একসময় ভারতের তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন তিনি। এখন আর সেই দিন নেই। এখন তার সেরা সময়কে অনেক পেছনে ফেলে এসেছেন। সেই সেরা সময়, নিজের দেখা সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা বোলার এবং নিজের জীবনের মজার সব ব্যাপার নিয়ে হরভজন সিং কথা বলেছেন ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সাথে। বাংলায় সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
ক্রিকেটার হিসেবে আপনার জীবনের সেরা স্মৃতি কোনটি?
অনেক। তবে সম্ভবত ২০১১ বিশ্বকাপ (এটি সবার আগে থাকবে)।
ক্রিকেটার হিসেবে আপনার সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল কোনটা?
শুরুতে আমাকে যখন চাকিংয়ের জন্য পরীক্ষা দিতে হলো এবং ইংল্যান্ডে এসে আমার বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কাজ করতে হলো। সেটা খুব কঠিন ছিল।
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে আপনার পারফরম্যান্স ছিল বিস্ময়কর। ৩২ উইকেট পেয়েছিলেন। এর চেয়ে কখনো ভালো করেছেন? আর সেই পারফরম্যান্সটা কি এরপর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আপনার জন্য বোঝা হয়ে ছিল?
হ্যাঁ, ওটা সম্ভবত খানিকটা বোঝাতেই পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ওই সিরিজটা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার মনে হয়, আমি সেটি ছাড়াও নানা সময়ে ভালো বল করেছি। কিন্তু সেরকম ফলাফল পাইনি। ২৪ বা ২৫ উইকেট নিয়েছি (এক সিরিজে)। কিন্তু তাতে আমার দলের সেই রকম সৌভাগ্য আসেনি। ২০০১ সালে আমি যা স্পর্শ করছিলাম, তা সোনা হয়ে যাচ্ছিল।
আপনি যাদের সাথে খেলেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষতা সম্পন্ন খেলোয়াড় কে?
শচীন টেন্ডুলকার।
টেস্টে কাকে বল করাটা আপনার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল?
ম্যাথু হেইডেন যখন ফর্মের শীর্ষে ছিল, আমার মনে হয়েছে সে তখন কঠিনতম ছিল। সে আক্রমণ করতো। সে মাঠে নামতো, নিয়ন্ত্রণ করতে। এর বাইরে ইনজামাম-উল-হককে আউট করাটাও খুব কঠিন ছিল।
আপনি যাদের সাথে খেলেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অনুশীলন কে করতেন এবং সবচেয়ে নিবেদিত কে ছিলেন?
রাহুল দ্রাবিড়। সে তার খেলা নিয়ে সত্যিই প্রবল পরিশ্রম করতো। সে শেষ অবধি নিজের জন্য এবং দলের জন্য আরেকটু ভালো কিছু অর্জন করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেত।
যাদের সাথে ক্রিকেট খেলেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে মজার মানুষ কে?
এটা বলা কঠিন। তবে সম্ভবত বিরাট কোহলি। সে সত্যিই খুব ভালো নকল করতে পারে। সে আপনার সাথে একটু মিশবে এবং দশ মিনিটের মধ্যে আপনি যা যা করেন, সব সে করতে শুরু করবে। আপনার কণ্ঠ, আপনার হাঁটা, আপনার হাত চালনা ইত্যাদি সবকিছু।
আপনার দেখা সবচেয়ে স্মার্ট ক্রিকেটার?
অবশ্যই অনিল কুম্বলে।
আপনার কি কোনো কুসংষ্কার আছে?
হ্যাঁ, আছে। তবে এটা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাই না। একটা জিনিস শুধু মনে হয়, আমার বোলিংয়ে জুতোর অনেক ভূমিকা আছে। কোনটা আগে পরবো আর কোনটা পরে, এসব। এমনকি এখনো আইপিএলে আমি এটা অনুসরণ করি। যেভাবে করলে ভালো ফল দেয়, আমি সারা মৌসুম ধরে সেভাবেই করি।
আইপিএল ফাইনাল হচ্ছে মনে করুন। শেষ বলে প্রতিপক্ষের ছয় রান দরকার। এরকম অবস্থায় আপনি কাকে সামলাতে চাইবেন না?
এবি ডি ভিলিয়ার্স।
কোনটা বেশি ভালো অনুভূতি- একটা টেস্ট হ্যাটট্রিক, নাকি টেস্ট সেঞ্চুরি?
টেস্ট হ্যাটট্রিক। আর সেটা হবে পন্টিং, গিলক্রিস্ট ও ওয়ার্ন।
পন্টিং কিছুদিন আপনার প্রিয় শিকার ছিলেন…
আমি এটা জানতাম না। তবে আমি ওকে বেশ কয়েকবার আউট করেছি। জানি না এটা কীভাবে হয়েছে, কিন্তু আমি করেছি। সম্ভবত সে বলের বদলে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। অনেক সময় এই ব্যাপারটা হয় যে- আহহা, আবারো সেই বোলার! আমার আসলে তেমন কিছু করতে হতো না। সে নিজেই নিজেকে আউট করতো। কারণ, ব্যাপারটা তো এমন নয় যে পন্টিং জানে না যে, অফস্পিন কীভাবে খেলতে হয়।
স্টুয়ার্ট ব্রডের ২০১১ সালের ট্রেন্ট ব্রিজে হ্যাটট্রিকের মাঝের উইকেটটা ছিলেন আপনি। আপনার ব্যাটের ভেতরের দিকে লেগেছিল বলটা। এরপর ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে কী করলেন?
ওটা একটা ধাক্কা ছিল। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি ব্যাট ছুড়ে মারিনি। তবে সত্যি বলি, বেশ হতাশ ছিলাম।
আপনি যাদের অধীনে খেলেছেন, এর মধ্যে সেরা অধিনায়ক কে ছিলেন?
সৌরভ গাঙ্গুলি। সে এমন একটা সময় দলের দায়িত্ব নিলো, যখন দল ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি ও এসবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সে তরুণদের দারুণ সমর্থন দিতো। আর দলটাকে একত্রিত করতে পেরেছিল। সে আমাদেরকে নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে বলতো যে, আমাদের টেস্ট ম্যাচ জিততে গেলে এটাই করতে হবে।
আপনি যেসব কোচের অধীনে খেলেছেন, তার মধ্যে সেরা কোচ কে ছিলেন?
গ্যারি কার্স্টেন। সে কোচের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু ছিল। সে খুব বেশি কথা বলতো না। কিন্তু যখন বলতো, সে কথার অনেক অর্থ ছিল।
আপনার বাবা মারা যাওয়ার পর আপনি কি আসলেই আমেরিকায় গিয়ে ট্রাক চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমি কী করবো। এমনিতে দৃঢ়ভাবে বিদেশ চলে যাওয়ার একটা উপায় খুঁজছিলাম। কারণ আমাকে তখন জীবনের জন্য, আমার পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য কিছু একটা করতে হতো। আমি এমন পরিবার থেকে আসিনি, যে পরিবারের অনেক অর্থ আছে। আমার বাবা যখন মারা গেলেন, তখনো আমি ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি তখন অনেক নাটকের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ক্রিকেট বোর্ডের সাথে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। তাছাড়া দেশের চেয়ে দেশের বাইরে কাজ করাটা সহজ ছিল।
কী করতাম? যেকোনো কিছু হতে পারতো- ট্রাক ড্রাইভার, দিনমজুরি, পেট্রোল ভরার কাজ; যেকোনো কিছু। আমার এরকম অনেক বন্ধু ছিল যারা আমেরিকায় চলে গেছে। আর ওখান থেকে এসব করে বাড়িতে টাকা পাঠাতো। যদিও শেষ অবধি আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর সেজন্য আমি খুশি।
আপনার যদি একটা জাদুর কাঠি থাকতো, আর অন্য কোনো খেলায় অংশ নিতে পারতেন, তাহলে কোনটা পছন্দ করতেন?
উইম্বল ফাইনাল জিততে চাইতাম। আর বিশ্ব হ্যাভিওয়েট শিরোপা জিততে চাইতাম। এটা বুঝতে চাইতাম যে, একজন মোহাম্মদ আলী হলে কেমন অনুভূতি হয়।
আপনি রাধতে পারেন? পারলে আপনার পছন্দের ডিশ কোনটা?
আমি রান্না করি না। একেবারেই না। তবে অমলেট বানাতে পারি। আর ভাত রান্না করতে পারি। আমার স্ত্রী বলে এর কোনোটাই রান্না নয়।
আপনার জীবনের কঠিনতম ইনজুরি কোনটা?
ভারতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার সময় আমার বোলিং আঙুলের লিগামেন্ট ছিড়ে গিয়েছিল। এটা অস্ট্রেলিয়া সফরের ঠিক আগের ঘটনা। আমি সেই সিরিজে গিয়েছিলাম এই ইনজুরি নিয়ে। কারণ, অধিনায়ক আমাকে চাইছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি আহত। কিন্তু সে বলেছিল, ‘না, তোমাকে দরকার।’ ইনজুরিটা এরপর আরো খারাপ হলো। ফলে আমি আট মাস খেলার বাইরে ছিলাম। যার কারণে আমি পাকিস্তানের বিপক্ষে (২০০৩-০৪) ঐতিহাসিক সিরিজটা মিস করলাম।
কোন ক্রিকেটারের পোশাকের রুচি সবচেয়ে খারাপ?
আপনি আমাকে ভালোই সমস্যায় ফেলছেন। তবে এটা রাহুল দ্রাবিড়। স্যরি, রাহুল!
আর সেরা?
আগের দিনের একজন- ইমরান খান। আর এই যুগে বিরাট কোহলি খুব ভালো পোশাক পরে।
আপনি যদি ড্রেসিংরুমের মিউজিকের দায়িত্বে থাকেন, কোনটা বাজাবেন?
পাঞ্জাবি মিউজিক। এটা অসাধারণ। প্রত্যেকে এর ছন্দ পছন্দ করে।
আপনার প্রিয় ছুটির গন্তব্য?
নিউইয়র্ক।
লম্বা একটা ফ্লাইটে আছেন। কী দেখতে চাইবেন- হলিউড, নাকি বলিউড?
আসলে আমি আজকাল নেটফ্লিক্স দেখি। আমি মাত্র নার্কোস শেষ করলাম; এটা পাবলো এসকোবারকে নিয়ে। আমি ট্রাম্পের ডকুমেন্টারিগুলো দেখি। নেটফ্লিক্স আমার খুব পছন্দ।
আপনাকে যদি অন্য কোনো একটা প্রাণী হিসেবে বানানো যায়, আপনি কী হতে চাইবেন?
ডাইনোসর।
আপনার সামলানো সবচেয়ে গতিশীল বোলার কে?
শোয়েব আখতার। মারাত্মক গতি।
আপনি যদি একটা আইপিএল স্কোয়াড বানান, প্রথম তিন পছন্দের খেলোয়াড় কারা হবেন?
আমি পাঁচ জন করতে পারি? সেক্ষেত্রে আমি জসপ্রিত বুমরাহ, রোহিত শর্মা, এবি ডি ভিলিয়ার্স, লাসিথ মালিঙ্গা ও বেন স্টোকসকে নেবো। না, এমএস ধোনিকে নেবো শেষ জায়গাটায়। স্যরি, বেন!
টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব একাদশ করার ক্ষেত্রে কোন তিন জনকে প্রথমে নেবেন?
এখনকার জন্য- বিরাট কোহলি, জো রুট ও জিমি অ্যান্ডারসন। আর সর্বকালের জন্য- শচীন টেন্ডুলকার, ভিভ রিচার্ডস ও কপিল দেব।
ফিচার ছবি- ESPN Cricinfo