জেরার্ড পিকে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে একজন গণশত্রুর নাম; বার্নাব্যুর গ্যালারিতে প্রিয় ক্লাবের খেলা দেখতে উপস্থিত হওয়া এমন রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক পাওয়া দুস্কর, যিনি অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চাইতে তাকে বেশি ঘৃণা করেন না! তিনি বার্সেলোনার হয়ে খেলেন, তিনি একজন গর্বিত কাতালান, তিনি ধৃষ্ট, তিনি স্পষ্টভাষী; পিকে মাদ্রিদিস্তাদের কাছে অনেকটা কমিক বইয়ের ভিলেনদের মতোই।
কিন্তু সেদিনের একরাত ছিল, যেদিন এই বার্নাব্যুই প্রফুল্লচিত্তে পিকে’র নামে উল্লাস করেছিল; ‘পিকে… পিকে…’ রব উঠেছিল মাদ্রিদিস্তাদের তীর্থভূমি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতেই!
আমরা সবাই জানি, স্পেন ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী দল। কিন্তু ২০০৯’র দিকে স্পেন কেবলই তৎকালীন ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন, এবং তখনো দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের টিকেট কাটা হয়নি তাদের। নতুন কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের অধীনে তাদের কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে বিশ্বকাপের টিকেট কাটতে হতো, যেখানে ছিলো বেলজিয়াম, তুরস্ক কিংবা বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মতো কঠিন প্রতিপক্ষ!
শুরুর চার ম্যাচেই জয়ের পর আত্মবিশ্বাসী স্পেনের প্রতিপক্ষ সেবার তুরস্ক। অদ্ভুত ম্যাচ শিডিউলের ধাঁধায় মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে তুরস্কের বিপক্ষে দুইটি ম্যাচ খেলতে হতো স্পেনকে, যার প্রথমটি ২৮ মার্চ ২০০৯ তারিখে, বার্নাব্যুতে। পিকে তখনো দেশের জার্সি গায়ে কোন প্রতিযোগিতামুলক ম্যাচ খেলেননি, যদিও গার্দিওলার বার্সায় কার্লোস পুয়োলের পাশে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন ইতঃমধ্যেই।
ক্যাম্প ন্যু’তে গার্দিওলা প্রজেক্টের প্রথম বছর এটি, ব্লাউগ্রানারা টানা ভালো পারফর্ম করে যাচ্ছিল, যেখানে দলের অন্যতম কী-ফ্যাক্টর ছিলেন জেরার্ড পিকে। সে সময়েই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে অভিষেক হয় পিকে’র। এরপরই বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তুরস্ক ম্যাচের স্কোয়াডে ইঞ্জুরড কার্লোস পুয়োলের স্থলাভিষিক্ত হোন পিকে।
ম্যাচটি কঠিনই ছিল। তৎকালীন কোচ ফাতিহ তারিমের তুরস্ক যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, এবং তাদের দলে গুণসম্পন্ন বেশ কিছু খেলোয়াড় ছিলেন; তাদের যোগ্যতা তারা ইতঃমধ্যে ২০০৮ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে প্রমাণও করেছিলেন। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হারার আগ অব্দি তারা অসাধারণ পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেছিলেন।
স্পেন-তুরস্ক ম্যাচেই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে রাউল আলবিওলের পাশে নিজের প্রথম প্রতিযোগিতামুলক ম্যাচ খেলতে নামেন পিকে। অন্যদিকে, সার্জিও রামোস ছিলেন রাইটব্যাক পজিশনে এবং জোয়ান ক্যাপদেভিয়া লেফটব্যাক, আর গোলবারের নিচে প্রহরী ইকার ক্যাসিয়াস।
চার ম্যাচে তুরস্কের পয়েন্ট ছিল ৮, অন্যদিকে স্পেনের ১২; স্পেনের বিপক্ষে যেকোনোভাবেই এক পয়েন্ট পাওয়ার আশায় তাদের স্বভাবসিদ্ধ খেলা প্রদর্শন না করে ডিফেন্স সামলানোতেই বেশি মনোযোগী ছিল তুরস্ক! সেদিনের ম্যাচে তুরস্ক নিজেদের প্রান্ত থেকে যেন বেরোতেই চায় না; কোনো আক্রমণ নেই, ডি-বক্সের মাঝেই একাধিক খেলোয়াড়দের রেখে বাস পার্ক করতে থাকে তারা। এদিকে স্পেনও ডেডলক ভাঙতে না পেরে হতাশ হতে থাকে। ডিফেন্সে বসে পিকে’সহ বাকি ডিফেন্ডাররা তেমন কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছিলেন না; তুর্কীশ ফরোয়ার্ডরা কালেভদ্রে বল নিয়ে স্পেনের ডিফেন্সে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তার চেয়ে তারা বাস-পার্কিং নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন! কিন্তু তবুও শেষমেশ সেই ম্যাচে ডিফেন্ডার পিকে তার পদচিহ্ন আঁকতে সমর্থ হন।
খেলার ৫৯ মিনিটে তুর্কিশ পেনাল্টি এরিয়ার ডান কর্নারে ফ্রি-কিক পায় স্পেন। সেখান থেকে লম্বা করে রামোসের দিকে বল বাড়িয়ে দেন জাভি, কিন্তু দারুণ সুযোগ থাকার পরও রামোস গোলের নিশানা খুঁজে পাননি, গোললাইনের ঠিক সামনেই বল বাউন্স করে চলে যায় পিকের পায়ে। অতঃপর… গোল!
দুর্দান্ত কোনো গোল ছিল না বটে, বরং বলা যায় এটি ছিল পিকে’র ক্যারিয়ারের সহজতম গোলগুলোর একটি। সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে সঠিক সময়ে বল পেয়ে গেলেন, নিখুঁত ফিনিশিংয়ে গোলও পেয়ে গেলেন।
স্পেনে কোনো জাতীয় স্টেডিয়াম নেই, যেখানে তারা বেশিরভাগ ম্যাচ খেলবে; সেখানে ইংল্যান্ডের মতো ওয়েম্বলি নেই, কিংবা ফ্রান্সের মতো স্তাদ দ্য ফ্রান্স নেই। স্পেন সাধারণত তাদের ম্যাচগুলো সারা দেশব্যাপী বিভিন্ন শহরে শহরে খেলে থাকে, ‘লা রোজা’র ট্যালেন্টদের নিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে ট্রাভেল করার মতো অনেকটা।
স্পেন কোনো শহরে তাদের যে ক্লাবের মাঠে ম্যাচ খেলতে যায়, ঐ ক্লাবের সিজন টিকেট হোল্ডাররা উক্ত ম্যাচের টিকেট ক্রয়ে অগ্রাধিকার পায়। হতে পারে তারা অন্যদের চেয়ে আগে টিকেট কিনতে পারবেন, কিংবা তারা ডিসকাউন্ট পাবেন, কিংবা দুইটিই। সেজন্যই স্পেনের মাটিতে প্রতিটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ ভিন্ন ভিন্ন সুবাস ছড়ায়; স্পেন যখন মেস্তালায় ম্যাচ খেলে, তখন গ্যালারির অধিকাংশ দর্শকই থাকে ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থক; আবার বেনিতো ভেলামারিনে অধিকাংশ দর্শকই থাকে রিয়েল বেটিস সমর্থক; এবং তারা যখন বার্নাব্যুতে খেলে, সেখানে গ্যালারির অধিকাংশ দর্শকই থাকেন মাদ্রিদিস্তারা!
সুতরাং পিকে তুরস্কের বিপক্ষে স্কোর করার পর স্পেনকে কেবল এগিয়েই দিলেন না, বরং বার্নাব্যু জুড়ে উল্লাসের ঢেউ ছড়িয়ে দিলেন। সেদিন যারা পিকে’র গোলে উৎসবে মেতেছিলেন, “পিকে… পিকে…” স্তুতি গাইছিলেন, তাদের সিংহভাগই ছিলেন মাদ্রিদ সমর্থক।
স্পেন সে ম্যাচে ১-০ গোলে জয় পায়, আর পিকের গোলটিই সেই জয়সূচক গোল। এই ম্যাচে জয়ের মধ্য দিয়ে ২০১০ বিশ্বকাপ টিকেটের লক্ষ্যে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় স্পেন। স্পেন বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিল, স্পেন সেই বিশ্বকাপটি নিজেদের ঘরেও এনেছিল; বাছাইপর্বে পিকে আরো দুইটি গোল পেয়েছিলেন, যা তাকে কেবল আফ্রিকার প্লেনেই চড়ায়নি, বরং প্লেয়িং একাদশেও পাকাপোক্ত একটা জায়গা করে দিয়েছিল।
তবে হ্যাঁ, সে সময় থেকে শুরু করে জোহানেসবার্গ থেকে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে মাদ্রিদে আসা অব্দি সময়ের মাঝে পিকে ইতঃমধ্যে রাজধানী মাদ্রিদে তার কিছু ভক্ত বা প্রশংসাকারীকেও হারিয়েছিলেন। বার্নাব্যুতে তুরস্কের বিপক্ষে সেই গোল করার মাত্র ৩৫ দিন পরই পিকে বার্নাব্যুতে আবারো গোল পেয়েছিলেন, কিন্তু এবার আর গ্যালারিতে উৎসবের রোল পড়েনি; বরং হতাশার নীল রংয়ে ছেঁয়ে গিয়েছিল বার্নাব্যুর আকাশ। স্বাগতিক রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে বার্সেলোনার ৬-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে জয়ের শেষ পেরেকটি যে ঠুকেছিলেন ঐ পিকে’ই!
গোলটি মাদ্রিদিস্তাদের ক্ষিপ্ত করেছিল বেশ কিছু কারণে। তার একটা হতে পারে গোলটি কোনো সেট পিস থেকে ছিল না, বরং ওপেন-প্লে গোল ছিল। সেখানে এই সেন্টারব্যাককে একান্তই নির্ভার দেখাচ্ছিল যে গোল হজম করার চিন্তা নেই, আর মাঝমাঠেরও নিচ থেকে দৌড়ে গিয়ে গোল করার মতো শরীরী ভাষাতে যেন লুকিয়ে ছিল অনেকটা ‘কাটা ঘায়ে নুন ছিটানো’ প্রয়াস!
তবে অন্য আরেকটি কারণও নিশ্চিতভাবেই মাদ্রিদ সমর্থকদের গা জ্বলুনির কারণ ছিল; আর তা হলো সেলেব্রেশনে নিজের জার্সি টেনে ধরে বার্নাব্যুর অ্যাওয়ে দর্শকদেরকে প্রদর্শন করা। অনেকেই পিকের সেলেব্রেশনকে দেখেছিলেন স্প্যানিশ ফুটবলের শক্তিমত্তা হাতবদলের প্রতীকস্বরূপ।
গার্দিওলার বার্সা সে সময়কার অন্য যেকোনো দলের চেয়ে নিঃসন্দেহে এগিয়ে ছিল, এটা কেউই অস্বীকার করবে না; পরিসংখ্যানও সেই সাক্ষ্যই দেয়। বার্সা এবং মাদ্রিদের মতো দলের কাছে কেবলমাত্র দুইটি স্থান বিবেচ্য ― একটি হলো প্রথম হওয়া, অন্যটি প্রথম না হওয়া। আর সেই সময় মাদ্রিদের অবস্থান ছিল পরেরটিতে।
মাদ্রিদের ম্যানেজার হিসেবে জোসে মরিনহো যুক্ত হওয়ার পর বার্সা-মাদ্রিদ রাইভালরি যেন অনন্য এক পর্যায়ে চলে যায়। ম্যাচ পূর্ববর্তী বাকযুদ্ধ, মাঠে হট্টগোল, কিংবা ম্যাচ-পরবর্তী কাঁদা ছোড়াছুড়ি ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী বার্সার খেলোয়াড়দের প্রতি মাদ্রিদিস্তাদের যে মুগ্ধতা বা সম্মানের জায়গা ছিল, তা ম্লান হতে থাকে। সংবাদ সম্মেলনে পিকের উত্তপ্ত বাক্য কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় রাইভালদের শ্লেষবিশিষ্ট পোস্টগুলো বার্সা-মাদ্রিদের রাইভালরিতে সে সময় নতুন এক মোড় দেয়। ২০১০-১১ মৌসুমে মাদ্রিদের বিপক্ষে বার্সার ৫-০ গোলে জয় পাওয়ার ম্যাচে হাত তুলে পাঁচ আঙ্গুল তুলে মক করে পিকে নিজেকে মাদ্রিদিস্তাদের গণশত্রুতে পরিণত করেন।
এরপর বার্নাব্যুতে যখনই ফিরেছেন পিকে, আর কখনোই নিজের নামে উল্লাসধ্বনি শোনেননি। ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ মাদ্রিদের মাঠেই খেলতে গিয়েছিলেন পিকে, এরপর ২০১৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বরে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচের আগে মাদ্রিদের মাঠে স্পেনকে প্রতিনিধিত্ব করতে যেতে হয়নি পিকে’কে। ততদিনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। একদিন পিকের গোলে উৎসব করা সেই বার্নাব্যুর গ্যালারিতেই ততদিনে কাতালান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জেরার্ড পিকে’কে বাজে মন্তব্য শুনতে হয়, ব্যু শুনতে হয়। পিকে তখন কেবল একজন বার্সেলোনা কিংবা স্পেনের খেলোয়াড়ই নন, বরং কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামী জণগণের কণ্ঠস্বর এবং স্বাধীনতার দাবিতে কাতালানদের গণভোটের পক্ষে সদা সরব; বার্সেলোনা খেলোয়াড়দের মাঝে মাঠের বাইরে কাতালানদের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ভূমিকা পালনকারীদের একজন ছিলেন পিকে।
ইতালির বিপক্ষে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচকে সামনে রেখে প্রেস কনফারেন্সে সে সময়কার স্পেন কোচ লোপেতেগি এবং ক্যাপ্টেন রামোস সমর্থকদের অনুরোধ করেন যেন তারা পিকে’কে ব্যু না দেন। রামোস সেদিন বলেন,
“কেবল পিকে কেন, স্পেনের জার্সি পরিহিত কোনো খেলোয়াড়কেই যেন বার্নাব্যুতে অসম্মান না করা হয়। আমরা দল হিসেবে ভালো পারফর্ম করতে চাই।”
তবুও ইতালির বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের সেই ম্যাচে প্রথমবার পিকের পায়ে বল যাওয়ার সাথে সাথেই দর্শকরা ব্যু দিতে থাকেন পিকে’কে। সেই মুহূর্তেই ক্যাপ্টেন রামোস ইশারায় তার অনুরোধটি স্মরণ করিয়ে দেন। তারপরই কেমন জাদুকরি কিছু যেন ঘটে যায় বার্নাব্যুর গ্যালারিতে, তৈরি হয় অসাধারণ এক মুহূর্ত। পিকের পায়ে বল গেলে অনেককেই দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দেখা গেল, কাউকে কাউকে তো “পিকে… পিকে…” চ্যান্ট করতেও শোনা গেল। খানিক বাদে যেনো পুরো গ্যালারিই তাদের বৈরিতা ভুলে পিকে’র জন্য আনন্দধ্বনি গাইতে থাকে।
২০১৮ বিশ্বকাপের পর অবসর নিতে পারেন, এমন ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন পিকে; যদিও অনেক স্পেন সমর্থক বিশ্বকাপের আগেই তাকে দল থেকে ছেঁটে ফেলার কথা বলছিলেন। আসলেই সবকিছুর একটা পর্যাপ্তি রয়েছে, অবসাদ রয়েছে; বৈরিতার ক্ষেত্রেও বোধহয় তাই। একজন খেলোয়াড়, যিনি জাতীয় দলের জন্যে নিজের সবটুকু দিয়েছেন, দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, ইউরো ট্রফি জিতিয়েছেন। হ্যাঁ, এটি সত্য যে ক্লাব ফুটবল চলাকালীন তিনি ক্লাব মাদ্রিদ কিংবা মাদ্রিদিস্তাদের মক করতে ভালোবাসেন; হ্যাঁ, এটা সত্যি যে তিনি কাতালানদের স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোটের পক্ষে সরব, যা স্পেনের জাতীয়তাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক; কিন্তু তিনি ঠিক যতবারই স্পেনের জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন, ততবারই তিনি ক্লাবের রাইভালরি কিংবা রাজনীতিকে অন্যপাশে রেখে জার্সিটিকে নিজের প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন, দলের জন্য নিজের সেরাটুকু দিয়েছেন।
এটিও সত্য যে সব স্পেন সমর্থকরাই যে পিকে’কে নিয়ে এমন ভাবনা ধারণ করত, তা নয়; স্পেন জুড়ে অসংখ্য ভক্ত-সমর্থক রয়েছেন যারা স্পেনের পিকে থেকে বার্সেলোনা কিংবা কাতালানদের পিকে থেকে আলাদা করে না। জাতীয় দলের সেই জার্সি তো পিকে নিজের ঘাম, অশ্রুজল, এমনকি নিজের রক্তেও ভিজিয়েছেন! নিঃসন্দেহে সেই দেশের রাজধানীর দর্শকদের কাছে একটু সম্মান পিকে’র প্রাপ্যই বটে! আর সেই রাতে পিকে সেই সম্মানটুকুই পেয়েছিলেন ‘প্রিয় শত্রু’ রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদের কাছে, হয়েছিলেন আপ্লুত, সম্মানিত!
২০১৭’র সেপ্টেম্বরের সে রাতে কিছু সাহসী সমর্থকেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, যারা বৈরিতা ভুলে সেদিন পিকের নামে উল্লাস করেছিলেন। হ্যাঁ, তারা তুরস্কের বিপক্ষে পিকে’র গোলেও উল্লাস করেছিলেন; কিন্তু সেদিন ছিল গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে স্পেনের গোলের খাতা খোলায় দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিস্পন্দন, কিন্তু এবারের আনন্দধ্বনি ছিল উদ্দেশ্যপূর্ণ, ছিল রাজনীতিকে অন্য পাশে রেখে ফুটবল মাঠে জাতীয় দলের জন্যে নিজের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেয়া সফল একজন সৈনিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে যিনি বার্নাব্যুতে অধিকতর ঘৃণিত, সেই বার্নাব্যুর একদল সমর্থকই ভদ্রজনোচিতভাবে বার্নাব্যুতেই দাঁড়িয়ে পিকে’র জন্যে হাততালি দিয়েছিলেন, পিকে’র নামে চ্যান্ট করেছিলেন!
আপনি পিকে’র পুরো নাম জানেন কি? জেরার্ড পিকে বার্নাব্যু; পিতা জোয়ান পিকে এবং মাতা মন্টসিরাত বার্নাব্যু’র সন্তান জেরার্ড পিকে বার্নাব্যু। বলতে পারেন, পিকের রক্তেই ‘বার্নাব্যু’ শব্দটি গেঁথে আছে; সেই ‘বার্নাব্যু’ শব্দেই পিকে নিজেকে লাখো সমর্থকদের চোখের শত্রু ছিলেন, সেই ‘বার্নাব্যু’তেই পিকে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটিরও সাক্ষী হয়েছেন, যেদিন মাদ্রিদিস্তারা তার নামে আনন্দধ্বনি বইয়েছিলেন পুরো গ্যালারিজুড়ে, রিয়াল মাদ্রিদের তীর্থভূমি বার্নাব্যুজুড়ে!
আমাদের কাছে কিংবা ফুটবলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও এই রাত রূপকথার মতোই শুনাবে। রূপকথার সেই রাত, যেই রাতে বার্নাব্যুতে ‘পিকে’র নামে উল্লাসধ্বনি হয়েছিল!