২০১৪ সালের মার্চে মালয়েশিয়ায় প্রথমবারের মতো ইউরোপ ও এশিয়ার তারকা গলফারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইউরেশিয়া কাপ গলফ’। চার মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রাইজমানির এ টুর্নামেন্টে এশিয়া ও ইউরোপের দশজন করে গলফার অংশ নেন। এশিয়ার পক্ষে অংশ নেন বাংলাদেশের তারকা গলফার সিদ্দিকুর রহমান। প্রথম দিনেই ইউরোপের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এশিয়া। নির্ধারিত ১০ ম্যাচ শেষে ৭-৩ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ইউরোপ। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের শেষ রাউন্ডে দুর্দান্তভাবে ফিরে আসে এশিয়া। সিদ্দিক ও ভারতের অনির্বাণ লাহিড়ির দারুণ দু’টি জয় ও অন্যান্যদের দৃঢ়তায় মান বাঁচে এশিয়ার। ৭-৩ ব্যবধানে জেতে এশিয়া। ফলে সমান ১০-১০ ম্যাচ জিতে দুই মহাদেশীয় লড়াইয়ের প্রথম আসরটিতে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় ইউরোপ ও এশিয়া। সিদ্দিকুর রহমান নামক বাংলাদেশি তরুণ গলফার এশিয়ার মান-বাঁচানো খেলা উপহার দিয়ে নজর কাড়েন ইউরোপ ও এশিয়ার গলফার, দর্শক ও মিডিয়ার।
মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন যদি থাকে আকাশ ছোঁয়ার, আর সে জন্য যদি কেউ পরিশ্রম করে যায় অবিরাম, তাহলে একদিন সেই স্বপ্নের পাখি ধরা দেবেই, নিশ্চিত করে এটা বলাই যায়।
প্রতিটি মানুষই কমবেশি প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিভার সাথে পরিশ্রম আর স্বপ্ন দেখার সাহস যখন যোগ হয়, তখনই মূলত মানুষ সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন, যাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত প্রতিভা কম, কিন্তু পরিশ্রম সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেয় খুব ভালোভাবেই। আবার অনেকে প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু পরিশ্রম করতে না পারায় প্রতিভাকে সাফল্যে অনূদিত করতে পারে না। প্রতিভা, পরিশ্রম আর স্বপ্ন দেখার বাইরে আরও একটা ব্যাপার সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সেটা হলো, মানুষ জন্মগতভাবেই ধনী কিংবা দরিদ্র হয়ে জন্ম নেয়। জীবনে সফলতা বা ব্যর্থতার পেছনে এই ব্যাপারটাও কম ভূমিকা রাখে না।
বলছিলাম গলফার সিদ্দিকুর রহমানের কথা।
আমাদের দেশে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ব্যাডমিন্টন ও গ্রামগঞ্জের কাবাডির বাইরে অন্য খেলাগুলো খুবই অবহেলিত, অপ্রচলিত খেলা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এমনকি পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত খেলা গলফ নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম। এই খেলাটি বোঝেন, এরকম মানুষ আমাদের চারপাশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবু আজ এক গলফারকে নিয়েই এই লেখাটি। আরও অনেক আগেই যাকে নিয়ে লেখা উচিত ছিল, লিখেছেনও অনেকে। যিনি গলফ মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন, যার জন্য বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে গলফের জন্যও চেনে, তিনিই হলেন সিদ্দিকুর রহমান।
দুইটি এশিয়ান ট্যুর, ছয়টি পেশাদার টুর্নামেন্ট, বারোটি অপেশাদার টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়া শুধু নয়, দেশের একমাত্র গলফার হিসেবে খেলেছেন বিশ্বকাপে, দেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ হিসেবে ওয়াইল্ড কার্ড ছাড়া সরাসরি খেলেছেন অলিম্পিকে। শুধু তাই নয়, র্যাঙ্কিংয়ে এশিয়ার সেরা দশজন গলফারের মধ্যেও ছিলেন অনেকদিন। এত এত সাফল্য যার ঝুলিতে, যিনি ইতঃমধ্যেই দেশের গলফের সবচেয়ে বড় তারকা ও গ্রেট হয়ে গেছেন, তারও ছিল এক কষ্টের অতীত, তারও আছে এক অবিশ্বাস্য সংগ্রামের গল্প।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মাদারীপুরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের খেটে খাওয়া যুবক আফজাল হোসেন সাহেব ঢাকায় চলে আসেন সপরিবারে। ভাড়ায় ওঠেন ধামালকোট নামের এক বস্তির বাসায়। আফজাল হোসেন-মনোয়ারা বেগম দম্পতির ঘরে ১৯৮৪ সালের ২০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তাদের তৃতীয় সন্তান সিদ্দিকুর রহমান। জন্মের পর থেকেই অভাব-অনটন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। বাবা কখনো অটোরিকশা, কখনো ট্যাক্সি চালিয়ে খুব কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাতেন। একবেলা খাবার জুটত, উপোস থাকতে হতো। সেই সাথে সন্তানদের পড়াশোনার খরচও চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতেন আফজাল হোসেন।
ছেলেদের নিয়ে আফজাল হোসেন সবসময় আরেকটি ভয়ে থাকতেন। ধামালকোট বস্তিটি ছিল সন্ত্রাস ও মাদকের আতুড়ঘর। ফলে ছেলেরা নষ্ট হয়ে যায় কি না, সেই ভয়ে থাকতেন। একদিন শুনলেন, সিদ্দিক স্কুল থেকে ফিরে বস্তি থেকে মাইলখানেক দূরে কুর্মিটোলা নামক জায়গায় সেনাবাহিনীদের গলফ খেলায় গিয়ে বল কুড়োনোর কাজ করে। শুনে স্বস্তি পান তিনি। সেনা অফিসারদের সান্নিধ্যে থাকলে ছেলেরা নষ্ট হবে না, অন্তত এটাই ছিল স্বস্তির কারণ। কিন্তু কে জানতো, সেই বল কুড়োনো ছেলেটাই যে একদিন নিজ হাতে লিখবে দেশের পেশাদার গলফের ইতিহাস!
একদম শৈশবে সিদ্দিক বল কুড়োতেন কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে। কেতাবি ভাষায় ‘বলবয়’ ডাকা হতো তাকে। বিনিময়ে পেতেন প্রতিদিন ত্রিশ টাকা মজুরি। স্কুল থেকে ফিরে বইখাতা বাসায় রেখে, কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়েই দৌড় দিতেন গলফের মাঠে৷ এভাবেই একদিন ‘বলবয়’ থেকে ‘প্রমোশন’ পেয়ে ‘ক্যাডি’ হয়ে যান। সাধারণত গলফারদের গলফ ক্লাব, ব্যাগ ও সরঞ্জাম বয়ে বেড়ান ও মেইনটেন্যান্স করাই ক্যাডির কাজ। আনন্দের সাথেই সে কাজটি করলেও নিজে খেলার একটা তাড়না অনুভব করতেন তিনি।
কিন্তু গলফ ক্লাব আর সরঞ্জামগুলো তো অনেক দামী! বুদ্ধি বের করেন তিনি। লোহার রড দিয়ে কামারের কাছ থেকে কোনোরকমে চলনসই একটা গলফ ক্লাব বানিয়ে সেটা দিয়েই খেলতে শুরু করেন তিনি। ক্যাডিবয়ের কাজের পাশাপাশি নিজের গলফ-চর্চাও চলতে থাকে সমানতালে।
এই শতকের শুরুর দিকে গলফ ফেডারেশন দেশে পেশাদার গলফার তৈরির জন্য উদ্যোগ নেয়। প্রথমেই বলবয়, ক্যাডিদের মধ্য থেকে খেলোয়াড় বাছাই করা শুরু হয়। সেই বাছাইয়ে টিকে যান সিদ্দিক, শুরু হয় প্রশিক্ষণ। তার একাগ্রতা, পরিশ্রম ও অনুশীলনে দারুণ খেলা দেখে অপেশাদার গলফের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলতে পাঠানো হয়। একের পর এক অপেশাদার টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে থাকেন। সার্কভুক্ত সকল দেশেই অপেশাদার গলফ টুর্নামেন্ট জেতেন তিনি, করেন অনন্য রেকর্ড। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল আর নিজ দেশ মিলিয়ে ১২টি অপেশাদার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেকে পেশাদার গলফের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালের দিকে প্রবেশ করেন গলফের পেশাদার জগতে। সেখানেও কয়েকটা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। বিশেষ করে প্রথম বাংলাদেশি গলফার হিসেবে ২০০৮ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত ৩০ লাখ রুপির প্রফেশনাল গলফ ট্যুর অব ইন্ডিয়ায় প্রফেশনাল প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপের টাইটেল জিতে প্রথম বিজয়ের স্বাদ পান। এর পর ইন্ডিয়ান সার্কিটে আরও দু’টি বিজয়সহ অন্যান্য টুর্নামেন্টে সফলভাবে অংশগ্রহণ করে পেশাদার গলফের ভুবনে দারুণভাবে পরিচিতি পান।
২০০৮ সাল থেকে শুরু করেন এশিয়ান ট্যুরে অংশগ্রহণ। এশিয়ান গলফের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা এশিয়ান ট্যুরের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ভালো খেলতে থাকেন নিয়মিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পান ২০১০ সালের ১লা আগস্ট, প্রথম এশিয়ান ট্যুর ব্রুনেই ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সিদ্দিকুর রহমানের সৌজন্যে গলফের ভুবনে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
এরপর একের পর এক এশিয়ান ওপেনের টুর্নামেন্টে দারুণ খেলতে থাকেন, এশিয়ান র্যাঙ্কিংয়ে একসময় নয় নাম্বারে ওঠে আসেন। শুধু তাই নয়, হতদরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা এক ‘ওয়ান্ডার বয়’ লাখ লাখ ডলার প্রাইজমানি পেতে শুরু করেন। আয় বাড়তে থাকে হু হু করে।
একদিন পান দারুণ সুসংবাদ। এশিয়ান র্যাঙ্কিংয়ে সেরাদের কাতারে থাকার সুবাদে ২০১৩ গলফ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়ে যান।
গলফ বিশ্বকাপের ঠিক আগেই আরেকটি বড় সাফল্য এসে যোগ হয় সিদ্দিকুর রহমানের ক্যারিয়ারে। এশিয়ান ট্যুরের অন্যতম জনপ্রিয় ও বড় টুর্নামেন্ট হিরো ইন্ডিয়ান ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের দ্বিতীয় এশিয়ান ট্যুরের শিরোপা জয় করে নেন। অনির্বাণ লাহিড়ি ও চৌরাশিয়ার মতো ভারতীয় গলফারদের হারিয়ে ঐ টুর্নামেন্ট জেতা ছিল দারুণ একটি সাফল্য। ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বাংলা ভার্সন এই সময় সিদ্দিককে ‘বাংলার টাইগার উডস’ উপাধিতে ভূষিত করে তখন। আর সিদ্দিকও স্বপ্ন দেখেন, একদিন টাইগার উডস, লি ওয়েস্টউড, গ্রেগ নরম্যান, আর্নি এলস’দের মতো কিংবদন্তি গলফারদের সাথে খেলবেন।
বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে বরাবরই ওয়াইল্ড কার্ড নামক দাক্ষিণ্যের সৌজন্যে খেলতে যায়। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিও অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি খেলার সুযোগ পান। বিশ্বে ২০০টির বেশি দেশে পেশাদার গলফারের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি, তার মধ্যে মাত্র ৬০ জন সুযোগ পান অলিম্পিকে খেলার। এই ৬০ জনের মধ্যে প্রায় ৩০ জন শুধু আমেরিকা থেকেই অংশ নেন। বাকি ৩০ জনের মধ্যে একজন গলফার হিসেবে ২০১৬ সালের অলিম্পিকে দেশের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করে দেশকে দারুণ সম্মানিত করেন সিদ্দিকুর রহমান।
গলফ খেলতে খেলতেই কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে এক অ্যামেচার গলফার তরুণীর সাথে পরিচয় হয় সিদ্দিকের। তরুণীটির নাম অরণি। দুই পরিবারের সম্মতিতে সে পরিচয় পরিণয়ে গড়ায়। গলফার দম্পতির বিয়ে হয় ২০১৫ সালের ২০শে জানুয়ারি। অরণি নিজে জাতীয় অ্যামেচার ওপেনে তিনবার রানার্সআপ, বাংলাদেশ গেমসে সেনাবাহিনীর হয়ে ব্রোঞ্জ ও দলগতভাবে সোনা জেতা গলফার। বিয়ের পর অবশ্য অরণি কোচিংয়ে ঝুঁকে গেছেন। সেই সাথে সিদ্দিকের ব্যাকআপ হিসেবে বিভিন্ন ট্যুরে নানাবিধ কার্য সম্পাদনাও করে থাকেন তিনি।
গলফ একটি ব্যয়বহুল খেলা। নিতান্তই দরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা সিদ্দিককে দেখে অনেকেই এখন গলফের দিকে ঝুঁকছেন। দেশে এখন নিয়মিত প্রায় প্রতি বছরই এশিয়ান ট্যুরের টুর্নামেন্ট হয়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকেই ওঠে আসতে পারছেন না। সিদ্দিকের সাথে শুরুতে দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর ছিল, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এত দূর আসতে পেরেছেন বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছেন। পর্যাপ্ত সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সিদ্দিকের মতো আরও গলফার ওঠে এসে বিশ্বদরবারে দেশকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাবেন, এটা বলে দেয়াই যায়।
টানা খেলার ধকল ও নানা ইনজুরিতে আক্রান্ত সিদ্দিকের ফর্ম একটু পড়তির দিকে এখন। যদিও আবারও ঘুরে দাঁড়াবার সকল সুযোগই আছে তার সামনে। ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, কিংবা না-ই পারেন, ইতঃমধ্যে সিদ্দিক যা করেছেন, তাতে দেশের গলফের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি মহাতারকা হয়েই যে বেঁচে থাকবেন, তাতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই কারোরই। শুভকামনা সিদ্দিকুর রহমানের অনাগত দিনগুলোর জন্য।