কলেজে নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি পর ক্লাসের আগে ‘নবীন বরণ’ অনুষ্ঠানের রীতি এখনও আছে। ক্রিকেট দলে নতুন কোচ এলে একই রেওয়াজ আছে কি না সে ব্যাপারে অবশ্য তথ্য দেওয়া ভার। তবে বোর্ডের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক পরিচয়, আলাপ-আলোচনা এগুলো তো অবশ্যই হয়। কিন্তু স্টিভ রোডসের কী ভাগ্য, বাংলাদেশ দলে যোগ দিয়ে সেটা তিনি পেলেন না।
পেলেন, তবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে না। তিনি যখন দায়িত্ব নিলেন, তখন বাংলাদেশ উইন্ডিজ সিরিজের জন্য জোর অনুশীলন চালাচ্ছে। ৭ জুন বাংলাদেশে এসে নিয়োগপত্র নিলেন, তারপর ফিরে গেলেন নিজের দেশে। আবার ফিরে এলেন ঢাকায়। দিন তিনেক অনুশীলন করে উড়ে গেলেন দলের সঙ্গে উইণ্ডিজে। অর্থাৎ, পুরোটাই একরকম দৌড়ের মধ্যে কেটেছে সাবেক কাউন্টি ক্লাব কোচের।
এসেই বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে এক টানে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। কারণ ক্রিকেট কোনো রকেট সায়েন্স নয়। পাশাপাশি এটাও বলেছিলেন, বাংলাদেশ ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য রাখে।
প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পাওয়া। বড় কপাল নিয়ে জন্মেছিলেন রোডস। তার জন্য মাশরাফি বিন মুর্তজা আর সাকিব আল হাসান এমন উপহার রেখে দেবেন; তা তিনিও ভাবেননি। অতীতে কজন কোচই বা বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সিরিজেই এক জোড়া ট্রফি নিতে দেখেছে? দেখেনি।
রোডস সেটা দেখলেন। যদিও মাঠে খেললেন সাকিব-সাব্বিররা। তারপরও, রোডস যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের মুখ থুবড়ে পড়া দেখে নিন্দুকরা মুখ টিপে হেসেছিল। হয়তো বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন রোডস নিজেও। কিন্তু তিন ম্যাচের ওয়ানডে আর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ালো লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। জিতে নিলো এক জোড়া ট্রফি। হাফ ছেড়ে বাঁচলেন বাংলাদেশের নতুন কোচ।
প্রথম মিশন শেষে যেন টের পেলেন, এই ছেলেগুলো হাল ছাড়ার নয়। এদের ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজনও নেই!
১.
‘আ মিশন উইথ টাইগার বয়েজ’; উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে রোডস এমন একটা বই লিখতে পারেন। অন্তত তার প্রথম সিরিজটাকে কেন্দ্র করে।
স্টিভ রোডস বাংলাদেশের সব ক্রিকেটারের ব্যাপারে জানার সুযোগ পাননি। তাই বলে থেমেও থাকেননি! নিজে নিজে পরিচিত হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে নিজে থেকে ধারণা নিয়েছেন। নির্বাচকদের সঙ্গেও আলাপ করেছেন। তাতে নিজের কাজটা আরও সহজ করতে পেরেছেন সাবেক এই ক্রিকেটার। ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত তার সঙ্গে চুক্তি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। তাই সময়টা যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে চান তিনি।
টেস্টের ব্যর্থতার পর সীমিত ওভারে ঘুরে দাঁড়ানো দেখে অবাক হয়েছেন রোডস। তবে গর্বও হয়েছে তার। সিরিজ শেষে ঢাকায় নেমে বিমানবন্দরে সে কথা জানিয়েছেন। রোডস বলেছেন, “টেস্ট সিরিজটা আমাদের জন্য সহজ ছিল না। টেস্টের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় শুরুতে আমরা অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছি। তবে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরে খুব গর্ববোধও করছি। ওয়ানডে সিরিজ জয় করার প্রত্যাশা আমাদের ছিল। আমরা সেটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় করাটা অবাক করার মতো ছিল। আমরা আসলেই দারুণ খেলেছি শেষ দুই ম্যাচে। খুবই খুশি দুটি সিরিজ জয় করতে পেরে।”
পুরো সিরিজে তরুণরা খুব একটা ভালো করতে পারেনি। কিন্তু কোচ কাউকে সরাসরি দায় করছেন না। সবাইকে নিয়েই ভালো কিছু হয়েছে; এটা মানছেন। পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দলের দুই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসানের কারণে সবকিছু সম্ভব হয়েছে। প্রসংশা করেছেন তাদের দূরদৃষ্টির।
রোডসের ভাষায়, “ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টিতে দুই অধিনায়কই তাদের বোলারদের দারুণভাবে ব্যবহার করেছে। মাশরাফি ও সাকিব, দুজনই বোলারদের ভালো পারফরম্যান্সটা বের করে নিয়েছে। আমাদের কিছু যোগ্যতাসম্পন্ন স্পিন বোলার রয়েছে। ভালো পেস বোলারও ছিল যা আমাদের উইন্ডিজ থেকে ভালো ফলাফল করতে সাহায্য করেছে। আমাদের যথেষ্ট বোলার রয়েছে। তবে টেস্ট ম্যাচের জন্য আমাদের কয়েকজন দ্রুত ও দীর্ঘদেহী বোলার খুঁজে বের করতে হবে, যারা উইকেটে জোরে আঘাত করে সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে, যেমনটা উইন্ডিজ বোলাররা করে দেখিয়েছে।’
এখানেই শেষ নয়। এক সাক্ষাতকারে দলের দুই অধিনায়ক প্রসঙ্গে রোডস বলেন, “আপনি যখন বাংলাদেশের কথা বলবেন, তখন এটা বলতেই হবে মাশরাফি দারুণ একজন অধিনায়ক। তাকে উদাহরণ মানা যায়। সে একজন যোদ্ধা। তাকে অন্যরা অনুসরণ করে। সাকিব টি-টোয়েন্টিতে অনেক ম্যাচ খেলেছে। বিভিন্ন বিদেশি লিগ খেলেছে। তাই সে এই ফরম্যাটের কৌশলগত ব্যাপারগুলো জানে। সে-ও অসাধারণ অধিনায়ক। সবাই তার খেলার ধরন দেখে শ্রদ্ধা করে। টি-টোয়েন্টিতে তার ক্রিকেটীয় জ্ঞান এককথায় অন্যরকম।”
২.
উইন্ডিজ সিরিজ শেষ করে ঈদ পর্যন্ত যে যার মতো ছুটি কাটাচ্ছে ক্রিকেটাররা। কেউ গ্রামের বাড়িতে, কেউ বা বিদেশে। সাধারণত কোনো আন্তর্জাতিক সিরিজের পর যে ছুটি পাওয়া যায় সেই ছুটিতে কোচরা তাদের দেশে ফিরে যান। সময় দেন পরিবারকে। সেই গর্ডন গ্রিনিজ থেকে শুরু করে সর্বশেষ চান্দিকা হাতুরুসিংহে; সবাই একই পথের পথিক হয়েছেন।
কিন্তু প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচের দায়িত্ব পাওয়া রোডস যেন অনন্য নজির তৈরি করে গেলেন। তিনি ছুটিতে যাননি! তিনি সোজা উড়ে গেছেন আয়ারল্যান্ডে। যেখানে সে দেশের ‘এ’ দলের সঙ্গে সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ ‘এ’ দল!
তার এমন ভাবনায় দারুণ খুশি বিসিবি। বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলে দিয়েছেন, “আমাদের নতুন কোচ এখনও কারো সম্পর্কেই তেমন একটা জানেন না। সামনাসামনি তিনি কাউকেই দেখেননি। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজে আমাদের প্লেয়ারদের কাছ থেকে অনেক নাম শুনেছেন। তার যতটুকু ধারণা নেওয়া সম্ভব সেটা তিনি নিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে তিনি আয়ারল্যান্ডে খেলা দেখতেও চলে গেছে। সুতরাং তার সেই আগ্রহটা তার মধ্যে আছে। আগের কোচের সাথে এখন যে খুব একটা পার্থক্য হবে তা কিন্তু নয়। গত চুক্তিতে দেখেছি আমাদের দরকারের সময় কেউ ছিল না। এবার সেটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা নিশ্চিত করবো আমাদের যখন দরকার তখন যেন দলের সাথে থাকে।”
সামনে এশিয়া কাপ ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। এরপর অক্টোবরে জিম্বাবুয়ে সিরিজ। রয়েছে বিশ্বকাপও। দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে রোডসকে। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও নেই খুব বেশি। এরই মধ্যে তিনি নির্বাচকদের কাছে ৩০ জনের দল চেয়েছেন।
তাহলে আয়ারল্যান্ডে কেন গেলেন তিনি? কারণ সাবেক শ্রীলঙ্কান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে কিংবা ডেভ হোয়াটমোরের মতো তাকেও জায়গা দেওয়া হয়েছে নির্বাচক প্যানেলে। আয়ারল্যান্ডে ‘এ’ দল থেকেও তিনি কিছু মুখ চিনে রাখতে চান।
এ প্রসঙ্গে রোডসের ভাষ্য, “এরই মধ্যে টেস্ট, টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে দলের ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তো আমি চাচ্ছি মোটামুটি ২০-২২ জন ক্রিকেটারের একটা তালিকা। আমি আয়ারল্যান্ডে আরও কিছু ক্রিকেটার পাবো যাদেরকে আমি আগে থেকেই জানি। আমার জন্য যেটা প্রয়োজন, নতুনদের ব্যাপারে জেনে নেওয়া। আমি আশাবাদী কিছু ক্রিকেটার আমি আয়ারল্যান্ডে গিয়ে পাবো। ‘এ’ দলের কোচ সায়মন হেলমটের সঙ্গে সময় কাটাবো, আলাপ করবো এগুলো নিয়ে।”
অনেক দীর্ঘ সময় পর জাতীয় দলের কোচ পেয়েছে বাংলাদেশ। রোডস সেই ভাগ্যের কান্ডারি। হাতুরুসিংহের অধীনে যে বাংলাদেশকে ক্রিকেট বিশ্ব চিনেছে ‘শক্তিশালী’ হিসেবে; সেই দলকে এখন ‘চ্যাম্পিয়ন’ বানানোর মিশনে নামতে হবে স্টিভ রোডসকে।
ফিচার ইমেজ- BCB