না, এর চেয়ে ভিন্নভাবে এশিয়া কাপের মুখবন্ধ লেখা হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল না। দল বন্দী বাজে খেলার বৃত্তে, ‘অধিনায়ক কে‘, ‘কোচ কে‘-জাতীয় অদ্ভুতুড়ে প্রশ্নগুলো টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েকদিন আগ পর্যন্তও ভেসে বেড়িয়েছে ক্রিকেটপাড়ার অলিতে-গলিতে, টি-টোয়েন্টির চাহিদা মেটাতে না পারা এক ঝাঁক ক্রিকেটার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দিনের পর দিন – রাতারাতি সেই দলটা সব বদলে ফেলছে, এমন কিছুই বা কে দেখেছে কবে।
সর্বোচ্চ যা হতে পারত, এশিয়া কাপের এই আসরটা হতে পারত সব ইতিহাস নতুন করে লেখার মঞ্চ। সুযোগ এখনো আছে, কিন্তু প্রথম ম্যাচেই দল যা দেখাল, তাতে পরবর্তী ম্যাচগুলোতেও (থামুন, এশিয়া কাপই তো শেষ নয়, বিশ্বকাপও দু’মাসের মধ্যেই) সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হবে, এমন স্বপ্ন দেখলেও তো হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হচ্ছে।
কেন প্রথম ম্যাচের পরই এমন নৈরাশ্যবাদী কথাবার্তা, তা তো আপনি বুঝে গেছেন আফগানিস্তান ম্যাচের স্কোরকার্ড দেখেই। টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন যেখানে দেশ ছাড়ার আগে চড়িয়ে গেছেন ১৮০-এর স্বপ্ন দেখানো বিমানে, সেখানে শারজায় ইনিংস থামল ১২৭ তুলেই। দেশের সব সংবাদমহল কিছুদিন ভালোই শোরগোল তুলল ‘পাওয়ার হিটিং’ শিরোনামে। অথচ বাংলাদেশের ইনিংসে ছক্কার সংখ্যা আর সৌরজগতে সূর্যের সংখ্যা সমান। সেই ছয়টাও হলো ক্যাচ ধরতে গিয়ে ফিল্ডারের পা সীমানাদড়িতে লেগে গিয়েছিল বলে।
কিন্তু এর বিপরীতে পাল্টা যুক্তিও তো অকাট্য। ব্যাটিং এমনিতেই মাসল মেমোরি-নির্ভর প্রক্রিয়া, পাওয়ার হিটিং আরও বেশি। চার-পাঁচটা সেশন করেই সব যদি বদলে যেত, তবে তো জন্মানোর পরে নবজাতকদের কানে প্রথমে গোঁজা হতো ‘আমার সন্তান পাওয়ার হিটার হবে’ মন্ত্র। আর শারজার উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য দুরূহ ছিল পুরো ম্যাচজুড়েই, ৯ বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতে যাওয়া আফগানিস্তানও ১৪.৩ ওভার পর্যন্ত তুলেছিল মাত্র ৬৭ রান। এই উইকেটে ‘বল দেখো আর মারো’ ব্যাটিং করতে ব্যর্থ হবেন জস বাটলারও।
কেবল ফলাফল দেখেই তাই ‘পুরনো রূপে বাংলাদেশ’ সমালোচনা করাটা অযৌক্তিক। আর বাংলাদেশের সমস্যাটাও তো ফলাফল ছাপিয়ে ঢের গভীর। পুরো ম্যাচজুড়ে একটা ইঙ্গিতও কি পাওয়া গেল, এই বাংলাদেশ বদলে ফেলতে চলেছে সব কিছু?
এই যেমন ধরুন দল নির্বাচনের কথাটাই। ৩৪ টি-টোয়েন্টি খেলার পরে নাঈম শেখের স্ট্রাইক রেট ছুঁতে পারেনি ১০৪-ও, নতুন বাংলাদেশ গড়ার মিশনে তাকে ছেঁটে ফেলে পরিকল্পনা করাটাই বোধ হয় সবচেয়ে সহজবোধ্য সিদ্ধান্ত হতো। নির্বাচকেরা প্রথমে তা নিলেও দেশ ছাড়ার আগে ঠিকই তার নামটা পুরে দিলেন স্কোয়াডে। আমিরশাহীতে গিয়েও অনুশীলন-পর্বেও বোধ হয় জাদুমন্ত্র চালু রইল তার, নতুন টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট পর্যন্ত রায় দিলেন,
‘নাঈম শেখ ন্যাচারাল হিটার। ম্যাচে গিয়ে ওর কাজ একটাই, মারা।’
অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন সহকারী কোচের ভূমিকায়, শ্রীধরন শ্রীরামের কথায় বাড়তি ভরসা তাই ছিলই। বিরতিতে ব্যাটিংটা আমূল বদলে ফেলেছেন, এমন হতেই পারত। নাঈম শেখ যখন ম্যাচের প্রথম বলেই বাইরে বেরিয়ে এসে খেলতে চাইলেন ফজলহক ফারুকির বল, একটা ভ্রমও জাগল, ‘তাহলে কি নাঈম শেখকে চিনতেই পারেননি অতীতের সমস্ত অধিনায়ক-কোচেরা?’ কিন্তু, খানিকক্ষণ বাদেই অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাটের মুখ আগেই বন্ধ করে দিয়ে টাইমিং করতে পারলেন না, মুজিব-উর-রেহমানের বলে ভুল লাইনে ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হয়ে ফিরলেন প্যাভিলিয়নে, আরও একবার রান করতে বল নিয়ে ফেললেন বেশি, যে সমস্যাগুলো অতীতেও তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। তাকে ‘আপাতত’ দলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্তও তো এ কারণেই এসেছিল।
দল থেকে বাদ পড়বেন, এমন গুঞ্জন চাউর হয়েছিল মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ঘিরেও। কিংবা, দলে থাকলেও ব্যাট করতে হবে দলের বেঁধে দেওয়া চাহিদাপত্রে। প্রায় ১০০ করে ম্যাচ খেলার পরও দু’জনের কারও স্ট্রাইক রেট কিংবা ব্যাটিং গড়ই টি-টোয়েন্টির দাবি মানতে সক্ষম নয়। দু’জনে একত্রে যে ৯৩ ম্যাচ খেলেছেন, বাংলাদেশ তাতে জিতেছে মাত্র ৩৪টি, কেবল এই পরিসংখ্যানকে সত্যি মানলেও তো একটা বদল তো আসতেই পারত।
শেষমেশ ম্যাচে অবশ্য দেখা গেল, ওসব অসারের তর্জন গর্জনই সার। মুশফিক নামলেন চার নম্বরেই, খানিক বাদে ৪ উইকেট পড়তে নামলেন রিয়াদও। সবার মুখ বন্ধ করে দেবেন এক ইনিংসে, তেমন কিছুও করতে পারলেন না। মুশফিক ষষ্ঠ ইনিংসে চতুর্থবারের মতো কাটা পড়লেন রাশিদ খানের বলে, মাহমুদউল্লাহ আবারও সংগ্রাম করে গেলেন স্ট্রাইকরেটকে ১০০-এর ডানপাশে তুলতেই।
এই দু’জনকে জায়গা করে দেওয়ার মূল্যটাও কড়াভাবেই চুকোতে হলো বাংলাদেশকে। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত স্পিনের বিপক্ষে ভালো, অভিষেকের আগে থেকেই এই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন অনেক ক্রীড়া বিশ্লেষকই। যদিও পরিসংখ্যানটা সমর্থন জানাচ্ছিল না সেই দাবিতে, গতকাল ৩১ বলে ৪৮ রান করার পরও যেমন স্পিনের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১০৯, ওয়ানডেতে সেটা ৬৫।
কিন্তু কেবল গতকালকের আলোচনাতেই যদি সীমা বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, রশিদ-মুজিব-নবীর বিপক্ষে ১৫ বলে ২৫ রান নিয়েছেন তিনি। তিনি স্ট্রাইকে আছেন দেখে মোহাম্মদ নবী বোলিং কোটা পূর্ণ করার সাহসটা পর্যন্ত করলেন না। অথচ, এই ত্রয়ীর বাদবাকি ৫১ বল থেকে মাত্র ৩৬ রান তুলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। মোসাদ্দেক কি তাদের বিপক্ষে আরও রান তুলতে পারতেন? জানার সুযোগ হয়নি, কারণ, তাকে আগে নামানো হয়নি।
মোসাদ্দেকের এই ব্যাটিংটা কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? হতেই পারে। পরিসংখ্যানে অগাধ বিশ্বাস থাকলে টিম ম্যানেজমেন্টের মনে হতেই পারে, তিনি স্পিনের বিপক্ষে দুর্বল। নাকি, মাঝখানে ব্যাটিংটা নিয়ে খেটেছেন? রশিদ খানকে সাবলীলভাবে খেলতে পারলেন যখন, তখন তো মন এই বিশ্বাসটাই করতে চাইছে। তা-ই যদি হবে, তাহলে টিম ম্যানেজমেন্ট তাদের কাজটা ঠিকঠাক করছে কি না, এই প্রশ্নটাও তো উঠবে। আমজনতার তো আর অনুশীলন দেখার সুযোগ হয় না, ক্রিকেটের খুঁটিনাটি জ্ঞানও খুব একটা নেই বলে তাদের ভরসা কেবলই পরিসংখ্যান। কিন্তু, টিম ম্যানেজমেন্টের দুটোই বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে বলেই না তারা সেই জহুরির আসনে বসেছেন। কে কোথায় ভালো, কার বিপক্ষে ভালো – এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর বের করেই না দল নির্বাচন করবেন তারা, ব্যাটিং-অর্ডার সাজাবেন।
অথচ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটায় সব যদি পরিকল্পনামাফিকও এগোত, মোসাদ্দেককে খেলতে হতো ফিনিশারের ভূমিকায়। কিন্তু, পেসারদের বিপক্ষে তার শটের ঝুলিতে স্লগ বলে কিছু নেই। এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে চার কিংবা ছয়, একমাত্র এ শটটাই পেসারদের বিপক্ষে কর্তৃত্ব নিয়ে খেলতে দেখা যায় তাকে। এ দিনও দেখা গেল, জায়গা বানিয়ে অফে খেলতে চাইছেন তিনি, কিংবা বলটা থার্ডম্যান দিয়ে গলিয়ে দিতে চাইছেন। কয়েকবার সফল হলেন, তবে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। শেষ ৪ ওভারে বাংলাদেশ তুলতে পারল মাত্র ৩২ রান। সাকিবের আফসোসও রয়ে গেল ম্যাচ শেষে, ‘ইশ, আর ১০-১৫টা রান যদি হতো..’
অথচ, মোসাদ্দেককে ওপরে তুলে ফিনিশারের ভূমিকায় অন্য কাউকে খেলানোর মতো বিকল্প কিন্তু শারজাতেই ছিল। বল-বাই-বল ডেটা পাওয়া যায়, এমন টি-টোয়েন্টিগুলোতে শেষ চার ওভারে সাব্বির রহমান রান তুলেছেন প্রায় ১৩৯ স্ট্রাইক রেটে। যদিও আউট হয়েছেন নিয়মিত, তবে পেসারদের বিপক্ষে তার ব্যাটটা আরও একটু ক্ষুরধার ডেথ ওভারে। মাঝে দীর্ঘ সময় জাতীয় দলে সুযোগ হয়নি তার, কিন্তু তার জায়গায় সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটাররা তো তার সমপর্যায়ের পারফরম্যান্সও দেখাতে পারেননি মাঝের সময়টায়, ‘ফিনিশারের ভূমিকায় সাব্বিরই আমাদের সেরা বিকল্প’ মেনে নিতে তাহলে আপত্তি কোথায়?
কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টের তা মানতে এখনো আপত্তি আছে। বদলে দেওয়ার বদলে বরং পূর্বেকার ব্যাটিং অর্ডারটা ধরে রাখাই শ্রেষ্ঠ বিকল্প মনে হলো তাদের কাছে। মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ ওপরে নামলেন আরও একবার। তারা দু’জনে রান করতে পারলেন না, সেটা তো অবশ্যই সমস্যার। কিন্তু, তাঁরা যে বাকিদের রান করতেও দিলেন না, এটাও তো কম বড় সমস্যা না।
সব দেখে-টেখে আফসোস হওয়াটাই স্বাভাবিক। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান যখন পারফর্ম করছেন সুপারম্যানের মতো, তখন নাকি অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছে গিয়ে অফ-ফর্মের মাহমুদউল্লাহকে বসানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। এরপরে ঘাটের জল অনেকদূর গড়িয়েছে। ভাগ্যের ফেরে মাহমুদউল্লাহকে হটিয়ে সাকিবই হয়েছেন অধিনায়ক। আর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছেন, অধিনায়ক থাকলে একাদশ নির্বাচন সাকিবই করেন।
সাকিব আলটপকা, অকপট; দলের প্রয়োজনে অপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলো নিতেও পিছপা হন না বলে একটা আলাপ দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ মেললেই। অধিনায়ক হওয়ার পরে অফ-ফর্মের ভেতর দিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারকে বসাবেন, সুযোগ করে দেবেন তরুণদের ডানা মেলে ওড়ার – এমন প্রত্যাশা তাই ছিলই। বিসিবি কর্তাদের হাবভাব দেখেও মনে হচ্ছিল, প্রত্যাশাটা তাদেরও। কিন্তু সাকিবের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্বের তৃতীয় পর্বটা যেভাবে শুরু হলো, তাতে তো মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, যা রটে, তার কিছুই বটে না। দিনের পর দিন বদলে যাওয়ার মহড়াই দেওয়া হয়, বদলটা আর আসে না।