স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান থেকে হালের বিরাট কোহলি, এই সময়ের মধ্যে ক্রিকেটে পরিবর্তন এসেছে অনেক। তবে মাঠের খেলায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বলতে, বহুগুণে বেড়েছে ব্যাটসম্যানদের রাজত্ব। আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের চওড়া উইলোর সামনে বোলাররা অনেকটাই অসহায়। সেজন্যই হয়তো আগের তুলনায় বোলারদের আকালও চোখে পড়ার মতো। বিশেষত পেসারদের ক্ষেত্রে এ কথাটি শতভাগ প্রযোজ্য। দুই যুগ আগেও ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, ম্যাকগ্রা, বন্ড, চামিন্দা ভাসদের আতঙ্কে কাঁপতো ব্যাটসম্যানরা। সে তুলনায় বর্তমানে চোখ রাঙ্গানো পেস বোলারদেরকে হাতের কর দিয়েও গুনে ফেলা যাবে।
টি-টোয়েন্টির আগমনে ব্যাটসম্যানদের প্রসার বেড়েছে অনেক। তবে শুধু কি টি-টোয়েন্টিই বোলারদের অসহায়ত্বের প্রধান কারণ? নাকি আধুনিক ক্রিকেটের আরো অনেক ভূমিকাই রয়েছে এর পিছনে? চলুন তা দেখে আসা যাক।
ছোট বাউন্ডারি
আইসিসির নতুন নিয়ম অনুযায়ী ১৯.১ আইনে বলা আছে, কোনো বাউন্ডারি ৯০ গজ (প্রায় ৮৩ মিটার)-এর চেয়ে বেশি এবং ৬৫ গজ (প্রায় ৬০ মিটার)-এর কম হতে পারবেনা।
২০১৭ সালে এই পরিবর্তনের ফলে দিনকে দিন আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর বাউন্ডারি ছোট হয়ে আসছে। এমনকি টেস্ট ম্যাচের জন্যও আইসিসির এই নিয়মের আওতায় স্টেডিয়ামগুলোর আয়তন নির্ধারিত করা হচ্ছে। ছোট বাউন্ডারির ফলে বেশিরভাগ ম্যাচই হচ্ছে হাইস্কোরিং ম্যাচ। অথচ কয়েক বছর আগেও প্রতিপক্ষকে আড়াইশ’ রানের লক্ষ্য বেঁধে দিলেও তা নিরাপদ ভাবা হতো। অথচ আধুনিক ক্রিকেটে ৩২০-৩৩০ রানও নিরাপদ নয়।
ছোট বাউন্ডারির ফলে ব্যাটসম্যানরা ফাঁকা জায়গায় দুর্বল সব শট খেলেও অবলীলায় চার রান পেয়ে যাচ্ছেন, আর যার জন্য ভুক্তভোগী হচ্ছে একজন বোলারের ইকোনমি রেট। আইসিসির এই নিয়ম মানতে গিয়ে বিখ্যাত মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট মাঠের বাউন্ডারিকেও ছোট করতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের। অনেকের মতে, স্যার ভিভ রিচার্ডস নাকি নিজের সময়ে এত ছোট বাউন্ডারি পেলে অবলীলায় সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক বনে যেতেন!
ফিল্ডার রেস্ট্রিকশন
ফিল্ডার রেস্ট্রিকশন একজন বোলারের সবচেয়ে বড় অসহায়ত্বের কারণ। তিন পাওয়ারপ্লে নিয়ম ছাড়াও ফিল্ডিংয়ে আইসিসি আরো বেশ কয়েকটি নিয়ম কার্যকর করেছে, তবে এক্ষেত্রে ফায়দা লুটছে ব্যাটসম্যানরাই।
উইকেটকিপার বাদ দিয়ে ক্রিজের পেছনে লেগসাইডে দুইজনের বেশি ফিল্ডার না থাকার নিয়মটিতে ভালোই সুবিধা পাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরা। এই নিয়মের ফলে স্ট্যাম্পের পিছনে সুইপ কিংবা স্কুপ শট খেললেই বোলাররা পড়ে যাচ্ছেন বিপদে। এছাড়া প্রথম দশ ওভারে মাত্র দুইজন ফিল্ডার থাকতে পারবে ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে। এ ক্ষেত্রে লেগ সাইডে বল পড়ামাত্রই বাউন্ডারি হওয়াটা অনেকটাই বাঁধাধরা, ফলে মাশুল গুনতে হচ্ছে বোলারকেই। ব্যাটিং ও বোলিং পাওয়ারপ্লেতে বৃত্তের বাইরে থাকতে পারবেন তিনজন খেলোয়াড়।
বোলারদের আরো সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়ে ‘আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭’-এর আগে নতুনভাবে আইন সংশোধন করে আইসিসি, যার ফলে নন-পাওয়ারপ্লেতেও সর্বোচ্চ চারজন খেলোয়াড় থাকতে পারবেন ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে। পাওয়ারপ্লে প্রথার কারণে খেলা জমে উঠছে ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যের কষাঘাতটুকু সহ্য করতে হচ্ছে বোলারদেরই।
দুইটি নতুন বলের ধারণা
একজন বোলারের প্রধান স্কিলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পুরোনো বলে রিভার্স সুইং। কিন্তু এখন প্রতি ইনিংসেই দুইটি নতুন বল ব্যবহার করায় বোলারদের জন্য রিভার্স সুইং দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। যার জন্য আধুনিক ক্রিকেটে, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ও এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে এখন রিভার্স সুইংয়ের দেখা মেলাই ভার।
নতুন বলে শুধু ফাস্ট বোলাররাই নয়, সমস্যায় পড়ছেন স্পিনাররাও। প্রতি ইনিংসে দুইটি নতুন বল থাকায় ব্যাটসম্যানরা নরম হয়ে যাওয়া বলের মুখোমুখি হচ্ছেন না। বলের নমনীয় হওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়াতে ব্যাটসম্যানরাও পাচ্ছেন প্রচুর রান। বল যত শক্ত, ব্যাটসম্যানদের জন্য রান করাও তত সহজ। দুইটি নতুন বল, আর ফ্ল্যাট পিচ – এর চেয়ে বেশি আর কি’ই বা চাইতে পারেন একজন ব্যাটসম্যান!
এই প্রথা চালু হওয়াতে নিজেদের অবশ্য ভাগ্যবান দাবি করতে পারেন ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস। পুরনো বলে যে তারা কতটা ভয়ঙ্কর, তা হয়তো বিশ্ব জানতেও পারতো না যদি তৎকালীন সময়ে দুইটি নতুন বল ব্যবহার করার নিয়ম প্রচলিত হতো!
ফ্ল্যাট পিচ
বর্তমানে আধুনিক ক্রিকেটে প্রতিটি দেশই ফ্ল্যাট পিচকে কাজে লাগিয়ে ম্যাচ জিততে চায়, এর ব্যাতিক্রম হলেই আইসিসির বাধার মুখে পড়তে হয়। ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি–মার্চে অস্ট্রেলিয়া যখন ভারতে টেস্ট সিরিজ খেলতে যায়, তখন ভারত স্পিনারদের অনূকুলে ভেজা পিচ তৈরি করে। এর ফলে পুনে ও বেঙ্গালুরু টেস্টে মাত্র চারদিনের মধ্যেই ধরাশায়ী হয় অস্ট্রেলিয়া। এই নিয়ে সমালোচনার তোপে পড়লে আইসিসি ভারতকে নিরপেক্ষ পিচ বানাতে নির্দেশ দেয়, বলতে গেলে ব্যাটিং পিচ তৈরি করার পরামর্শই পায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড।
তবে ফ্ল্যাট পিচে ব্যাটসম্যানেরা রানের পাহাড় গড়লেও বোলারদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যাটসম্যানরাও। ফুটওয়ার্ক কিংবা অন্যান্য স্কিল কাজে না লাগিয়েই অনায়াসে রান পেয়ে যাচ্ছেন তারা, ফলে কঠিন পরিস্থিতিতে বিপত্তি ঘটছে প্রায়শ’ই।
চওড়া, বড় ও হালকা ব্যাট
আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের উইলোর পরিবর্তন হয়েছে অনেকবার। তবে প্রতি পরিবর্তনেই সুবিধা পেয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। পরিবর্তনের পর ঐতিহ্যগত উইলো গাছ থেকে ব্যাটগুলো তৈরি না হয়ে সেগুলো বানানো হচ্ছে স্যাপউড গাছ থেকে। এই গাছের তৈরি ব্যাটে বেশ ঘনত্ব থাকলেও ওজনে বেশ হালকা, আর ঘনত্ব বেশি হওয়ায় আজকাল ব্যাটের কিনারায় বল লাগার পরও সেগুলো অনায়াসে বাউন্ডারি পার হতে দেখা যায়। আগের ঐতিহ্যবাহী উইলো ব্যাটে খেললে হয়তো দিলশানও তার বিখ্যাত দিলস্কুপ শটটি খেলতে পারতেন না। বর্তমান ব্যাটগুলোর প্রান্ত সাধারণত ৭০ মিলিমিটার প্রশস্ত হয়ে থাকে, যার দরুন ব্যাটের শক্তিতেও অনেক মিসহিট বল ছক্কাতে পরিণত হচ্ছে। বোলাররা নতুন নতুন অনেক স্কিল আবিষ্কার করলেও ব্যাটের শক্তিতে কাটার কিংবা স্লোয়ার বলগুলোও উড়ে গিয়ে পড়ছে গ্যালারীতে।
তবে ব্যাটের এত পরিবর্তন হলেও বোলারদের বলে আসেনি তেমন কোনো পরিবর্তন।
দর্শকদের মনোভাব
দর্শকদের মনোভাবও খেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বেশিরভাগ দর্শকই বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিং দেখাটাকেই উপভোগ করেন বেশি। একজন বোলারের ৫ উইকেট পাওয়ার চেয়ে দর্শকেরা বাহবা দিতে পছন্দ করে একজন সেঞ্চুরিয়ানকে। আর সেজন্যই ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিগুলো প্রসার পেতে শুরু করেছে প্রায় সব ক্রিকেটখেলুড়ে দেশগুলোতে।
মারকাটারি যুগে দর্শকদের আনন্দ যোগান ব্যাটসম্যানরাই। লো-স্কোরিং টানটান উত্তেজনার ম্যাচগুলোও আজকাল ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচের আখ্যা পেতে শুরু করেছে। তুলনামূলকভাবে লো স্কোরিং হওয়া ম্যাচে শেষদিকে দর্শকদের স্টেডিয়াম ত্যাগ করার প্রবণতাও অনেক বেশি দেখা যায়।
এত সব বৈপরীত্য ও প্রতিকুলতার মাঝেও কিছু বোলার তাদের স্কিল দিয়ে একজন সত্যিকার ক্রিকেটপ্রেমীদের আনন্দ দিয়ে থাকেন। মুস্তাফিজের কাটার, বুমরাহর ইয়র্কার, স্টার্কের গতি, কিংবা হাসান আলীর স্লোয়ারগুলো এখনো বোলারদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তবে দিনদিন এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলে একটা সময় ক্রিকেট হয়ে উঠবে শুধুই ব্যাটসম্যানদের খেলা। তবে আনন্দের বিষয়, আইসিসি বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখছে। হয়তো বোলারদের অনুকূলে কিছু পরিবর্তন আসবে ক্রিকেটে। তবে তার আগ পর্যন্ত আধুনিক ক্রিকেটে সাম্রাজ্য কেবল উইলো হাতে একজন ব্যাটসম্যানেরই।