সাদা চোখে দেখলে বলবেন, সেরেনা উইলিয়ামস হেরে গেছেন। উইম্বলডন ফাইনালে এঞ্জেলিক কারবারের কাছে ২৩ বারের এই গ্র্যান্ড স্লামজয়ী তারকা।
কিন্তু এই সাদা চোখে সবকিছু দেখা যায় না। সেরেনার এই হারের মধ্যে লুকানো ছিলো বিরাট এক জয়।
উইম্বলডন ফাইনালে উঠেই তিনি জিতে গেছেন শত বছরের এক চ্যালেঞ্জ। উইম্বলডন ফাইনালে ওঠার ভেতর দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসে এই মেজরের ফাইনাল খেলা প্রথম ‘মা’। সেরেনা উইলিয়ামস হয়ে উঠেছেন একজন ‘সুপার মম’।
ফাইনালে পরাজয়ের পরও তাই সেরেনা উইলিয়ামসের মুখে এতটুকু দুঃখ ছিলো না, পরাজয়ের বেদনা ছিলো না। বরং অত্যন্ত গর্বিত কণ্ঠে সেরেনা বলেছেন,
‘আমি আজ সকল মায়েদের জন্য খেলেছিলাম। আমার এই লড়াই পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য। আমি যদি মা হয়ে এখানে পৌঁছাতে পারি, আমি বিশ্বাস করি, আপনারা সকলে পারবেন।’
সেরেনার এই উচ্চারণ নিশ্চয়ই সকল মাকে সাহস জোগাবে। টেনিস খেলুন আর না-ই খেলুন; মায়েদের জীবনে যে কঠোর সংগ্রাম, সেখানে হয়তো একটু হলেও সাহস জোগাবে সেরেনার এই কথা। বোঝাবে যে, সকল মা-ই একজন করে ‘সুপার মম’।
কিন্তু টেনিসের এই সুপার মমদের পথচলাটা কখনোই এত সোজা ছিলো না।
এক দশক আগেও উইম্বলডন খেলোয়াড়দের লাউঞ্জে যে বাচ্চাদের দেখা যেতো, তারা কোনো নারী খেলোয়াড়ের শিশু ছিলো না। তারা মূলত পুরুষ খেলোয়াড়দের বাচ্চা।
রজার ফেদেরার, আন্দ্রে, আগাসি, বরিস বেকাররা বাবা হওয়ার পরও আনন্দের সাথে টেনিস খেলে গেছেন। কারণ, কোর্টের বাইরে এই বাচ্চাদের সামলানোর জন্য একজন করে মা ছিলেন।
কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। টেনিস খেলুড়ে মায়েদের তখন খুঁজেই পাওয়া যেতো না।
২০১০ সালে কিম ক্লাইস্টার্স যখন দুই বছরের বাচ্চা জাদাকে নিয়ে উইম্বলডনে এলেন, তখন রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিলো। এরপর ইউএস ওপেন জিতে তো সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাইস্টার্স। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, একজন মা-ও গ্র্যান্ড স্লাম জিততে পারে।
কিম ক্লাইস্টার্সকে নিয়ে ঝড় ওঠার মূল কারণ ছিলো, তিনি সেই সময় ছিলেন বিরল একজন টেনিস খেলুড়ে মা। এর আগের ৩০ বছরে সব মিলিয়ে মাত্র ৮ জন নারী খেলোয়াড় মা হওয়ার পরও টেনিসে ফিরে এসেছিলেন।
পরের ৮ বছরে চিত্রটা অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। এখন বাচ্চা সাথে নিয়ে টেনিস খেলতে বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো মায়েদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেরেনা তো আছেনই। এছাড়া ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা, তাতজানা মারিয়া, এভজেনিয়া রোদিনা, মারিয়া মার্টিনেজ, ক্যাটেরিনা বোন্দারেনকো, ভেরা জোনারেভা, ম্যান্ডি মিনেলার মতো খেলোয়াড়রা একদিকে বাচ্চাকে বড় করে তুলছেন এবং অন্যদিকে টেনিসের সেরা টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিচ্ছেন।
তাতজানা মারিয়া মনে করেন, এই মেয়েদের উৎসাহটা পাওয়ার পেছনে উইলিয়ামস বোনেরা মা হওয়ার আগে থেকেই একটা বড় ভূমিকা রাখছেন। একজন নারী খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার যে এতটা লম্বা হতে পারে, সেটা এই বোনেরাই প্রমাণ করেছেন।
মারিয়া বলছিলেন,
‘একটা লম্বা সময় ধরে মনে করা হতো, মেয়েরা হয় টেনিস খেলতে পারে, নইলে বাচ্চা নিলে তাকে অবসর নিয়ে নিতে হবে।’
‘আমাদের দুটোই করার যেন উপায় ছিলো না। লোকেরা মনে করতো এটা সম্ভব না। (বাচ্চা নেওয়ার) মানে হলো তুমি হয় তোমার সেরা সময়টা হারিয়ে ফেলেছ, নইলে খুব দ্রুতই আর সেরা অবস্থানে ফিরতে পারছ না। কিন্তু এখন সেরেনা আর ভেনাসের কারণে লোকেরা দেখছে যে, মেয়েদের ক্যারিয়ারও লম্বা হতে পারে।’
মা হওয়ার পর ফিরে আসাদের মধ্যে ক্লাইস্টার্স বা সেরেনার মতো সফল মেয়েরা আছেন। মারিয়া নিজেও কম সফল নন। তিনি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পাঁচ বছর পর এসে ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছে; এ বছর প্রথম ডব্লুটিএ শিরোপা জিতেছেন। রাশিয়ার রোদিনা মা হওয়ার পরই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো উইম্বলডনের চতুর্থ রাউন্ডে পৌঁছাতে পেরেছেন।
কেউ কেউ মনে করেন, মা হওয়ার পর মেয়েদের শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। যেমনটা লম্বা দূরত্বের দৌড়বিদরা মা হওয়ার পরই বেশি সাফল্য পেয়ে থাকেন বলে মনে করা হয়। এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার বলে মনে করা যায়।
আবার অনেকে মনে করেন, ব্যাপারটা মানসিক। টেনিসের জগতটা খুবই একাকিত্বের। বিশেষ করে পরাজয়ের পর এখানে পাশে দাঁড়ানোর লোক খুব থাকে না; যেহেতু এটা দলীয় খেলা নয়। এরকম সময় পাশে নিজের বাচ্চাকে পাওয়াটা অনেক বড় একটা ব্যাপার বলে মনে করেন মারিয়া নিজেই,
‘একা একা এরকম সফরে থাকাটা খুব কঠিন। যখন আপনি হারবেন, একেবারে একাকী হয়ে যাবেন। এটা সহজ নয়। কিন্তু আপনার পরিবার যখন আপনার সাথে থাকবে, আপনি ১০ গুণ ভারমুক্ত থাকবেন ম্যাচের পর। আপনি বাচ্চার মুখ দেখলে সাথে সাথে ভুলে যাবেন কোর্টে কী খেলে এসেছেন। এমনকি ম্যাচের মধ্যেও আপনি তার কথা ভাববেন।’
তবে মা হওয়ার সবটাই যে সুবিধা, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে চ্যালেঞ্জটাই বেশি। একেবারে ট্রেনিং থেকে শুরু করে খেলা, র্যাংকিং ধরে রাখা; অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ এই মায়েদের জন্য।
ক্যাটেরিনা বোন্দারেনকো বলছিলেন, অনুশীলনের সময় বের করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ,
‘এটাই আসলে বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। এমন অনেক সময় আসবে যে, আপনাকে প্র্যাকটিস করতে হবে এবং বাচ্চাকে তার মতো একা একা থাকতে হবে। একটা বাচ্চা চারপাশে ঘুরছে, চিৎকার করছে এবং নানারকম প্রশ্ন করছে, এমন সময়ে প্র্যাকটিসে মন দেওয়াটা খুব কঠিন।’
সেরেনা অবশ্য নিজের মতো করে এই প্র্যাকটিসের সুন্দর একটা সূচী বানিয়ে নিয়েছেন,
‘আমার অগ্রাধিকার হলো, আমার বাচ্চা। তার সাথে থাকা, তার সাথে কিছু করাটাই আমার জীবনের এখন অগ্রাধিকার। আমাকে এভাবে সূচী তৈরী করে নিতে হয়েছে, যাতে আমি সময় বের করতে পারি। যেমন আমি ট্রেনিং করি খুব ভোরে উঠে। দিনের বাকিটা সময় আমি বাচ্চার সাথে কাটাই। ফলে আমি ওকে পুরো দিনের জন্য না পেলেও ভালো একটা সময়ের জন্য পাচ্ছি।’
সেরেনোদের অবশ্য আরেকটা চ্যালেঞ্জ নিতে হয় না, যেটা আরেকটু নিচু সারির খেলোয়াড়দের নিতে হয়। সেরা একশ খেলোয়াড়ের মধ্যে যারা থাকেন, তাদের আয় যথেষ্ঠ ভালো। ফলে তারা সফরের সময় সঙ্গে স্বামী বা কাউকে নিয়ে ঘুরতে পারেন; এই সামর্থ তাদের আছে। ফলে তারা যখন কোর্টে থাকেন, বাচ্চাটা দেখার কেউ না কেউ বাইরে থাকে।
কিন্তু যারা নিচের দিকের খেলোয়াড়, তাদের তো এটা করা সম্ভব না। প্রতিটা টুর্নামেন্টে নিজের খরচে স্বামী বা অন্য কাউকে নিয়ে যাওয়া মোটেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে তাদের জীবনটা হয়ে ওঠে আরও কঠিন।
বোন্দারেনকো বলছিলেন,
‘এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। বাইরে যদি সাহায্য করার কেউ না থাকে, তাহলে এটা অসম্ভব। আমাকে কোনো না কোনো আত্মীয়কে নিয়ে ঘুরতে হয়। নইলে স্রেফ অসম্ভব।’
এর সাথে আছে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলা চলাকালীন বাচ্চাদের রাখার জায়গার সংকট। আস্তে আস্তে সুবিধাগুলো তৈরি হচ্ছে। উইম্বলডনে যেমন এখন একটা বিনামূল্যের কিন্ডারগার্টেন তৈরি হয়েছে। সেখানে খেলুড়ে বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের দেখা শোনার জন্য রাখতে পারেন। এখানে বাচ্চাদের বিনামূল্যে খাবারও দেওয়া হয়। সাথে তাদের খেলার নানারকম উপায় রাখা হয়েছে।
কিন্তু অন্যান্য গ্র্যান্ড স্লাম টুর্নামেন্টগুলোতে বা এটিপিগুলোতে সুযোগ এখনও সীমিত।
এই মায়েদের আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো, মা হওয়ার পর ফিরেই ভালো করতে হবে; নইলে সব শেষ।
এটিপি এখন মা হওয়া খেলোয়াড়দের একটা ‘প্রোটেক্টিভ র্যাংকিং’ দেয়। এটা আট মাস থাকে এবং দুটো গ্র্যান্ড স্লামে ব্যবহার করা যায়। যার অর্থ আপনি মা হয়েছেন বলে একটা র্যাংকিং না হারানোর সুবিধা আট মাস পাবেন। কিন্তু এই আট মাসের মধ্যে যদি ভালো করতে শুরু না করেন, তাহলে আবার আপনাকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।
আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হয় বাচ্চা একটু বড় হওয়ার পর। বোন্দারেনকো ও মারিয়া, দুজনেরই বাচ্চা আস্তে আস্তে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠছে। মায়েদের সারা বছর থাকতে হচ্ছে বিশ্ব ভ্রমণের ওপর। সেখানে বাচ্চার নিয়মিত স্কুলিং কিভাবে চলবে। মারিয়া বলছিলেন, তাকে হয়তো দ্রুতই খেলা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, তিনি বাচ্চার স্কুলে যাওয়ার সময়টাতে ঘুরে বেড়াতে চান না।
তার মানে, এই সময় এসে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
তবে যতই কঠিন হোক, এটা সম্ভব। সম্ভব বলেই এসব সংগ্রামী মায়েরা পারছেন। সেরেনা যেমন সকল মায়েদের উদাত্ত আহবান জানিয়ে বললেন, খুব কঠিন, জীবনটা খুব কঠিন, তারপরও সম্ভব,
‘আমি সকল মাকে বলি, আমাকে এখানে (খেলায়) ফিরে আসতে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এটা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু আমি সত্যিই মনে করি, আমি যদি পারি, আপনারারও পারবেন।’
ফিচার ইমেজ: Vogue