হলিউডের সিনেমা বানানোর মতো একটি গল্প আছে আমার কাছে। কিছুটা রম-কম ধাঁচের হলেও, গল্পটি কিন্ত একদম সত্য। যে গল্পের শুরু হয়েছিল এক ক্রোয়েশিয়ান যুবকের বারে প্রবেশের মাধ্যমে।
সময়টা ২০১১। আমার বয়স তখন ২১। স্পেনে বেশ দেরি করেই পৌঁছেছিলাম সেদিন, ঘড়িতে তখন রাত দশটা বাজে। বিগত চার বছর ধরে জার্মান ক্লাব শালকের হয়ে খেলার পর এবার আমার স্পেনের ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সবকিছু নিশ্চিত। আগামীকাল সকালে শুধু আমার মেডিকেল টেস্ট ও চুক্তিতে সই করা বাকি।
আমার বড় ভাই দেজান আমার সাথে এসেছিল। স্পেনে পা রাখার পর আমরা হোটেলে গেলাম, দেরিতে হলেও ক্লাবের কিছু কর্মকর্তার সাথে রাতের খাবার শেষ করি। কিন্ত কোনো এক কারণে, ডিনারের পর আমি একদমই স্থির থাকতে পারছিলাম না। আর জানার কথা যে আজ আমার চোখে ঘুম আসবেনা। তাই আমি ভাইকে বললাম, “চলো গলা ভিজিয়ে আসি, তারপর নাহয় ঘুমানো যাবে।”
এই কথাই আমার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল।
কারণ বারে যেয়ে যে মেয়েটিকে কাজ করতে দেখলাম, সে ছিল এককথায় অপূর্ব। আমার মনে হচ্ছিল যেন স্লো মোশনে চলা কোনো সিনেমার দৃশ্য। আসলেই খুবই সুন্দরী ছিলো সে।
মনে মনে নিজেকে বললাম, “ওকে, সেভিয়া, ওয়াও। আমার শহরটি পছন্দ হয়েছে।”
আমি মেয়েটিকে ওলা (স্প্যানিশে Hola, ইংরেজিতে হ্যালো) ছাড়া কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ আমি স্প্যানিশ জানি না। জার্মান, ইংরেজি, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ক্রোয়েশিয়ান ভাষা জানি, কিন্ত স্প্যানিশ একদমই না। মুহূর্ত তখন বেশ অসহনীয় ছিল আমার জন্য।
ভাইকে নিয়ে আমি বারের এক টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলাম। ঠিক তখনই, তার মোবাইলে অন্য একটি নামকরা বড় ইউরোপিয়ান ক্লাবের ফোন আসে। তাদের ভাস্যে, আমাদের সেভিয়াতে আসার ঘটনা তারা জানে এবং তৎক্ষনাৎ প্লেন পাঠিয়ে আমাদের তুলে নিতে চায়, যাতে আমি তাদের ক্লাবে গিয়ে সাইন করে ফেলতে পারি।
সেভিয়ার সাথে তখনও আমার বড় ধরনের চুক্তি হয়নি। স্পেনে আসাটা আমার জন্য বিরাট পদক্ষেপ ছিলো, একইসাথে ঝুঁকিও ছিলো। নতুন দেশ, নতুন ভাষা। এখানে আমি কাউকে চিনি না। তাই ইউরোপিয়ান ক্লাবের নতুন অফার আমার কাছে যুতসই মনে হচ্ছিল।
ভাই আমার দিকে প্রশ্ন করে, “তুমি কী করতে চাও?”
আমি তাকে বলি, “আচ্ছা… আমি সেভিয়ার প্রেসিডেন্টকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছি। আর আমার মুখের কথা একটি সিগ্ন্যাচার থেকে অনেক বেশি দামী”
সে বলে, “ঠিক আছে! আমি তাদেরকে না বলে দিচ্ছি।”
তারপর আমি তাকে ইশারায় দেখিয়ে বলি, “তুমি কি আমাদের ওয়েট্রেসকে দেখতে পাচ্ছো? আমি এখানে সেভিয়ার হয়ে খেলবো এবং এই মেয়েটিকে আমি বিয়ে করবো।”
দেজান হেসে বলল “ওকে, তুমি যা চাও!” সে ভেবেছিলো আমি তার সাথে মজা করছি।
এরপর সেই মেয়েটি আমাদের কাছে এসে জানতে চায়, আমাদের আর কিছু লাগবে কি না! আমি আমার ভাইকে বলি, “দেজান, আমি এখনও নার্ভাস ফিল করছি, আর আমার মনে হয় না আজ রাতে আমার আর ঘুম হবে। চলো আরেকটা ড্রিংক নেওয়া যাক।”
পরদিন সেভিয়ার সাথে আমি চুক্তি সম্পূর্ণ করি। পরবর্তী তিন মাস আমি সেই হোটেলেই থেকেই নতুন বাসা খুঁজছিলাম। প্রত্যেক সকালে এক কাপ কফি এবং অরেঞ্চ জুসের বাহানায় হোটেল সেই বারে যেতাম, যাতে সেই সুন্দরীকে একনজর দেখতে পারি।
একটা সময় পর আমি জানতে পারলাম তার নাম রাকেল। সে ইংরেজি জানে না আর এদিকে আমি স্প্যানিশ জানিয়া। তাই আমাদের রোজকার কথাবার্তা (Buenos días, Raquel. Un café y un Fanta naranja/শুভ সকাল রাকেল, আমার জন্য কফি আর জুস আনো) এর ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলো।
আমি জানি না এ অনুভুতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো। কখনো আপনার সাথে যদি কোনো প্রিয় মানুষের দেখা হয়, আপনার মধ্যে ভিন্ন কিছু অনুভূতি কাজ করে। যখনই আমি তাকে দেখতাম, মনে হতো কেউ আমার শরীরে বোমা ফাটয়েছে। আমি খুবই ধীরে ধীরে স্প্যানিশ শিখতে লাগলাম। আমার দুর্বল স্প্যানিশ দিয়েই আমি তার সাথে কথা বলতাম, যখন আটকে যেতাম হাত নেড়ে নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করতাম আমি আসলে কী বলতে চাচ্ছি।
ব্যাপারটায় সে খুব মজা পেতো।আর বলতো, “আমি… জেইন আর তুমি… টারজান।”
ব্যাপারটা হাস্যকর শুবনালেও সত্যি যে আমি প্রচুর কফি খেতাম। আর সেই ছুঁতোয় আমি তাকে অন্তত ২০/৩০ আমার সাথে ঘুরতে যেতে বলেছি।
সে কখনো না বলতো না। কিন্তু সবসময় অজুহাত দিতো তাকে কাজ শেষ করে ঘুমাতে হবে। তিন মাস পর, আমি আমার নতুন বাড়িতে শিফট করি। আমার মনে আছে, আমার তখন খুব খারাপ লাগছিলো। কারণ আমি ভেবেছিলাম সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমি রোজ গাড়িয়ে চালিয়ে ঐ হোটেলের বারে যেতাম শুধুমাত্র কফির জন্য।
যদি সে বারে না থাকতো, আমি সাথে সাথে ইউটার্ন দিয়ে বের হয়ে অন্য কোথাও চলে যেতাম। আর যদি সে থাকতো, তাহলে যেন আমার পুরো দিনটি পরিপূর্ণতা পেতো।
ততদিনে আমার স্প্যানিশ বেশ ভালো হয়েছে। তাই আমি তার সাথে আরও বেশি কথা বলতে পারতাম। আমি নিজেকে সবসময় জোর করতাম স্প্যানিশ টিভি দেখতে এবং স্প্যানিশ রেডিও শুনতে। আর একজন বলকান হিসেবে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতাম, কেননা তাদের অন্য ভাষা শেখায় বিশেষ দক্ষতা ছিলো।
একদিন রাকেল অবশেষে আমাকে বোঝাল কেন সে আমার ডেটে যেতে চায় না। সে বলল, “তুমি একজন ফুটবলার। এবং সামনের বছরই হয়ত তুমি অন্য কোনো দেশে চলে যাবে। আমি দুঃখিত, আমার পক্ষে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব না।”
আপনারা তো জানেনই, আমি তেমন বড় মাপের ফুটবলার নই। তাই আমি ভেবেছিলাম, শিট! সে সম্ভবত ভাবছে আমি সেভিয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারবোনা, তাই হয়তো আগামী সামার ট্রান্সফারের সময়ই সেভিয়া আমাকে বিক্রি করে দেবে।
ব্যাপারটা আমি অনুপ্রেরণা হিসেবে গায়ে মাখলাম এবং ট্রেনিংয়ে সর্বোচ্চটা দিতে থাকলাম যাতে আমি মূল দলে খেলার সুযোগ পাই এবং রাকেল যেন আমার সাথে ডিনারে যেতে রাজি হয়। এভাবে ৭ মাস পার হয়ে গেলো। আমি জানুয়ারির ২৭ তারিখে এ শহরে আসি এবং আগস্টের ২০ তারিখে আমি একটা মেসেজ পাই, সে বারে তার বোনের সাথে ড্রিংক করছে। আর আজ তার কোনো কাজ নেই।
দেখুন, এত দিনে শহরের প্রায় সবাই আমার কাহিনী জেনে গিয়েছিলো। তাই সেদিন বারের কেউ একজন আমাকে মেসেজটি পাঠায়। তবে আমি মেসেজের সোর্স সম্পর্কে কিছুই বলবো না। 🙂
আমি আমার বন্ধুকে ডাকি এবং তৎক্ষণাৎ গাড়ি নিয়ে হোটেল বারে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি রাকেলের একদম সামনের সিটে বসে বলি, ” আচ্ছা.. আজ তো তোমার কাজ নেই। অবশেষে আমার সাথে ডিনারের জন্য তোমার সময় হলো!”
সে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। বলতে লাগল, সে তো কিছু জানে না, হয়তো…
আমি তার কথা শেষ করার আগেই বললাম, “না, আমি আজ আর তোমায় ছাড়া যাচ্ছি না। আমি জানি তুমি তোমার বোনের সাথে আছো। এবং আমি আজ থেকেই সব শুরু করতে চাই, এখনই চলো, একসাথে সবাই মিলে যাই।”
এরপর আমরা সবাই মিলে বের হলাম।
পরদিন লাঞ্চে আমাদের দেখা হলো। এবং সেই থেকে আমরা একসাথে। ৬ বছর আমরা একসাথে, আমাদের দুটি ফুটফুটে মেয়ে আছে। আমার জীবনে করা কঠিন কাজগুলোর ভেতর এটাই সর্বোচ্চ কঠিন ছিলো। এ কাজটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের চেয়েও কঠিন ও সময় সাপেক্ষ।
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার ছিলো যখন প্রথমবারের মতো রাকেলের পরিবারের সাথে আমার দেখা হয়। সেই সময় আমার স্প্যানিশ ভাষা নিয়ে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্ত তারপরও আমি বিশাল একটি পরিবারের মাঝে পড়ে গেলাম, ওহ ঈশ্বর… এরা সবাই তো সেভিয়ার উচ্চারণে কথা বলে। যদিও আমার আর তাদের মাঝে তখনকার পার্থক্য খুব সামান্যই ছিলো কিন্তু দ্রুত কথা বলায় আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল।
রাকেলের বাবা আমার সাথে ঠাট্টা করার চেষ্টা করছিলেন। এবং আমার কোনো ধারণাই ছিলো না তিনি কী আবোল তাবোল বলছিলেন! আমি এমন ভান করছিলাম যে আমি সব বুঝতে পারছি এবং সাথে সাথে হেসে যাচ্ছিলাম। তবে তিনি ঠিকই বুঝতে পারছিলেন যে তিনি যা বলছেন এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছেনা। তাই শেষমেশ তিনি বলে উঠলেন, “ব্যাপার না। দুই-তিন মাস যাক, সবকিছু বুঝতে পারবে।”
আমি মনে করি সেভিয়ার মানুষের ভালো দিকগুলোর ভেতর এটাই উল্লেখযোগ্য। তারা অনেক খোলা মনের মানুষ এবং খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে। আমার স্ত্রীর ফুটবল নিয়ে একদমই আগ্রহ ছিলো না। তাই আমি ভেবেছিলাম রাকেলের পরিবারও এমন হবে। কিন্তু তারা সেভিয়ার অন্ধভক্ত ছিলো। রাকেলের সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তার অনেক আগেই তার দাদু মারা গেছে। তবে রাকেলের বাবা আমাকে বলেছে তাকে তার জীবনের শেষ সময়ে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিলো। নার্সরা তার শরীরের কাপড় পরিবর্তন করে হাসপাতালের গাউন পড়িয়ে দেন। কিন্ত তারা যখন তার হাতের ঘড়ি খোলার চেষ্টা করে, তখন তিনি তা করতে বারণ করেন। কারণ ঐ ঘড়িটা সেভিয়ার চিহ্ন বহন করতো।
তিনি বলেন, “না, এটি আমার সাথে থাকবে, আমার শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত। যদি আমি মারা যাই, আমি আমার ক্লাবের সাথে থেকে মারা যেতে চাই।”
আমি মনে হয়, বাইরের লোকেরা আসলেই বোঝে না সেভিয়ার মানুষদের জীবনের সাথে ফুটবল কীভাবে সম্পর্কিত। যখন আমরা ইন্টারভিউ দেই, সমর্থকেরা দলের ম্যানেজার, ট্যাকটিস এবং ট্রেনিং সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারা কখনোই জানতে চায় না মাঠের বাইরে হচ্ছেটা কী! এবং আমার জন্য ক্যারিয়ারের জন্য এটা প্রয়োজনীয়। বিগত ছয় বছরে, আমি সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানি এবং জার্মানি থেকে স্পেনে এসেছি। সে সময়গুলো তীব্র একাকীত্বের মধ্য দিয়ে আমার যেতে হয়েছে। যদিও আমি বাসেল ও শালকেতে খুব খারাপ খেলোয়াড় ছিলাম না। কিন্ত আমি সবসময় কিছু একটার অভাববোধ করতাম।
যখন আমার সাথে আমার স্ত্রীর দেখা হলো, আমার মনে হলো বেঁচে থাকার জন্য আমার আসলেই কেউ আছে এবং এরপর থেকে আমার ক্যারিয়ারও এক ধাপ এগিয়ে গেলো। সেভিয়াতে আমাদের অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত আছে। ২০১৩ সালে, ম্যারাডোনার পর ক্লাবে প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করি। সেই মুহূর্তটা আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক ছিলো।
আমার পূর্বপুরুষের জন্যও তা অত্যন্ত সম্মানের। আমার পরিবার এসেছে ক্রোয়েশিয়া থেকে। কিন্ত বসনিয়ান যুদ্ধ শুরু হবার আগেই তারা সুইজারল্যান্ড চলে যায়। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। রবার্ট প্রসিনেটস্কিকে আইডল মেনে আমি সুইজারল্যান্ডে বড় হয়েছি। তিনি ক্রোয়েশিয়ার একজন নামকরা ফুটবলার ছিলেন। যখন আমি ছোট ছিলাম তখন তিনি রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও সেভিয়ার মতো দলে খেলেছেন। আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ সুইজারল্যান্ডে আমার বন্ধুদের সাথে খুবই সাধারণ জীবন পার করেছি এবং যুদ্ধ থেকে একদম দূরে ছিলাম। তবে অনেকটা সময়ের জন্য, ক্রোয়েশিয়াতে ফিরে যাওয়া আমার পরিবারের জন্য অসম্ভব ছিলো। সম্ভবত যখন আমার বয়স ৭ বছর, তখন আমরা একবার ক্রোয়েশিয়াতে গিয়েছিলাম আমার দাদা-দাদীকে দেখতে। আমার ক্রোয়েশিয়ান হিসেবে পরিচিত শুধুমাত্র প্রসিনেটস্কি ও ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের ভেতরই বাঁধা ছিলো।
আমার মা একটা গল্প বলতে খুব পছন্দ করেন। যখন আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তিন-চার বার যাবার পর যখন আমি বাসায় ফিরতাম, তখন বলতাম, “মা, আমি আর স্কুলে যেতে চাই না। আমি শুধু ফুটবল খেলতে চাই। এভাবে কত বছর আমাকে স্কুলে যেতে হবে?”
মা উত্তর দিয়েছিলেন, “নয় বছর!”
জবাবে বলেছিলাম, “নয় বছর? আচ্ছা… আমি নয় বছর পর্যন্ত মেনে নিলাম, কিন্ত এরপর আর একদিনও নয়।
যখন আমার বয়স ১৭, আমি পেশাদার ফুটবল খেলতে বাসেলে যোগ দেই। আমার স্বপ্ন একদমই পরিষ্কার ছিলো। আমি রবার্ট প্রসিনেটস্কি হতে চেয়েছিলাম। আর তাই তার মতো স্পেনে গিয়ে খেলতে পারা এবং সেভিয়ার ক্যাপ্টেন হতে পারাটা বিশাল ব্যাপার ছিল।
তারপর ২০১৪ সালে যখন বার্সেলোনা আমাকে দলে নিতে চাইলো, সেটা আমার জন্য অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা ছিলো। কারণ আমার স্ত্রীর পরিবার চাইতো আমি সেভিয়াতে থেকে যাই। তবে তারা এটাও জানতো যে ইতিহাসের সেরা কোনো ক্লাবে খেলার জন্য এটাই আমার অন্যতম সুযোগ। অবশেষে, আমার সিদ্ধান্তকে তারা সমর্থন জানালো। এটা আমাদের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ছিলো। আপনি যতটুকু মনে করছেন তার থেকেও অনেক বেশি। আমার ক্লাব আমাকে জানালো বার্সেলোনার অফারে তারা সন্তুষ্ট। তারা আমার দল পরিবর্তনকে সমর্থন জানায়। আমি প্রচন্ড খুশি ছিলাম সে সময়, কারণ আমার সমগ্র জীবন পরিবর্তন হয়েছে এই সেভিয়াতেই।
রাকেলের বাবা সেদিন বললেন ,” ওকে, গুড লাক। তবে তুমি যখন সেভিয়ার বিপক্ষে খেলবে… ওয়েল, আই অ্যাম সরি।”
বার্সেলোনায় খেলা সবার জন্যই স্বপ্নের মতো। আমার মনে আছে আমার প্রেজেন্টেশনের সময় কী হয়েছিলো। আমি ড্রেসিং রুমে হাঁটছিলাম এবং আমার বুটজোড়া ড্রেসিংরুমের লকারে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি বুটজোড়া দেখে স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি ভাবছিলাম এগুলো সাধারণ কোনো বুট নয়। এগুলো তো আমার বার্সেলোনার।
একজন ফুটবলার হয়ে আপনি সবসময় চাইবেন ম্যাচ ও শিরোপা জিততে। তবে বার্সেলোনার একজন হয়ে যখন খেলবেন তখন ভাবনা কিছুটা ভিন্ন। অন্য সব ক্লাবের উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেই বলছি। বার্সেলোনাতে, এ শহরের মানুষের সাথে ভিন্ন একরকম অনুভূতি কাজ করে।
একজন প্লেমেকার হিসেবে, বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগের সাথে খেলতে পেরে আমি ধন্য। উদাহরণস্বরূপ, মেসি! পুরো বিশ্ব সবসময় দেখে তার প্রতিভা। একজন সত্যিকার ফুটবলের ভক্ত হয়ে, প্রতিদিন তার সাথে খেলাটা আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক। তবে শুধু সে নয়, একটা সময়ে জাভি ও নেইমার এবং বর্তমানে সুয়ারেজ, ইনিয়েস্তা। আমরা ছন্দময়ী ফুটবল খেলার চেষ্টা করি। এটা একটা যন্ত্রের মতো। শুধুমাত্র যন্ত্রটি চালু করে দিতে হবে। এরপর যন্ত্র নিজেই জানে তাকে কী করতে হবে! এটা টিভির পর্দায় দেখতে পাবেন, অথবা বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলার সময়। নিজের অভিজ্ঞতার জন্য এটা আরেকটা ঘটনা। আপনি যদি বার্সেলোনার ফুটবলকে উপভোগ না করতে পারেন তাহলে আপনি ফুটবলকেই উপভোগ করেন না।
যখন আমি ফুটবল খেলতে নামি, আমার জন্য এখনও প্রত্যেকটা দিন আনন্দের। সুইজারল্যান্ডের বাইরে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে আমি ১০ বছর আগে দেশ ত্যাগ করেছিলাম। আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমি শেষপর্যন্ত এখানে আসতে পেরেছি, বার্সেলোনাতে। আমি আশা করি আরও অনেক বছর পর্যন্ত এই জার্সি পরতে পারবো।
আমি মনে করি, যখন আমি এখানে এসেছিলাম, কিছু খেলোয়াড় আমার স্প্যানিশে কথা বলার অবস্থা দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলো এবং ড্রেসিং রুমের কালচারের সাথে মানিয়ে নিতে এটাই আমার জন্য সহায়ক ছিলো। এজন্য আমি আমার স্ত্রীকেও ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ একমাত্র তার জন্যই আমি টারজানের রূপ থেকে বের হতে পেরেছি, সেভিয়া দলের ক্যাপ্টেন হতে পেরেছি এবং বার্সেলোনায় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি।
আমার সবথেকে বড় মেয়ের বয়স এখন চার। সে এখন বুঝতে শুরু করেছে যে বার্সেলোনার মানুষেরা ফুটবলকে কতটা সিরিয়াসলি গ্রহণ করে। আমরা এখনই বলে দিতে পারি সে আমার মতো ফুটবলের অন্ধভক্ত হবে নাকি তার মায়ের মতো ফুটবলে কোনো আসক্তি থাকবে না! বর্তমানে, সে দুটোর মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে।
যদি আমি বাসায় বসে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতে থাকি এবং কেউ গোল করে, সে এতে রীতিমত ক্ষিপ্র হয়ে যায়। সে বলে, “না! এই গোল তোমার করা উচিত।”
যদি মেসি অথবা সুয়ারেজ গোল করে, তাতেও না। এটা সে মেনে নিতেই পারে না। গোলদাতা অবশ্যই তার ড্যাডিকে হতে হবে। সে অ্যাসিস্টও করতে পারবে না, তাকে গোল করতে হবে। তাই আমি আমার সেরাটা দেবার চেষ্টা করছি। সম্ভবত এ বিষয়ে আমার লিওনেল মেসির সাথে কথা বলা উচিত।
ফিচার ইমেজ: Getty images
“মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে। সেখান থেকেই লেখাটি তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য”