বোর্ডের সাথে খেলোয়াড়দের বিবাদ না থাকলে, সব খেলোয়াড় দলে থাকলে জেসন হোল্ডার হয়তো ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে সুযোগই পেতেন না। সেই হোল্ডার নাটকীয়ভাবে ২৩ বছর বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন এবং এখনও দায়িত্বটা পালন করছেন।
অধিনায়ক হিসেবে খুব বলার মতো কিছু না থাকলেও কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। অন্য দিকে বল ও ব্যাট হাতে তার পারফরম্যান্সও প্রশ্নের সামনে পড়ে প্রায়শ। অধিনায়ক না থাকলে দলে থাকতেন কি না, এমন প্রশ্নও ওঠে। এসব প্রশ্ন নিয়েই চলছিলেন মাঝারি মানের এই ক্রিকেটার।
অবশেষে জেসন হোল্ডার নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটো সিরিজে দারুন পারফর্ম করার পর বলছেন, নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে দেখতে চান।
২০১৮ সালের শুরুতে জেসন হোল্ডারের ব্যাটিং গড় ছিলো ২৯.০০; আর বোলিং গড় ছিলো ৩৮.৫২।
হোল্ডারকে এখন দুনিয়া জুড়ে মানুষ চেনে যে, একজন লোয়ার অর্ডারের কাজ চালানোর মতো ব্যাটসম্যান এবং মোটামুটি মানের একজন শক্তিশালী ফাস্ট বোলার। সেই হিসেবে তার ব্যাটিং ও বোলিং গড় ঠিকই ছিলো। কিন্তু এই পরিসংখ্যান দিয়ে দুনিয়ার কোনো টেস্ট দলে শুধু বোলার বা শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে সুযোগ পেতে পারেন না হোল্ডার।
তবে ব্যাপারটা বদলাতে শুরু করেছে। এই বছরে হোল্ডার যে পাঁচটা টেস্ট খেলেছেন, সেখানে তার রেকর্ড নাটকীয়ভাবে উন্নতি করেছে; বিশেষ করে বোলিংয়ের দিকে। এই পাঁচটি টেস্টই হয়েছে গত দুই মাসে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনটি ও বাংলাদেশের বিপক্ষে দুটি টেস্ট ছিলো। এই পাঁচ টেস্টে হোল্ডার ১২.০০ গড়ে ২৮টি উইকেট নিয়েছেন, যার মধ্যে তিনবার ইনিংসে ৫ উইকেট ছিলো। এছাড়া ৩৭.৮৫ গড়ে এই সময়ে ২৬৫ রান করেছেন।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৬৬ রানে স্যাবাইনা পার্ক টেস্ট জেতার পথে ম্যাচসেরা ক্রিকেটারও হয়েছেন হোল্ডার। এই পারফর্মেন্সের পর এখন অন্তত ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই অধিনায়ককে ভদ্রস্থ একজন অলরাউন্ডার বলে মনে হচ্ছে। তার বোলিং ও ব্যাটিং গড় এখন দুটোই তিরিশের কোটায়। হোল্ডার দলের নির্বাচকদের ও তরুণ ক্রিকেটারদের কৃতিত্ব দিলেন। নির্বাচকদের কৃতিত্ব দিলেন তার ওপর আস্থা রাখার জন্য এবং তরুণদের কৃতিত্ব দিলেন আস্তে আস্তে দলের মূল খেলোয়াড় হয়ে ওঠার জন্য।
বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ের পর হোল্ডার বলছিলেন,
“আমার মনে হচ্ছে অবশেষে সবকিছু আমার পক্ষে আসতে শুরু করেছে। আমি সম্ভবত ত্রিশটার মতো টেস্ট খেলে ফেলেছি। আমি সবসময় ক্লাইভ লয়েডের একটা কথা মনে রাখি। উনি একবার বলেছিলেন, তিন বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলার পর উনি খেলাটা শিখতে শুরু করেছিলেন।”
“আমারও বছর তিনেক লাগলো টেস্ট খেলাটা বুঝতে। এটা দেখতে ভালো লাগে যে, আমাদের নির্বাচকরা এই তরুণ দলটার ওপর আস্থা রেখেছেন, যাতে তারা একটা দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আমার ধারণা, আমি এখন বুঝতে পারছি যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের খেলাটা কিভাবে খেলতে হবে। আমার মনে হয়, আমার স্কিল সবসময়ই ছিলো। ব্যাপারটা ছিলো, সবকিছু এক করে মাঠে পারফর্ম করতে পারা।”
হোল্ডার স্বীকার করছেন যে, বোলিং সহায়ক কন্ডিশন তাকে এই সময়ে খুব সহযোগিতা করেছে। যদিও এখনও তিনি লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করে কিছু অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। তারপরও হোল্ডারের আশা, একটা-দুটো বড় ইনিংস খেলে নিজের ব্যাটিং অর্ডারটা একটু ওপরে তুলতে পারবেন একদিন,
“একেবারে সত্যি কথা বলি, আমার মনে হয় এই উইকেট আমার মুভমেন্টের ক্ষেত্রে আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে। এখানকার কন্ডিশন এই দুটো হোম সিরিজে আমাদের খুব উপকার করেছে। আমি আবারও বলবো, আমার জন্য ব্যাটে ও বলে সবকিছু এখন আমার পক্ষে আসতে শুরু করেছে।”
“আমি অবশ্যই আরেকটু ধারাবাহিকভাবে রান করতে চাই। বিশেষ করে বড় কিছু ইনিংস খেলতে চাই। তবে ৮ ও ৯ নম্বরে ব্যাট করে আমার জন্য ভালো স্কোর করাটা আসলেই খুব কঠিন হয়। যদি না আপনি শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হয়ে থাকেন। তবে আমরা এই স্তরে এসে এখানে যে ধরনের জুটি আশা করছি, তা এখনও করতে পারছি না।”
হোল্ডার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭ নম্বরে ব্যাট করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে আবার একটু নেমে গেছেন। কারণ, এখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অতিরিক্ত একজন ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলেছে। তবে হোল্ডার চান স্থায়ীভাবেই ৭ নম্বরে ব্যাট করতে। যদিও তিনি ব্যাপারটা নির্বাচকদের হাতেই তুলে রাখছেন,
“সত্যি বলতে, আমি ওটাই (সাত নম্বরে ব্যাট করা) পছন্দ করবো। কিন্তু এখনকার সময়ে দলের বাস্তবতায় এটাই নির্বাচকরা সঠিক বলে মনে করেছেন। আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই যে, একজন অলরাউন্ডারের জায়গায় ব্যাট করবো। আমি নিজেকে একজন জেনুইন অলরাউন্ডার হিসেবেই দেখতে চাই। আশা করি, আমার পারফর্মেন্স দিয়ে নির্বাচকদের আমি আরেকটু ওপরে ব্যাট করানোর ব্যাপারে রাজি করাতে পারবো।”
হোল্ডারের অবশ্য আরেকটু ওপরে ব্যাটিং না পাওয়ার আরেকটা কারণ আছে। তাকে বছর জুড়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটাতে হবে ক্রিকেটে। অন্যদিকে তার কাঁধ এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। এই বাস্তবতার কথা জেনেই হোল্ডার বলছিলেন,
“আমি বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলবো। এরপর সরাসরি সিপিএলে চলে যাবো। আমার মনে হয় না যে, বছরের শেষ না হওয়া অবধি আমরা সেরকম কোনো বিশ্রাম পাবো। আমাদের এখন থেকে ডিসেম্বর অবধি টানা ক্রিকেট আছে। কোনো বিশ্রাম নেই। এখন আমাকে যতদূর ভালোভাবে পারি, নিজেকে ঠিকঠাক রাখতে হবে।”
“আমার ডান কাঁধে একটু সমস্যা তো এখনও আছে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে আমার কনুইয়ে একটা অপারেশন হয়েছে। ওই কনুই থেকে চাপ সরাতে গিয়ে কাঁধের ওপর চাপটা বেড়ে যাচ্ছে। এটা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আমাকে বেশ ভুগিয়েছে। ফলে আমি এখন যতদূর সম্ভব এটা ঠিকঠাক মতো ব্যবস্থাপনা করে চলতে চাচ্ছি।”
বাংলাদেশের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতার পথে বোলারদের পারফর্মেন্সের দারুন প্রশংসা করলেন এই তরুণ ক্যারিবীয় অধিনায়ক। তবে একইসাথে তিনি ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে আরেকটু ভালো পারফর্মেন্স আশা করলেন। বিশেষ করে স্যাবাইনা পার্কে যেভাবে তার দল দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৯ রানে অলআউট হয়েছে, সেটা তিনি আশা করেননি। সামনে ভারত ও বাংলাদেশ সফর। এই সময়ে হোল্ডার চাচ্ছেন তার দল স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের এই দীর্ঘদিনের সমস্যা কাটিয়ে উঠুক,
“আমার মনে হয়, আমাদের নিজেদের খেলাটা আরেকটু ভালো বুঝতে হবে। আমাদের স্কোরিংয়ের আরও কিছু অপশন নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ধীরগতির বোলাররা যখন আক্রমণে আসছে। গত সাত থেকে দশ বছর ধরে আমরা স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে সম্ভবত এই একই সমস্যা নিয়ে চলছি।”
“উইকেটও স্পিনারদের একটু সহায়তা করেছে এবং ওরা (বাংলাদেশ) ব্যাপকভাবে স্পিনারদের ওপর ভরসা করেছে। ফলে আমাকে আরও কঠিন উইকেটে স্পিনারদের আরও ভালো সামলাতে পারতে হবে। আরেকটু বেশি সুইপ করতে হবে, আরেকটু উদ্ভাবনী শট খেলতে হবে। আমার মনে হয়, এই ব্যাপারে আসলেই আমাদের আরেকটু মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে উপমহাদেশে খেলতে যাওয়ার আগে এই প্রস্তুতিটা খুব জরুরি।’
ফিচার ইমেজ: AFP