১.
লেখাটা শুরু করার আগে একটা ক্রিকেট ম্যাচ থেকে ঘুরে আসা যাক।
১৯৩৭ সালের অ্যাশেজ। ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে মোটামুটি খোঁজ রাখেন, এমন যে কেউই এই সিরিজটা সম্পর্কে জানেন। এই সিরিজেই ক্যাপ্টেন্সি পান স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, এবং প্রথম দুই ম্যাচ হেরে চলে যান খাদের কিনারে। সেখান থেকে পরের তিন ম্যাচ জেতেন, সেই সাথে জিতে নেন সিরিজও। এটাই সেই সিরিজ, যে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ব্যাটিং অর্ডার উল্টো করে নামিয়েছিলেন ডন, তার এই রণকৌশলকে আজও মনে করা হয় সর্বকালের সেরা কৌশল। সেই টেস্টে কী ঘটেছিল, তা জানতে পাঠক এই আর্টিকেলটা পড়ে নিতে পারেন। আপাতত আমরা সিরিজের শেষ টেস্টে ফিরি।
শেষ টেস্ট হচ্ছিল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ব্র্যাডম্যান, ম্যাককেব আর ব্যাডককের সেঞ্চুরিতে রানের পাহাড়ে উঠে যায় অস্ট্রেলিয়া। স্কোর যখন ৫৪৪, এবং ব্যাটিংয়ে যখন রস গ্রেগরি নামের ব্যাটসম্যান, তখন বল করতে এলেন কেন ফার্নেস নামের একজন বোলার। সেদিন চমৎকার খেলছিলেন গ্রেগরি, করেছিলেন ৮০ রান। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটা যখন সময়ের ব্যাপারমাত্র, তখনই আউট হয়ে গেলেন তিনি। ফার্নেসের বলে হেডলি ভেরিটির হাতে ক্যাচ দিয়ে বসলেন।
ক্রিকেটে এরকম আউট হরহামেশাই হয়, তা নিয়ে আলাদাভাবে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও পড়ে না তেমন। কিন্তু এই তিনজন একটা জায়গায় সম্পূর্ণ আলাদা, তিনজনই এসে মিলে গেছেন একটা বিন্দুতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন তিনজনই, এবং তাদের কেউই আর যুদ্ধ থেকে জীবিত ফিরতে পারেননি।
সবার প্রথমে মারা যান পাইলট অফিসার কেন ফার্নেস, ১৯৪১ সালের ২০ অক্টোবর অক্সফোর্ডশায়ারের আকাশে মৃত্যু ঘটে তার। সবার শেষে মারা যান ক্যাপ্টেন হেডলি ভেরিটি, ১৯৪৩ সালের ৩১ জুলাই সিসিলির এক রণাঙ্গনে মারাত্মক আহত হওয়ার পর মারা যান। আর রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের পাইলট অফিসার রস গ্রেগরি মারা যান ১৯৪২ সালের ১০ জুন, তার বিমান বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশের ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে!
২.
রস গ্রেগরির জন্ম হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তার পুরো নাম রস জেরাল্ড গ্রেগরি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ১৯৩৩ সালে, পুরো ক্যারিয়ারে ৩৩ ম্যাচ খেলে রান ১৮৭৪, সেঞ্চুরি ১টা, হাফ সেঞ্চুরি ১৭টা। ২ টেস্টের ক্যারিয়ারে করেছেন ১৫৩ রান, গড় ৫১। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, শেষ ইনিংসে ৮০ রান করা সত্ত্বেও পরের ইংল্যান্ডগামী দলে জায়গা হয়নি তার। পরে হয়তো জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও পেতে পারতেন, কিন্তু তার আগেই জীবনের উইকেট নিয়ে নিল ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ নামের বোলার।
৩.
১৯৪২ সালের ১০ জুন আসলে কী ঘটেছিল?
আসলে যে কী ঘটেছিল, তা নিশ্চিত করে বলার আর কোনো উপায় নেই। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আর সেই সাথে টুকরো টুকরো ঘটনা জোড়া দিয়ে পুরো ছবিটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।
সেদিন সকালে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যেই আকাশে শুরু হলো দুই যুদ্ধবিমানের ধাওয়া, সামনের বিমানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল পিছনের বিমান। সামনের বিমানে ছিলেন রস গ্রেগরি। ধারণা করা হয়, বার্মার আকিয়াব বন্দরের একটি জাপানি স্থাপনায় বোমা হামলা করে ফেরার পথে এক জাপানি বিমানের হামলার শিকার হন রস।
নিচে দাঁড়িয়ে দুই বিমানের এই কাণ্ড দেখছিল কৌতূহলী মানুষজন। হঠাৎই জাপানি বিমান থেকে একটা গোলা আঘাত হানল রসের বিমানের গায়ে। আহত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল বিমানটা, তারপর গায়ে আগুন আর ধোঁয়া নিয়ে পড়তে শুরু করল ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন এলাকার দিকে।
এবার প্রত্যক্ষদর্শীদের টনক নড়লো। আতঙ্কিত অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়াতে শুরু করলো তারা, ততক্ষণে পুরোপুরি ভূপাতিত হয়েছে রসের বিমান। যেখানে বিমানটা ধ্বংস হলো, তার নাম ছিল ‘বগামারা চর’। বিমান ধ্বংসের পরে জায়গাটার নাম হয়ে যায় ‘জাহাজপড়া চর’। শুধু যে লোকের মুখে ফিরতে ফিরতে এরকম নাম হয়ে গেল, তা-ই নয়। ময়মনসিংহ জেলা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের ফাইলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে রীতিমতো স্থায়ী রূপ পেয়ে গেল নামটা।
ভূপাতিত হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে এগিয়ে এলো মানুষজন। বিমানের মূল অংশ যেখানে পড়েছিল, সেখানে বিশাল এক গর্ত চোখে পড়লো তাদের। পানির রঙ কোথাও নীল, আবার কোথাও বা লাল। পানির নিচ থেকে বুদ্বুদ উঠে আসছে তখনো, ছোট ছোট বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যাচ্ছে।
ঘটনার ঘন্টাতিনেক পরে বাহিনী নিয়ে অকুস্থলে হাজির হন ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তার পুরো নাম যে কী ছিল, তা জানা যায়নি, তবে ‘মিস্টার ক্রেক’ নামেই পরিচিত ছিলেন। তার আদেশে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে তার বাহিনী, বিমানের টুকরো আর মৃত পাইলট ও তার সঙ্গীদের অবশিষ্টাংশ নিয়ে ময়মনসিংহে ফিরে যান তিনি।
সে বছর শীতকালে যখন ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে গেল, তখন একটা লোহার বড় গোল পাত্রের মতো একটা জিনিস বেরিয়ে এলো পানির নিচ থেকে। প্রথমে কেউই বুঝে উঠতে পারেনি, জিনিসটা কী। গ্রামের অনেকে গবাদিপশু বেঁধে রাখত তাতে, মনের আনন্দে সেখানে খেলা করতো বাচ্চারা। এই পাত্রের খবর জানতে পেরে আবার পুলিশ আসে, এবং তাদের থেকেই জানা যায়, নিরীহদর্শন পাত্রসদৃশ জিনিসটা আসলে ভয়ঙ্কর এক বোমা। গ্রামবাসীদের সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বোমাটার। বোমার ঝাঁকুনিতে পুরো গফরগাঁওই যেন কেঁপে উঠেছিল সেদিন।
৪.
রস গ্রেগরির মৃত্যুরহস্যের কিনারা করেন ডেভিড ফ্রিথ নামের এক অনুসন্ধিৎসু ব্রিটিশ সাংবাদিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন রস। পরবর্তীতে সেই ডায়েরি এক বন্ধুর মাধ্যমে নিজের দেশে পাঠাতেও সক্ষম হন তিনি। অনেক বছর পরে এক নিলামের দোকানে সেই ডায়েরির সন্ধান পান ফ্রিথ। এটা কি শুধুই কাকতাল? কে জানে! সম্ভবত জীবন নদীর ওপার থেকে রস নিজেই চাইছিলেন, এবার তার মৃত্যুরহস্যের কিনারা হোক। না হলে ডায়েরিটা একদম ফ্রিথের হাতেই পড়বে কেন?
নিলামে ডায়েরিসহ রসের সাথে সম্পর্কিত সব জিনিসপত্র কিনে নেন ফ্রিথ। এরপরে রসের সকল আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করেন একে একে, সাক্ষাৎকার নেন তাদের। আর সেই সাথে মিলে যায় রসের দুর্লভ সব ছবি। সেই সব গবেষণার ফলাফল, ‘দ্য রস গ্রেগরি স্টোরি’ নামের দুই খণ্ডের ঢাউশ এক বই। গবেষণার এক পর্যায়ে বাংলাদেশেও এসেছিলেন ফ্রিথ। রসের বিমান কোথায় যে বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেটা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না তিনি। ফাইলে লেখা ছিল, বিমানটা বিধ্বস্ত হয়েছিল ভারতবর্ষের আসামে। খুঁজতে খুঁজতে জাহাজপড়া চরের খবর জানতে পারেন ফ্রিথ। সেখান থেকেই জানা যায় রস গ্রেগরির মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে।
৫.
প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা বলা হয়েছে উপরে। তাদেরই একজন আবুল হাশেম, ১৯৪২ সালে তিনি গফরগাঁও ইসলামিয়া হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বিমানের ধ্বংসাবশেষের সাথে চামড়ার ব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল একটা চিঠি। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠি বাংলায় অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন তারই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। চিঠিতে লেখা ছিল,
‘তুমি কবে দেশে আসবে? তোমার দুই ছেলেমেয়ে শুধু তোমাকে খোঁজে, ফুল ছেঁড়ে, পাখি দেখলে বাগানে ছুটে যায়। আর শুধু তোমার কথা বলে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসো।’
রস গ্রেগরির আর নিজের বাড়িতে, নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে আর ফেরা হয়নি। তিনি ঘুমিয়ে আছেন বাংলাদেশের কোনো এক গণকবরে। বাংলার মাটি মমতার সাথে আগলে রেখেছে এই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারকে।