ক্রিকেট একটি দলীয় খেলা। এই খেলায় সফলতা পেতে হলে সতীর্থদের কাছ থেকে একটু হলেও সমর্থন পাওয়াটা জরুরি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে সমর্থনটা আসলে কী ধরনের হতে পারে? একজন ব্যাটসম্যান যখন সেঞ্চুরি করেন, তখন সেটা তার নিজের কৃতিত্ব বলেই গণ্য হয়, তাহলে এখানে সতীর্থদের সহায়তার বিষয়টা কীভাবে আসে? আসে, একটু চিন্তাভাবনা করলেই বিষয়টি বুঝতে পারা যায়। একজন ব্যাটসম্যান তখনই সেঞ্চুরি করতে পারেন, যখন অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি ব্যাটসম্যানরা ক্রিজে টিকে থাকতে পারেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি ভালো ভাবে বোঝা যাবে।
ক্রিকেটের যেকোনো ফরম্যাটেই একজন ব্যাটসম্যানের জন্য সেঞ্চুরি অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। তার জন্য সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে ৯৯ রানে আউট হয়ে যাওয়া। টেস্ট ক্রিকেটে এ পর্যন্ত ৯১ বার ৯৯ রানে আউট হবার ঘটনা ঘটেছে। তবে এর মাঝে ছ’বার ব্যাটসম্যান অপরাজিত ছিলেন।
৯৯ রানে অপরাজিত থাকার দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমটা হচ্ছে আপনি রান তাড়া করতে গিয়ে সেঞ্চুরি করার জন্য পর্যাপ্ত রান অবশিষ্ট পাননি, দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে আপনার সঙ্গী ব্যাটসম্যানরা একের পর এক আউট হয়ে গিয়েছিলেন। উপরের ছয়টি ঘটনার মাঝে শুধু মাত্র একবার এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রান তাড়া করতে গিয়ে ব্যাটসম্যান ৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। সেই ব্যাটসম্যানের নাম অ্যালেক্স টিউডর। বাকি ব্যাটসম্যানরা অপরাজিত ছিলেন সঙ্গীদের আউট হবার কারণেই।
শুধু সেঞ্চুরির ক্ষেত্রেই নয়, ডাবল সেঞ্চুরির ক্ষেত্রেও অপরাজিত ১৯৯ রানের ঘটনা রয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে ১৯৯ রানের স্কোর রয়েছে ১২টি, এর মাঝে অপরাজিত ১৯৯ রান করেছেন দু’জন; জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আর শ্রীলংকার কুমারা সাঙ্গাকারা। দু’বারই সঙ্গীদের আউট হবার জন্য ঘটনাটি ঘটেছিল।
ঠিক একইভাবে একজন বোলারকেও উইকেট পেতে হলে সতীর্থদের সাহায্য পেতে হয়। যখন বোলারের বলে ক্যাচ ওঠে, তখন ফিল্ডারকেই ক্যাচটা নিতে হয়।
এতকিছু বিবেচনা করার পরেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সতীর্থদের সাহায্য ছাড়া ক্রিকেটে কিছু করার সুযোগ ব্যাটসম্যানের চেয়ে একটু হলেও বোলারদের বেশি। অন্তত চার ধরনের উইকেট পাবার ক্ষেত্রে কোনো সতীর্থের সাহায্য পাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বোলারদের; বোল্ড, এল.বি.ডব্লিউ, হিট উইকেট এবং কট অ্যান্ড বোল্ড। এর মাঝে এল.বি.ডব্লিউর ক্ষেত্রে ন্যূনতম সাহায্য প্রয়োজন হয় আম্পায়ারের। এখন এই আউটগুলোতে কোন বোলাররা সবচেয়ে এগিয়ে, সেদিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।
বোল্ড
টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি বোল্ড আউট করেছেন শ্রীলংকার মুত্তিয়া মুরালিধরন। তার ৮০০ উইকেটের মাঝে ১৬৭টিই বোল্ড, যা কিনা তার মোট উইকেটের ২০.৮৮%। পরবর্তী সেরা শেন ওয়ার্ন। তার ৭০৮ উইকেটের মাঝে ১১৫ টি বোল্ড যা মোট উইকেটের ১৬.২৪%। টেস্ট ক্যারিয়ারে ১০০ কিংবা তার চেয়ে বেশি বোল্ড আউট করেছেন এমন বোলার আছেন আর মাত্র পাঁচজন। তারা হলেন জেমস এন্ডারসন, ট্রুম্যান, স্ট্যাথাম, ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস। তবে ক্যারিয়ারে পাওয়া মোট উইকেটের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে বেশি বোল্ড আউটের মধ্যে পাওয়া এমন বিস্ময়কর কীর্তিও কিছু বোলার করে রেখেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এ পর্যন্ত পাঁচজন বোলার আছেন, যাদের মোট উইকেটের অর্ধেকেরও বেশি বোল্ড আউটের মাধ্যমে পাওয়া। এরা হচ্ছেন ইংল্যান্ডের থমাস রিচার্ডসন (১৮৯৩-১৮৯৮), অস্ট্রেলিয়ার জোনস (১৮৯৪-১৯০২), ইংল্যান্ডের উইলিয়াম বোয়েস (১৯৩২-১৯৪৬), অস্ট্রেলিয়ার ফ্রেডরিক স্পোফোর্থ (১৮৭৭-১৮৮৭) এবং অস্ট্রেলিয়ার জর্জ পালমের (১৮৮০-১৮৮৬)।
ওয়ানডে ক্রিকেটে আবার ওয়াসিম আকরাম (১৭৬টি) আর ওয়াকার ইউনুসের (১৫১টি) রাজত্ব। এই দু’জনের বাইরে ১০০ এর বেশি বোল্ড আউটে উইকেট পেয়েছেন মুরালিধরণন (১২১ টি) আর শহীদ আফ্রিদি (১০৪ টি)। টি টুয়েন্টিতে বোল্ড আউটে সবচেয়ে বেশি উইকেট (৩৯ টি) পেয়েছেন শহীদ আফ্রিদি, যা কিনা তার মোট উইকেটের ৪০.২১%। তবে আফগানিস্তানের হামিদ হাসান তার মোট উইকেটের ৬৮.৭৫% ই পেয়েছেন বোল্ড আউটের মাধ্যমে, যা কিনা এখন পর্যন্ত টি টুয়েন্টিতে একটি উল্লেখযোগ্য রেকর্ড।
এল.বি.ডব্লিউ
টেস্ট ক্রিকেটে এল.বি.ডব্লিউর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন স্পিনাররা। অনিল কুম্বলে (১৫৬), মুরালিধরন (১৪৯) আর শেন ওয়ার্নের (১৩৯) এর পর ১১৯ টি উইকেট নিয়ে পেসার হিসেবে আছেন ওয়াসিম আকরাম। তবে এখানেও শতকরা হিসেবে এই শীর্ষ বোলারদের কারো উপস্থিতি নেই। সেখানে মোট উইকেটের ৩৮.৫৭% নিয়ে এগিয়ে আছেন বিস্ময় বোলার হিসেবে খ্যাত অজান্তা মেন্ডিস। ক্যারিয়ারের ৭০ টি টেস্ট উইকেটের মাঝে ২৭ টিই এল.বি.ডব্লিউর মাধ্যমে পাওয়া।
ওয়ানডেতে আবার পেসাররা এগিয়ে, শীর্ষ পাঁচের তিনজনই পেসার – ওয়াসিম আকরাম (৯২), ওয়াকার ইউনুস (৭৩), শহিদ আফ্রিদি (৭২), চামিন্দা ভাস (৬৯) এবং মুরালিধরন (৬৩)। তবে শতকরা হিসেবে আফগানিস্তানের রশিদ খান ৩৫.০০% উইকেট পেয়েছেন এল.বি.ডব্লিউর মাধ্যমে। এর পরেই আছেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ হাফিজ (৩০.১৫)। টি টুয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি (১৬) উইকেট অজান্তা মেন্ডিসের।
কট অ্যান্ড বোল্ড
নিজে বল করে নিজেই ক্যাচ নেওয়া– একজন বোলারের জন্য কাজটি যথেষ্টই কঠিন। বল করার পর নিজের ভারসাম্য ঠিক রেখে ক্যাচ করার চেষ্টা করা – কোনো সন্দেহ নেই যে কাজটি করার জন্য বোলারকে যথেষ্ট তৎপর হতে হয়। ভারসাম্য ঠিক রাখার ব্যাপারটা আসে বলেই হয়তো এই উইকেট শিকারের ক্ষেত্রে পেসারদের চেয়ে স্পিনাররা যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। টেস্টে এই তালিকার প্রথম ১৪ জনই স্পিনার । কমপক্ষে ২০ টি করে উইকেট পেয়েছেন এমন বোলার আছেন পাঁচজন; অনিল কুম্বলে (৩৫), মুরালিধরণ (৩৫), ভেট্টোরি (২১), শেন ওয়ার্ন (২১), আন্ডারউড (২০)।
ওয়ানডের সেরা পাঁচেও চারজন স্পিনার, বাকি একজন ক্রিস হ্যারিস। তিনি মূলত স্লো বল করতেন। কমপক্ষে ২০টি উইকেট পেয়েছেন চারজন; মুরালিধরন (৩৫), ক্রিস হ্যারিস (২৯), শহিদ আফ্রিদি (২৪) আর সাকলাইন মুস্তাক (২০)। টি টুয়েন্টিতে সাতটি উইকেট পেয়েছেন কট অ্যান্ড বোল্ডের মাধ্যমে আফগানিস্থানের মোহাম্মদ নবি ।
হিট উইকেট
হিট উইকেট ক্রিকেটে কিছুটা বিরল প্রকৃতির আউট। এই আউটে বোলারের কৃতিত্বের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ব্যর্থতাই বেশি থাকে। তবে ব্যাটসম্যানকে ব্যর্থ করানোর পেছনে শুধু মাত্র বোলারের কৃতিত্ব থাকে বিধায় এই উইকেটটাও বোলার কারো সাহায্য ছাড়াই পেয়েছেন বলে ধরা যায়। টেস্টে ৬০ এর দশকের অস্ট্রেলিয়ান বোলার গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি ৪টি উইকেট পেয়েছেন হিট উইকেটের মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যাচ্ছে টেস্ট, ওয়ানডে আর টি টুয়েন্টিতে পুরো ক্যারিয়ারে বোল্ড আউট, এল.বি.ডব্লিউ, কট অ্যান্ড বোল্ড আর হিট উইকেটের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন মুরালিধরন। ক্যারিয়ারের মোট ১৩৪৭ টি আন্তর্জাতিক উইকেটের ৫০৯ টি উইকেটের ক্ষেত্রেই তাকে দলীয় কোনো সতীর্থর প্রত্যক্ষ সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। এর পরের অবস্থানেই আছেন পাকিস্তানি বোলার ওয়াসিম আকরাম। তার ক্যারিয়ারের ৯১৬টি উইকেটের মাঝে ৫০৫টিই নিজের কৃতিত্বে অর্জিত।
তবে কমপক্ষে ৩০০ উইকেট পেয়েছেন এমন বোলারদের মাঝে শতকরা হিসেবে ক্যারিয়ারের মোট উইকেটের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক উইকেট নিজের কৃতিত্বে পেয়েছেন পাকিস্তানি বোলার ওয়াকার ইউনুস। তার ৭৮৯টি উইকেটের মাঝে ৫৫.৬৪% কারো সাহায্য ছাড়া। এর পরেই অবস্থান করছেন ওয়াসিম আকরাম (৫৫.১৩%)। স্পিনারদের মাঝে শতকরা হারে এগিয়ে আছেন শহীদ আফ্রিদি (৪৭.৪১%)। যেহেতু রেকর্ড হয়ই ভাঙার জন্য, কাজেই নিকট ভবিষ্যতে কোনো বোলার এই রেকর্ডগুলো ভাঙতে পারে, সেটা দেখার জন্য একটু অপেক্ষা করা যাক ।
[বি.দ্র: সকল তথ্য ১৪ই মে ২০১৮ ইং পর্যন্ত।]
ফিচার ইমেজ: Shalanka.com