সুযোগের শেষ কিনারে দাঁঁড়িয়ে বাংলাদেশ

ভারতের জিততে তখনও রান ১৫ এর মতো বাকি। উইকেটে রোহিত শর্মা ও মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাট করছেন। ৩২ ওভার চলছে। যেন সুখের সাগরে গা ভাসানোর মতো অবস্থা। তারপরও ফিল্ডিংয়ে শেষবার জ্বলে ওঠার চেষ্টা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। কিন্তু মাঠের বাইরে দেখা গেল অন্য দৃশ্য।

বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের পাশে ছোট একটা ফাঁকা গ্যালারি। সেখানে মুখে হাত দিয়ে ভার হয়ে বসে আছেন দলের প্রধান কোচ স্টিভ রোডস। তার পাশেই পাংশু মুখে দুপাশে হাত ছেড়ে দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ। তার পাশে বসে আছেন দলের ফিজিও।

ওদিকে ড্রেসিংরুমের অবস্থাও খারাপ। দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন ও স্পিন বোলিং কোচ সুনীল জোশি মুখ ভার করে কী যেন বলাবলি করছেন নিজেদের মধ্যে। মোদ্দা কথা, ততক্ষণে তাল হারিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টও।

শেষ দুই ম্যাচে এই চিত্রটা ছিল অপরিচিত; Image Source: BCB

ক্রিকেটারদের বাইরে টিম ম্যানেজমেন্ট তথা কোচদের কথা বলার কারণ এই যে, কেন যেন মনে হয়েছে এশিয়া কাপ থেকে মানসিকভাবেই ছিটকে পড়তে চাইছে বাংলাদেশ। অথচ, এই টুর্নামেন্টেই নিজেদের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সফল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। দুবার খেলেছে ফাইনাল। দিন শেষে এটা ভুলে গেলে চলবে না, এখনও দুটি ম্যাচ খেলতে হবে মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তার দলকে। হাল ছাড়ছেন না মাশরাফি নিজেও। চোখ আফগানিস্তানের বিপক্ষে রবিবারের ম্যাচে। যেখানে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার শেষ সূত্রটি।

১.

সূচি নিয়ে সমালোচনা ছিল। কেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই গ্রুপে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ঘোষণা করা  হলো, তা নিয়ে নিন্দা এখনও চলছে। কিন্তু ওই ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের ইনজুরির পর দেশে ফিরে গেছেন তিনি। অন্যদিকে, পাঁজরের ব্যথাটা আবারও বেড়ে যাওয়ায় আফগানদের বিপক্ষে মাঠে নামেননি মুশফিকুর রহিম।

ফলাফল, মাত্র ১১৯ রানের নিচে গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ, আগে বল করতে নামা বাংলাদেশ প্রায় ২০০ রানের নিচে আফগানদের গুটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ডেথ ওভারে মাশরাফি যেভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে বল করেছেন, সেই পথে হাঁটতে ব্যর্থ হয়েছে বাকিরা। একই অবস্থা ব্যাটিংয়েও। ২৫৬ রানের লক্ষ্য জয় করতে নেমে ব্যাট হাতে বেকায়দায় পড়েছিল বাংলাদেশ।

এই  ম্যাচে হারের পরদিনই আবার খেলা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেপরোয়া গরম আর অবুঝ কন্ডিশনের মারপ্যাঁচে বাংলাদেশ অন্তত একটি দিন বিশ্রাম পেতেই পারতো। সেটা হয়নি। ভারতের মতো বড় দলের বিপক্ষে নিজেদের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ খেলতে হয়েছে দৌড়ের উপর।

ভারতের বিপক্ষে নামলেও, পাঁজরের ব্যথায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্রামে ছিলেন মুশফিক; Image Source: AFP

আগে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ এদিনও ব্যর্থ হয়েছে। ৪ উইকেট নিয়ে এক রবিন্দ্র জাদেজাই ধস নামিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপে। টপ অর্ডারের ব্যর্থতার পর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মিলে মিডল অর্ডারে গড়লেন ৩৬ রানের জুটি। প্রথমে উল্লেখ করার মতো না হলেও, এটাই এই ম্যাচে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি। পরের উইকেটে মাশরাফি ও মেহেদী হাসান মিরাজের ৬৬ রানের জুটি অন্তত সম্মান বাঁচিয়েছে বাংলাদেশের। সেখান থেকে ১৭৪ রানে থামে দলটি।

জবাবে,  ৭ উইকেট হাতে রেখেই জয় তুলে নিয়েছে রোহিত শর্মার ভারত।

তবে বোলিং যা-ই হোক, বাংলাদেশের ব্যাটিং ধস বেশ চোখে লেগেছে স্বয়ং দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজারও। সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

‘প্রথম দশ ওভারে ৬০ রান করতে হবে এমন কোনো কথা ছিল না। দুই প্রান্তে দুই নতুন বল, একটু সময় নিয়ে খেললে সহজ হয়ে যায়। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৪০-৪৫ রান করেছি। যদি দ্রুত উইকেট যায় তাহলে ৩০-৩৫ রানেও খুশি ছিলাম আমরা।’

হতাশ মাশরাফি দলের ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সের কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে আরও বলেন,

‘দ্রুত উইকেট পড়ে গেলে মিডেল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ম্যাচটা তৈরি করে নিতে হয়। সবসময় মিডেল অর্ডার থেকে এমন প্রত্যাশা করা কঠিন। এই ধরনের ম্যাচে উপরে দুটি উইকেট পড়ে গেলে মিডেল অর্ডারে অনেক প্রেশার থাকে। পরপর দুটি ম্যাচে আমরা ব্যাটিং কলাপস করেছি।’

শেষ দুই ম্যাচের স্কোরবোর্ড জানাচ্ছে, দুই ম্যাচের প্রায় পুরোটা সময়েই ব্যাট হাতে হতাশ করেছে দলের বেশিরভাগ তরুণ ব্যাটসম্যানরা। উইন্ডিজ সফরে যে আকাল দেখা গিয়েছিল, সেই ধারাটা সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপেও বিদ্যমান। অথচ, এই সমস্যার কারণেই এশিয়া কাপে দলে পরিবর্তন আনেন নির্বাচকরা।

তিন ম্যাচে লিটনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ৭ রানের; Image Source: BCB

দলের প্রধান কোচ স্টিভ রোডস প্রায় পুরোটা সময় পড়ে থাকেন তরুণ ব্যাটসম্যানদের নিয়ে। মাশরাফি-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-তামিম-সাকিব; দলের জ্যেষ্ঠ এই পঞ্চ পাণ্ডবের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থনও পায় তারা। কিন্তু দিন শেষে জ্বলে ওঠাটা আর হয় না। তামিম ইকবালের ইনজুরি, মুশফিকের পাঁজরের ব্যথার পর থেকে যেন বিপদটা বহুগুণে বেড়েছে।  

২.

সুপার ফোরের দ্বিতীয় ম্যাচে আবারও আফগানিস্তানের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে এই ম্যাচে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই মুশফিক-সাকিবদের সামনে। সতর্ক মাশরাফি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন  ড্রেসিংরুমকে আরও আত্মবিশ্বাসী করতে। যে কারণে তিনি এখনই হাল ছাড়ছেন না।

টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তার ভাষ্য,

‘মনে হয় এখনো সম্ভব। এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা দুটি ম্যাচে হারবো, এটা কেউই চায়নি। ফলাফলটা হতাশার, বিশেষ করে এই ম্যাচের ফলাফলটা একটু বেশি হতাশার। কারণ গত ম্যাচের তুলনায় আজকের ম্যাচটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু আমরা আজও ব্যাটিং করা কলাপস করেছি, অবশ্যই হতাশার। আমাদের এখনো টুর্নামেন্টে ফেরার সুযোগ আছে। একটা ভাল দিনে আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচে যদি আমরা জিততে পারি, তাহলে ৫০-৫০ চান্স চলে আসবে, পাকিস্তানের সাথে ম্যাচে।’

এই হাত নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন তামিম ইকবাল; Image Source: AP

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে যখন রণপরিকল্পনায় পুরো দল, তখনই ঢাকায় ইমরুল কায়েস ও সৌম্য সরকার ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ, আবারও দলে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আরব আমিরাতে উড়িয়ে আনা হচ্ছে। অথচ, অধিনায়ক মাশরাফি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না!

মাশরাফি বলেন,

‘যারা আসছে, তারাও কিন্তু এভাবেই দল থেকে ছিটকে পড়েছে। আর যারা আসছে তাদের নিয়ে আমি এখনো নিশ্চিত না, আলোচনা হয়নি। বিষয়টি এখনো পরিস্কার না। তবে ওরা কিন্তু এভাবেই পারফর্ম না করেই দল থেকে বের হয়েছে। আর এই কন্ডিশনে এমন চাপের মধ্যে তাঁরা দলে ফিরছে, আমি জানি না ওরা টেকনিক্যালি কী কাজ করেছে। যে সমস্যাগুলোর কারণে টিমের বাইরে গিয়েছে, সেই সমস্যা তাঁরা ঠিক করে আসছে কি না; এমন টুর্নামেন্টে এসব কিন্তু ম্যাটার করবে।’

শনিবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে আফগান দল যে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকবে তা মানছেন মাশরাফি। বিশেষ করে দলটির বোলিং লাইনআপের কথা আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন তিনি। দলের নতুন দুই সদস্যকেও মনে করিয়ে দিলেন চ্যালেঞ্জটা সহজ হবে না।

তিনি বলেছেন,

‘আরও কঠিন বোলার মোকাবেলা করতে হবে। এটা নিশ্চিত, কারো জন্যই এটা সহজ হবে না। যারা আছে তাদের জন্যও সহজ হচ্ছে না, যারা আসছে তাদের জন্যও না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কঠিন সবকিছুই। এর ভেতরেই রান করতে হবে, ব্যাটিং-বোলিং ভালো করে করতে হবে। যেহেতু আগে পরে আমরা এমন অবস্থা থেকে কামব্যাক করেছি। অসম্ভব কিছুই না। যে-ই খেলুক একটু দায়িত্ব নিতেই হবে।’

ভাবনার পথ যতই শাখা খুঁজে নিক, এশিয়া কাপের আসরে টিকে থাকলে হলে জয় ছাড়া গতি নেই বাংলাদেশের।

ইতিহাসের পাতা থেকে

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, তামিম ইকবালের অভিষেকের পর থেকে তাকে ছাড়া মোট ১১টি ওয়ানডেতে হেরেছে বাংলাদেশ দল।

আফগানিস্তানের হাসমাতুল্লাহ শাহিদি পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। এর মধ্যে দিয়ে ওয়ানডেতে আফগানদের পক্ষে নার্ভাস নাইটিজে অপরাজিত থাকা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।    

ফিচার ইমেজ- BCB

Related Articles

Exit mobile version