১.
এক যুগের বেশি সময় ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পর ২০১৭ সালের ২৫ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল ডেভিড মালানের। ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পরিচিত মুখ মালান নিজের অভিষেক ম্যাচেই বাজিমাত করেছিলেন। অভিষেক ইনিংসের দ্বিতীয় বলে ক্রিস মরিসকে ছয় হাঁকিয়ে রানের খাতা খোলা মালান কার্ডিফে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে খেলতে নেমে মাত্র ৪৪ বলে ১২টি চার এবং দু’টি ছয়ের মারে ৭৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ইনিংস খেলে দলের জয়ে বড় অবদান রাখার দরুন ম্যাচসেরার পুরস্কারও জেতেন তিনি।
ইংল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ইতঃমধ্যে অবশ্য টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল তার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্ট সিরিজে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। দুই ম্যাচে তার ব্যাট থেকে সর্বসাকুল্যে ৩৫ রান এসেছিল। এরপর ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চার ইনিংসে দু’টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের মিডল-অর্ডারে ব্যাট করার টিকেট পেয়ে যান তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত ২০১৭-১৮ মৌসুমের অ্যাশেজ বেশ ভালোই কেটেছিল মালানের। অ্যাশেজে নিজের প্রথম ইনিংসে ৫৬ রানের ইনিংস খেলার পর পার্থে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতক হাঁকিয়ে ১৪০ রান করেন। ঐ সিরিজে তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৮৯ রান করেছিলেন। অ্যাশেজের পর পরবর্তী পাঁচ টেস্টে মাত্র একটি অর্ধশতক হাঁকালে টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। ১৫ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৮ সালের পহেলা আগস্ট। এরপর আর সাদা পোশাকে জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি।
২.
রানখরার কারণে টেস্ট ক্রিকেটের অঘোষিত সমাপ্তি ঘটলেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ঠিকই ছন্দে ছিলেন মালান। অভিষেক ম্যাচে ৭৮ রানের ইনিংস খেলার পর নিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নিউ জিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে চার ম্যাচ খেলে তিনটিতে অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন। এক ম্যাচে দশ রান করে রানআউটের শিকার হয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ ম্যাচের চারটিতে অর্ধশতক হাঁকানো মালান নিজের ৬ষ্ঠ ম্যাচ খেলার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন প্রায় দুই বছর। এই সময়ে ইংল্যান্ড নয়টি টি-টোয়েন্টি খেললেও এক ম্যাচেও সুযোগ পাননি তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। পাঁচ ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম চার ম্যাচ খেলে যথাক্রমে ১১, ৩৯, ৫৫ এবং ১০৩* রানের ইনিংস খেলেছিলেন। অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংস খেলার পথে মাত্র ৪৮ বলে শতক পূর্ণ করেছিলেন তিনি, যা ইংল্যান্ডের হয়ে দ্রুততম টি-টোয়েন্টি শতকের রেকর্ড। নিজের শেষ ইনিংসে অপরাজিত ১০৩ রান করার পরও পরবর্তী ম্যাচে দলে জায়গা হয়নি তার। শেষ চার ম্যাচের মাঝে খেলেছিলেন মাত্র এক ম্যাচ।
৩.
ডেভিড মালান মাত্র নয়টি টি-টোয়েন্টি খেলেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের র্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিলেন। তিনি ১০ ম্যাচে একটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫২.১১ ব্যাটিং গড় এবং ১৫৩.৭৭ স্ট্রাইকরেটে ৪৬৯ রান সংগ্রহ করেছেন। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের দুর্দান্ত এই ব্যাটসম্যান ওডিআই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র একবার। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের একমাত্র ওডিআইতে ২৪ রান করার পর দ্বিতীয়বার আর সুযোগ পাননি তিনি।
শতক হাঁকানোর পরের সিরিজেই তার বাদ পড়া নিয়ে কথা চালাচালি ঠিকই হয়েছিল। প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন কোচ এবং অধিনায়ক ইয়োন মরগান। উত্তরে তিনি বলেন,
“মালান অসাধারণ একজন ক্রিকেটার। তবে সে সাদা বলের ক্রিকেটে অন্যদের সফলতার বলি হয়েছে। ডেভিড তার প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছে, সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেছে। দলে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তুমুল লড়াই হচ্ছে, যা দলের জন্য ভালো লক্ষণ।”
৪.
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করার পরও দলে জায়গা না পেলেও থেমে যাননি ডেভিড মালান। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে রাখছেন পরবর্তী সুযোগের জন্য। তবে বেশ কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটার এবং বারবার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে না পারা ক্রিকেটার দলে জায়গা পেলেও মালানের বাদ পড়ায় কানাঘুষো কম হয় না।
অনেকেই অনুমান করেছে, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৩* রানের ইনিংস খেলার পথে দলীয় ইনিংসের শেষ বলে রানআউটের ঝুঁকি থাকার কারণে বাড়তি রান নেওয়ার চেষ্টা না করাতেই অধিনায়কের ‘গুড বুক’ থেকে কাটা পড়েন মালান। অধিনায়ক মরগানের কথাতেও সেটি স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন,
“আমাদের ছেলেরা অপরাজিত থাকার জন্য যদি শেষ বলে না দৌড়াতে চায়, তবে সেখানে ভাবার অনেক কিছুই আছে।”
৫.
ডেভিড মালানের কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল মিডলসেক্সের হয়ে ২০০৬ সালে। এরপর থেকে একটানা ২০১৯ সাল পর্যন্ত মিডলসেক্সের হয়ে খেলে আসছেন তিনি। ২০১৮ সালে তাকে তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার দুই মৌসুমের মাথায় দীর্ঘদিনের ক্লাব মিডলসেক্সকে বিদায় জানিয়ে নতুন গন্তব্য হিসাবে ঠিক করেন ইয়র্কশায়ার। সবকিছু ঠিক থাকলে এই মৌসুমেই নতুন দলের হয়ে খেলবেন তিনি।
অধিনায়ক ক্লাব পরিবর্তন করার পর দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যান নিক কম্পটন সার্কাজম করে টুইট করেন, “Good luck Yorkshire.”
পরে অবশ্য নিজের টুইটটি মুছে ফেলেছিলেন তিনি। এটা সত্যি যে, মিডলসেক্সে তিনি সবার পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন না। ইংল্যান্ডের সীমিত ওভারের অধিনায়ক ইয়োন মরগানও মিডলসেক্সে তার সতীর্থ।
দীর্ঘ ১৩ বছর মিডলসেক্সের হয়ে খেলার পর দল পরিবর্তন করেন ডেভিড মালান। নতুন কোচ স্টুয়ার্ট ল’র সাথে মতানৈক্য এবং দু’জনের পরিকল্পনায় সামঞ্জস্য না হওয়ার কারণেই তিনি দলত্যাগ করেন। পুনরায় টেস্ট দলে জায়গা করে নিতে এবং নিজের খেলা উপভোগ করার জন্য তিনি ইয়র্কশায়ারে যোগদান করেন।
৬.
১৯৮৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। ইংল্যান্ডের রোহ্যাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ডেভিড জোহানেস মালান। বাঁহাতি এই টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানের ১৯ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লাব বোল্যান্ডের হয়ে অভিষেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেন। তার বাবা ডেভিড জোহানেস মালানের জন্মস্থান এবং ক্রিকেটের হাতেখড়ি দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়াতে তার অভিষেকও সেখানে ঘটে। পাঠকেরা হয়তো একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন, ডেভিড মালান এবং তার বাবার নাম একই। না, এখানে কোনো ভুল হয়নি। তাদের দু’জনের নাম একই।
বোল্যান্ডের হয়ে এক মৌসুম খেলার পর কাউন্টি ক্লাব মিডলসেক্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। ২০০৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগের ক্রিকেটে ৫১.০০ ব্যাটিং গড়ে ৯৬৯ রান করার পর ২০০৮ সালের জুনে মিডলসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেকেই খেলেন অপরাজিত ১৩২ রানের ইনিংস। তিনি ২০০৮ সালের ৮ই জুলাই টি-টোয়েন্টি কাপে ল্যাঙ্কাশায়ার লাইটিংয়ের বিপক্ষে ৫৪ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে তিনি এই ইনিংস খেলেছিলেন, ছয়ে ব্যাট করে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে শতক হাঁকানোর কৃতিত্ব সেটাই প্রথম। ২০১৮ সালে ড্যানিয়েল ক্রিস্টিয়ান ছয়ে ব্যাট করে শতক হাঁকানোর আগে তিনি ছিলেন একমাত্র।
৭.
বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের কাছেও বেশ পরিচিত নাম ডেভিড মালান। তিনি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে বরিশাল বুলসের হয়ে বিপিএল খেলেন। মাঝখানে খুলনা টাইটান্সের হয়ে খেলার পর সর্বশেষ আসর খেলেছেন কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের হয়ে। কুমিল্লার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি ১১ ম্যাচে একটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৯.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৪৪৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য আদর্শ এই ব্যাটসম্যান এখন পর্যন্ত ২০০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে পাঁচটি শতক এবং ৩০টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৩৩.৩১ ব্যাটিং গড়ে ৫,৪৩০ রান করেছেন। পার্ট-টাইম বোলার হিসাবে নিজের লেগ স্পিনে নিয়েছেন ২৩ উইকেট। লিস্ট-এ ক্রিকেটে ১৪৯ ম্যাচে ১০টি শতক এবং ২৫টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪১.৪১ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৫,১৩৫ রান। এই ফরম্যাটে উইকেট সংখ্যা ৪০টি।
পুনরায় ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে ফেরার লক্ষ্যে ইয়র্কশায়ারের সাথে চার বছরের চুক্তিবদ্ধ হওয়া মালান এখন পর্যন্ত ১৮৮টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ২৫টি শতক এবং ৫৯টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। ৩৭.৪৩ ব্যাটিং গড়ে মোট ১১,২২৯ রান সংগ্রহ করেছেন।
ডেভিড মালান জানেন, দলে জায়গা করে নিতে হলে রান করতে হবে। দলকে ম্যাচ জেতাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নয়টি টি-টোয়েন্টিতে ৫৭-এর বেশি ব্যাটিং গড় এবং ১৫০-এর বেশি স্ট্রাইকরেটে রান করার পরও দল থেকে কেন বাদ পড়েছেন, সেটা জানেন না। তবে তিনি সেই উত্তর না খুঁজে নিজেকে তৈরি করছেন পরবর্তী সুযোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে৷