বিশ্বকাপ- একজন ফুটবলারের জন্য সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত শিরোপা। অনেক সেরা খেলোয়াড়ের হাতেই বিশ্বকাপ উঠেনি, আবার শুধুমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের কারণেই অনেক খেলোয়াড় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশ্বকাপ যেহেতু ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট, সেই কারণে এখানে ভালো কিছু করলে বেশি মানুষের নজরে পড়া যায়, আবার ব্যর্থ হলে সেই ব্যর্থতাটাও বেশি মানুষের চোখে পড়ে।
দীর্ঘদিন ধরেই ফুটবল বিশ্বের সেরা দুই তারকা হচ্ছেন লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু এই দুই খেলোয়াড়ের একজনের পরবর্তী বিশ্বকাপ মোটামুটি নিশ্চিত হলেও, অন্যজন দাঁড়িয়ে আছেন খাদের কিনারায়।
প্লে অফের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখতে হলেও আর্জেন্টিনাকে শেষ ম্যাচ ইকুয়েডরের বিপক্ষে জিততেই হবে। অন্যদিকে পর্তুগালের গ্রুপে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বসে আছে সুইজারল্যান্ড। রোনালদো বিহীন ম্যাচটা পর্তুগাল হেরে গিয়েছিল সুইসদের কাছে। সরাসরি বিশ্বকাপে যেতে চাইলে তাই শেষ ম্যাচে পর্তুগালের অবশ্যই জয় লাগবে, অন্যদিকে সুইসদের ড্র হলেও চলবে। অ্যাওয়ে ম্যাচে নিশ্চিতভাবেই তাই ডিফেন্সিভ মুডে খেলতে চাইবে সুইসরা।
জয় না পেলে প্লে অফে পর্তুগালের মুখোমুখি হতে পারে ইতালি। এই দুই খেলোয়াড় যদি বিশ্বকাপে খেলতে না পারেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপ আকর্ষণ হারাবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অন্য খেলোয়াড়রা আলোচনায় আসেন খেলায় অসাধারণ কোনো নৈপুন্য দেখালে। কিন্তু বর্তমানে এই দুজন খেলোয়াড় নৈপুন্য দেখালে তো স্বাভাবিকভাবে আলোচনাতে আসবেনই, সাথে সাথে ব্যর্থ হলেও আলোচনার কমতি হয় না। আর্জেন্টিনা কিংবা পর্তুগালের বাদ পড়ার মতো কোনো অঘটন ঘটলে এত বড় দুই জন চরিত্রের অভাব অবশ্যই বিশ্বকাপ অনুভব করবে।
তবে বাছাই পর্বে এরকম বিপদে কিন্তু প্রতি বছরই কোনো না কোনো দল পড়ে। খুব জায়ান্ট কোন দল না হলে আলোচনায় সেই বিষয়গুলো আসে না।
যুগে যুগে অনেক বড় দলও বাছাই পর্বে বিপদে পড়েছিল, তাদের কাউকে কাউকে হয়তো প্লে অফের বাধাও পার হয়ে আসতে হয়েছিল। এই লেখায় ইতিহাসের সেই বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ম্যাচগুলোর কয়েকটি নিয়েই আলোচনা করা হবে।
ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে- ১৯৯৪
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের প্রথম ৭টি ম্যাচে রোমারিও দলে ছিলেন না। বলিভিয়ার সাথে ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর এক পর্যায়ে সমীকরণ এমন দাঁড়ায় যে, বিশ্বকাপে যেতে হলে ব্রাজিলের শেষ ম্যাচে উরুগুয়েকে ২ গোলের ব্যবধানে হারাতে হবে।
কোচ প্রথমে রোমারিওকে দলে নিতে চাননি। কিন্তু সাংবাদিক আর দর্শকদের প্রবল চাপের মুখে রোমারিওকে দলে ডাকতে বাধ্য হন তিনি।
দলে ডাক পেয়ে রোমারিও বলেন,
“আমি জানি কী হতে যাচ্ছে। আমি উরুগুয়েকে শেষ করতে যাচ্ছি।”
সেই ম্যাচে ব্রাজিল ২-০ গোলে জয় পায় এবং দুটো গোলই করেন রোমারিও।
আর্জেন্টিনা বনাম অস্ট্রেলিয়া- ১৯৯৪
১৯৯৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাও বিপদে পড়েছিল। ঘরের মাঠে কলম্বিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হেরে যাওয়ার পর পুরো মাঠ জুড়ে ম্যারাডোনাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য স্লোগান শুরু হয়। এরপর ম্যারাডোনা দলে ফিরেন।
আর্জেন্টিনাকে প্লে অফ খেলতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেই ম্যাচের প্রথম লেগে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র করে এসেছিল আর্জেন্টিনা। পরে ঘরের মাঠে ১-০ গোলে জিতে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে তারা।
ব্রাজিল বনাম ভেনিজুয়েলা- ২০০২
২০০২ বিশ্বকাপে চ্যম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। অথচ সেই বিশ্বকাপে একটু উনিশ-বিশ হলে হয়তো মূল পর্বে খেলার সুযোগই পাওয়া হতো না ব্রাজিলের। বাছাইপর্বের ১৭ তম রাউন্ড শেষ হবার পর পরিস্থিত এমন ছিল, যদি ব্রাজিল বেশি ব্যবধানে হেরে যায় আর কলম্বিয়া বেশি ব্যবধানে জিতে যায় তাহলে কলম্বিয়া মূল পর্বে চলে যাবে। কলম্বিয়া ৪-০ গোলে ম্যাচটি জিতলেও, ব্রাজিল ঘরের মাঠে ভেনেজুয়েলাকে ৩-০ গোলে হারাতে ভুল করেনি।
তবে সেই বাছাইপর্বেই প্রথমবারের মতো ব্রাজিল দুটোর বেশি ম্যাচে হেরেছিল এবং গ্রুপে শীর্ষে থেকে শেষ করতে পারেনি।
জার্মানি বনাম ইউক্রেন- ২০০২
২০০২ বিশ্বকাপে বাছাই পর্বে ইংল্যান্ডের সাথে একই গ্রুপে থাকায় যেকোনো এক জায়ান্টের প্লে অফ খেলাটা নিশ্চিতই ছিল। জার্মানির পক্ষে বাছাই পর্বে মাইকেল বালাক সবচেয়ে বেশি গোল করেও (৩টি) গ্রুপে তাদেরকে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাছাই পর্ব পার হতে হয়েছিল তাদেরকে প্লে অফ খেলে। সেই প্লে অফেও মাইকেল বালাকের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
প্লে অফে জার্মানির মুখোমুখি হয় সেই সময় এসি মিলানের হয়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা শেভচেঙ্কোর ইউক্রেন। প্রথম লেগটা হয় ইউক্রেনের মাঠে। ১৮ মিনিটেই গোল করে ইউক্রেন এগিয়ে যায়। তবে ৩০ মিনিটে মূল্যবান একটা অ্যাওয়ে গোল করে জার্মানিকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন মাইকেল বালাক। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে ১-১ ফলাফলটা খারাপ নয়, কিন্তু দলটি যখন জার্মানি, তখন তাদের কাছ থেকে ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে।
সেই প্রত্যাশা জার্মানি মেটালো পরের লেগে। ৪-১ গোলে জেতা সেই ম্যাচে জার্মানদের পক্ষে ১ম আর শেষ গোলটা আসে মাইকেল বালাকের পা থেকেই। বলা যায়, অনেকটা এককভাবেই জার্মানিকে মূল পর্বে নিয়ে যান মাইকেল বালাক।
ফ্রান্স বনাম আয়ারল্যান্ড- ২০১০
আয়ারল্যান্ডের মাঠে গিয়ে আনেলকার একমাত্র গোলে মূল্যবান জয়টি পায় ফ্রান্স। সাথে ছিল মূল্যবান অ্যাওয়ে গোল। তবে পরের লেগে এই সুবিধাটা ধরে রাখতে পারেনি ফ্রান্স। ৩৩ মিনিটে গোল করে আয়ারল্যান্ড সমতা নিয়ে আসে। অবস্থা দাঁড়ায় এমন, সেই মূহুর্তে আয়ারল্যান্ড আরেকটা গোল করলে ফ্রান্সকে আরো দুটো গোল করতে হবে।
নির্ধারিত সময়ের পর ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। অতিরিক্ত সময়ের ১০৩ তম মিনিটে গোল করে ফ্রান্সকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায় উইলিয়াম গালাস।
আর্জেন্টিনা বনাম উরুগুয়ে- ২০১০
২০১০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার অবস্থান ছিল ৪র্থ। তবে সেই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের শেষ দুই ম্যাচ আর্জেন্টিনার জন্য ভয়ঙ্কর ছিল। পেরুর সাথে ১ গোলে এগিয়ে গিয়েও ৮৯ মিনিটে আবার গোল খায় আর্জেন্টিনা। ৯৩ মিনিটে পালের্মো গোল করে সে যাত্রা বাঁচিয়ে দেন আর্জেন্টিনাকে। শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের সাথে সমীকরণ ছিল এমন, ইকুয়েডর যদি চিলির সাথে জেতে আর আর্জেন্টিনা যদি উরুগুয়ের সাথে হেরে যায়, তাহলে বিশ্বকাপ থেকে সরাসরি আর্জেন্টিনা বাদ পড়বে। আর যদি চিলি জেতে আর আর্জেন্টিনা হারে, তাহলে প্লে অফ খেলতে হবে আর্জেন্টিনাকে।
ম্যাচের ৮৪তম মিনিটে বোলাত্তি গোল করে সেই যাত্রায় আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যান।
ফ্রান্স বনাম ইউক্রেন- ২০১৪
২০১৪ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে স্পেন আর ফ্রান্স ছিল একই গ্রুপে। যেহেতু একটি মাত্র দল সরাসরি মূল পর্বে যেতে পারবে, তাই অনুমিতই ছিল যে, অন্য দলকে প্লে অফ খেলতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্লে অফ খেলতে হলো ফ্রান্সকে।
ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ ইউক্রেন সেবার বাছাইপর্বে বেশ ভালো অবস্থাতেই ছিল। ইংল্যান্ডের চেয়ে মাত্র ১ পয়েন্ট পেছনে থাকার কারণে তাদেরকে প্লে অফ খেলতে হয়।
ফ্রান্সের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ২-০ গোলে জিতে ইউক্রেন মূল পর্বে যাওয়ার সম্ভাবনাটা ভালোভাবেই জিইয়ে রাখে। পরের লেগে ফ্রান্সকে ঘরের মাঠে ৩-০ গোলে জিততে হতো সরাসরি কোয়ালিফাই করার জন্য, অন্তত ২-০ গোলে জিততে হতো ম্যাচটিকে টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর ইউক্রেন যদি কোনোক্রমে ১ টি গোল করে ফেলে, তাহলে ফ্রান্সকে করতে হবে ৪ গোল।
ম্যাচটা ফ্রান্স জেতে ৩-০ গোলে। সর্বশেষ গোলটা হয় ম্যাচের ৭২ তম মিনিটে।
সুইডেন বনাম পর্তুগাল- ২০১৪
এই দুই দলের কোনটিই আসলে সেরকম বড় দলের কাতারে পড়ে না। তবে ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সময়ের দুই সেরা তারকা ইব্রাহিমোভিচ আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর কারণে।
প্লে অফে মুখোমুখি হওয়ায় একটি বিষয় নিশ্চিত ছিল যে, কোনো এক তারকা বাদ পড়ছেন। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে পর্তুগালের ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে গোল করেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ম্যাচের ৮২ তম মিনিটে।
দ্বিতীয় লেগেও ম্যাচের ৫০ তম মিনিটে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর গোলেই আবার এগিয়ে যায় পর্তুগাল। সবাই ভেবেছিল পর্তুগালই জিততে যাচ্ছে। কিন্তু ম্যাচের ৬৮ আর ৭২ মিনিটের মাথায় ইব্রাহিমোভিচ গোল করে সুইডেনকে ম্যাচে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ানোর ৭৭ আর ৭৯ মিনিটের ২ গোল পর্তুগালকে পাইয়ে দেয় ব্রাজিলের টিকেট।
বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই তারার মেলা। সেই তারার মেলায় যদি সমসাময়িক দুজন সেরা তারকা অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তাদের অভাব পূরণ হওয়ার মতো নয়। তবে এটিও সত্যি যে, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। যদি সত্যি সত্যিই এই দুজন শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে সুযোগ না পান, তাহলে হয়তো নতুন কোনো তারকার আবির্ভাব ঘটবে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে।
কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই দুজন যাতে শেষ পর্যন্ত তাদের দল নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে পারে, এই মূহুর্তে সেটাই সকল সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের কামনা।