বিগ ব্যাশ ক্রিকেটে বড় চুক্তিতে সিডনি থান্ডার্সের কোচ হয়েছেন সাবেক নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটার শেন বন্ড। এই সময়ে নিজের জীবনের ক্রিকেট সংগ্রাম ও টি-টোয়েন্টির অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন সাবেক এই ফাস্ট বোলার।
আমি বিরাট সৌভাগ্যবান। এই খেলাটায় আমরা সকলেই তাই।
আমি যখন প্রথম ক্রিকেট শুরু করি, কখনো কল্পনাই করতে পারিনি যে, আমি এটাকেই জীবিকা করে নিতে পারবো কোনোদিন। আসলে আমার বয়স যখন ২৪, আমি তখন ক্রিকেট ছেড়ে একটা সত্যিকারের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলাম। এর তিন বছর আগে আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক হয়েছিলো। সে সময় আমরা একটা চার দিনের ম্যাচের জন্য ৮০০ মার্কিন ডলারের মতো পেতাম। ক্যান্টারবুরির সাথে আমার প্রথম চুক্তি ছিল ২,০০০ ডলারের।
এটা দিয়ে চলা সত্যিই খুব কঠিন ছিল। ফলে এক গ্রীষ্মে আমি পুলিশকর্মী হতে ক্রিকেট থেকে বের হয়ে গেলাম। তবে সমস্যা হলো, খুব দ্রুতই আমি বুঝে ফেললাম, আমি খেলাটাকে খুব মিস করছি। ফলে পরের শীতেই আমি একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম, আমার পুলিশের কাজের সাথে ক্রিকেটটাকে মিশিয়ে ফেললাম। আমার সারা বছরের ছুটির বদলে আমি বছরে একবারে ছয় থেকে সাত সপ্তাহ ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললাম। অ-মৌসুমের এই সব ছুটি আমি জমিয়ে ফেলতে শুরু করলাম, আর গ্রীষ্মে এসে ক্রিকেট খেলতে শুরু করলাম।
আমি ক্রাইস্টচার্চ মধ্যাঞ্চলের একজন কনস্টেবল ছিলাম। শুক্রবার ও শনিবার আমার সন্ধ্যার কাজের পালা শুরু হতো ৭টায়, এবং শেষ হতো গিয়ে ভোর ৪টায়। ভোর চারটাও এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। আপনি যদি সাড়ে তিনটায় কাউকে হাজতে ঢোকান, সব প্রক্রিয়া শেষ করতে এবং কাগজের কাজ শেষ করতে আপনাকে চারটারও অনেক পরে বের হতে হবে।
আমার মনে আছে, আমি একবার একজনকে ওরকম সাড়ে তিনটায় হাজতে ঢুকিয়েছিলাম। কাগজপত্রের কাজ শেষ করেছিলাম ৫টায়। এরপর বিছানায় গিয়ে একটু ঘুমানোর পর আড়াই ঘন্টার মধ্যেই উঠে পড়তে হয়েছিলো। এরপর গাড়ি চালিয়ে ক্রিকেট ক্লাবে গেলাম, সেখানে ৬টা অবধি খেললাম। তারপর গোসলের জন্য শাওয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, এরপর আমার পরের শিফটের কাজের জন্য পুলিশ স্টেশনে ছুটলাম। মাঝরাত অবধি ছোটাছুটি করতে হলো, একেবারে যেন বিধ্বস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। ওই শিফটে আমি বেশ কয়েকটা রেড বুল শেষ করে ফেলেছিলাম।
এরকম যেদিন দেরি করে কাজ শেষ হতো, মাথা নিচু করে মাঠে যেতাম। আশা করতাম, আমাদের অধিনায়ক টসে জিতবে এবং ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেবে। অথবা প্রতিপক্ষ অধিনায়ক আমাদের ব্যাটে পাঠাবে। যাতে আমি আর খানিকটা সময় ড্রেসিংরুমে একটু ঝিমিয়ে নিতে পারি। এটা খুব চ্যালেঞ্জিং একটা সময় ছিল। কিন্তু জীবন তো এরকমই।
এর কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের সিরিজের জন্য বাছাই করা হলো। আর কিছুদিন পর আমি নিজেকে অস্ট্রেলিয়ায় নিউজিল্যান্ড দলের হয়ে অভিষেকের জন্য আবিষ্কার করলাম। আমার মনে হয়, আমরা প্রতি টেস্টের জন্য ৩ হাজার ডলারের মতো পেতাম। আর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ওই সফরের শেষে আমাকে ১৫ হাজার ডলারের একটা চুক্তি প্রস্তাব করলো। আমি খুব উৎসাহী হয়ে পড়লাম। আমি সেই সময় ভাবছিলাম, ‘জিসাস, দারুণ তো! আমি এখন খেলার জন্য, আর জিমে যাওয়ার জন্য কিছু টাকাও পাচ্ছি।’
ওই বছরের শেষে ‘প্লেয়ারস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠিত হলো। আমাদের জন্য খেলাটা রাতারাতি পেশাদার একটা ব্যাপারে পরিণত হলো। খেলোয়াড়দের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সরাসরি আলোচনা চলতে থাকলো। ক্যান্টারবুরিতে সে সময় নিউজিল্যান্ডের বেশ কিছু ক্রিকেটাররা খেলেন; স্টিফেন ফ্লেমিং, নাথান অ্যাস্টল, ক্রিস কেয়ার্নস, ক্রিস হ্যারিস, ক্রেইগ ম্যাকমিলান। আর প্রধান নির্বাহী মার্টিন স্নেডেন আমাদের সাথে নতুন একটা চুক্তি করার জন্য সবকিছু করলেন। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো একটা অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। আমার এখনও মার্টিনের প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি ক্রিকেটটা স্রেফ ভালোবাসা থেকেই খেলেছি। জীবনের কোনো সময়ে এসেই এটাকে একটা চাকরি বলে মনে করিনি।
এখন আমরা আইপিএল নিলাম, গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগ এবং বিলিয়ন ডলার ক্রিকেট সম্প্রচার চুক্তির যুগে বাস করছি। আমার বয়সী অনেক ক্রিকেটার আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কী মনে হয় না যে, আমাদের বয়স যখন ২৫ ছিলো, তখন এগুলো থাকলে ভালো হতো?’
আমি মনে মনে ভাবি, ‘নাহ। আমি যেভাবে খেলেছি, তাতেই আমি খুব খুশী।’
আমি অল্প সময়ের জন্য হলেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা পেয়েছি। আমি ক্রিকেটকে একটা স্বপ্নের মতো বাঁচিয়ে রেখেছি এবং কোচিংকে একটা আবেগ হিসেবে গড়ে তুলেছি; আজ যেটাকে আমি পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি। আজকের দিনগুলোতে দলগুলোর এত অ্যাসেট আছে যে, তারা ক্রিকেটারদেরকে ক্রিকেট-পরবর্তী জীবনের জন্যও প্রস্তুত করে দিতে পারে। আমি যখন শুরু করেছি, তখন জীবন ও ক্রিকেটকে স্রেফ কোনোক্রমে ম্যানেজ করে চালাতে হতো। এটা অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিল।
আমি আজ নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। কারণ এই গ্রীষ্মে আমি বিগ ব্যাশ লিগে সিডনি থান্ডার্সের কোচিং করাতে যাচ্ছি। এটা একটা প্রাপ্তি।
আমি কখনো মনে করি না যে, জীবনে একদিন আমি ক্রিকেটের ক্ষেত্রে চাকরি করেছি। কারণ, আমি এটাকে ভালোবাসি। অবশ্যই আমি যখন প্রথম এটা শুরু করলাম, তখনই হয়তো জীবনে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রভাবটা টের পেতাম। হয়তো পেতাম, কিন্তু সেটা টেকেনি।
আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেট ম্যাক্সটা একটা বড় ব্যাপার ছিলো। সেটা ছিল মার্টিন ক্রো’র মস্তিষ্কজাত একটা ব্যাপার। ওখানে দুটো দশ ওভারের ইনিংস ছিল, শট করলে আপনি দ্বিগুন রান পেতেন। ওখানে প্রায় হাজারপাঁচেক দর্শক হতো। নিউজিল্যান্ডের জন্য সেটা ভালো দর্শক ছিল।
কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ টি-টোয়েন্টির মতো শুরুটা পায়নি। আমার মনে আছে, আমি ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ২০ ওভারের খেলাটা দেখেছিলাম। এরপর ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো আকর্ষণটা আরও বেড়ে যায়। আর এরপরই আমি ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (অধুনা নিষিদ্ধ লিগ আইসিএল) থেকে প্রস্তাব পাই।
আইসিএল ছিল একটা ভারতীয় টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু করা টুর্নামেন্ট। এটা আইপিএলের আগে শুরু হয়েছিলো। একজন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার হিসেবে আমাকে যে অর্থ প্রস্তাব করা হয়েছিলো, তা আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট থেকে ছাড়পত্র পেয়েছিলাম, এবং ওখানে সই করেছিলাম। ইচ্ছেটা ছিল নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলার ফাঁকে ফাঁকে ওটা খেলবো।
কিন্তু এর মধ্যেই আইপিএল এলো ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের উদ্যোগে। তারা আইসিএলকে বিদ্রোহী লিগ বললো। আর আমাকে বলা হলো, আমি যদি আইসিএলের চুক্তি বহাল রাখি, তাহলে আর নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারবো না।
আমি শাঁখের করাতে আটকে গেলাম।
আমি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে আদালতের পথে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা করতে চাইনি। আমি আইসিএলের চুক্তিকে সম্মান দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আর ব্ল্যাক ক্যাপস থেকে সরে দাঁড়ালাম। প্রায় দেড় বছর আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলাম।
আইসিএল ছিল এমন একটা ব্যাপার, যেরকম অভিজ্ঞতা আমার ক্রিকেটে এর আগে কখনো হয়নি। সাধারণত কী হয়, একটা সিরিজশেষে বড়জোর প্রতিপক্ষের সাথে আপনার একবার ড্রেসিংরুমে দেখা হয়। কিন্তু এখানে আমরা সব দল একই হোটেলে থাকতাম। আমরা সবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলাম। এর আগে যাদের বিপক্ষে খেলেছি, সেই ল্যান্স ক্লুজনার, জ্যাসন গিলেস্পি, ডেমিয়েন মার্টিনের সাথে প্রতি রাতে ক্রিকেট এবং জীবন নিয়ে কথা বলতাম।
আমি এমন একটা দলে খেলতাম, যেখানে এশিয়ান খেলোয়াড়দেরই আধিক্য ছিল। আমি এমন একজন খেলোয়াড়, যে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু ভারতে আপনি রাত ১০টা থেকে মাঝরাত অবধি যেকোনো সময় রাতের খাবার খেতে পারেন। এখন তো মুম্বাইকেই আমার দ্বিতীয় বাড়ি বলে মনে হয়।
আইসিএলের মতো আইপিএলেও এই সংস্কৃতির বন্ধন ভাঙা, আর খেলোয়াড় ও কোচদের কাছে আনার ক্ষেত্রে অসাধারণ একটা টুর্নামেন্ট। এটা এমন একটা টুর্নামেন্ট, যেখানে আপনার প্রতিপক্ষও এক মাসের জন্য আপনার সতীর্থ হয়ে যেতে পারে।