২০১৬ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে অ্যান্ডি মারেকে হারিয়ে নোভাক জোকোভিচ যখন নিজের ক্যারিয়ার গ্র্যান্ডস্ল্যাম পূরণ করলেন, তখন মনে হচ্ছিলো রজার ফেদেররারের সর্বোচ্চ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ডটা হয়তো একসময় ভেঙে ফেলবেন জোকোভিচ। কিন্তু এরপরই আচমকা ছন্দপতন! ২০১৬ সালের উইম্বলডন ও ইউএস ওপেন জিততে ব্যর্থ হওয়ায় সেই বছর মাত্র একটা গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতেই শেষ করেন জোকোভিচ। ভক্তরা ভেবেছিলেন ২০১৭ সালে হয়তো নিজের সেই চিরচেনা রূপেই ফিরবেন জোকোভিচ। কিন্তু কনুইয়ের ইনজুরির কারণে ২০১৭ সালটা জোকোভিচের জন্য দুঃস্বপ্ন হিসেবেই আসে। জোকোভিচের এই খারাপ সময়ে নিজেদের রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেন রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদাল। এই দুই মহারথীর রাজত্ব পুনরুদ্ধারে অনেক টেনিস ভক্ত খুশি হলেও জোকোভিচের এই আকস্মিক পতন কিছুতেই তার ভক্তরা মেনে নিতে পারছিলেন না।
ওমন একটা হতাশাময় বছর কাটানোর পর জোকোভিচ ভক্তরা আশা করেছিলেন যে নতুন বছরে জোকোভিচ বুঝি তার স্বরূপে ফিরে আসবেন। কিন্তু হায়! নতুন বছরের শুরুটাও হলো হতাশার মাধ্যমে। ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে দক্ষিণ কোরিয়ারে চুং হিউনের কাছে সরাসরি সেটে হেরে চতুর্থ রাউন্ডেই বিদায় নেন জোকোভিচ। এরপর ফ্রেঞ্চ ওপেনে বিদায় নেন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। এই দুই গ্রান্ডস্ল্যাম তো বটেই, ছোট ছোট টুর্নামেন্টেও ঠিক সুবিধা করতে পারছিলেন না জোকোভিচ। সব দেখে মনে হচ্ছিলো ইনজুরির অভিশাপে জোকোভিচ বুঝি তার সেরা সময়টা অতীতেই ফেলে এসেছেন।
এ কারণে এবারের উইম্বলডনের শুরু থেকে জোকোভিচকে নিয়ে তার ভক্তরাও তেমন উঁচু গলায় কিছু বলতে পারছিলেন না। ১২ নম্বর বাছাই হিসেবে এবারের উইম্বলডন খেলতে আসা জোকোভিচ কতদূর যেতে পারবেন, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু লড়াকু স্বভাবের জোকোভিচ এভাবে হাল ছেড়ে দেবেন, তা কীভাবে সম্ভব! উইম্বল্ডনের মঞ্চটাকেই নিজের স্বরূপে ফেরার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন জোকোভিচ। সেই লক্ষ্যে প্রথম দুই রাউন্ডে সরাসরি সেটে জিতে জোকোভিচের সূচনাটা বেশ ভালোই হয়। কিন্তু তৃতীয় রাউন্ডে এসেই জোকোভিচকে কিছুটা হোঁচট খেতে হয়। ২১ তম বাছাই কাইল এডমুন্ডের কাছে প্রথম সেটে হেরে বসেন জোকোভিচ। কিন্তু পরের তিন সেটে জিতে বেশ সহজেই পরের রাউন্ডে চলে যান জোকোভিচ।
চতুর্থ রাউন্ডে কারেন কাচানভকে সরাসরি সেটে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখেন জোকোভিচ। কোয়ার্টার ফাইনালে জোকোভিচের প্রতিপক্ষ ছিলেন জাপানিজ তারকা কেই নিশিকোরি। নিশিকোরিকে ৩-১ সেটে হারিয়ে দীর্ঘদিন পর কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যামের সেমিফাইনালে ওঠেন নোভাক জোকোভিচ। তবে সেমিফাইনালে রাফায়েল নাদালের মতো প্রতিপক্ষ অপেক্ষা করায় জোকোভিচের ভক্তরা ঠিক আশাবাদী হতে পারছিলেন না। যদিও গ্রাস কোর্টে নাদালের তুলনায় জোকোভিচের রেকর্ড ভালো, কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের কারণে অনেক টেনিস বোদ্ধাই এ ম্যাচে নাদালকেই এগিয়ে রাখছিলেন।
নাদাল বনাম জোকোভিচের সেমিফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। প্রথম সেট ৬-৪ গেমে জিতে শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেন জোকোভিচ। কিন্তু পরের সেটে ৬-৩ গেমে জিতে খেলায় পুরোপুরি ফিরে আসেন নাদাল। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় তৃতীয় সেটে, শেষপর্যন্ত সেই সেট গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকেও ধুন্ধুমার লড়াই শেষে ১১-৯ পয়েন্টে তৃতীয় সেট জিতে নেন নোভাক জোকোভিচ। এই সেট শেষ হওয়ার পরেই খারাপ আবহাওয়ার কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়, শেষপর্যন্ত সেদিনের মতো খেলা স্থগিত করে পরদিন আবারো খেলা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নতুন দিনে নাদাল দোর্দণ্ড দাপটে খেলায় ফিরে আসে, চতুর্থ সেট ৬-৩ গেমে জিতে নিয়ে খেলা নিয়ে যান পঞ্চম সেটে। পুরো ম্যাচ জুড়েই অসাধারণ কিছু ড্রপ শটের মাধ্যমে জোকোভিচকে বেশ ভোগাচ্ছিলেন নাদাল। কিন্তু জোকোভিচ তার স্বাভাবিক খেলাতেই জোর দিয়ে যাচ্ছিলেন, নাদালের পাওয়ার শটগুলো ঠেকাতে কিছুটা ব্যাকলাইনে থেকেই খেলে যাচ্ছিলেন তিনি। পঞ্চম সেটের লড়াই দেখে মনে হচ্ছিলো এই ম্যাচ বুঝি আর শেষই হবে না। নাদাল বা জোকোভিচ কেউই কারো সার্ভ ব্রেক করতে পারছিলেন না। পঞ্চম সেটে জোকোভিচ যখন ৯-৮ গেমে এগিয়ে তখন রাফায়েল নাদাল সার্ভ করতে যান। নাদালের এই সার্ভিং গেমে টানা চারটি পয়েন্ট জিতে অবশেষে নাদালের সার্ভ ব্রেক করতে সমর্থ হন জোকোভিচ। ফলে ৩-২ সেটে নাদালকে হারিয়ে উইম্বলডনের ফাইনালে চলে যান নোভাক জোকোভিচ।
ফাইনালে কেভিন অ্যান্ডারসনের মুখোমুখি হন নোভাক জোকোভিচ। এই অ্যান্ডারসন কোয়ার্টার ফাইনালে শীর্ষ বাছাই রজার ফেদেরারের বিপক্ষে ২-০ সেটে পিছিয়ে থেকেও সেই ম্যাচ ৩-২ সেটে জিতেছিলেন। আর সেমিফাইনালে ছয় ঘণ্টার মহাকাব্যিক এক ম্যাচে জন ইসনারকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করেছিলেন কেভিন অ্যান্ডারসন। অসাধারণ সার্ভিং পাওয়ার দিয়ে আগের দুই ম্যাচেই বাজিমাত করেছিলেন অ্যান্ডারসন। কিন্তু জোকোভিচ হচ্ছেন টেনিস ইতিহাসের অন্যতম সেরা রিটার্নার তাছাড়া কেভিন অ্যান্ডারসনের বিপক্ষে শেষ দশ বছরে একটা ম্যাচেও হারেননি জোকোভিচ। তাই এই ফাইনালে জোকোভিচকেই এগিয়ে রাখছিলেন সবাই।
ফাইনালের শুরু থেকেই অ্যান্ডারসনের উপর ছড়ি ঘোরাতে থাকেন জোকোভিচ। প্রথম দুই সেটে ৬-২ ও ৬-২ গেমে জিতে নিজের চতুর্থ উইম্বলডন জয়ের কাছাকছি চলে যান জোকোভিচ। তৃতীয় সেটে অবশ্য প্রতিরোধ গড়েছিলেন অ্যান্ডারসন ফলে সেই সেট গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে অ্যান্ডারসনকে ৭-৩ পয়েন্টে হারিয়ে নিজের চতুর্থ উইম্বলডন শিরোপা ঘরে তুলেন নোভাক জোকোভিচ। এই উইম্বলডন জয়ের মাধ্যমে দুই বছর পর আবারো কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের স্বাদ পেলেন নোভাক জোকোভিচ। সবমিলিয়ে এটি জোকোভিচের ১৩ তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়। গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের দিক থেকে এখন নোভাক জোকোভিচের সামনে আছেন কেবল তিনজন ব্যক্তি- রজার ফেদেরার (২০টি), রাফায়েল নাদাল (১৬টি) ও পিট সাম্প্রাস (১৪টি)।
দুঃসময় পার করে অসাধারণ এই প্রত্যাবর্তনের পর নোভাক জোকভিচ বলেন,
“এই দুঃসময় আমাকে ধৈর্যশীল হতে শিখিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে কনুইয়ের অস্ত্রোপচারের পর আমি খুবই অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। যত দ্রুত সম্ভব আমি আবার মাঠে ফিরতে চাচ্ছিলাম। এ কারণেই কিছুটা ব্যথা নিয়েই আমি বেশ কিছু টুর্নামেন্ট খেলেছি। সত্যি কথা বলতে, একমাস আগে আমি নিজেও এবারের উইম্বলডন জয়ের ব্যাপারে জোর গলায় কিছু বলতে পারতাম না। কিন্তু আমি সেটা করতে পেরেছি। আমি এর আগেও উইম্বলডনের শিরোপা জিতেছি, কিন্তু সত্যি বলছি, দু বছরের দুঃসময় ঘুচিয়ে এই উইম্বলডন জয়টা বাকি সবগুলোর চেয়ে আলাদা।”
জোকোভিচ আরো বলেন যে নাদালের বিপক্ষে ওই শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের ফলে তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। আর উইম্বল্ডন জয়ের ফলে সেই আত্মবিশ্বাস ঠিক সেই আগের জায়গায় ফিরে গিয়েছে, তা বলাই যায়।
গত দেড় বছরে জোকোভিচ আর অ্যান্ডি মারে ইনজুরির কারণে টেনিস কোর্ট থেকে দূরে থাকায় টেনিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেকখানি কমে গিয়েছিলো। নোভাক জোকোভিচের এমন প্রত্যাবর্তন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরিয়ে আনার আভাস দিয়ে গেলো। আত্মবিশ্বাসী জোকোভিচ কতটা ভয়ঙ্কর, তা টেনিস ভক্তরা ২০১১-১০১৬ সালেই দেখেছে। মাঝের দু বছরের খারাপ সময় কাটিয়ে জোকোভিচ যদি সত্যিই তার সেই পুরনো রুদ্রমূর্তিতে ফিরতে পারেন, তাহলে সামনের ইউএস ওপেনে আমরা একটা ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্ট দেখতে পাবো, তা বলাই বাহুল্য। টেনিস ভক্তরা নিশ্চয়ই প্রত্যাশার বাসা বাঁধছেন যে রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচ ও অ্যান্ডি মারে- এই চারজনই সামনের ইউএস ওপেনে ফুল ফিট থাকবেন এবং স্মরণকালের অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গ্র্যান্ডস্ল্যাম টুর্নামেন্ট টেনিস ভক্তদের উপহার দেবেন।
ফিচার ইমেজ: Wimbledo