১
‘উই উইল, উই উইল রক ইউ…’
কুইনের সেই বিখ্যাত গানটি যখন নটিংহামে বাজছে, গ্যালারিতে ‘বাংলাদেশি’ ও ‘বাংলাদেশের’ সমর্থকদের উপচে পড়া ভিড়। একে অন্যের হাতে হাত রেখে সমস্বরে গলা মেলাচ্ছে গানের সাথে। মুখে হাসি, কন্ঠে গান আর হাত নিয়মিত বিরতিতে হাত নাড়ানো দূর থেকে দেখে মনে হয় বিশাল মানব ঢেউ। এই ঘটনার মুহূর্তখানেক আগেই কেবল মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মাত্র ৮৩ বল মোকাবেলা করে পার করেছেন ঝড়ো ১০০ রানের জুটি। এটা তারই উদযাপন।
কার্ডিফে ২০০৫ সালে সেই প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতেছিল বাংলাদেশ। দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এখনও সেই ম্যাচের কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হন। পুরনো সেই স্মৃতিকথা মনে রেখে, বুকে ধারণ করেই বিশ্বকাপের মাঠে অজিদের বিপক্ষে খেলতে কিংবা লড়তে নয়, ‘জিততে’ নেমেছিল বাংলাদেশ দল। টসে হার দিয়ে শুরু। কিন্তু অধিনায়কসহ দুই দলের সবাই জানতেন, এই উইকেট রানের স্বর্গ। তাই যত যা-ই হোক, রান হবে বন্যার মতো। কিন্তু বাংলাদেশের বোলাররা যেন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল শেষ ১০ ওভারে। ফলাফল, বাড়াবাড়ি দলীয় রান গিয়ে ঠেকলো ৩৮১ তে!
এই বাংলাদেশ অন্য ধাতুতে গড়া। ৩৮১ রান চেজ করা তো দূরে থাক, নিজেদের ইতিহাসে এত রান কখনো করেইনি মাশরাফিরা। তবুও, মিরাকলের স্বপ্নেই ব্যাটিং শুরু। ওপেনিং জুটি থেকেই ক্রমশ ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দেওয়া বাংলাদেশের লাইনআপ ইংলিশ কন্ডিশনে টর্নেডো বইয়ে দেয় চতুর্থ উইকেটে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-মুশফিকুর রহিম জুটিতে ধীরে ধীরে ‘উইনিং প্রেডিক্টর’ এর ক্রমিক বদলে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। তারপরও নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের মোট রানের রেকর্ড গড়ে থেমেছে এই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ৮ উইকেটে ৩৩৩ রানে থেমে গেছে বাংলাদেশের ইনিংস। হার ৪৮ রানের ব্যবধানে।
২
শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কেবল একটি ওয়ানডেতেই জয় আছে বাংলাদেশের। কিন্তু সময় যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের চেহারা। চলতি আসরে দলের পুরনো ম্যাচগুলো তো বটেই, গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান দেখে তা হয়তো আগেই বুঝে নিয়েছিল অজিরা। এর বাইরেও নিয়মিত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের সাথে খেলতে গিয়ে সাবেক বিশ্বজয়ীরা টের পেয়েছে বাংলাদেশের শক্তি। সবকিছু মিলিয়ে তাই তারাও ছিল সতর্ক। বিশেষ করে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ সেমিফাইনাল নিশ্চিত করতে মরিয়া। তাই ম্যাচটি তাড়া জিততেই চেয়েছিল।
নটিংহামে টসে হার দিয়ে শুরু। বল হাতে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা জিতলে অবশ্য ব্যাটিং নিতেন। কিন্ত তিনি এটাও জানতেন, এই উইকেট এতটাই ব্যাটিং স্বর্গ যে, টসে হার-জিত খুব বেশি ব্যবধান করে না। কিন্তু নিজেদের বোলিংয়ে কাজটি এখন ঠিকভাবে করতে পারলেই হয়।
বোলিংয়ে বাংলাদেশের মন্ত্র জানা যায়নি। তবে শেষ ১০ ওভারে অজিরা একেবারে চড়ে বসেছিল উপমহাদেশের এই ক্রিকেটারদের উপর তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাইরে ওয়ার্নারের ব্যক্তিগত ১০ রানের মাথায় ক্যাচ ফেলে দেওয়া, বাজে ফিল্ডিং; সবকিছুর মাশুল দিন শেষে দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। যে কারণে ওয়ার্নারের ব্যাট ফুলেফেঁপে ১৬৬ রানের ইনিংস খেলেছে। অ্যারন ফিঞ্চকে নিয়ে ওপেনিংয়ে ১২১ রানের জুটি, দ্বিতীয় উইকেটে ১৯২ রানের জুটি দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বোলিংয়ের হালচাল। এই ম্যাচে বল হাতে চমক দেখিয়েছেন দলের ‘স্ট্রাইক’ ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার। তার মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে কাবু হয়েছে তিনজন অজি ব্যাটসম্যান!
বল হাতে একমাত্র মেহেদি হাসান মিরাজ ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন খরুচে। সবকিছু মিলিয়ে পাঁচ উইকেটে অস্ট্রেলিয়া তুলে নেয় ৩৮১ রান।
৩
প্রথম ইনিংসের ৪৯তম ওভারে যখন বৃষ্টি নামে, খেলা বন্ধ হয়ে যায়। তখন হয়তো মনে হয়েছিল বৃষ্টি না থামতে দেরি হলে খেলা গড়াবে বৃষ্টি আইনে। যেখানে বাংলাদেশ হয়তো কিছুটা সুবিধা পেতে পারে। আবার সমর্থকরা এটাও চেয়েছেন, ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেসে গেলেই বোধ হয় ভালো হয়। অন্তত পয়েন্ট ভাগাভাগিতে সান্ত্বনা পাওয়া যাবে। কিন্তু বিধাতা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো বাংলাদেশকে ‘ফাউ’ পয়েন্ট দিতে চাননি। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল বলেই কি না নিজেদের জাত চেনাতে পেরেছিল বাংলাদেশ। অন্তত এই হারে সমর্থকদের মন ভাঙ্গেনি, প্রতিপক্ষের চোখে ছিল সমীহ, কলজেতে ধরেছিল ভয়ের টান।
পুরস্কার বিতরণীতে অ্যারন ফিঞ্চ সেই কথা অস্বীকার করেননি। রিয়াদ-মুশফিক জুটিতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন তা স্বীকার করেছেন। প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ১৬৬ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হওয়া ওয়ার্নার। বলেছেন,
এই ম্যাচে জয় পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। দুটো পয়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কন্ডিশনে আপনাকে ভালো করতে হলে আবহাওয়ার সাথে মানাতেই হবে। অসাধারণ একটা ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের সাথে। মুশফিক খুব ভালো খেলেছে। ম্যাচটা উপভোগের ছিল।
ভুলটা যা করার বাংলাদেশের বোলাররা করে ফেলেছিল। ৩০০ রান পার হবে তা জানা কথা। কিন্তু ৩৮১ পর্যন্ত যাবে তা অভাবনীয়। সেই বাংলাদেশ গিয়ে থামলো ৩৩৩ রানে। তখনও হাতে দুই উইকেট। এবারের বিশ্বকাপে এই প্রথম হাফ সেঞ্চুরি পার করতে পারলেন তামিম ইকবাল। খেললেন ৬২ রানের ইনিংস। তবে তার মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছ থেকে এই ম্যাচের এই অবস্থায় ৭৪ বলে ৬২ রানের ইনিংস খানিকটা বিলাসিতা হয়ে যায়। তামিম ছাড়া দলের বাকি সবাই কম বলে বেশি রান করেছেন। সৌম্য যখন ৮ বলে ১০ রান করে রানআউট হলেন, তখন দলীয় রান কেবল ২৩। তিনি থাকলে হয়তো রানের চাকা আরেকটু গতি পেতো। আগের ম্যাচগুলোতে দুই সেঞ্চুরি আর দুই হাফ সেঞ্চুরি করা সাকিব এবার ৪১ রানে ফিরেছেন। উইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো লিটন কুমার দাস ২০ রানে ফিরেছেন। তারপর বড় জুটি গড়েন মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক। মূলত তাদের ইনিংসেই জয়ের সুবাতাস টের পায় বাংলাদেশের সমর্থকরা।
প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, অ্যাডাম জাম্পা আর ম্যাক্সওয়েলদের একরকম উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই দুই ব্যাটসম্যান। হতাশ হয়েছিল অজি বোলাররা। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? ৫০ বলে ৬৯ রান করে থেমে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। এরপর বাংলাদেশের একমাত্র টি-টোয়েন্টি স্পেশালিষ্টখ্যাত সাব্বির রহমান মাঠে নেমেছিলেন। তখন আর ৩০ বলও বাকি নেই । রান প্রয়োজন ৭০ এর উপরে। এই সময়ে সাব্বিরের থেকে টি-টোয়েন্টির মতোই ইনিংস আশা করেছিল ড্রেসিংরুম। কিন্তু কোল্টার-নেইলের ওভারে নিজের প্রথম বলেই বোল্ড হলেন সাব্বির।
এরপর মাশরাফি উইকেটে এলেন। ততক্ষণে জয়ের স্বপ্ন শেষ হয়ে এসেছে বাংলাদেশের। ফিকে হয়ে এসেছে সেমিফাইনালের স্বপ্ন। ওই মুহূর্তে মুশফিকের সেঞ্চুরিটা পার করাই দলের প্রাপ্তি ছিল। মাশরাফি মুশফিককে সেই কাজে সফল করতে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ইনিংসের শেষ পর্যন্ত মুশফিক ১০২ রানে অপরাজিত ছিলেন। আর শেষ বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আউট হন মাশরাফি (৬)।
৪
মুশফিক-মাশরাফিরা যখন মাঠ ছাড়ছিলেন, তার আগেই নিজেদের মধ্যে জয়ের উদযাপন করে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের এমন পারফরম্যান্স তাদের মন ভুলিয়েছে। সম্মান জানিয়ে তাই এই দুই ব্যাটসম্যানের সাথে সাথে অনেকটা দূর হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানালো পুরো অস্ট্রেলিয়া দল।
অবশ্যই ৩৮২ রানের লক্ষ্য পার করতে হলে বাংলাদেশকে রেকর্ড গড়তে হতো। বাংলাদেশ দল তা গড়েছেও। ভেঙেছে ওয়ানডেতে অতীতের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। কিন্তু তারপরও পৌঁছতে পারেনি জয়ের বন্দরে। এর পেছনে যেমন ব্যাটিংয়ের দৃঢ়তা এগিয়ে দিয়েছিল, তেমনই নামিয়ে দিয়েছিল বোলিংয়ের ব্যর্থতা।
বিশ্বকাপে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ইংলিশ কন্ডিশনে বড় রান হবে, সেই বড় রান তুলতে ও চেজ করতে পারা। এখন পর্যন্ত দল সেটা ভালোই পেরেছে। প্রতি ম্যাচেই একাধিক ব্যাটসম্যান বড় রান পাচ্ছে, বাড়ছে দলীয় সংগ্রহ। এই ম্যাচে হার বাদ দিলে, ব্যাটিংয়ের প্রায় সবটুকুই প্রাপ্তি। এমন রোমাঞ্চকর ম্যাচে বাংলাদেশ নিজেদের জাত চিনিয়েছে তা বলার অবকাশ নেই।
কিন্তু প্রায় প্রতি ম্যাচেই ব্যর্থ দলের বোলাররা। চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে অলআউট করতে পারেনি।
সবকিছু মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ নিজেদের হারের পেছনে কেবলই বোলিং ব্যর্থতাকে দায়ী করতে পারছে। ম্যাচ শেষে মাশরাফি বলেছেন,
প্রায় ৪০ ওভার পর্যন্ত ওরা ওভারপ্রতি ৬ করে নিয়েছে। তার আগপর্যন্ত আমরা ম্যাচে ছিলাম। এরপর রানটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। ওরা যে শটই খেলেছে, তাতেই রান পেয়েছে।
তামিমের আক্ষেপ ভুল সময়ে আউট হওয়াতে। এ নিয়ে বলেছেন,
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি ভুল সময়ে আউট হয়ে গেলাম। সাকিবও আউট হয়ে গেল। ভালো জুটি হচ্ছিল আমাদের। আমরা ভালো খেলেছি, তবে আরও ভালো হতো যদি ভুল সময়ে উইকেট না পড়ত।
৫
কার্ডিফে ২০০৫ সালে জয়ের পর লিমুজিনে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন মাশরাফিরা। সেই সময়ের বাংলাদেশ গিলক্রিস্ট-হেইডেনদের হারিয়েছে, এই খুশিতে আনন্দ ভ্রমণ হয়েছিল বাংলাদেশ দলের। ১৪ বছর পর ইংল্যান্ডদে লিমুজিনে চড়া মাশরাফিদের জন্য খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু জয়ের উদযাপন যে এবারও হতো তা নিশ্চিত। এই ম্যাচটি বাংলাদেশ হয়তো ভুলে যাবে। কিন্তু প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া মনে রাখবে অনেকদিন। আর বাংলাদেশ, নিজেদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে বাকি তিন ম্যাচে লড়বে মরিয়া হয়ে।
হেরেও যে জয়ী দলের চাইতেও বেশি প্রসংশার ভাসা যায় তা বৃহস্পতিবার প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। পুরো ক্রিকেট বিশ্ব মেতেছে বাংলাদেশ বন্দনায়।
আর মাশরাফি নিজের দল নিয়ে বলেছেন,
এটাই আমাদের ইতিহাসের সেরা ওয়ানডে দল। আজ মুশফিক-তামিম-সাকিব-রিয়াদ খুব ভালো খেলেছে। ৪০-৫০ রান বল হাতে কম দিতে পারলে ফলাফলটা অন্যরকম হতে পারতো। আমরা ব্যাট হাতে তারপরও ম্যাচের প্রথম বল থেকে ইতিবাচক ছিলাম, জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমেছিলাম।