ফাইনালের বড় মঞ্চ। শেষ ওভারে এক দলের রান প্রয়োজন ১৬। উইকেট আছেন হাফ সেঞ্চুরি করা এক ব্যাটসম্যান। তার সঙ্গী আরেক জেনুইন ব্যাটসম্যান। অন্যদিকে বোলার হচ্ছেন তুলনামূলক তরুণ, এখনো জাতীয় দলের আশেপাশে ভেড়েননি। মারকাটারি টি-টোয়েন্টির এই যুগে বাজিটা কার পক্ষে ধরবেন? বেশিরভাগই পক্ষ নেবেন ব্যাটিং দলের। আর ঠিক এখানেই বাজির দান পাল্টে দিয়েছেন সেই তরুণ বোলার।
বলছিলাম সদ্য সমাপ্ত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনালের কথা। উপরের সিনারিওটা সেই ফাইনালেরই। ম্যাচ জিততে শেষ ওভারে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। উইকেট ছিলেন হাফ সেঞ্চুরি করা সৈকত আলী। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক ‘সৈকত’, মোসাদ্দেক হোসেন। জেমকন খুলনার অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শেষ ওভারে তিনি বল তুলে দিলেন তরুণ পেসার শহীদুল ইসলামের হাতে।
প্রথম বলটা ছিল ফুল লেন্থ, সৈকত রুম পাননি শট খেলার। দ্বিতীয় বলটা করতে মাথা খাটালেন শহীদুল। ব্যাকহ্যান্ডে ছুঁড়লেন দারুণ এক স্লোয়ার, প্রায় ইয়র্কার। মোসাদ্দেক বের করলেন দুই রান। পরের ডেলিভারিও ব্যাকহ্যান্ড স্লোয়ার। তবে এবার লো ফুলটস। মোসাদ্দেক ধরতে পারলেন না গতির তারতম্য। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তুলে মেরে ধরা পড়েছেন লং অনে।
এরপর শহীদুলের সামনে সৈকত। বড় শট চাই তার। আগের দুই ডেলিভারি পড়েছে স্লোয়ার। সৈকতের ভাবনাতেও তাই। মারার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। শহীদুলের ভাবনাতে ছিল অন্য কিছু। করলেন দারুণ এক ইয়র্কার। গতি বাড়িয়ে দিয়ে খেললেন ব্যাটসম্যানের সাথে। সৈকত সেটাকে ফুলটস বানিয়ে খেলতে গিয়ে হলেন বোল্ড। আবারও গতির হেরফেরে তাল হারালো চট্টগ্রাম। পরের বলে হলো এক রান। শেষ বলে ছয় হলেও ম্যাচ জিতেছে খুলনা।
ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে নার্ভ ধরে রেখে এমন বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং করে দারুণ এক বার্তা দিলেন শহীদুল। জাতীয় দলের দরজায় আসছেন তার মতোই আরো অনেক তরুণ ক্রিকেটার, যারা গোটা টুর্নামেন্টেই আলো ছড়িয়েছেন। কেউ ব্যাট হাতে, কেউ বল হাতে, কেউ বা আবার নজরকাড়া ফিল্ডিং করে। আজকের আয়োজনে থাকছে ঘরোয়া এই টুর্নামেন্টে এই তরুণদের উত্থান আর নিজেদের প্রমাণের গল্প।
নাজমুল হোসেন শান্ত
অনেক সাধের নাজমুল হোসেন শান্ত। গত পাঁচ বছরে যে কয়জন ক্রিকেটার জাতীয় দলে খেলেছেন বা জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। বিসিবির অনেক বড় বিনিয়োগ আছে তার পেছনে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপেই তার সাথে ছিল বোর্ড। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বোর্ডের করা বিনিয়োগের প্রতিদান এবার দু’হাতে দিয়েছেন শান্ত।
এইচপি টিম, প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটসহ ঘরোয়া ক্রিকেটে শান্তর অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপেও অধিনায়কত্ব করেছেন। ব্যাট হাতে সময় ভালো না কাটলেও অধিনায়ক হিসেবে বেশ ভালো করেছেন। তার অধিনায়কত্বে দল উঠেছিল ফাইনালে। বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড প্লেসিংয়ে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তরুণ এই ক্রিকেটার। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তার কাঁধে বর্তায় মিনিস্টার গ্রুপ রাজশাহীর অধিনায়কত্ব। দলে ছিল না বড় কোনো নাম। তরুণ আর জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়া অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের মিশেলে এক দল পেয়েছেন। তা নিয়েই ছুটে চলেছেন শান্ত।
রাজশাহীকে প্লে-অফে তুলতে না পারলেও ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সময় কেটেছে তার। দুই হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে আছে একটি সেঞ্চুরি। আট ম্যাচে করেছেন টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩০১ রান। তবে শীর্ষ দুই রানসংগ্রাহক লিটন দাস-তামিম ইকবালের চেয়ে সেখানে শান্তর স্ট্রাইকরেট বেশি, ১৬৫.৭৭। হাঁকিয়েছেন টুর্নামেন্টে সবার চেয়ে বেশি ছক্কা, ২১টি – যার মধ্যে ১১টিই মেরেছেন এক ইনিংসে। ৫০ করেছেন ৩২ বলে, সেঞ্চুরি ৫৩ বলে। সহজাত স্ট্রোকমেকিং দিয়ে শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের বোলারদের চাপে রাখা, পাওয়ারপ্লের সুবিধা পুরোটা আদায় করা – এই কাজটুকু ভালোভাবেই করেছেন শান্ত।
সবচেয়ে জ্বলজ্বলে ইনিংস খেলেছেন ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে। টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরি এসেছে তারই ব্যাট থেকে। সেই ম্যাচে শান্ত হাফসেঞ্চুরি করেন ৩২ বলে। পরের পঞ্চাশ ছুঁতে তার খেলেতে হয়েছে ২১ বল। সেই ২১ বলে বাউন্ডারি থেকেই এসেছে ৪২ রান। ৫৫ বলে ১০৯ রানে আউট হন শান্ত। তবে আউট হবার আগে দলকে পৌঁছে দেন দু’শো রানের ওপারে।
একেকটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে এভাবেই শান্তকে একটু একটু করে অধিনায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে বিসিবি। আর ব্যাটসম্যান সত্ত্বার পরিচয় তো শান্ত দিয়েই যাচ্ছেন। জাতীয় দলের হয়ে যে কয়টা ম্যাচ খেলেছেন, তার ছিটেফোঁটা দেখা না গেলেও এবারের বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে বাজিমাৎ করেছেন তিনি। গেল বিপিএলেও সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো দারুণ এক অধিনায়ক আর ব্যাটসম্যান পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্ট তো সেই বার্তাই দিয়ে গেল।
ইয়াসির আলী রাব্বি
বিসিবির রাডারে থাকা আরেক ক্রিকেটার ইয়াসির আলী রাব্বি। চট্টগ্রামের এই ক্রিকেটার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন বেক্সিমকো ঢাকার হয়ে। নয় ম্যাচে ২৯৪ রান করে হয়েছেন টুর্নামেন্টের চতুর্থ সর্বোচ্চ স্কোরার। আছে দুই হাফ সেঞ্চুরি, স্ট্রাইকরেট প্রায় ১২৫। কেবল রানসংখ্যা কিংবা স্ট্রাইকরেট দিয়ে তাকে মাপাটা সমীচীন নয় বোধ করি। গোটা টুর্নামেন্টেই ছিলেন ঢাকার ‘ক্রাইসিসম্যান’। যখনই দলের বিপদ এসেছে, ব্যাটটাকে ঢাল বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি। ঢাকার প্লে-অফে ওঠার পেছনে অনেক অবদান তার। কেবল প্লে-অফই নয়, এলিমিনেটর পেরিয়ে ঢাকার কোয়ালিফায়ারে ওঠার নেপথ্যেও আছে রাব্বির ব্যাট।
প্রথম তিন ম্যাচের তিনটিতেই হারে ঢাকা। সেই তিন ম্যাচে নিষ্প্রভ ছিলেন রাব্বিও। তবে চতুর্থ ম্যাচেই ছন্দে ফেরেন রাব্বি। দলকে এনে দেন জয়ের স্বাদ। বরিশালের বিপক্ষে ৪৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়েন দলকে জিতিয়ে। পরের ম্যাচে আরো চওড়া রাব্বির ব্যাট। রাজশাহীর বিপক্ষে ৩৯ বলে ৬৭ রান। দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৭৫। ঢাকাও জিতে নেয় ২৫ রানে।
দলের প্রয়োজনে এমন বেশ কয়েকটি ইনিংসই খেলেছেন রাব্বি। ঢাকার ভঙ্গুর টপ-অর্ডারের ব্যর্থতার পর ঢাকার হয়ে কথা বলেছে রাব্বির ব্যাট। প্রায় প্রতি ম্যাচেই মিডল অর্ডারে চাপের মুখে ব্যাট করতে হয়েছে তাকে। সেখানে দেখিয়েছেন দারুণ টেম্পারমেন্ট আর ম্যাচুরিটি, খেলেছেন পরিস্থিতি বুঝে। হিটিং স্কিলের সাথে আছে ম্যাচ ফিনিশ করার ক্ষমতা। এইচপি, ‘এ’ দলকে নিয়ে বিসিবির যেসব প্রোগ্রাম আছে, সেসবের নিয়মিত মুখই রাব্বি। খেলে বেড়াচ্ছেন ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতেও। আসছে দিনে জাতীয় দলের মিডল-অর্ডারের ভরসা হয়ে ওঠার মতো যোগ্যতা তার আছে। ভরসা হয়ে উঠতে পারবেন কিনা, তার উত্তর সময়ের হাতে। তবে এই টুর্নামেন্টে চাপের মুখে যে সাবলীল ব্যাটিং তিনি করেছেন, তা নির্বাচকদের ভাবনার খোড়াক হবে নিশ্চিত।
পারভেজ হোসেন ইমন
নয় ম্যাচে ২৩৩ রান। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ রানস্কোরারদের তালিকায় দশ নম্বর। নামটা পারভেজ হোসেন ইমন। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের ওপেনার। প্লেয়ার্স ড্রাফটে তাকে ডেকেছিল বরিশাল। সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচেই করেছেন হাফসেঞ্চুরি। খুলনার বিপক্ষে এক প্রান্তে সতীর্থদের আসা যাওয়া। অন্য প্রান্তে ঠিকই অ্যাটাক করে গেছেন ইমন। চার ছক্কা ও তিন চারের মারে ৪২ বলে করেন ৫১। এরপর বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন রাজশাহীর জন্য। প্রথম ইনিংসে শান্তর অনবদ্য সেঞ্চুরিতে রাজশাহী গড়ে রান-পাহাড়। সেই রান-পাহাড় অনায়াসেই টপকে যায় বরিশাল, একমাত্র ইমনের সাবলীল ব্যাটিংয়ে। শান্তর সেঞ্চুরি ম্লান হয়ে যায় তার বিস্ফোরক ব্যাটে।
সাইফ হাসান উড়ন্ত শুরু এনে দিয়ে ফিরে গেলে উইকেটে যান ইমন। অন্য প্রান্তে অধিনায়ক তামিম ইকবালকে রেখে একের পর এক তোপ দাগান বাঁহাতি এই ওপেনার। ফরহাদ রেজা, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, কিংবা মেহেদী হাসান – কেউই বাদ যাননি তার হাত থেকে। ফুটওয়ার্কের মুন্সিয়ানা আর খুনে ব্যাটিংয়ের মিশেলে উইকেটের চারপাশেই ছুটিয়েছেন শটের ফুলঝুরি। ৪২ বলে নয় চার আর সাত ছক্কায় খেলেন ১০০* রানের ইনিংস। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশীদের মধ্যে দ্রুততম শতক।
ব্যাটের সুইট স্পটে বল মিডল করা, টাইমিং আর ফুটওয়ার্ক; তার মূল শক্তির জায়গা। তিনের মিশেলে পায়ের ওপর আসা বলগুলোতে দারুণ সক্রিয়, কব্জির মোচড়েও বেশ দক্ষ; ফ্লিক, কভার ড্রাইভেও লক্ষ্য করা গেছে এর প্রভাব। এছাড়া প্রতি শটে বডির ওয়েট শিফটিংও দারুণ। শট খেলার পর তার ফলো-থ্রু খেয়াল করলে বুঝতে পারার কথা। তবে সব ছাপিয়ে আসবে তার অ্যাটাকিং মাইন্ডসেট। সেঞ্চুরি হাঁকানো ম্যাচের আগে কোচের থেকে ‘ফ্রি’ খেলার লাইসেন্স চেয়ে নিয়েছিলেন ইমন। সেই ইনিংসই তার নির্ভীক মানসিকতার পরিচয় দেয়। সব মিলিয়ে সময়ের সাথে সাথে দারুণ এক প্যাকেজ হতে পারেন ইমন।
আকবর আলী
ইন্সটাগ্রামে তার প্রোফাইলের নাম ‘আকবর দ্য গ্রেট’। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। সতীর্থরাও তাকে ইন্সটাগ্রামের নামেই ডাকেন। ভারতের বিপক্ষে সেই ফাইনালে পরিচয় দিয়েছিলেন নিজের সিংহহৃদয়ের। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতেও দেখা মিলেছে সেই সিংহহৃদয় আকবরের। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দেখা মিলেছিল তার টেম্পারামেন্টের। এই টুর্নামেন্টে দেখা গেছে তার হিটিং স্কিল। নিজের জোনের যেকোনো ডেলিভারিকে বাউন্ডারির ওপারে আছড়ে ফেলার সক্ষমতা আছে তার। ঢাকার ইনিংসের শেষদিকে বুস্টারের কাজটা তিনি বেশ ক’বারই করেছেন।
রাব্বির বিল্ডআপের সঙ্গে তার ক্যামিওগুলো বেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে ঢাকার এগিয়ে যাওয়ায়। রাজশাহীর বিপক্ষে রাব্বির সঙ্গে গড়েন ১০০ রানের জুটি। সেই ম্যাচে ৪৫* রানের ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়েন দলকে জিতিয়ে। তবে স্লগার আকবরকে দেখা গেছে এর এক ম্যাচ পর খুলনার বিপক্ষে। ছয় নম্বরে নেমে খেলেন ১৪ বলে ৩১ রানের ইনিংস। যেখানে ছিল চারটি ছক্কা ও একটি চার। টেম্পারমেন্ট, হিটিং স্কিল, সাথে আছে উইকেটকিপিং। অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতাও আকবরের প্লাস পয়েন্ট। একদম ঘরোয়া এই টুর্নামেন্টে নয় ইনিংসে ব্যাট করে তার নামের পাশে ১৭১ রান।
তরুণ ব্যাটসম্যানদের তালিকায় আরো আসবে আফিফ হোসেন ধ্রুব, মোহাম্মদ নাঈম শেখ, মাহাদী হাসান, তৌহিদ হৃদয়, আনিসুল ইমনদের নাম। প্রথম তিনজন ইতিমধ্যে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। হৃদয়ও ঘরোয়া সার্কিটের নিয়মিত মুখ। ধারাবাহিক না হলেও রান পেয়েছেন তিনজনই। প্রথমবার বড় মঞ্চে এসে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছেন আনিসুল ইমনও। রাজশাহীর হয়ে আট ম্যাচে দুই হাফসেঞ্চুরিতে করেছেন ১৯৯ রান।
এবার নজর দেয়া যাক বোলারদের দিকে। পুরো টুর্নামেন্টেই ছন্দে ছিলেন তরুণ পেসাররা। বিশেষ করে মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখা গেছে তার চেনা রুপে। হয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। তার সাথে জুটি বেঁধেছিলেন আরেক বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম। চট্টগ্রামের হয়ে দুই বোলারই আগুন ঝরিয়েছেন। এই তালিকায় আরো আছেন খুলনার শহীদুল-হাসান মাহমুদ, রাজশাহীর মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধ, ঢাকার শফিকুল ইসলাম। বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে দারুণ বল করা সুমন খানের দিকেও নজর ছিল। তবে এই টুর্নামেন্টে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি বরিশালের হয়ে খেলা এই ডানহাতি পেসারকে।
মুস্তাফিজুর রহমান-শরীফুল ইসলাম
মুস্তাফিজ ফুরিয়ে যাননি এখনো, তার এখনো আরো অনেক কিছু দেয়ার বাকি। এই টুর্নামেন্টে এই কথাটাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন বাঁহাতি এই পেসার। জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন পাঁচ বছরের বেশি। অভিজ্ঞতার ঝুলিও তাই ভর্তি। তবে মাঝে তার ছন্দে বিশাল পতন হয়েছিল। সেই ছন্দ এবার ফিরে পেয়েছেন বল হাতে। ৬.২৫ ইকোনোমিতে ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ২২ উইকেট। তার চেয়ে স্বস্তির খবর হলো আগের ধার ফিরেছে তার কাটারে। কাটারগুলো গ্রিপ করেছে উইকেটে। বিশেষ করে পুরনো বলে দেখিয়েছেন ঝলক। ব্যাটসম্যানরাও ভুগেছেন তাকে খেলতে। প্রতি ওভারেই চেষ্টা করেছেন বোলিংয়ে ভ্যারিয়েশন রাখতে। বাউন্সার দিয়েও উইকেট পেয়েছেন।
চট্টগ্রামকে ফাইনালে তুলতে লিটন-সৌম্য জুটি ছিল অনবদ্য, আর বোলিংয়ে মুস্তাফিজের সঙ্গে শরীফুল। দু’জনই বাঁহাতি পেসার, দু’জনকেই দারুণ ব্যবহার করেছেন অধিনায়ক মিথুন। ১০ ম্যাচে ১৬ উইকেট নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট, অধিনায়ক-কোচের ভরসার প্রতিদান দিয়েছেন শরীফুল। নতুন বলে দুর্দান্ত তিনি। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে নতুন বলে তার বিপক্ষে বেশ ভুগেছিলেন ভারতের দুই ওপেনার। এই টুর্নামেন্টেও নতুন বল হাতে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিয়েছেন। শরীরী ভাষা, বলের গতি, উপস্থিত বুদ্ধি আর আগ্রাসী মানসিকতা। একজন আদর্শ পেসারের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, সবই আছে শরীফুলের।
ঢাকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে রান বোলিং ফিগার ২/১০। ওপেনার তানজিদ হাসান তামিমকে ফিরিয়েছিলেন ম্যাচের শুরুতেই। নতুন বলে ছোট সুইংয়ে কুপোকাত হয়েছিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় শিকার ছিলেন সাব্বির রহমান। সেই ওভারে শরীফুলের সব কয়টি বলই খেলেন সাব্বির। তবুও ওভারের শেষ বলে গতির পরিবর্তনটা ধরতে পারেননি তিনি। প্রথমে টানা এক জায়গায় বল করে ডট আদায় করেছেন, শেষ বলটা করেছেন স্লোয়ার। চাপে পড়ে মারতে গেছেন সাব্বির, সেখানেই মাইন্ডগেমে জিতে গেছেন শরীফুল। টুর্নামেন্টে উইকেটশূন্য ছিলেন কেবল দুই ম্যাচে। মুস্তাফিজের সঙ্গী হওয়ার দৌড়ে কতটা এগিয়ে গেলেন, সেটা এখনো বোঝা বাকি। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জাতীয় দলের জার্সিতে এই দুই পেসারকে জুটি বাঁধতে দেখে রোমাঞ্চিতই হবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
শহীদুল ইসলাম
ডেলিভারিতে এক্সপ্রেস বোলারদের গতি নেই। দেখতেও শান্ত। কিন্তু আছে টানা একই লাইনলেংথে বল করে যাওয়ার সক্ষমতা। অস্ত্রাগারে আছে কয়েক রকম ইয়র্কার, পেসের চেঞ্জটা করতে পারেন দারুণ, স্টক ডেলিভারির সাথে করতে পারেন ব্যাকহ্যান্ড স্লোয়ারও। নতুন বল-পুরনো বলের ব্যবহারেও পটু। পাওয়ারপ্লে কিংবা ডেথ ওভার – দারুণ ধারাবাহিক। লেখার শুরুতেই বলেছি তার কথা। খুলনার হয়ে খেলা ডানহাতি পেসার শহীদুল ইসলাম আট ম্যাচে নিয়েছেন ১৫ উইকেট।
প্রথম ম্যাচেই করেছেন বাজিমাৎ। বরিশালের বিপক্ষে চার ওভার বল করে মাত্র ১৭ রান দিয়ে নেন চার উইকেট। এরপর উইকেট পাননি কেবল এক ম্যাচে। প্রতি ম্যাচেই মাপা লাইনলেংথ আর গতির ভ্যারিয়েশন রেখে বল করে গেছেন। খেলতে পারেননি দুটি ম্যাচ। প্রথমটিতে বাদ পড়েছিলেন মাশরাফিকে জায়গা করে দিতে, দ্বিতীয়টি খেলতে পারেননি বাবার মৃত্যুতে। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেন শহীদুল, পিতৃবিয়োগের শোক বুকে নিয়ে নেমেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে। ফাইনালের সেই বীরত্বের কথা তো লেখার শুরুতেই পড়েছিলেন। খুলনাও চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেই জয় উৎসর্গ করেছে শহীদুলের বাবাকে। মাশরাফি-রিয়াদরাও মাঠে নেমেছিলেন শহীদুলের জন্য জেতার পণ নিয়ে। এমন বুদ্ধিদীপ্ত বোলার জাতীয় দলের পেস ব্যাটারির সদস্য হতে চাইলে বেশ স্বাস্থ্যকর একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হাসান মাহমুদ
আলোচনায় এসেছিলেন গেল বিপিএলে ঢাকা প্লাটুনের জার্সিতে খেলে। ১৩ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। টানা বল করতে পারেন ১৪০+ গতিতে। জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেকও হয়ে গেছে তার টি-টোয়েন্টিতে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চলতি বছরের মার্চে খেলেছেন ক্যারিয়ারের একমাত্র টি-টোয়েন্টি। সেই ম্যাচে চার ওভার বল করলেও উইকেট পাননি। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতেও নজর ছিল তার দিকে। নয় ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। তাক লাগানো বোলিং স্পেল না থাকলেও গতির ঝড়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন ডানহাতি এই পেসার। চেষ্টা করেছেন ভ্যারিয়েশন রাখারও, ব্যাকহ্যান্ড স্লোয়ারটা তার শক্তির জায়গা।
তরুণ বোলারদের এই তালিকায় আরো আছেন মুকিদুল ইসলাম, শফিকুল ইসলামরা। স্পিনারদের দিকে তাকালে নাহিদুল ইসলাম ও ঢাকা লিগের নিয়মিত মুখ রবিউল ইসলাম। নাহিদুল প্রায় সবকয়টি ম্যাচেই চট্টগ্রামের হয়ে বল হাতে শুরু করেছেন। ১১ ম্যাচে ১০ উইকেট তার। অন্যদিকে আট ম্যাচে ঢাকার রবিউলের আছে ১৩ উইকেট; যদিও তরুণ ক্রিকেটারদের তালিকায় তাকে রাখাটা ঠিক সমীচীন নয়। পেসারদের আধিপত্যের এই টুর্নামেন্টে স্পিনারদের পতাকা তুলে ধরেছিলেন এই দু’জনই। সেই ভাবনা থেকেই রবিকে স্মরণ করা। টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং ফিগারটাও যে তার।
আলাদা করে বলতে হবে একজনের কথা। খুলনার বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শামীম হোসেন পাটোয়ারী। আউটফিল্ড কিংবা সার্কেলের মাঝে ছিলেন উড়ন্ত, বাজপাখির মতো দুরন্ত। এত দারুণ ফিল্ডিং করেছেন প্রতি ম্যাচে, বিশেষভাবে তার কথা বলতেই হতো। দশ ম্যাচে ধরেছেন ১৩টি ক্যাচ, তার থেকে বড় কথা, প্রতি ম্যাচে অন্তত ১০-১৫টি নিশ্চিত রান বাঁচিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে। দারুণ ফিটনেসের অধিকারী শামীম মাঠে দুরন্ত গতিতে দৌড়ান, শরীরও ফ্লেক্সিবল, দারুণ অ্যাথলেটিক। অফস্পিন করেন, মিডল অর্ডারেও স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাটিং করেন।
সিনিয়রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছেন তরুণ ক্রিকেটাররাও। এই বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি সাক্ষী হয়ে রইলো তরুণদের আধিপত্যের। দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত কাণ্ডারি কারা হতে পারেন, তার একটা স্বচ্ছ ধারণাও দিয়ে গেল এই টুর্নামেন্ট। কনকনে শীতের এই মৌসুমেও গোটা টুর্নামেন্টেই বয়েছে তারুণ্যের দাপুটে হাওয়া, বেজেছে তারুণ্যের জয়গান। দেশের ক্রিকেটের জন্য, ক্রিকেটের অনাগত দিনগুলোর জন্য দিয়ে গেছে বসন্তের আগমনী বার্তা। এখন প্রয়োজন যথাযথ পথপ্রদর্শন, প্রয়োজন তাদের যত্নে রাখা। প্রয়োজন তাদের আগলে রেখে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এই ক্রিকেটারদের সদিচ্ছা আর ত্যাগ তিতিক্ষা।
এই মঞ্চে আলো ছড়ানো তরুণ ক্রিকেটাররা একদিন বিশ্ব শাসন করবেন, সেই সুদিনের প্রত্যাশায় বুক বেঁধে থাকাটাই এই টুর্নামেন্টের সম্বল। ২০২০ অন্তত বুঝিয়ে দিল, বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুনের কেতন ওড়ানোর সময়টা বুঝি হয়েই এলো!