বিশ্বকাপ মানেই কী তারুণ্যের জয়গান?
ব্যাপারটি সবসময় এমন নয়। এবার বিশ্বকাপ মাতাতে যেমন তৈরী আছেন ৩০ পার করে ফেলা একঝাঁক ফুটবলার। ত্রিশোর্ধ্ব এই ফুটবলারদের কয়েকজনকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
লিওনেল মেসি: ৩০ বছর
লিওনেল মেসি ‘বুড়ো’ হয়ে গেছেন, এটা মানতে একটু কষ্ট হবে। তারপরও সত্যি হলো, ৩০ পার করে ফেলেছেন তিনি। হয়তো আরও একটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলতে পারবেন। কিন্তু তার সত্যিকারের শেষ সুযোগ এটাই।
ভক্তরা তো বটেই, শত্রুরাও তাকে বলেন ভিনগ্রহের ফুটবলার। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন ‘ভিডিও গেম’ থেকে বেরিয়ে আসা এক চরিত্র!
ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে এই সব কথা সত্যি বলেই মনে হয়।
সারাটা ক্যারিয়ার বার্সেলোনায় কাটানো লিওনেল মেসি ক্লাবের হয়ে জেতেননি এমন কিছু নেই। পাঁচবার ফিফা বর্ষসেরা ও পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। বার্সেলোনার হয়ে ৩২টি ট্রফি জিতেছেন। এর মধ্যে আছে ৯টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৬টি কোপা দেল রে। লা লিগায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। এছাড়াও লা লিগায় এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইউরোপে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইউরোপে এক বর্ষপঞ্জিতে সর্বোচ্চ গোলাদাতা; ভুরি ভুরি রেকর্ড তার দখলে। জাতীয় দল আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি। জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে ছয় শতাধিক গোল করেছেন।
কিন্তু মেসি কি এসব নিয়ে তৃপ্ত? মেসি নিজেকে কি ভিনগ্রহের ফুটবলার বলে ভাবতে পারেন? উত্তর- না। কারণ, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অতৃপ্তিটা হলো জাতীয় দলের হয়ে কোনো মেজর ট্রফি জিততে পারেননি। যুবদলের হয়ে জিতেছেন, অলিম্পিক জিতেছেন; কিন্তু আর্জেন্টিনা মূল দলের হয়ে কিছু জেতা হয়নি। গত বিশ্বকাপে নিশ্বাস ফেলা দূরত্ব থেকে ফিরে এসেছেন। ইতিমধ্যে চারটি বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন মেসি। এটাই সম্ভবত তার শেষ সুযোগ। এবার না হলে সারাজীবন মেসিকে এই বিশ্বকাপের অতৃপ্তি নিয়ে থাকতে হবে।
লিওনেল মেসি কি পারবেন ত্রিশে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপটাকে স্পর্শ করতে!
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: ৩৪ বছর
নিঃসন্দেহে এটা রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ। দেখতে দেখতে বয়স ৩৪ হয়ে গিয়েছে।
বলা হয়, এই যুগটার নাম ‘মেসি-রোনালদোর যুগ’।
ফুটবলের জন্য এটি একটি দুর্লভ ঘটনা, যেখানে প্রায় একই মাপের দুজন ফুটবলার একই সময়ে একই লিগে বসে সারা বিশ্ব শাসন করছেন। কখনো মনে হয় মেসি সেরা, কখনো মনে হয় রোনালদো। এই নিয়ে সারা বিশ্ব বিভক্ত হয়ে থাকে। তর্ক করে। গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে শ্রেষ্ঠত্ব এই দুজনের। এর মধ্যে রোনালদোর বিশেষ কৃতিত্ব হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি লিগে রাজত্ব করেছেন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ২৬টি ট্রফি জিতেছেন। মেসির সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ পাঁচটি ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কারের মালিক তিনিও। ক্লাব ও দেশের হয়ে ৬৭০টিরও বেশী গোল করেছেন।
মেসির মতো তার অবশ্য জাতীয় দল নিয়ে অত বেশী আক্ষেপ নেই। তিনি বিস্ময়করভাবে ২০১৬ সালে পর্তুগালকে ইউরো চ্যাম্পিয়ন করেছেন। ফাইনালে ইনজুরি তাকে খেলতে না দিলেও সাইডলাইনে বসে হয়ে উঠেছিলেন এক সত্যিকারের নেতা। পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়েও দারুণ গোলস্কোরার তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ৮১টি গোল করেছেন।
পর্তুগাল বিশ্বকাপে ফেভারিট দলগুলোর একটি নয়। কিন্তু একজন রোনালদোর উপস্থিতি বদলে দিতে পারে সব সমীকরণ। সবাইকে ছাপিয়ে হয়ে উঠতে পারেন এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় তারকা।
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা: ৩৪ বছর
এই সেদিনও ছিলেন টগবগে তরুণ। কিন্তু সেই ইনিয়েস্তা এখন ৩৪ বছরে দাঁড়িয়ে।
ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আন্ডার রেটেড ফুটবলার মনে করা হয় ইনিয়েস্তাকে। বার্সেলোনার নিজস্ব অ্যাকাডেমি ‘লা মেসিয়া’র তৈরী এই ফুটবলার। বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ক্লাব ফুটবলে যা কিছু সম্ভব সবকিছুই। সেই সাথে জাতীয় দলের হয়েও আছে একটি বিশ্বকাপ ও একটি ইউরো জেতার রেকর্ড। মাঝমাঠের শিল্পী বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই। তিনি শুধু ফুটবল খেলেন না, পেপ গার্দিওলা বলতেন, তিনি একটি দর্শন তৈরী করেন ফুটবল মাঠে। তাকে ফুটবলের দার্শনিকও বলেন অনেকে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই মিডফিল্ডার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্পেনকে বিশ্বকাপ জেতানো গোলটা করার জন্য।
এবার ইনিয়েস্তার সামনে আরেকবার আড়ালের নায়ক থেকে সত্যিকারের নায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ। ২০১৪ সালে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছিলেন। সেই দুঃসময় কাটিয়ে উঠেছে স্পেন। এবার আবার তাদের ফেবারিট মনে করা হচ্ছে। স্পেনকে তেমন কিছু করতে হলে ইনিয়েস্তাকে আরেকবার জাদুর কাঠি বের করতে হবে।
টিম কাহিল: ৩৮ বছর
৩৮ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার টিম কাহিল এবার রাশিয়ায় যাওয়া অভিজ্ঞতম ফুটবলারদের একজন।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার এই টিম কাহিল। এখনও তিনি দলটির ফুটবলের জন্য দারুণ প্রয়োজনীয় একজন খেলোয়াড়। এবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও রেখেছেন দারুণ ভূমিকা। সিরিয়ার বিপক্ষে বাছাইপর্বে তার দুই গোল অস্ট্রেলিয়াকে এগিয়ে দিয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল লড়াইয়ের দিকে। এবার বাছাইপর্বেও ১১ গোল করে যুগ্মভাবে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েছেন এই টিম কাহিল।
এভারটনে ক্যারিয়ারের লম্বা একটা সময় পার করেছেন। গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের বাইরের বিভিন্ন ক্লাবেই খেলছেন। বয়সটা পক্ষে নেই বলে অস্ট্রেলিয়াতেই আজকাল শুরুর একাদশে খুব একটা থাকেন না। বদলী হিসেবে আসতে হয় মাঠে। তারপরও গোল করার অভ্যেসটা ধরে রেখেছেন। এবার বিশ্বকাপে একটা গোল করতে পারলেই একটা এলিট ক্লাবে নাম উঠে যাবে তার। পেলে, উই সিলার ও মিরোস্লাভ ক্লোসার পর চতুর্থ ফুটবলার হিসেবে চারটি বিশ্বকাপে গোল করার বিস্ময়কর রেকর্ড হবে কাহিলের।
জন ওবি মিকেল: ৩১ বছর
চেলসিতে ক্যারিয়ারের লম্বা সময় কাটিয়েছেন। প্রায় আড়াইশ ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু বলা হয়, চেলসি কখনোই জন ওবি মিকেলের সেরাটা ব্যবহার করতে পারেনি।
চেলসিতে যোগ দেওয়ার আগে বিশ্বের অন্যতম সেরা ও প্রতিশ্রতিশীল মিডফিল্ডার হিসেবে বিবেচিত হতেন। ২০০৫ ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের সেরাটা দেখিয়ে নাইজেরিয়াকে ফাইনালে তুলেছিলেন। সেখানে অবশ্য লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যেতে হয়েছিলো। কিন্তু ওবি মিকেলের সৃজনশীল মিডফিল্ডার হিসেবে পারফর্মেন্স নজর কেড়েছিলো সবার।
চেলসিতে হোসে মরিনহো মূলত তাকে আরও অনেক বেশী নিচে খেলানো শুরু করেন। ফলে গোল তৈরী ও করার যে সহজাত দক্ষতা, সেটা ইউরোপকে খুব একটা দেখাতে পারেননি তিনি। তবে নাইজেরিয়া দলের জন্য এখনও গুরুত্বপূর্ণ এই ১০ নম্বর।
৩১ বছর বয়সে আরও একবার মেসির সাথে লড়বেন ওবি মিকেল। অপেক্ষা থাকবে এবার মেসিতে তিনি আটকে দিতে পারেন কি না!
হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো: ৩৪ বছর
মাশ্চেরানোও দেখতে দেখতে ৩৪ বছর ছুঁয়ে ফেললেন!
আর্জেন্টিনার গত এক দশকের উত্থান-পতনের বিরাট সাক্ষী এই হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো। একসময় ছিলেন নিরেট আক্রমণভাগের ফুটবলার। লিভারপুলে এসে হয়ে গেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। বার্সেলোয় পেপ গার্দিওলা তাকে সেন্টার ব্যাক বানিয়ে ফেলেছিলেন। খুবই বৈচিত্রময় ফুটবল খেলার ক্ষমতা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছেন।
আর্জেন্টিনায় তাকে বলা হয় ‘এল জেফিসিতো’, মানে ‘ছোট নেতা’। তিনি সত্যিকারের একজন নেতা, যিনি দলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন লড়াই করার জন্য। গত বিশ্বকাপ দেখেছিলো তার আমরণ লড়াই করার চেষ্টা। মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরও আবার ফিরে এসে খেলা চালিয়ে গেছেন।
বয়স তার ধার হয়তো কিছুটা কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এই বয়সেও একটা ট্রফির জন্য শেষ লড়াইটা করবেন।