সাবেক থেকে শুরু করে দেশের বর্তমান সুপারস্টার ক্রিকেটাররাও মানেন, মোহাম্মদ আশরাফুল দেশের ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেলেন ফিক্সিং কেলেংকারিতে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) নিষিদ্ধ ফ্র্যাঞ্চাইজি ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের হয়ে আশরাফুলের ম্যাচ পাতানো প্রমাণ হতেই ক্ষয়ে যেতে বসলো ইতিহাসের এক স্বরূপ সন্ধানের মুখবন্ধ। পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞার খড়গে তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো স্বপ্ন দেখাটাই বন্ধ রাখতেন। কিন্তু শূন্য থেকে শিখরে উঠে আসা আশরাফুল হাল ছাড়েননি। নিজের ভুল বুঝেছেন, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন ক্রিকেটও।
যে ৩০ বছর বয়সে ক’দিন আগেও দেশের ক্রিকেটে ক্যারিয়ারের অন্তিম সূর্য দেখতো ক্রিকেটাররা, আশরাফুল এই ৩৪ বছর বয়সে এসেও খেলে যাচ্ছেন কেবলই আবারও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর তাগিদে। যখন ঘরোয়া লিগেও নিষিদ্ধ ছিলেন, তখন দেশ বিদেশের আনাচ-কানাচে, এমনকি গ্রামেগঞ্জে গিয়েও খেলেছেন। কেবলই নিজেকে ফিট রাখতে, আত্মার অভ্যেসটা ধরে রাখতে। সেই আশরাফুল গেল দুই বছরে ফিরেছেন মূলধারার ক্রিকেটে। খেলেছেন জাতীয় লিগ, ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের মতো দেশের প্রথম সারির টুর্নামেন্টগুলোতে।
কিন্তু অপেক্ষা ছিল বিপিএলের। যে টুর্নামেন্ট দিয়ে তার জীবনের মোড় ঘুরেছিল, সেখানেই আবার ফিরলেন, ঠিক পাঁচ বছর পর। ২৮ অক্টোবর, রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বিপিএলের প্লেয়ার্স ড্রাফট অনুষ্ঠানে ‘বি’ ক্যাটাগরি থেকে আশরাফুলকে নিজেদের দলে নাম লিখিয়েছে চিটাগং ভাইকিংস।
সাবেক জাতীয় দলের এই অধিনায়ক যা শাস্তি পাওয়ার পেয়ে গেছেন। এবার অপেক্ষা, যে ক’টা দিন পাবেন ক্রিকেটের মাঝে ডুবে থাকবেন, চেষ্টা করে যাবেন জাতীয় দলে ফেরার। বিপিএলে দল পাওয়ার পরপরই তিনি মুখোমুখি হয়েছেন রোর বাংলা-র। সেখানে জানিয়েছেন, অপেক্ষা আবারও সেই গ্যালারিভরা দর্শকের সামনে নিজেকে মেলে ধরার।
আবারও বিপিএলে ফেরা। কতটা স্বস্তি পাচ্ছেন?
হ্যাঁ, এটার জন্য পাঁচ বছর খেলার বাইরে ছিলাম। আসলে আন্তর্জাতিক ম্যাচের পর বিপিএল টুর্নামেন্টই তো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট। টেলিভিশনে প্রচার হয়, বিদেশি ক্রিকেটাররা আসে; সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট। তো এখানে আবার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট। যেহেতু সুযোগ পেয়েছি, তখন চেষ্টা করবো ম্যাচ খেলতে পারলে ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য। কারণ আমি এখনও স্বপ্ন দেখি জাতীয় দলে খেলবো, তো সেখানে সুযোগ পেতে হলে এই ধরণের প্ল্যাটফর্ম খুব দরকার। এখানে ভালো খেললে বাকি প্রশ্ন আর থাকে না, সিলেকশনের ব্যাপারটাও সহজ হয়ে যায়।
মাত্র ক’দিন আগেই পাঁচ বছরের পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা কাটিয়েছেন। বিপিএলে দল পাবেন কি পাবেন না, মনে এমন কোনো শঙ্কা ছিল?
দল যদি না পাইতাম, তাহলে তো কিছু করার ছিল না (হাসি)। তবে হ্যাঁ, ওই আত্মবিশ্বাসটা ছিল যে আমি দল পাবো, অবশ্যই কোনো না কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি আমাকে দলে নেবে। ধন্যবাদ, চিটাগং ভাইকিংসকে। সত্যি বলতে, প্লেয়ার্স ড্রাফট হওয়ার আগেই আমি ভাবছিলাম যদি এই দলে সুযোগ হয় তাহলে ভালো হবে। তাহলে হয়তো সুযোগটা বেশি পাবো।
বিপিএলের অন্ধকার একটা দিকে আপনার নাম জড়িয়ে গেছে। সেই বিপিএলেই আবার ফেরা। বাড়তি কোনো চাপ মনে হচ্ছে?
চাপ হলে আর কী করা যাবে। এই চাপ নিয়েই তো এগোতে চাচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি।
গেল দুই বছরে জাতীয় লিগ খেলেছেন, প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ খেলেছেন। কেবল তাই নয়, যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই খেলছেন। কিন্তু বিপিএলের রোমাঞ্চ তো অন্যরকম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতো গ্যালারি ভরা দর্শক। হয়তো অনেক মিস করেছেন। আবার সেই সুযোগ সামনে, কতটা রোমাঞ্চিত আপনি?
অবশ্যই, সেই জিনিসটার জন্যই তো এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরো গ্যালারিভর্তি মানুষ থাকবে, তাদের মাঝখানে পারফর্ম করবো। হয়তো এটার জন্যই এই পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলিনি কিংবা তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলিনি। কিন্তু দেশের আনাচে-কানাচে যেখানে সুযোগ পেয়েছি, খেলার চেষ্টা করেছি। যেন এই মানুষগুলোর সামনে খেলতে পারি। যখনই ঢাকার বাইরে খেলতে গিয়েছি, যখন দেখেছি ৮-১০ হাজার দর্শক আসছে খেলা দেখতে; ওই আনন্দটা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তো ওটাই আর কি, আবারও অনেক মানুষের সামনে খেলার সুযোগ পাবো। আবার অত তাড়াতাড়ি কিছু ভাবতেও চাই না। দেখি কী হয়।
নিষেধাজ্ঞা কাটানোর পর থেকেই মূলধারার ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। তো সবমিলিয়ে বিপিএলের জন্য নিজেকে কতটা প্রস্তুত করতে পেরেছেন?
গেল দুই বছরের চেয়ে আমি অনেক ফিট। শারীরিক বলেন, কিংবা দক্ষতার দিক থেকে বলেন। যদিও জাতীয় লিগের প্রথম দুই ম্যাচে বল-ব্যাটে দুই জায়গাতেই অবদান রাখতে পেরেছিলাম, আবার শেষ দুই ম্যাচের চারটা ইনিংসে ভালো করতে পারিনি। সোমবার থেকে নতুন রাউন্ড শুরু হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো বড় বড় ইনিংস উপহার দেওয়ার।
অনেকেই মনে করেন, আপনার শাস্তিটা বেশি হয়ে গেছে। পুরো ব্যাপারটা থেকে শিক্ষা নেওয়া, নতুনদের প্রতি পরামর্শ – সব মিলিয়ে কি বলবেন?
ওইটা নিয়ে আসলে আর ভাবছি না। কারণ অন্যায় করেছি, শাস্তি পেয়েছি। সেটাও এখন শেষ হয়ে গেছে। এখন সামনের দিনগুলোতে কিভাবে ভালো করা যায়, সেভাবেই চিন্তা করছি। শাস্তি যেটা ছিল, যেটা নিয়ম ছিল, সেটাই পেয়েছি। আর চিন্তা করে লাভ নেই। সামনের যে কয়টা দিন আছে, কতটা ভালোভাবে থাকা যায়, খেলা যায়, সেটা নিয়েই ভাবছি আসলে।
যখন পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা কেটে গেল, তখন ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেখানে কি কি কাজ করলেন?
কাজ বলতে অনুশীলন করেছি, ম্যাচ খেলেছি, বেড়িয়েছি এই আর কি। যেহেতু পরের বিশ্বকাপটা ইংল্যান্ডে হবে, তো সেখানকার কন্ডিশনে কিছু ম্যাচ খেললাম, বোঝার চেষ্টা করলাম এসবই।
চিটাগং ভাইকিংসের প্লেয়ার লিস্ট দেখে কি মনে হচ্ছে?
খুবই চমৎকার একটা ব্যালান্সড দল গড়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ আমরা যারা লোকাল ক্রিকেটার আছি, যাদেরকে বিদেশী কোটায় নেওয়া হয়েছে, সব মিলিয়েই ভালো টিম হয়েছে। তাছাড়া টি-টোয়েন্টিতে ফেবারিট বলতে পারাটাও কঠিন। হ্যাঁ, ঢাকা-কুমিল্লা কিংবা রংপুর হয়তো বা বড় বাজেটের দল। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে আসলে যার দলে যে ভালো খেলে আর কি। আবার এই দলে মুশফিকুর রহিম আছে আইকন হিসেবে।
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আগের আসরগুলোতে দলটা খুব ভালো করতে পারেনি। এর আগে তামিমকে আইকন করে খুব শক্তিশালী একটা দল গড়েছিলো, কিন্তু ফাইনালে খেলতে পারেনি। তারপর থেকেই আসলে চিটাগং ভাইকিংস মাঝারি মানের দল গড়ার চেষ্টা করে। সেদিক থেকে আমি বলবো, অবশ্যই বেশ ভালো একটা দল এবার হয়েছে। মুশফিক আইকন হিসেবে আছে, মোসাদ্দেক আছে, সানজামুল, রাহী আছে; তো ভালো দল হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমরা যারা আছি, যদি নিজেদের সেরাটা দিতে পারি, অবশ্যই ভালো কিছুই হবে।
এই ফেরায় নিজের উপর নিজের কিংবা দল থেকে বাড়তি প্রত্যাশার কোন চাপ থাকবে কিনা?
না, ওভাবে আমি চিন্তা করছিই না। চাপ তো থাকবেই, এসব পার করেই ভালো খেলতে হবে।