যালকমের ইতালি যাত্রা বাকি তখন শেষ মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে আর্বিভাব ঘটল বার্সেলোনার। গত উয়েফা চ্যাম্পিনস লিগ থেকে এই রোমার কাছেই হেরে বিদায় নিয়েছিল বার্সেলোনা। পুরনো ক্ষোভটা হয়ত পুষে রেখেছিল তারা। ম্যালকম রোমাতে গেলে রোমা আরও শক্তিশালী দলে পরিণত হবে এমনটা হয়ত কোনভাবেই মেনে নিতে পারেরি বার্সেলোনা। সেজন্যই হয়ত, চুক্তির প্রায় শেষে গিয়ে এমন কর্ম করে বসল।
রোমার সাথে বোর্দের চুক্তি যখন সমাপ্ত তখনই বার্সেলোনা থেকে জানানো হয় ম্যালকমকে কিনতে চায় তারা। রোমা থেকেও বেশি ট্রান্সফার ফি ও বেতন দিতে প্রস্তুত বার্সেলোনা বোর্ড। রোমা তখন নিজেদের টুইটারে ঘোষণা দিয়েছে ম্যালকমের সাথে চুক্তির কথা। পরবর্তীতে আসল বোমাটা ফাটান বার্সেলোনার সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমেরো। তিনি বলেন, “ম্যালকমের সাথে রোমা চুক্তি করলেও বার্সেলোনা তাকে হাইজ্যাক করতে যাচ্ছে। রোমা থেকে বেশি অঙ্কের অফার দেওয়া হয়েছে। এবং ফরাসী ক্লাব বোর্দে ম্যালকমকে প্লেনে উঠতে মানা করেছে।” রোমেরোর টুইটের পর প্রমাণ হয়ে যায় আসলেই বার্সেলোনা ম্যালকমের জন্য ৪১ মিলিয়ন ইউরোর নতুন অফার দিয়েছে বোর্দের কাছে।
রোমার স্পোর্টিং ডিরেক্টর মনচি এক ইন্টারভিউতে ম্যালকমের ট্রান্সফারের বিষয়টি বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন,
ম্যালকমের সাথে চুক্তি শেষ হবার আধ ঘন্টা পর বোর্দের সভাপতি স্টেফানে মার্টিন ফোনে বলেন যে, “ম্যালকমকে নিয়ে অনেক গুজব শোনা যাচ্ছে, আমাদের চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে করে ফেলা উচিত।” আমি বলি, এটা এখনই ঠিক হবে না। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে।” কিন্তু তারা জোর করে বিষয়টিকে টুইটারের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। যখন ম্যালকমের একান্ত কাছের মানুষ আমাকে জানায় বোর্দে চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে এবং রোমা আসার বিষয়টি বন্ধ রাখছে তখন আমি বেশ অবাক হই। আমি তখনই মার্টিনকে ফোন করে সবকিছু জানতে চাই। মার্টিন বলে, “তারা বার্সেলোনার কাছ থেকে আরো ভালো প্রস্তাব পেয়েছে, আমরা যদি দাম না বাড়াই তবে ম্যালকমকে আমরা পাব না।” রোমার সভাপতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আবারও মার্টিনকে জানাই। কিন্ত তারা বলে ম্যালকমের এজেন্ট বার্সেলোনা রওনা হয়ে গেছে চুক্তি পাকা করতে। তারা সবকিছু তখনই কাগজপত্রের মাধ্যমে করতে চাচ্ছিল। যা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।”
স্কাই স্পোর্টসের ভাষ্যমতে, ম্যালকমকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি ছিল রোমা সমর্থকেরা। এমনকি রোমায় পৌঁছে সোমবার রাতে তার শারীরিক পরীক্ষা হওয়ার কথাও চূড়ান্ত ছিল। এ ঘটনা দেখে রোমা বোর্ড ক্ষুব্ধ হয়ে দল বদল খুব তাড়াতাড়ি চূড়ান্ত করে ফেলতে চাইছিল। কিন্তু বার্সেলোনা যে রোমা হতে একদম ছিনিয়ে নিয়ে আসলো ম্যালকমকে।
আসলেই ছিনিয়ে আনল? নাকি গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের হারের প্রতিশোধ নিল? তবে হতে পারে বার্সেলোনা হয়ত ম্যালকমকে কেনার চিন্তাভাবনা করে আসছিল কিন্ত রোমার সাথে হুট করে এভাবে চুক্তি পাকা হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। তাই পিঠ ঠেকে যাবার পর শেষ চেষ্টাই ছিল এটা।
বাংলাদেশ সময় দুপুর আড়াইটার দিকে ম্যালকমের এজেন্ট ফার্নান্দো গার্সিয়া পৌঁছে যান বার্সেলোনায়। রোমাকে অপেক্ষারত অবস্থায় রেখেই বার্সেলোনা ঘোষণা করে ম্যালকম এখন বার্সেলোনার খেলোয়াড়। অনেক নাটকীয়তা ফুটবল বিশ্ব দেখল! তবে বোর্দে প্রথমে রোমার সাথে চুক্তি করে পরে তা বাতিল করে কি প্রতারণা করলো রোমার সাথে?
ঘটনা আসলে ঠিক সেরকম নয়। বোর্দের মতো মধ্যমানের ক্লাব সবসময় চাইবে তাদের দলের সেরা খেলোয়াড়ের জন্য একটু বেশিই অর্থ পেতে। সেখানে বার্সেলোনা রোমার থেকে ৯ মিলিয়ন ইউরো বেশি দিতে চেয়েছে বোর্দেকে। আর পাশাপাশি ম্যালকমের বেতনও প্রায় দ্বিগুণ করে দিতে চেয়েছে তারা। আর কোন খেলোয়াড়ই বা বার্সেলোনার মতো ক্লাবের কাছ থেকে বড় অঙ্কের এমন লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারে?
তবে বর্তমান বার্সেলোনা দলে আসার সিদ্ধান্ত ম্যালকম কি ভেবেচিন্তে নিয়েছেন? তার বোর্দের হয়ে গত মৌসুমের পারফর্মেন্স খুবই ভালো। ৩৫ ম্যাচ খেলে করেছেন ১২ গোল ও ৭ অ্যাসিস্ট। শারিরীকভাবে সেভাবে ফিট না হলেও অসমান্য গতি তার ড্রিবলটাও দারুণ করতে পারেন। রাইট-উইংয়ে নিয়মিত খেললেও লেফট-উইং ও স্ট্রাইকার পজিশনেও ম্যালকম খেলে থাকেন। তার খেলার স্টাইল ও ভার্সেটাইল প্রতিভা বার্সেলোনার সাথে মিলে গেলেও বার্সেলোনাতে তো এখন তারাদের মেলা। দলে তার জায়গা কোথায়? গতবছর উসমান দেমবেলকে কিনেছিল বার্সেলোনা। তারও খেলার ধরণ প্রায় ম্যালকমের মতো। কিন্ত এক বছর পার হয়ে গেলেও দেমবেলে এখন স্কোয়াডে জায়গা করে নিতে পারেননি। হুট করে এসে ম্যালকম কীভাবে স্থান পাবেন?
ম্যালকমের বয়স এখন মাত্র ২১। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আসলেই তার নিয়মিত মাঠে থাকা দরকার। যেটা রোমাতে গেলে তিনি অবশ্যই পেতেন। তবে বার্সেলোনা তাকে নিয়ে কী ভাবছে সেটা কেউই বলতে পারবে না। তবে বার্সেলোনায় এসে ম্যালকম বেশ বড় একটু ঝুঁকি নিয়ে ফেললেন। তবে সিদ্ধান্ত তার। সুযোগ পেলে তার সদ্ববহার তাকেই করতে হবে। আর এ ট্রান্সফারে অন্তত বার্সেলোনা সমর্থকেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবে। আর যাই হোক, ব্রাজিলের অন্যতম প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে তুলনামূলক কম দামেই কিনেছে বার্সা। আকাশছোঁয়া দামে বুড়িয়ে যাওয়া উইলিয়ানকে তো আর কিনতে হয়নি!
তথ্যসূত্র:
1. http://www.asroma.com/en/news/2018/7/monchi-explains-how-malcom-saga-unfolded
ফিচার ছবি- Trome