ফুটবলে সবচেয়ে বড় মঞ্চটি হচ্ছে বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপে ভালো খেলা উপহার দেওয়া প্রতিটি ফুটবলারের জন্যই বড় কিছু। ভালো খেলার সংজ্ঞাটা ভিন্ন ভিন্ন পজিশনের খেলোয়াড়দের জন্যও ভিন্ন রকমই হবে। গোলকিপারের ভালো খেলা মানে নিজের গোলবার অক্ষুণ্ন রেখে দলকে গোল খাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। কিন্তু স্ট্রাইকারের ভালো খেলাটা সিংহভাগ নির্ভর করবে সে গোল পাচ্ছে কি না তার উপরে।
একটি দল যদি সাফল্য পেতে চায় তবে রক্ষণভাগ ও আক্রমণভাগ দুই ধরনের খেলোয়াড়দেরই ভালো করাটা সমান জরুরি। কিন্তু গোলের খেলা ফুটবল। তাই যারা গোল করে তারা স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়ার স্পটলাইটও বেশি পায়। বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের সম্মান জানাতেই ১৯৮২ সাল থেকে অ্যাডিডাসের সৌজন্যে গোল্ডেন বুট পুরস্কারটি প্রদান করা শুরু করে ফিফা। ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে গোল্ডেন বুট দেওয়া শুরু করলেও আগের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের সম্মান জানাতে ফিফা তাদের নামও তালিকায় রেখেছে। আজ আমরা এ পর্যন্ত হওয়া প্রতিটি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের নিয়েই জানবো।
১৯৩০ বিশ্বকাপ: গুইলার্মো স্ট্যাবিলের আট গোল
উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার গুইলার্মো স্ট্যাবিল। প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ১-০ গোলের জয়ে স্ট্যাবিল কোনো গোল না পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। আর্জেন্টিনা ঐ ম্যাচটি জিতে নেয় ৬-৩ গোল। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে চিলিকে ৩-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা, সেই ম্যাচেও গোল পান স্ট্যাবিল।
সেমিফাইনালে স্ট্যাবিলের জোড়া গোলে ভর করে যুক্তরাষ্ট্রকে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা। ফাইনালেও গোলের ধারা অব্যাহত রাখেন স্ট্যাবিল, কিন্তু তার দল আর্জেন্টিনা আর পেরে ওঠেনি। স্বাগতিক উরুগুয়ের কাছে ৪-২ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আর্জেন্টিনাকে। তবে আট গোল করে ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা স্ট্যাবিলই হন।
১৯৩৪ বিশ্বকাপ: চেকোস্লোভাকিয়ার ওল্ডরিখ নেজেদলির বাজিমাত
ইতালিতে অনুষ্ঠেয় ১৯৩৪ বিশ্বকাপ হচ্ছে নক আউট বিশ্বকাপ অর্থাৎ এই বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব বলে কিছু ছিলো না। ১৬ দলের বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচই ছিল নকআউট ম্যাচ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৩০ বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন রানার্স আপ দলের সদস্য। চেকোস্লোভাকিয়ার ওল্ডরিখ নেজেদলি পুরো টুর্নামেন্টে পাঁচ গোল করে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। তবে নেজেদলির এমন পারফর্মেন্স সত্ত্বেও চেকোস্লোভাকিয়াকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় রানার্স আপ হিসেবেই। ফাইনালে তারা স্বাগতিক ইতালির কাছে হারে ২-১ গোলে।
১৯৩৮ বিশ্বকাপ: সর্বোচ্চ গোলদাতা যখন সাইডবেঞ্চে!
শিরোনামটা কিছুটা অবাক করার মতো হলেও এমনটিই ঘটেছিলো ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ১৯৩৮ বিশ্বকাপে। আগের আসরের মতো এই আসরটিও ছিল নকআউট ফরম্যাটের। আগের দুই আসরে ব্যর্থ হলেও এই আসরে ব্রাজিল দলটা বেশ ভালোই খেলছিলো। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের নাটকীয় এক ম্যাচে পোল্যান্ডকে ৬-৫ গোলে হারায় ব্রাজিল। এ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলের জয়ে বড় অবদান রাখেন লিওনিদাস। কোয়ার্টার ফাইনালেও লিওনিদাস তার গোল করার ধারা অব্যাহত রাখেন। তার করা দুই গোলেই ব্রাজিল পায় সেমিফাইনালের টিকিট।
সেমিফাইনালে ব্রাজিল কোচ পিমেন্তা আদেমার করলেন অদ্ভুত এক পাগলামি। ফাইনালের কথা ভেবে তিনি তার দলের সেরা খেলোয়াড় লিওনিদাসকে সেমিফাইনালে বিশ্রামে রেখে দিলেন! তার এই ভুলের চড়া মাশুল গুনতে হলো ব্রাজিলকে। ইতালির কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় সেলেসাওরা। পরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করে লিওনিদাস প্রমাণ করেন, তাকে বসিয়ে রাখাটাই ছিল সেমিফাইনালে ব্রাজিলের হারার সবচেয়ে বড় কারণ। অবশ্য ৭ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই হয়েছিলেন।
১৯৫০ বিশ্বকাপ: বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুঃখী সর্বোচ্চ গোলদাতা
১৯৫০ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা আদেমিরের ব্যাপারে এর চেয়ে ভালো উপমা আর কিছু পাওয়া গেলো না। কারণ ১৯৫০ বিশ্বকাপটা পুরো ব্রাজিলের জন্যই এতবড় ট্র্যাজেডি যে এই আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার স্মৃতিটাও হয়তো আদেমির মনে করতে চাইবেন না।
সেই বিশ্বকাপে উরুগুয়ের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগে পাঁচ ম্যাচে আট গোল করেছিলেন আদেমির। কিন্তু হায়! জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করতে ব্যর্থ হলেন আদেমির। মারাকানায় উরুগুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ঘরের মাঠে প্রায় দুই লাখ দর্শকের সামনে ২-১ গোলে হেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পুরো ব্রাজিল। তাই আট গোল করে সেই আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও আদেমির হয়তো সেই স্মৃতি মনে করতে চাইবেন না, যদি মারাকানায় কোনো অশ্রুসিক্ত মুখের ছবি আবার তার মনে পড়ে যায়!
১৯৫৪ বিশ্বকাপ: ককসিসের গোলউৎসব
১৯৫৪ বিশ্বকাপের আগে এক আসরে একজন খেলোয়াড় সর্বোচ্চ আটটি গোল করেছিলেন। কিন্তু এই আসরে সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দেন হাঙ্গেরির স্ট্রাইকার স্যান্দর ককসিস! সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় সেই বিশ্বকাপে তিনি একাই করেন ১১ গোল! এই ১১টি গোলের মধ্যে সাতটি গোলই ককসিস করেন গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচে!
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। উরুগুয়ের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও জোড়া গোল করেন তিনি। কিন্তু ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে আর গোল পাননি। তিনি সেদিন গোল পেলে ম্যাচটা হয়তো ৩-২ ব্যবধানে হারতে হতো না হাঙ্গেরিকে। এই একটা হার হাঙ্গেরির ফুটবলকে যত বড় ধাক্কা দিয়েছে তার কাছে ককেসিসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার অর্জনটা হয়তো কিছুই না।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ: জাঁ ফন্টেইনের ১৩ গোলের রেকর্ড
এক বিশ্বকাপে ১৩ গোল! হ্যাঁ পাঠকবৃন্দ আপনারা ঠিকই পড়েছেন, এক বিশ্বকাপেই ১৩ গোল করেছিলেন ফ্রান্সের জাঁ ফন্টেইন। সেই বিশ্বকাপে দুই হ্যাটট্রিকসহ সবগুলো ম্যাচেই গোল করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে একাই করেছিলেন চার গোল! সেই আসরে তার গড়া ১৩ গোলের রেকর্ড আজও কেউ ভাংতে পারেনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপে ফন্টেইনের মোট গোল সংখ্যাও কিন্তু ১৩টিই, কারণ ১৯৫৮ বিশ্বকাপই ছিল ফন্টেইনের ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ বিশ্বকাপ!
১৯৬২ বিশ্বকাপ: এক বিশ্বকাপে ছয়জন সর্বোচ্চ গোলদাতা!
হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন। সপ্তম বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ছয়জন! ব্রাজিলের গারিঞ্চা ও ভাভা, চিলির লিওনেল সানচেজ, যুগোস্লাভিয়ার দ্রাজান জার্কোভিচ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেতিন ইভানভ ও হাঙ্গেরির ফ্লোরাইন আলবার্ট- প্রত্যেকেই চারটি করে গোল করেছিলেন। একই বিশ্বকাপে ছয়জন সর্বোচ্চ গোলদাতা পাওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম আর এখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র। ভাগ্যিস তখন গোল্ডেন বুট দেওয়া ফিফা শুরু করেনি। সেবার গোল্ডেন বুট দিতে গেলে ফিফাকে নির্ঘাত লটারি করা লাগতো।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ: কালো চিতা ইউসেবিওর নয় গোল!
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই তাক লাগিয়ে সেয় পর্তুগাল। আর তাদের এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারিগর ছিলেন ইউসেবিও। ঐ টুর্নামেন্টে ইউসেবিও একাই করেন নয় গোল! হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে চরম নাটকীয় ম্যাচে তিনি একাই করেছিলেন চার গোল। তার নয় গোলে ভর করেই পর্তুগাল সেবার তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলো, যা এখনো দেশটির বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ অর্জন।
১৯৭০ বিশ্বকাপ: জার্ড মুলারের দশ গোল
মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ১৯৭০ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির হয়ে জার্ড মুলার করেন ১০ গোল! গ্রুপপর্বে বুলগেরিয়া ও পেরুর সাথে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে জয়সূচক গোলটি করেন তিনিই। সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষেও জোড়া গোল করেন মুলার, কিন্তু পশ্চিম জার্মানি ম্যাচটা হেরে যায় ৪-৩ গোলে। দল তৃতীয় হলেও দশ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা মুলারই হয়েছিলেন। তার পর আর কোনো খেলোয়াড়ই এক আসরে দুই অঙ্কের গোলসংখ্যা স্পর্শ করতে পারেননি।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ: পোলিশ ফরোয়ার্ড ল্যাটোর চমক
পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন পোল্যান্ডের ফরোয়ার্ড ল্যাটো। প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী আর্জেন্টিনাকে ৩-২ গোলে হারানোর ম্যাচে জোড়া গোল করে পোল্যান্ডের জয়ে বড় অবদান রাখেন তিনি। পরের ম্যাচে হাইতির বিপক্ষেও জোড়া গোল করেন। তার পারফর্মেন্সে ভর করেই আর্জেন্টিনা ও ইতালির মতো পরাশক্তিকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে যায় পোল্যান্ড।
সেকেন্ড রাউন্ডের তিন ম্যাচে দুই গোল করেন ল্যাটো আর পোল্যান্ডকে নিয়ে যান সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তিনি আর গোল পাননি, পোল্যান্ডও ফাইনালে যেতে পারেনি। তবে ব্রাজিলের বিপক্ষে ল্যাটোর গোলে তৃতীয় স্থান নিশ্চিত হয় পোল্যান্ডের, আর সাত গোল করে ল্যাটো হন সেই আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ: মারিও কেম্পেসের নতুন ইতিহাস
১৯৭৮ বিশ্বকাপের আগে অনুষ্ঠেয় দশটি আসরে কখনোই চ্যাম্পিয়ন দলের কোনো খেলোয়াড় এককভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে পারেননি। কিন্তু ১৯৭৮ বিশ্বকাপে সেই ধারা ভাঙ্গেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার মারিও কেম্পেস। সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার সাথে সাথে নিজের দেশ আর্জেন্টিনাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরা বানান কেম্পেস।
এমন অসাধারণ কীর্তি গড়া ফুটবলার গ্রুপপর্বে একটি গোলও করতে পারেননি! তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে জ্বলে ওঠেন কেম্পেস। পোল্যান্ড ও পেরুর বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে নিয়ে যান ফাইনালের মঞ্চে। ফাইনালেও গোল করার ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি। তার জোড়া গোলেই নেদারল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। আর ছয় গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার সাথে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে কেম্পেস গড়েন নতুন এক ইতিহাস।
১৯৮২ বিশ্বকাপ: রূপকথার চেয়েও নাটকীয়ভাবে রসির ফিরে আসা
১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকেই অ্যাডিডাসের সৌজন্যে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে গোল্ডেন বুট দেওয়া শুরু করে ফিফা। আর এই আসরে পাওলো রসি যা করেছিলেন সেটাকে রূপকথা বললেও কম বলা হবে। বিশ্বকাপের আগের দুই মৌসুম ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ থাকায় পাওলো রসির বিশ্বকাপ খেলাটাই ছিল অনিশ্চিত। কিন্তু তৎকালীন ইতালি কোচ এনজো বেয়ারজোট রসির উপর ভরসা রাখায় ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পান তিনি।
কিন্তু হায়! টুর্নামেন্টের প্রথম চার ম্যাচে গোলের দেখাই পেলেন না রসি! ব্রাজিলের বিপক্ষে ইতালির জীবন-মরণ ম্যাচে সবাই রসিকে সাইডবেঞ্চে বসানোর কথা বললেও এনজো আবারো রসির উপরই আস্থা রাখেন। রসি কোচের আস্থার প্রতিদান ভালোমতোই দেন। তার হ্যাটট্রিকেই সেসময়ের ভীষণ প্রতাপশালী দল ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ইতালি। সেমিফাইনালেও রসির চমক, তার জোড়া গোলে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে যায় ইতালি। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। ফাইনালে এক গোল করে দলকে বিশ্বসেরা করার সাথে গোল্ডেন বুট জয়টাও নিশ্চিত করেন পাওলো রসি।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ: গ্যারি লিনেকারের গোল্ডেন বুটজয়
প্রথম ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বমঞ্চে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন গ্যারি লিনেকার। সেই বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে কোনো গোল না পেলেও শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। তার হ্যাটট্রিকে ভর করেই নকআউট রাউন্ড নিশ্চিত হয় ইংল্যান্ডের।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনেও গোলধারা অব্যাহত রাখেন লিনেকার। তার জোড়া গোলে প্যারাগুয়েকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনালেও গোল পেয়েছিলেন লিনেকার, কিন্তু ম্যারাডোনার জাদুতে সেদিন আর পেরে ওঠেনি ইংল্যান্ড। তবে দল কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিলেও ছয় গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে গোল্ডেন বুট জিতে নেন তিনি।
১৯৯০ বিশ্বকাপ: শিলাচির ছয় গোল
১৯৯০ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন স্বাগতিক ইতালির স্যালভেটর শিলাচি। সেই আসরে তিনি গোল করেন ছয়টি। তবে তার এমন পারফর্মেন্স সত্ত্বেও সেমিফাইনালেই ইতালিকে বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে। সেই আসরে অবশ্য গোল্ডেন বুটের সাথে গোল্ডেন বলও জিতে নিয়েছিলেন শিলাচি।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ: এক গোল্ডেন বুটের দাবিদার দুজন!
গোল্ডেন বুট দেওয়া শুরু করার পর ফিফা নিয়ম করে দিয়েছিলো যে, দুই বা ততোধিক খেলোয়াড় সর্বোচ্চ গোলদাতা হলে যার অ্যাসিস্ট বেশি হবে তাকেই দেওয়া হবে গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার রিস্টো স্টয়চকভ ও রাশিয়ার ওলেগ স্যালেঙ্কা দুজনই গোল করেছিলেন ছয়টি আর দুজনের অ্যাসিস্ট সংখ্যাও ছিল একটি! তাই দুজনকেই গোল্ডেন বুটজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে ফিফা। দুজনের বিশ্বকাপ অভিযান ছিল দু’রকমের, স্যালেঙ্কার রাশিয়া বিদায় নিয়েছিলো গ্রুপপর্ব থেকেই!
গ্রুপপর্বে বিদায় নেওয়ার আগে ক্যামেরুনকে ৬-১ গোলে হারায় রাশিয়া। সেই ম্যাচে স্যালেঙ্কো একাই করে পাঁচ গোল। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড এটিই। স্যালেঙ্কাই বিশ্বকাপ ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি গ্রুপপর্বে বিদায় নেওয়া দলে থেকেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওলেগ স্যালেঙ্কার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে গোলসংখ্যাও ছয়টিই! অর্থাৎ এই বিশ্বকাপ বাদে আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলের দেখাই পাননি তিনি। আরেক সর্বোচ্চ গোলদাতা রিস্টো স্টয়চকভের দল বুলগেরিয়া গিয়েছিলো সেমিফাইনাল অব্দি। সেখানে ইতালির কাছে হেরে থামে বুলগেরিয়ানদের স্বপ্নযাত্রা।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ: ক্রোয়েশিয়ার ডেভর সুকারের চমক
যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ক্রোয়েশিয়া প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ১৯৯৮ সালে। নিজেদের প্রথম আসরেই তাক লাগানো পারফর্মেন্স উপহার দেয় ক্রোয়াটরা। সেই বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে তারা। তাদের এই সাফল্যে বড় অবদান ছিল ডেভর সুকারের। ছয় গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে তিনি জিতেছিলেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৭৮-৯৮ পর্যন্ত টানা ছয় বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের গোলসংখ্যা ছিল ছয়টি করে!
২০০২ বিশ্বকাপ: রোনালদোর অসাধারণ প্রত্যাবর্তন
২০০২ বিশ্বকাপের আগে দু’বছর ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করায় রোনালদো নিজের কতটুকু দিতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের মাঝেই। কিন্তু সেসব সংশয়কে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে গোল পাননি। বাকি সব ম্যাচেই গোল পেয়েছিলেন দ্য ফেনোমেনন। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ব্রাজিলের তিন গোলের তিনটিই এসেছিলো তার পা থেকে! তার অসাধারণ পারফর্মেন্সে ভর করে ব্রাজিল জিতে নেয় রেকর্ড পঞ্চম বিশ্বকাপ। আর আট গোল করে গোল্ডেন বুট জয়ের সাথে রোনালদো ভাঙেন সর্বোচ্চ গোলদাতাদের ছয় গোল করার ধারা।
২০০৬ বিশ্বকাপ: মিরোস্লাভ ক্লোসার গোল্ডেন বুটজয়
২০০৬ বিশ্বকাপের শুরু থেকেই জার্মানির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন মিরোস্লাভ ক্লোসা। উদ্বোধনী খেলায় কোস্টারিকাকে ৪-২ গোলে হারানোর ম্যাচে ক্লোসা করেন দুই গোল। পোল্যান্ডের বিপক্ষে গোল না পেলেও ইকুয়েডরের বিপক্ষে জোড়া গোল করে ক্লোসা নিশ্চিত করেন জার্মানির গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সুইডেনকে ২-০ গোলে হারায় জার্মানরা। এ ম্যাচে অবশ্য গোল পাননি ক্লোসা। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে আবারো ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তার করা গোলেই খেলায় ১-১ এ সমতা আনে জার্মানি। পরে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে স্বাগতিক জার্মানি চলে যায় সেমিফাইনালে। কিন্তু সেমিফাইনালে তিনি আর গোল পাননি, দল জার্মানিও ইতালির সাথে পেরে ওঠেনি। তবে পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ায় গোল্ডেন বুটটা ক্লোসার কাছেই যায়।
২০১০ বিশ্বকাপ: ২১ বছর বয়সী থমাস মুলারের চমক
২০১০ বিশ্বকাপে থমাস মুলারের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। আর এই বয়সেই বাজিমাত করেন তিনি। টুর্নামেন্টের শুরুটাও ভালোভাবে করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জার্মানির ৪-০ গোলের জয়ে একটি গোল করেন মুলার। গ্রুপপর্বে আর কোনো গোল না করলেও রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি করেন জোড়া গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জার্মানির ৪-০ গোলের জয়ে প্রথম গোলটিও করেন তিনিই। তবে সেমিফাইনালে আর গোল পাননি মুলার, জার্মানিও আর পেরে ওঠেনি স্পেনের কাছে।
উরুগুয়ের সাথে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে মুলার এক গোল করলে তার গোলসংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচে, সমান সংখ্যক গোল করেছিলেন স্পেনের ডেভিড ভিয়া, উরুগুয়ের দিয়েগো ফোরলান ও নেদারল্যান্ডসের ওয়েসলি স্নাইডার। কিন্তু বাকি তিনজনের একটি অ্যাসিস্টের বিপরীতে মুলারের অ্যাসিস্ট ছিল তিনটি। তাই গোল্ডেন বুটটা থমাস মুলারের কাছেই যায়।
২০১৪ বিশ্বকাপ: হামেস রদ্রিগেজের ছয় গোল
২০১৪ বিশ্বকাপ শুরুর আগে কলম্বিয়ার সেরা খেলোয়াড় রাদামেল ফ্যালকাও ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ মিস করবেন- এমন সংবাদ যখন এলো তখন মনে হচ্ছিলো ১৬ বছর পর কলম্বিয়ার বিশ্বকাপে প্রত্যাবর্তনটা হয়তো সুখকর হবে না। কিন্তু ফ্যালকাওয়ের অনুপস্থিতিতে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন হামেস রদ্রিগেজ।
গ্রুপপর্বে হামেস তিন গোল করে কলম্বিয়াকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিয়ে যান রাউন্ড অফ সিক্সটিনে। তিনি আসল খেলাটা দেখান রাউন্ড অফ সিক্সটিনে উরুগুয়ের বিপক্ষেই। তার দর্শনীয় দুই গোলে উরুগুয়েকে ২-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় কলম্বিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক ব্রাজিলের বিপক্ষেও গোল পান হামেস, তবে তার দল সেই ম্যাচ হেরে যায় ২-১ গোলে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়লেও ছয় গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে হামেস রদ্রিগেজ জিতে নেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কারটি।
এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন মোট ২৬ জন। এর মধ্যে ১৯ জন খেলোয়াড় নিজেদের অভিষেক বিশ্বকাপেই সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। চ্যাম্পিয়ন দল থেকে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন মাত্র চারবার। পক্ষান্তরে সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন তৃতীয় স্থান অর্জন করা দলের খেলোয়াড়েরা। সর্বমোট দশবার তৃতীয় স্থান অর্জনকারী খেলোয়াড় বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। এর পেছনে বড় একটি কারণ হচ্ছে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। এই ম্যাচের ফলাফল প্রাইজমানির হেরফের ছাড়া আর তেমন কোনো প্রভাব না রাখায় দুই দলই বেশ আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। ফলে এ ম্যাচে বেশি গোল পেয়ে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বুট জয়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এছাড়া সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার সেরা গোলদাতা হয়েছে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা। সর্বমোট পাঁচজন ব্রাজিলিয়ান বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
এবারের আসরে কে জিতবে গোল্ডেন বুট এটা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসি, গ্রিজম্যান কিংবা নেইমারের মতো বড় কোনো তারকাই কি এবার গোল্ডেন বুট জিতবেন নাকি গত দুই আসরের মুলার কিংবা হামেসের মতো নতুন কেউ চমক দেখিয়ে জিতে নিবেন গোল্ডেন বুট? চ্যাম্পিয়ন দলের কেউ কি গোল্ডেন বুট জিতবে নাকি আগের আসরগুলোর মতো এই আসরেও পরাজিত দলের খেলোয়াড়েরাই দাপট দেখাবে গোল্ডেন বুট জয়ের ক্ষেত্রে? সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চোখ রাখতে হবে রাশিয়া বিশ্বকাপের দিকে।
ফিচার ইমেজ : 12elfthman.com