অসামান্য এক সম্ভাবনা ও প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন ফুটবলে। কিন্তু নানা কারণেই সেই প্রতিভার বিকাশটা দেখতে পায়নি বিশ্ব। পেলে বলেছিলেন, তার মতো একজন ফুটবলার রবিনহো। সেটা হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। এখন ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছেন অখ্যাত কিছু ক্লাবে।
নিজের ক্লাব জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিত সাক্ষাতকার দিয়েছেন ফোর ফোর টু ম্যাগাজিনে।
আপনি একসময় ফুটসাল খেলতেন। আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে ফুটসালের ভূমিকা কতটা?
আমি অনেকটা সময় ফুটসাল খেলতে অভ্যস্থ ছিলাম। এটা আমার একটা আবেগের জায়গা ছিলো। আমি এখনও আমার ছেলের সাথে রসিকতা করি যে, আমি পারলে আমার ক্যারিয়ারের শেষ বছরটা ফুটবসালই খেলতাম। ওটা দিয়েই আমি শুরু করেছিলাম। এখন আমি যত ড্রিবল করি, তা ওখান থেকে এসেছে।
আপনি খুব ছোট থাকতে পেলে আপনার প্রশংসা করেছিলেন। এমনকি আপনাকে নিজের সাথে তুলনাও করেছিলেন। এটা কি আপনার জন্য চাপ হয়েছিলো?
শুরুতে এটা (হজম করা) খুব কঠিন ছিলো। কারণ পেলে একজন অতুলনীয় ফুটবলার। একজন এক হাজার গোল করা ফুটবলার, চারটি বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার এবং যাকে সর্বকালের সেরা মনে করা হয়, তার সাথে আপনি কারো তুলনা করতে পারেন না। আমার শুরুর সেই সময়টাতে আমাকে যারা দেখে রেখেছিলেন তাদের ধন্যবাদ দিতে হবে। আমাকে সবসময় সান্তোসের অ্যাকাডেমিতে সঠিক পথে গাইড করা হয়েছে। এরপর সিনিয়র দলে এসে আমি এমারসন লিয়াওকে কোচ হিসেবে পেয়েছি। তিনি আমাকে দেখে রেখেছেন।
এটা কি সত্যি যে, আপনি মাদ্রিদ শহরে পৌঁছানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের হয়ে খেলতে নেমে গিয়েছিলেন? ওই ম্যাচ নিয়ে আপনার স্মৃতি কী?
এটা খুব ভালো একটা অভিষেক ছিলো, অসাধারণ। রোনালদো, জিনেদিন জিদান, রাউলের মতো খেলোয়াড়দের পাশে খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। আমি মনে করতে পারি যে, আমি বিমানে বসে ওদের সাথে খেলার পরিকল্পনা করছিলাম। অভিষেকটা প্রায় নিখুঁত ছিলো। আমি যখন প্রথম বল পেলাম, প্রতিপক্ষের একজনের ওপর দিয়ে বল লব করে নিয়ে ড্রিবল করে এগিয়ে গেলাম। আমার জন্য এটা খুব স্মরণীয় একটা অভিষেক ছিলো। আমি আগের দিন মাদ্রিদে পৌঁছেছিলাম। সে সময় আমি একটা বাচ্চা ছিলাম এবং খেলার জন্য খুব আগ্রহী ছিলাম।
রিয়াল মাদ্রিদে কেন গেলেন? বার্সেলোনা নয় কেন?
শুনলে মনে হয় কঠিন ছিলো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা। আসলে তা নয়। রিয়াল মাদ্রিদই আমার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলো। দুটো দলই গ্রেট দুটো ক্লাব, সারা বিশ্বে যাদের অনেক সমর্থক আছে। কিন্তু মাদ্রিদ যখন আমার কাছে এলো, আমি দেখলাম, ওদের স্কোয়াডে অনেক ব্রাজিলিয়ান আছে। কোচিং স্টাফও ব্রাজিলের। ভ্যান্ডারলেই লুক্সেমবার্গো (সান্তোস ও রবিনহোর সাবেক কোচ) তখন রিয়ালের কোচ। এই সব যখন এক করে ভাবলাম, তখন আমি আর বার্সেলোনায় যাবো কেন?
২১ বছর বয়সে জিদান, রাউল, রোনালদোদের সাথে এক ড্রেসিংরুমে থাকাটা কেমন অভিজ্ঞতা ছিলো?
বড় একটা ইউরোপিয়ান ক্লাবের হয়ে খেলার স্বপ্নটা সত্যি হয়েছিলো। আমি যখন প্রথমবার ড্রেসিংরুমে ঢুকি, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম। এমনকি লকারটাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওনারা আমাকে যতোটা সম্ভব ভালোভাবে নিয়েছিলেন। আমি তখন একটা বাচ্চা ছিলাম। ওনারা আমাকে দেখে রাখতেন।
ডেভিড বেকহ্যাম কেমন ছিলেন?
বেকহ্যাম সবসময় ব্রাজিলিয়ানদের সাথেই মিশতেন। উনি আমাদের গ্রুপের একজন ছিলেন। এমনকি স্প্যানিশ খেলোয়াড়দের মধ্যে এ নিয়ে একটু ঈর্ষাও ছিলো। কারণ, তিনি স্প্যানিশের চেয়ে পর্তুগিজটা ভালো বলতেন। ফলে তিনি আমাদের সাথে বেশি সময় কাটাতেন। খুব বিনয়ী একজন মানুষ, আমি বলবো মাটির মানুষ। অসাধারণ ছিলেন তিনি।
রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়া নিয়ে কোনো আফসোস আছে?
আমার রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়া নিয়ে কোনো আফসোস নেই। তবে যখন চলে এলাম, তখন যে মতবিরোধটা হয়েছিলো, সে নিয়ে আফসোস আছে। মাদ্রিদই সেই ক্লাব যারা আমার জন্য প্রথম ইউরোপের দরজা খুলে দিয়েছিলো। তারা আমাকে ইউরোপ জয় করার সুযোগ দিয়েছিলো। আমি তাদের চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছি। আমি মনে করি, আমি আমার সময়ে তাদের হয়ে ভালো খেলেছি। তবে আমি দল ছাড়ার জন্য একেবারে বদ্ধ পরিকর ছিলাম। আমার মেজাজটা একটু বিস্ফোরণমুখী ছিলো। ফলে এখন হলে আমি যা করতাম, তা ঠিক করিনি।
আপনি তখন আসলেই বিশ্বাস করতেন যে, ম্যানসিটি প্রকল্প কাজে দেবে?
আমি যেদিন ওখানে পৌঁছলাম, সেদিন থেকে মনে করেছি, সিটির প্রকল্প সফল হবে এবং এই ক্লাবটা বড় হবে। তবে এটা এত দ্রুত হবে, এটা কল্পনা করিনি। আমি ক্লাবে যাওয়ার আগে ওদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তবে আমি সবসময় ওদের প্রথম বড় তারকা হিসেবে সম্মান পেয়েছি। আমি ভালোই শুরু করেছিলাম। কিন্তু তখন তো ওখানে খুব বেশি বড় নাম ছিলো না। ম্যানসিটিই একমাত্র দল, যেটা ছেড়েছি আমি কোনো শিরোপা না জিতেই।
আপনি কি মনে করেন যে, মিলানের হয়ে প্রথম মৌসুমেই সিরি-আ জেতায় আপনাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে যে সংশয় ছিলো, সেটা দূর হয়েছিলো?
আমি যখন মিলানে গেলাম, তখন প্রধান লক্ষ্য ছিলো সিরি-আ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগটা জিততে পারিনি। তবে আমরা ইতালিতে আবার শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলাম। আমাদের দারুণ একটা দল ছিলো। থিয়াগো সিলভা, সিড্রফ, ইব্রাহিমোভিচ, ফিলিপো ইনজাগি, আলেক্সান্দ্রে পাতো প্রমুখ।
আমার মনে হয় না আমার ম্যানসিটি বা ইংল্যান্ডে কাউকে কিছু প্রমাণ করার দরকার ছিলো। আমি আমার ওখানকার সময়টাতে ভালো খেলেছি। তবে যতদিন খেলতে চেয়েছি, তা খেলতে পারিনি। ওখানে কিছু ঝামেলা ছিলো। আপনি যদি বড় ক্লাব হতে চান, আপনাকে একাধিক বড় নাম দলে ভেড়াতে হবে। আপনার একটা শক্তিশালী দল লাগবে, শক্তিশালী বেঞ্চ লাগবে। মিলানে আমার চারপাশে গ্রেট সব খেলোয়াড় ছিলো, যেটা ম্যানসিটিতে ছিলো না।
ইব্রাহিমোভিচ, পাতো ও রবিনহো; মিলানের অসাধারণ একটা ফারোয়ার্ড লাইআপ। আপনি কেমন মজা পেতেন ওখানে?
আমি ওদের সাথে অনেক মজা করেছি। আমাদের দলে তখন রোনালদিনহোও ছিলেন। যদিও তিনি তখন বেশি খেলতেন না। ইনজাগি, পিরলো ছিলেন। আমাদের কী অসাধারণ একটা দল ছিলো! আমি এখনও সেই দিনগুলো মিস করি। আমার মিলানে অসাধারণ কিছু দিন কেটেছে। আমরা সবাই খুব সুখী ছিলাম।
জ্লাতানকে নিয়ে আপনার পছন্দের গল্পটা কী?
আসলে মিলানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আদ্রিয়ানো গালিয়ানি আমাকে বলেছিলেন, জ্লাতানই আমাকে দলে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলো। তার প্রতি বোর্ডের একটা সম্মান ছিলো। তিনি বার্সেলোনা থেকে এসেছিলেন। গালিয়ানি আমাকে বলেছিলেন, জ্লাতান নাকি তাকে বলেছিলেন, “যাও, ওকে নিয়ে আসো। ও একটা ফেনোমেনন। আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করবো আর দলের জন্য গোল করবো।” তিনি (ইব্রাহিমোভিচ) আমাকে প্রায়ই মজা করে বলতেন, “আজ তুমি এখানে আমার জন্য।”
আপনি গুয়াংজু এভারগ্রেনেডে কয়েক মাস খেলেছেন। চীনে ফুটবলের কী অবস্থা?
চীনে ফুটবল খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। বিদেশি কোচরা এখানে খেলাটার উন্নতিতে অনেক কাজ করছেন। তারা এখানে কোচিংয়ের মানও বাড়াচ্ছেন। গুয়াংজুতে আমার দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। কয়েক বছর আগে একজন সেরা খেলোয়াড় চীনের প্রস্তাব নেবে, এটা অসম্ভব ছিলো। কিন্তু তারা এখন ইউরোপকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এখন চীনের ফুটবলে অনেক অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
আপনি লা লিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও সিরি-আ তে খেলেছেন। কোনটা সেরা লিগ এবং কেন?
সবচেয়ে ভালো ও গোছালো লিগ হলো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। এখানকার স্টেডিয়ামগুলো সবসময় পূর্ণ থাকে। মাঠগুলো অসাধারণ। আর দলগুলো সবসময় আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তবে আমি খেলা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি লা লিগাতে। আমি বলবো, স্পেনের লিগটা হলো ব্রাজিলের লিগের উন্নত সংষ্করণ।
জাতীয় দলের হয়ে কি কোপা ২০০৭ আপনার সেরা অর্জন?
কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত ব্যক্তিগতভাবে। কারণ আমি টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা ছিলাম এবং আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমি যখন জাতীয় দলে খেলতাম তখন এক ফরোয়ার্ড লাইনেই চার বড় তারকা ছিলেন- রোনালদিনহো, কাকা, রোনালদো ও আদ্রিয়ানো। এদের নিয়ে মন্তব্য করার নিশ্চয়ই দরকার নেই।