২০২৩ সালের জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোটি অন্য যেকোনোবারের চেয়েই আলাদা ছিল। আগে সবসময় এই উইন্ডো ব্যবহার করা হতো মধ্য মৌসুমে দলের স্কোয়াডের মেরামতের জন্য। এবারও এমন কাজে ব্যবহার হলেও এবার বিশ্বকাপ ছিল নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। তাই নতুন নতুন খেলোয়াড় নিজেদের বিশ্ব দরবারে চিনিয়েছে এই মৌসুমের মাঝপথের এই বিশ্বকাপে। তাই এই বিশ্বকাপের পারফর্ম্যান্স দেখে খেলোয়াড়দের এই জানুয়ারি মাসেই দলে ভেড়ানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে ক্লাবগুলো। অনেক ক্লাবই এসময় এভাবে খেলোয়াড় কিনে দলকে নতুনভাবে সাজায় মৌসুমের বাকি সময়ের জন্য। কিন্তু অন্য সকল ক্লাবের ট্রান্সফারকে ছাড়িয়ে আলোচনায় চেলসি ফুটবল ক্লাব।
চেলসি এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে এমন কিছু ট্রান্সফার করেছে, যা পুরো ফুটবল বিশ্বের চোখ কপালে তুলে দেয়। অর্থনৈতিকভাবে এক অসম্ভব ট্রান্সফারকে সম্ভব করায় চেলসি। ফুটবলে ট্রান্সফারের সময় যাতে কোনো দল যথেচ্ছ খরচ না করে এবং মালিকপক্ষের অফুরন্ত টাকার অনৈতিক ব্যাবহার না করে, তাই কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নীতিমালায় বেশ কিছু ফাঁকফোঁকড় ছিল। চেলসি আসলে ব্যবহার করে এই ‘লুপহোল’গুলোই। শুধু এই এক উইন্ডোতেই তারা খরচ করে বসে ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি।
নতুন মালিক টড বোহেলির অধীনে চেলসি প্রিমিয়ার লিগে নিচের সারিতে থাকলেও খরচের দিকে তারা ছিল সবার উপরে। শুধু ২০২২-২৩ মৌসুমে তারা খেলোয়াড় কেনা বাবদ খরচ করেছে ৬১১ মিলিয়ন ইউরো।
ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষদিনে, মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে চেলসি গরম করে ফেলে ট্রান্সফার মার্কেট। ঘটনাবহুল এই কয়েক ঘন্টায় চেলসি প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড সাইনিং করে, তাদের ভাইস ক্যাপ্টেন জর্জিনহোকে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের শিবিরে পাঠায়, এবং হাকিম জিয়েশের লোনের নাম করে পিএসজিকে বিভ্রান্ত করে রাখে। বিশেষ করে পিএসজির সাথে এই লোনের নাম করে উলটাপালটা আচরণ করায় পিএসজি চেলসির এই কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করে “ক্লাস-এ সার্কাস” নামে।
জানুয়ারির ৩ তারিখ চেলসির দুই সহ-স্বত্বাধিকারী টড বোহেলি ও হোসে ফেলিসিয়ানো লন্ডনে যান বেহদাদ এগবালির সাথে, যিনি ক্লিয়ারলেক ক্যাপিটালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা যেটা কি না বর্তমানে চেলসির ৬০% শেয়ারের মালিক। সেখানে তারা ডিনার করেন বেনফিকার প্রেসিডেন্ট রুই কস্তা ও এনজো ফার্নান্দেজের এজেন্ট হোর্হে মেন্দেজের সাথে। বুলগারি হোটেলের সেই আলোচনায় আলাপ হয় এনজোকে কিনে চেলসিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে। আলোচনায় বেনফিকা তাদের চাহিদা খোলাখুলিভাবে চেলসিকে বলে দেয়। তারা এনজোর জন্য তার রিলিজ ক্লজ বাবদ পুরোপুরি ১০৬.৭ মিলিয়ন ইউরো দাবি করে। রিলিজ ক্লজ পরিশোধ ছাড়া তারা কোনোভাবেই এনজোকে চেলসির কাছে ছাড়বে না। এর মধ্যে বেনফিকার কোচ রজার স্মিথ একদম প্রকাশ্যে চেলসির খেলার ধরন নিয়ে সমালোচনা করেন এবং এ-ও বলেন যে এনজো আপাতত ক্লাব ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না।
জানুয়ারির শুরুর দিকের এই আলোচনায় চেলসির কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না এভাবে বেনফিকার দাবি পুরোপুরি মেনে এনজোকে লন্ডনে উড়িয়ে আনার। চেলসির কাছ থেকে অফার ছিল ৭৪ মিলিয়ন পাউন্ডের। এর সাথে চেলসির কোনো এক খেলোয়াড় লোনে কিংবা পাকাপাকিভাবে বেনফিকাতে যাবে। আর দলে মাত্র ৬ মাস আগে আসা এনজোকেও এত সহজে ছাড়তে রাজি ছিল না বেনফিকা। কারণ সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে এনজো সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এনজোর জন্য মার্কেটে তখন চেলসি ছাড়াও অন্য ক্লাব ছিল।
শীঘ্রই চেলসি তাদের এনজোকে রিলিজ ক্লজে না কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে যখন তারা জানতে পারে যে ইউরোপের আরো দু’টি বড় ক্লাব এনজোর জন্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি খরচ করতে প্রস্তুত এবং তারা পরবর্তী গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতেই চেষ্টা চালাবে এনজোকে তাদের কাছে নিয়ে আসার। চেলসির টাকা নিয়ে কোনো ভয় ছিল না। তারা গ্রীষ্মেও চাইলে এনজোর জন্য ১০০ নয়, ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডও খরচ করতে পারবে। কিন্তু তখন হয়তো বা তারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে থাকবে না এবারের মতো। যেকোনো খেলোয়াড় সাইনিংয়ের জন্য এটি একটি বড় ইস্যু। বড় টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ না থাকলে সচরাচর খেলোয়াড়েরা ক্লাবে আসতে চান না। তো তাদের মাথায় চিন্তা আসে যে হয় এখনই, নয়ত আর কখনো নয়।
চেলসি রাজি হয় বেনফিকাকে এনজো ফার্নান্দেজের রিলিজ ক্লজের পুরোটা দিতে। কিন্তু তারা এই টাকার পুরোটা না দিয়ে ৬ কিস্তিতে পরিশোধ করবে। ১ম কিস্তির ৩০ মিলিয়িন ইউরো পরিশোধ করে তারা এই ট্রান্সফারটি সম্পন্ন করে ট্রান্সফার উইন্ডোর একদম শেষ মুহূর্তে। চেলসি শিবিরে এই নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বলতা থাকলেও, সবাই তা উপভোগ করতে পারেননি।
এনজোর চেলসিতে আসা যখনও নিশ্চিত নয়, তখন চেলসির সহ-অধিনায়ক জর্জিনহো ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দেন আর্সেনালে। জর্জিনহোর এই ট্রান্সফারের পরই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে চেলসিতে নতুন একজন মিডফিল্ডার আসছেন। এবং সাম্প্রতিক সব সব খবরাখবরের ভিত্তিতে এটিও নিশ্চিত ছিল যে সেই মিডফিল্ডার হচ্ছেন এনজো ফার্নান্দেজ। বেনফিকা এনজোর ট্রান্সফারের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে রাত ১২:১৬ মিনিটে।
ঠিক ঐ একই দিন, চেলসির ২৯ বছর বয়সী মরোক্কান উইঙ্গার হাকিম জিয়েশ প্যারিসে যাত্রা করেন পিএসজিতে তার লোন চুক্তি সম্পন্ন করতে। জিয়েশ চেলসির কাছ থেকে সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় বসে থাকেন পিএসজির অফিসেই। কিন্তু সন্ধ্যা অব্দি চেলসির কাছ থেকে কোনো সংকেতই আসেনি। চেলসির এমন খামখেয়ালি আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন জিয়েশের প্রতিনিধিদল। জিয়েশ এবার সরাসরি যোগাযোগ করেন বোহেলির সঙ্গে। ট্রান্সফার প্রক্রিয়াটি দ্রুত করতে অনুনয় করেন তাকে।
রাত ৯:৪০ এ লোনের চুক্তি সম্পন্ন করতে চেলসির কাছে পিএসজি তাদের চুক্তিপত্রের খসড়া পাঠায়। এই ডকুমেন্ট সাইন করে ফেরত পাঠিয়ে দাখিল করতে হবে ফ্রেঞ্চ পেশাদার ফুটবল কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এর কিছুই করেনি চেলসি। পিএসজির এক সংবাদদাতার কাছ থেকে জানা যায় যে ডেডলাইনের যখন কয়েক মিনিট বাকি, তখন চেলসিকে সরাসরি ফোন করা হয়, কিন্তু কেউই ফোন ধরেনি। ব্রিটেনের সময়ে রাত ১১টায় ট্রান্সফার উইন্ডো বন্ধ হয়ে যায়। ১১টা বাজার অল্প কিছু সময় আগে চেলসির কাছে থেকে মেইল পায় পিএসজি। কিন্তু মেইলের সাথে পাঠানো কাগজপত্রগুলো সঠিক ছিল না, এবং সেই চুক্তিপত্রে ছিল না চেলসির কোনো কর্মকর্তার সাক্ষর! পিএসজি এরপর আবারও লোনের চুক্তিপত্র পাঠায় চেলসির কাছে, যেখানে জিয়েশ ও পিএসজি ক্লাব কর্তৃপক্ষের সই ছিল। কিন্তু চেলসির পক্ষ থেকে আবারও কিছু ভ্রান্ত ডকুমেন্ট পাঠানো হয়, এবং সই ছাড়াই ফিরে আসে চুক্তিপত্রটি। তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় রাত ১১:০৩ মিনিটে চেলসির কাছ থেকে ঠিকমতো সব কাগজ বুঝে পায় পিএসজি। সাথে সাথেই সেটি পাঠানো হয় ফ্রেঞ্জ লিগ কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু ৪ মিনিটের জন্য ছুটে যায় ডেডলাইন। পিএসজিতে আর যাওয়া হয় না জিয়েশের। পিএসজির পক্ষ থেকে চেলসিকে বলা হয় ‘ক্লাস-এ সার্কাস’। চেলসিতে ব্রাত্য হয়ে পড়া জিয়েশকে এখন বসে থাকতে হবে আরো ৬ মাস নতুন কোনো ক্লাবের হয়ে খেলার আগে।
চেলসি এই লোন চুক্তি নিয়ে খামখেয়ালি করেছে ওমারি হাচিনসনের সাথেও। এই মৌসুমের শুরুতে আর্সেনাল একাডেমি থেকে চেলসিতে এসেছিলেন হাচিনসন। উদ্দেশ্য ছিল প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়া। কিন্তু চেলসিতেও সে সুযোগ হয়নি। তাই তিনি নিজেও একটি লোন স্পেল কাটাতে চাচ্ছিলেন অন্য কোনো ক্লাবে। ওয়েস্টব্রম অ্যালবিওনের সাথে মোটামুটি কথা পাকাপাকি হয়ে যায়।
চেলসি মেডিকেল থেকে শুরু করে অন্য কাগজপত্র পাঠালেও শেষে এই নিয়ে আর কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তবে এই লোন ক্যান্সেল হওয়ার ব্যাপারটি ছিল জিয়েশেরটার চাইতেও অনেক জটিল। হাচিনসনকে সাইন করানোর জন্য তারা চাচ্ছিল তাদের ফরোয়ার্ড কারলান গ্র্যান্টকে অন্য কোথাও বিক্রি করে দিতে। সোয়ানসি গ্র্যান্টকে নিতে আগ্রহ দেখায়। পুরো জানুয়ারি মাস তারা বসে থাকে ওয়েস্ট ব্রমের কাছ থেকে চূড়ান্ত সবুজ সংকেতের আশায়। কিন্তু হাচিনসনের ট্রান্সফার নিশ্চিত না হওয়ায় ব্রাইটনও গ্র্যান্টকে ছাড়ছিল না।
তবে চেলসির অন্য সাইনিংগুলো এর তুলনায় বেশি সার্থক। জানুয়ারির অন্য সাইনিংগুলোর মধ্যে ছিল মিখাইলো মুড্রিককে আর্সেনালের ট্রান্সফার ডিল হাইজ্যাক করে নিয়ে আসা। মুড্রিকের ট্রান্সফারের ব্যাপারের আর্সেনালের সাথে শাখতারের কথাবার্তা হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। মুড্রিকও আর্সেনালের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় তিনি আর্সেনালের সাথে সম্পর্কিত এমন অনেক পোস্ট করেন। কিন্তু যখন চেলসি আর্সেনালের চেয়ে বেশি টাকার প্রস্তাব দেয়, তখন শাখতার একটু পিছিয়ে যায় আর্সেনালের সাথে চুক্তির ব্যাপারে। আর্সেনালও আর চেলসির সাথে কোনো নিলাম যুদ্ধে যায়নি। তারা এই ট্রান্সফার পুরোটাই শাখতার ও মুড্রিকের উপর ছেড়ে দেয়।
কোনোরকম আগাম বার্তা ছাড়াই একরকম হুট করেই চেলসি আগ্রহ প্রকাশ করে মুড্রিকের জন্য। এ লক্ষ্যে চেলসি মুড্রিক ও শাখতার কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসে তুরস্কে। ৮ ঘণ্টার এই আলোচনায় চেলসি তাদের সামনে তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও দলে মুড্রিকের ভূমিকা নিয়ে কথা হয়। এই এক ট্রান্সফার উইন্ডোতেই চেলসি একঝাঁক তরুন ফুটবলারকে নিয়ে আসে। এই তালিকায় ফার্নান্দেজ ও মুড্রিক ছাড়াও রয়েছেন ডিফেন্ডার বেনোয়া বাদিয়াশিলে, উইঙ্গার নোনি মাদুয়েকে, মিডফিল্ডার আন্দ্রে সান্তোস ও ফরোয়ার্ড ডেভিড ডাট্রো ফোফানা। এছাড়াও ফুলব্যাক মালো গুস্তোকে কিনলেও তাকে লোনে ফেরত পাঠানো হয়েছে লিঁওতে। চলমান মৌসুমটা তিনি সেখানেই কাটাবেন।
উলটাপালটা সাইনিং, বেশি দামে খেলোয়াড় কিনে মার্কেট অস্থিতিশীল করা, এসব কিছু কারণে চেলসির ভালই দুর্নাম রয়েছে। তবে ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর চাইতে এবারেরটা অনেকটাই একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে। এবারের কেনা খেলোয়াড়গুলোর সবাই একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে রয়েছে। চেলসি এবার দূরদর্শী পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই মার্কেটে নেমেছিল। অভিজাত গুণসম্পন্ন একঝাঁক তরুন ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠন ছিল তাদের উদ্দেশ্য, অনেকটা নগর প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের দেখানো পথ অনুসরণ করা।
কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে কীভাবে চেলসি উয়েফা ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে-কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মার্কেটে এত টাকা খরচ করে। কারণ উইন্ডোতে এমন নজিরবিহীন খরচ করে বেঁচে যাওয়া খুবই বিরল।
এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি বলা একটু জটিল। তবে যদি সহজভাবে ধারণা দিতে যাই, তবে বলতে হবে কিস্তিতে দাম পরিশোধ আর খেলোয়াড়দের সাথে চুক্তির মেয়াদকালের কথা। এখানে আমরা এনজো ফার্নান্দেজের সাথের চুক্তিটিকে উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। এনজোর সাথে চেলসির চুক্তি হয়েছে একদম ২০৩১ সাল পর্যন্ত। মানে তিনি সাড়ে ৮ বছরের চুক্তি করেছেন। তো তার জন্য খরচ করা চেলসির ১০৬.৭ মিলিয়ন পাউন্ডকে সাড়ে ৮ ভাগে ভাগ করা হবে। যখন এফএফপি এই দামে প্লেয়ার কেনাকে নথিবদ্ধ করবে, তখন তারা দেখবে যে এই সাড়ে ৮ বছরের জন্য খরচ করা হয়েছে কম। কিন্তু এনজোর সাথে চুক্তি যদি ৫ বছরের হতো? তখন হয়ত এফএফপি নিয়ে চেলসির কিছুটা ঝামেলা পোহানো লাগত। তাই চেলসি তাদের সাম্প্রতিক সব সাইনিংগুলো এমন লম্বা চুক্তিতে এনেছে। সচরাচর লম্বা চুক্তি হিসেবে আমরা দেখি ৪-৫ বছরের চুক্তি। চেলসি এই লম্বা চুক্তির সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছে।
তবে এমন পরিকল্পনা অনেক সময় উল্টো ইফেক্টও ফেলতে পারে। এমন যদি হয় যে যেসব খেলোয়াড়দের কেনা হয়েছে, তারা তাদের প্রত্যাশামতো পারফর্ম করতে পারছে না, এমন অবস্থা হচ্ছে যে মার্কেটে তাদের ভ্যালুও কমে যাচ্ছে, আবার তাদের বেতনের পেছনেও অনেক খরচ হচ্ছে, তখন কী হবে? চেলসি এসব বিষয় মাথায় নিয়েই এই লম্বা চুক্তিগুলো করেছে খেলোয়াড়দের সাথে। তাই এর সমাধানও তারা তৈরিই রেখেছে।
চেলসি একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে খেলোয়াড়গুলোকে কিনেছে। সর্বোচ্চ ২৩ বছর বয়সে থাকা খেলোয়াড়গুলোর এখন উত্থানের সময়। একজন খেলোয়াড় এই বয়সেই নতুনভাবে নিজেকে অন্য স্তরে তুলে নিতে পারে। খেলোয়াড়ের বৃদ্ধির মূল সময়টাই এটি। তো হয় খেলোয়াড় এমন স্তরে পৌছাবে যে চেলসির হয়ে আশানুরূপ নৈপুণ্য দেখাবে কিংবা, বছরখানেক পর তাকে রিসেল করে দেয়া হবে। বয়স বৃদ্ধির সাথে তখন ভ্যালু কিছু হলেও থাকবে। পরিণত অভিজ্ঞতার তো একটি দাম রয়েছে।
এছাড়া খেলোয়াড়দের বেতনের ব্যাপারের এবার চেলসি কিছুটা লাগাম টেনে ধরেছে। জানুয়ারিতে দলে আসা অনেক খেলোয়াড়ই তাদের টিমমেটদের চাইতে কম বেতন পাবেন। আব্রামোভিচ যখন মালিক ছিলেন, তখন যারা এসেছিলেন, তাদের বেতন মোটামুটি বেশিই বলা চলে। এছাড়া জানুয়ারিতে আসা খেলোয়াড়দের বেতনের চুক্তিতে বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী বেতন কম বেশি হওয়ার ব্যাপারটিও উল্লেখ করা আছে। যেমন মিখাইলো মুড্রিকের বেসিক স্যালারি ঠিক করা হয়েছিল প্রতি সপ্তাহে ৯৭,০০০ পাউন্ড। যদি চেলসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ালিফাই করতে না পারে, তবে তাদের বেতন কমে যাবে। এভাবে বেতন কমে যাওয়ায় যারা আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারবে না, তাদের বিক্রি করাও সহজ হবে।
এখানে আরো একটা বিষয় আছে। আপনি যখন একজন খেলোয়াড়কে কিনবেন, তখন সেটি খরচের খাতায় এমন ভাবে লিপিবদ্ধ হবে যে আপনি তাকে যে কয় বছরের চুক্তিতে আনবেন, সেই কয় বছরে পুরো পরিমাণটা ভাগ করে খাতায় লিপিবদ্ধ হবে। সেই হিসেবে এই বছর চেলসির খরচের হিসাব যখন দেখানো হবে, তখন সেখানো এনজোকে কেনার খরচ বাবদ লেখা থাকবে ১২.৫৫ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু যখন আপনি খেলোয়াড় বিক্রি করবেন, তখন ট্রান্সফার অ্যামাউন্টের পুরোটাই বিক্রির হিসেবে আসে। চেলসি যে জর্জিনহোকে আর্সেনালের কাছে ১১ মিলিয়নে বিক্রি করল, বিক্রির হিসেবে ১১ মিলিয়নই লেখা থাকবে। তখন এই দুই ট্রান্সফারের পর চেলসির নেট খরচ আসবে মাত্র ১.৫৫ মিলিয়ন ইউরো। এই পরিমাণটা পুরোপুরি এফএফপি মেনেই হচ্ছে। ফলে চেলসিকে কোনোভাবেই এফএফপি ভঙ্গের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। প্রতি বছরেই বড় বড় ক্লাবগুলো এভাবে এফএফপিকে ডিঙিয়ে তাদের নেট খরচের পরিমাণ ঠিক রাখছে।
চেলসির এবারের এমন লম্বা চুক্তির ট্রান্সফারের পর নড়েচড়ে বসেছে উয়েফা। তারা এই লুপহোলটি বন্ধ করতে সংশোধনী এনেছে তাদের নিয়মে। এখন থেকে যত লম্বা চুক্তিই করা হোক না কেন, এটি ভাগ হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরে। ফলে বর্তমান নিয়মে ক্লাবগুলোর নেট খরচ বেড়ে যাবে এমন ক্লাবগুলো এফএফপি মেনে চলতে আরো সচেতন হবে। কোনো ক্লাবের যদি বেশি খরচ করার সামর্থ্য থাকেও, তবুও তারা চেলসির এই সিস্টেমটি অনুসরণ করতে পারবে না।
এই উইন্ডোতে বোহেলি ও ক্লিয়ারলেক কাজের কাজ যা করেছে তা হলো চেলসির স্কোয়াডের গড় বয়স কমিয়ে আনা। মালিকানায় পরিবর্তন আসার পর ক্লাবে যে বড় পরিবর্তন আসবে, সেটিও স্বাভাবিক ছিল। বোহেলিকে এখন কাজ করতে হবে আব্রামোভিচের সময় কেনা খেলোয়াড়দের নিয়ে যাদের বেতন অত্যধিক বেশি। তাদের চুক্তিগুলো নতুন বেতন কাঠামোয় কীভাবে নবায়ন করা হবে তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সত্যিই, চেলসি একটি চমকপ্রদ ট্রান্সফার উইন্ডো পার করেছে। এখন বোহেলি কি আসলেই প্যাশন থেকে এইসব করছেন, না ক্লাব নিয়ে ছেলেখেলা করছেন? সেটিই সামনে দেখার বিষয়।