ফুটবল স্রেফ একটি বৈশ্বিক খেলাই নয়। বর্তমানে ফুটবল মানে বরং আরো অনেক বেশি কিছু। পুরো বিশ্বজুড়ে সবার পরিচিত এবং বহুল জনপ্রিয় এই খেলাটিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ইদানিং সমান তালে এগিয়ে চলছে। অথচ একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও নারী ফুটবল ছিল ফিফার অবহেলার পাত্র। সার্বজনীন করার নিমিত্তেই বর্তমানে ফিফা নারী ফুটবলের দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে শুধু ফিফা নয়, কিছু নারী ফুটবলাররাও অলংকৃত করে চলেছেন খেলাটিকে। আজ আমরা দেখবো এমনই কয়েকজন নারী ফুটবলারদের গল্প।
কার্লি লয়েড (যুক্তরাষ্ট্র)
নারী ফুটবলের অন্যতম তারকা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নন, বরং সমাদৃত পুরো বিশ্বেই। ৩৬ বছর বয়সী এই ফুটবলার জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপাই। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে জন্ম নেওয়া লয়েড ফুটবল খেলা শুরু করেন ১৭ বছর বয়স থেকেই।
ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা অবশ্য ফেলে এসেছেন তিনি। ২০১৫ নারী বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়কের বাহুবন্ধনী পরে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে নারী বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্ট্রিক করে যুক্ত্ররাষ্ট্রকে এনে দিয়েছেন তৃতীয় শিরোপার স্বাদ, পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিস্বরূপ গোল্ডেন বল জিতে নেন কার্লি লয়েড। ছয় গোল ও এক অ্যাসিস্ট করে সিলভার বুটও বগলদাবা করেন এই কৃতি ফুটবলার।
মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা কার্লি লয়েড সর্বপ্রথম ফুটবল মাঠে পা রাখেন ১৯৯৯ সালে স্কুল পর্যায়ে । শিকাগো রেড স্টারস, আটলান্টা বিট ক্লাবে খেলে বর্তমানে তিনি আছেন স্কাই ব্লু এফসি ক্লাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ২৬০ ম্যাচ খেলে কার্লি লয়েডের গোলসংখ্যা ১০৫টি। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু বিশ্বকাপই নন, এনে দিয়েছেন দুইটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকও। পাশাপাশি দুইটি অলিম্পিক ফাইনালে গোল করার কৃতিত্বও গড়েছেন এই ফুটবলার।
নারী ফুটবলে অসাধারণ সব কীর্তি গড়ার মাঝেই কার্লি লয়েড জিতেছেন দুইবার ফিফা নারী বর্ষসেরা ফুটবলারের সম্মাননা। ২০১৫ ও ২০১৬ টানা দুই বছর এই পুরষ্কার ঘরে তোলেন কার্লি লয়েড।
লিকা মার্টিন্স (নেদারল্যান্ড)
২৫ বছর বয়সে ২০১৭ সালে ফিফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের পুরষ্কার জিতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন এই ফুটবলার। এই ডাচ ফুটবলার ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলছেন বার্সেলোনা নারী দলের হয়ে।
১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডের বার্গেন শহরে জন্ম লিকা মার্টিন্সের। ফুটবলের সাথে হাতেখড়ি ২০০৯ সালে, নেদারল্যান্ডের ক্লাব হিরেনভেনে ক্যারিয়ার শুরু করেন মার্টিন্স। মিডফিল্ডার কিংবা ফরোয়ার্ড, যেকোনো পজিশনে খেলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে বার্সেলোনার হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন মার্টিন্স। অন্যদিকে, ২০১০ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ ইউরোতে নেদারল্যান্ডের হয়ে করেন নজরকাড়া পারফরম্যান্স। সেই হেতু ২০১১ সালেই লিকে মার্টিন্সের সামনে খুলে যায় জাতীয় দলের দরজা। নেদারল্যান্ডের হয়ে এখন পর্যন্ত ৯৩ ম্যাচ খেলে ৩৯টি গোল করেছেন লিকা মার্টিন্স।
তবে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন গত বছর। উয়েফা নারী ইউরোতে নেদারল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন, টিম অফ দ্য টুর্নামেন্টে জায়গা করার পাশাপাশি জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল পুরস্কার, সাথে বগলদাবা করেছেন ব্রোঞ্জ বুটও। যার দরুন সেই বছর ফিফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলারেরর পুরস্কারটিও অনুমিতভাবেই জিতেছেন লিকা মার্টিন্স।
অ্যালেক্স মরগান (যুক্তরাষ্ট্র)
বর্তমান বিশ্বে অন্যতম জনপ্রিয় নারী ফুটবলারদের মধ্যে একজন অ্যালেক্স মরগান। প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন ফিফা ১৬ ভিডিও গেমসের কভারেও।
১৯৮৯ সালের ২ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন অ্যালেক্স মরগান। ২০০৭ সালে কলেজ ফুটবলের মাধ্যমে ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে প্রোফেশনাল ফুটবল জগতে পা রাখেন অ্যালেক্স মরগান।
গোলমুখে ভয়ঙ্কর এক স্ট্রাইকার হিসেবে দ্রুতই সুনাম কুড়ান মরগান। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্রের নারী ফুটবল দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করা কার্লি লয়েডকেও প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছেন। মাত্র ১৫৩টি ম্যাচ খেলেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মরগানের গোল ৯৮টি। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক ও ২০১৫ সালে কানাডা নারী বিশ্বকাপে শিরোপা জয় করা যুক্তরাষ্ট্র দলের অপরিহার্য অংশ ছিলেন তিনি। অলিম্পিক ফাইনালে স্বাগতিক কানাডার বিপক্ষে মরগানের করা ১২৩ মিনিটের গোলেই সোনা জিতে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে মরগান খেলছেন ফরাসি ক্লাব অলিম্পিক লিঁওতে।
২০১২ সালে মরগান জিতেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফিমেল অ্যাথলেট অফ দ্য ইয়ার’এর পুরস্কার। মাঠের বাইরেও সমান জনপ্রিয় মরগান। তাই এন্ডোর্সমেন্ট থেকেও কাড়ি কাড়ি ডলার আয় করেন তিনি। ২০১৫ সালে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি আয় করা নারী অ্যাথলেটদের মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করেন অ্যালেক্স মরগান।
আদা হেগেরবার্গ (নরওয়ে)
সর্বপ্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে কয়েকদিন আগেই ব্যালন ডি’অরের মুকুট পড়েন আদা হেগেরবার্গ। তবে তা অনুমিতই ছিল, অলিম্পিক লিঁও’র হয়ে খেলেছেন দারুন। এই ক্লাবটিতে এই নরওয়েজিয়ান ফুটবলার যোগ দেন ২০১৪ সালে। সেই থেকে ক্লাবের হয়ে ১২০ ম্যাচ খেলে ঈর্ষনীয় গড়ে করেছেন ৯৫ গোল। মাত্র ২৩ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান পিলে চমকানোর মতোই। বর্তমানে নারী ফুটবলারদের মধ্যে সেরাদেরই একজন আদা হেগেরবার্গ।
১৯৯৫ সালে জন্ম নেওয়া আদা ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০১০ সালে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই খেলেন কোলবোটন নামের একটি ক্লাবে। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে ২০১১ সালেই পেয়ে যান জাতীয় দলের ডাক। জাতীয় দলের জার্সি গায়েও বেশ ধারাবাহিক ছিলেন তিনি। নরওয়ের জার্সি গায়ে চাপিয়ে আদা হেগেরবার্গ ৬৬টি ম্যাচ খেলে করেছেন ৩৮টি গোল। ২০১৩ সালে উয়েফা উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপে সিলভার পদক পাওয়া নরওয়ে দলের সদস্যও ছিলেন তিনি।
তবে এইবছরের পারফরম্যান্সে আদা ছাড়িয়ে যান সবাইকে। অলিম্পিক লিঁও’র হয়ে ঘরোয়া লিগ ও কোপা দে ফ্রান্স জেতার পাশাপাশি জিতেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগও। ট্রেবল জেতাতে অনবদ্য ভূমিকা ছিল এই ফুটবলারের। চ্যাম্পিয়নস লিগের এই আসরে ১৫ গোল করে করেছেন মেয়েদের এক আসরে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ডও।
এইবারের ব্যালন ডি’অর ছাড়াও হেগেরবার্গ ২০১৬ সালে জিতেছেন উয়েফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলার। ২০১৭ সালে বিবিসি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন উইমেন ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার।
মার্তা (ব্রাজিল)
মার্তা শুধু বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যেই নয়, বরং ইতোমধ্যেই নারী ফুটবলের একজন কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। নারী ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় বিবেচিত মার্তাকে স্বয়ং পেলেই বলেছেন ‘স্কার্ট পরা পেলে’। গতি এবং দুর্দান্ত ফিনিশিংই মার্তাকে করে তুলেছে অদম্য।
১৯৮৬ সালে জন্ম নেওয়া মার্তা ২০০২ সালে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ভাস্কো দা গামাতে। এরপর খেলেছেন সুইডিশ ক্লাব উমিয়া আইকে’তে। বর্তমানে মার্তা খেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের সকার লিগের ক্লাব অরল্যান্ডো প্রাইডে।
ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি গায়ে জড়িয়ে মার্তা খেলেছেন সর্বোচ্চ ১৩৩টি ম্যাচ, আর তাতে গোল করেছেন সর্বোচ্চ ১১০টি। ব্রাজিলের হয়ে নারী বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১৫টি গোলের মালিকও মার্তা। ব্রাজিলকে ২০০৪ ও ২০০৮ সালে দুইবার জিতিয়েছেন অলিম্পিক রৌপ্যপদক। ২০০৪ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান তিনি। ২০০৭ সালে প্রায় এককভাবে নারী বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে নিয়ে যান ফাইনালে। দুঃখজনকভাবে সেই ফাইনালে ব্রাজিল হেরে গেলেও গোল্ডেন বল এবং গোল্ডেন বুট দুইটি পুরস্কারই নিজের করে নেন ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক মার্তা।
শুধু টুর্নামেন্ট নয়, মার্তা ফিফা স্বীকৃত পুরস্কারও জিতেছেন অনেক। ২০১৮ সালসহ নিজের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ পাঁচবার জিতেছেন ফিফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের সম্মান। তাই সর্বকালের সেরা নারী ফুটবলারের নাম নিলে সবার আগে মার্তার নাম উচ্চারিত হওয়াটাই অনুমেয়।