ক’দিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। বাংলাদেশের সাবেক কোচ। উইন্ডিজ এই কোচের হাত ধরেই নাজুক বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জেতা, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার খুব কাছে যাওয়া। কিন্তু গ্রিনিজের মনে হয়েছিল, ১৯৯৯ সালে আইসিসি ট্রফি জেতা দলটি ২০০০ সালে টেস্ট খেলার জন্য তখনই ঠিক ‘পোক্ত’ নয়। এই ভাবনা প্রকাশের দায়ে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার পরও বাজেভাবে বহিস্কার করা হয়েছিল। কাজটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডই (বিসিবি) করেছিল। সেই গ্রিনিজের পর বাংলাদেশে বোর্ডের ডিরেক্টর পদ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান এডি বারলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি এখন প্রয়াত। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের কোচ তিনি। হঠাতই অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে পদটা ছাড়তে হয় তার। চোখের পানিতে ভিজেছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সবার মন। হুইল চেয়ারে বসেও অভিষেক টেস্ট ম্যাচটা দেখার সুযোগ ছাড়েননি বারলো।
সেই ২০০০ সালের ২৬ জুন থেকে শুরু, ২০১৮ সালের ২৬ জুনও পার হয়ে গেল। এই পুরো ১৮ বছরে ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাট ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট ক্রিকেট নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করেছে বোর্ড-খেলোয়াড় আর কোচিং স্টাফরা। কিন্তু সীমিত ওভারে যখন একের পর এক ভালো খবর আসছে লাল-সবুজ জার্সিধারীদের হাত ধরে, সাদা পোশাকের টেস্টটা যেন বেশ ধীরগতির। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায় দেওয়া হয় কম ম্যাচ খেলাকে। টেস্টে ক’দিন আগে বাংলাদেশ র্যাংকিংয়ের ৮ নম্বরে উঠে এসেছে। এযাবতকালের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে অনেকে এটাকেই দেখছেন। কিন্তু বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স আরও অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান হতে পারতো যদি কি না আরও বেশি ম্যাচ খেলতে পারতো সবাই। এই আক্ষেপগুলো দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর মুশফিকুর রহিমের মধ্যেই যেন বেশি। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে হলে বিসিবির কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে হবে, সেটার কোনো সন্দেহ নেই। বিসিবি সেটা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ কাজও করছে। কিন্তু বিধিবাম, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) এফটিপি (ফিউচার ট্যুর প্ল্যান) সবকিছুই যেন ক্রিকেটের তিন মোড়ল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের জন্য। সেটুকু কতদিনে কাটিয়ে ওঠা যাবে সেটার জন্য অপেক্ষা করাটাই আপাতত কাজ।
১৮ বছরে টেস্টে বাংলাদেশের অর্জন
উপরে যেটা বলা হলো, সাবেক-বর্তমান অনেক ক্রিকেটারেরই ভাবনা, ১৮ বছরে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পাওয়া র্যাংকিংয়ের ৮ নম্বরে জায়গা পাওয়া।
এই সময়ের মধ্যে মোট ১০৬টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ দল। যার মধ্যে জয় এসেছে ১০ ম্যাচে। ড্র হয়েছে ১৬ ম্যাচ। বাকি সবগুলোতেই হার। নিঃসন্দেহে সেরা অর্জনের মধ্যে সবার উপরে থাকবে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম অবশ্যই অর্জনের খাতায় এই ম্যাচ নিজের ক্যারিয়ারে সবার উপরে রাখতে চাইবেন। তাছাড়া নিজেদের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদেরকে হারানোটাও অনেক বড় পাওয়া। শুধু তা-ই নয়, ড্র বলতে আগের বাংলাদেশ বৃষ্টির ‘আশীর্বাদ’কেই বুঝতো। সেখান থেকে এখন লড়াই করে পাঁচদিন পর্যন্ত ম্যাচ টেনে নেওয়াও অনেক বড় ব্যাপার। এই চলতি বছরেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামের টেস্ট ম্যাচটি ড্র হয়েছে। সেই ম্যাচে পরপর দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন মুমিনুল হক।
বড় দলের বিপক্ষে হিসাব করলে বাংলাদেশ গেল ১৮ বছরে শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড ও উইন্ডিজের বিপক্ষে। অর্থাৎ, জয়-পরাজয়ের হিসেবে শুরুতে পিছিয়ে থাকলেও, ক্রমশ যে উন্নতির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কম ম্যাচের খড়গই বিপাকে ফেলছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের পরিসংখ্যানকে।
টেস্ট অধিনায়ক; সাফল্য-ব্যর্থতা
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন নাঈমুর রহমান দূর্জয়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি হয়েছিল। ক’দিন পর, অর্থাৎ জুলাইয়ের ৪ তারিখ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে উইন্ডিজ সিরিজ। সেখানে দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামবেন সাকিব আল হাসান। এটি তার দ্বিতীয়বারের মতো অধিনায়কত্ব পাওয়া।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১০ জন অধিনায়কের নেতৃত্বে টেস্টের ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ। যে তালিকায় দূর্জয়ের পর নাম রয়েছে খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ পাইলট, হাবিবুল বাশার সুমন, মোহাম্মদ আশরাফুল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের।
সবচেয়ে বেশি ৩৪ টেস্টে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন হাবিবুল বাশার সুমন, ১৮ ম্যাচ। সবচেয়ে কম ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়ক হলেন তামিম ইকবাল ও মাশরাফি বিন মুর্তজা। এই দুজন একটি করে ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের হিসেবে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি ৭ ম্যাচে জিতেছে বাংলাদেশ। লড়াই করে ড্র-ও করেছে বেশ কয়েকটি ম্যাচ। তবে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব হাবিবুল বাশার সুমনের। তার অধীনেই প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
বোলার
বোলারের কৃতিত্ব বলতে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারের কথা বোঝায়। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সেই জায়গাটা এখনো ধরে রেখেছেন দলের টেস্ট অধিনায়ক ও সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। নিজের ঝুলিতে তিনি ভরেছেন ১৮৮ উইকেট। এর জন্য খেলেছেন ৫১টি টেস্ট ম্যাচ। দ্বিতীয় অবস্থানে সাকিবের মতোই আরেক বাঁহাতি স্পিনার। তিনি হলেন কিংবদন্তি সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিক। ৩৩ ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ১০০ উইকেট। তৃতীয় অবস্থানে ৩৬ ম্যাচে ৭৮ উইকেট নেওয়া পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজা। চতুর্থ অবস্থানে আরেক পেসার শাহাদাত হোসেন। তিনি ৩৮ টেস্ট খেলে ৭২ উইকেট নিয়েছেন। পঞ্চম অবস্থানে আছেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম। তার অর্জন ৬৬ উইকেট।
ব্যাটসম্যান
টেস্টে ব্যাটসম্যান হিসেবে সবার উপরে অবস্থান ওপেনার তামিম ইকবালের। সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় তিনি ছাড়া সেরা পাঁচে আর যারা আছেন, তাদের সবাই নিজেদের সময়ের নিয়মিত অধিনায়ক। তামিম ইকবাল ৫৪ ম্যাচে ৩,৯৮৫ রান করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মুশফিকুর রহিম খেলেছেন ৬০ ম্যাচ, তার মোট রান ৩,৬৩৬। তৃতীয় অবস্থানে সাকিব আল হাসান। ৫১ ম্যাচে ৩,৫৯৪ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন হাবিবুল বাশার সুমন। তিনি ৫০ ম্যাচে তিনি তুলেছেন ৩,০২৬ রান। পঞ্চম অবস্থানে মোহাম্মদ আশরাফুল। ৬১ ম্যাচে ২,৭৩৭ রান করেছেন এই ক্রিকেটার।
এই পাঁচজনের মধ্যে ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের।
পারফর্মারের অভাব
এই মুহূর্তে বলা যায় বাংলাদেশ দল চলছে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারের কাঁধে চড়ে। নতুন যারা আসছেন তারা ভবিষ্যতের সাকিব-তামিম হয়ে উঠতে না পারার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগ তথা, টি-টোয়েন্টির যুগে টেস্ট ক্রিকেট নিছক অবহেলিত হচ্ছে। যার কারণে সাদা পোশাকের এই ঐতিহ্য যেন ক্রমশও নিজের মান হারাচ্ছে। তরুণরা তাই ওমুখো না হওয়ার একট প্রবণতা যেমন লক্ষ্য করছেন, পাশাপাশি দ্রুত বড়দের মতো হতে চাওয়াও বিপদে ফেলছে তাদের। পরিশ্রমের অভাব, দ্রুত খ্যাতিলাভ, বিতর্ক, জায়গা হারানোর বাড়তি চাপ, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে কম অংশ নেওয়া ইত্যাদি।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভালো করতে হলে এগুলো নিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।
ফিচার ইমেজ- BCB