গ্রীক মিথোলজি অনুযায়ী, প্যান্ডোরা হলেন দেবতাদের বানানো প্রথম নারী। দেবতা এপিমেথেউস দেখামাত্রই প্যান্ডোরার প্রেমে পড়ে যান, প্যান্ডোরার সাথে তার বিয়ে হয়।
দেবরাজ জিউস আসেন সেই বিয়েতে। প্যান্ডোরাকে উপহার দেন এক অদ্ভুত সুন্দর বাক্স। তবে, বাক্সটা খুলতে বারণ করে দেন। বলে দেন, বাক্সটা খোলামাত্রই সকল সুখ-শান্তি নষ্ট হবে প্যান্ডোরা আর এপিমেথেউসের।
আর জিউসের স্ত্রী দেবরাণী হেরার কাছ থেকে প্যান্ডোরা উপহার হিসেবে পান ‘কৌতুহল’। এই কৌতুহলের কাছে হার মানে জিউসের নিষেধাজ্ঞা। বাক্সটা খুলে ফেলেন প্যান্ডোরা। ব্যস! রোগ, জরা, হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, মিথ্যা, অসততা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে। প্যান্ডোরা যখন বাক্সটা বন্ধ করতে থাকে, তখন ভেতরে পড়ে থাকে কেবল ‘আশা’। সব ধরণের গুণ নিয়ে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে এসে নরকের যন্ত্রনা টের পায় মানুষ।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটও এখন সেই প্যান্ডোরার মতোই। বাক্সটা খুলে গিয়ে সকল রকমের পতন আর নেতিবাচকতা ঢুকে গেছে দেশটির ক্রিকেট অবকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এক সময়ের পরাক্রমশালী ক্রিকেট শক্তির ভাগ্য।
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট একটা বিস্ময়কর জায়গা। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক ছিল দেশটি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জের ধরে দেশটি থেকে বিশ্বকাপ সরিয়ে নেওয়ারও জোর সম্ভাবনা ছিল। সেটা শেষ অবধি না হলেও অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলগুলো সেখানে গিয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই ‘অবহেলা’র জবাব দিয়ে শ্রীলঙ্কা দল সব ফেবারিটদের হিসাব-নিকাশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জিতে নেয় বিশ্বকাপের শিরোপা। ক্রিকেটের ইতিহাসেরই সেটা অন্যতম বড় এক বিস্ময়।
সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট নতুন একটা রূপ লাভ করে। ২০০৭, ২০১১ – টানা দু’টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে দলটি। এখানেই শেষ নয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা পায় দলটি।
কিন্ত, আদতে সেটাই ছিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের ‘শেষ’-এর শুরু। ওই সময় অবধিও দলে মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো কিংবদন্তি ছিলেন। কিন্তু, তারা চলে যাওয়ার পরই অন্ধকার নেমে আসে লঙ্কান ক্রিকেটে। এক লাসিথ মালিঙ্গার স্টারডম ও অতিমানবীয় কিছু পারফরম্যান্স সেই পতন আটকাতে পারেনি।
আক্ষেপ করে তাই মুরালিধরন বলছিলেন,
‘অবসরের পর থেকে আমি আর লঙ্কান ক্রিকেটের সাথে জড়িত নই। তবে, লঙ্কান ক্রিকেটের একটু একটু করে হারিয়ে যাওয়া আমাকে কষ্ট দেয়। তিনটা (ওয়ানডে) বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা একটা দল, যাদের গর্ব করার মতো ক্রিকেট সংস্কৃতি আছে, তাদের এই অবস্থা খুবই দুশ্চিন্তার ব্যাপার।’
অর্থই অনর্থের মূল। মুরালিধরনও মনে করেন, অর্থের লোভেই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেশটির ক্রিকেট সম্ভাবনা। তিনি বলেন,
‘আমরা যখন খেলতাম, তখন অর্থ কোনো মানদণ্ড ছিল না। নব্বই দশকে ক্রিকেটে খুব বেশি অর্থ ছিলও না। আমাদের প্যাশন ছিল উইকেট পাওয়ার, রান করার। এখন সেই প্যাশনটা পাল্টে গেছে। এখন সবাই অর্থের পেছনে ছোটে, তাই ক্রিকেটের মান কমে গেছে। একজন খেলোয়াড়ের সবসময় নিজের খেলাটা নিয়েই ভাবা উচিৎ, অর্থ নয়। কারণ, ভাল পারফর্ম করতে পারলে অর্থ আর পরিচিতি দুটোই আসবে।’
লঙ্কান ক্রিকেটে এখন সেই অর্থে কোনো বড় প্রতিভার দেখা মেলে না। মুরালিধরন বলেন,
‘শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট যথেষ্ট পরিমান প্রতিভাবানকে তুলে আনতে পারছে না। গেল তিন থেকে চার বছরে প্রতিভার অনেক ঘাটতি ছিল। প্রতিভা পাওয়া গেলেও দেখা যায় যে, তারা খেলতে জানে না। কোচরা কখনো খেলোয়াড় বানায় না। তারা শুধু ব্যাসিক জ্ঞানটা শুধরে দিতে পারেন। প্রতিভা আদৌ বিকশিত হবে কি না, তা নির্ভর করে ওই মানুষটার সফল হওয়ার ইচ্ছাশক্তির ওপর।’
মুত্তিয়া মুরালিধরন যা বলেছেন, তার বাইরেও কিছু কারণ আছে, যা আসলে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। সেগুলো কী? চলুন দেখে নেওয়া যাক।
কিংবদন্তিদের অবসর
কিংবদন্তিতুল্য জুটি কুমার সাঙ্গাকার ও মাহেলা জয়াবর্ধনের কাছাকাছি সময়ে বিদায় লঙ্কান ক্রিকেটের পতনকে প্রভাবিত করেছে। তারা থাকতে থাকতেই তাদের জায়গা ভবিষ্যতে নিতে পারবে, এমন কাউকে বানিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। এখনো এই দু’জনের কাছাকাছি মানেও কেউ পৌঁছাতে পারেননি।
নেতৃত্বের সংকট
এই সমস্যাটা জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়। তাদের উপস্থিতিতে কখনো অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস, কখনো লাসিথ মালিঙ্গা অধিনায়ক হলেও মূল দায়িত্বটা ওই দুই মহারথীই পালন করতেন। এটা বড় একটা নির্ভরশীলতার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। পরে ম্যাথুস ও দীনেশ চান্দিমাল পালা করে অধিনায়কত্ব করেছেন। চান্দিমালের ছিল ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ঘাটতি, আর ম্যাথুসের ছিল ফিটনেসের ঘাটতি। আর মালিঙ্গা সেই অর্থে কখনোই ‘অধিনায়ক ম্যাটেরিয়াল’ ছিলেন না।
বোর্ডের দুর্নীতি
লঙ্কান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল নিয়ন্ত্রক সংস্থা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) অস্থিতিশীলতা। বোর্ডে এতটাই নিয়ম নীতির অভাব আর দুর্নীতি যে, প্রায়ই এখানে ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপ দরকার হয়। এই নিয়ে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিও বিরক্ত এসএলসির ওপর। ক্রিকেটারদের সাথেও বোর্ডের বনিবনার সমস্যা আছে। ২০১৩ সালে বেতনভাতা বিষয়ক জটিলতায় কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ২৩ ক্রিকেটার বিদ্রোহ করেছিলেন। সেবার বাংলাদেশ সফর নিয়েও শঙ্কা ছিল।
লঙ্কান বোর্ডের অস্থিতিশীলতা সেই নব্বই দশক থেকেই চলে আসছে। ২০১১ সালে কুমার সাঙ্গাকারা লর্ডসে দেওয়া বিখ্যাত এক ভাষণে বলেছিলেন,
‘আমাদের বোর্ড এতটাই অস্থিতিশীল যে, এটা (জাতীয় দলের) ভাল পারফরম্যান্স করার পথে প্রধান অন্তরায়।’
নিম্নমানের ঘরোয়া কাঠামো
ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর দিক থেকে শ্রীলঙ্কার নাম আসবে সবার নিচের দিকেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হয় সামান্যই। ক্লাব ক্রিকেটের আগের মতো রমরমা অবস্থা নেই। এখন বোর্ডের মূল আগ্রহের জায়গা হল প্রাদেশিক ক্রিকেট। তাই, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত ক্লাব ক্রিকেট হারিয়ে যেতে বসেছে।
দলে স্থিতিশীলতার ঘাটতি
লঙ্কানদের দল বা একাদশ, কোথাও স্থিতিশীল টিম কম্বিনেশন বলে কিছু নেই। পারফরম্যান্সের এতটাই ঘাটতি যে, মুহূর্মূহূ দলে এবং একাদশে পরিবর্তন আনা হয়। তরুণ ক্রিকেটাররা সুযোগ পেলেও নিজেদের প্রমাণ করতে পারে খুবই সামান্য কয়েকটা ক্ষেত্রে।
কোচ নির্বাচন
শ্রীলঙ্কা বোর্ড অবশ্য কোচ নির্বাচনে অর্থের কোনো মায়া করে না। তবে, অর্থটা তারা সব সময় সঠিক জায়গায় কাজে লাগায় না। গ্রাহাম ফোর্ড হঠাৎ করে চলে যাওয়ার পর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ নিক পোথাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেটা একটা বাজে সিদ্ধান্ত ছিল।
এরপর চান্দিকা হাতুরুসিংহেকে আনা হয়। এসএলসি’র ধারণা ছিল, বাংলাদেশে যে ইতিবাচক পরিবর্তনটা হাতুরু আনতে পেরেছিলেন, সেটা শ্রীলঙ্কাতেও হবে। কিন্তু সেটা তো হয়নি বটেই, বরং চান্দিকার সাথে প্রথমে খেলোয়াড়দের এবং পরে বোর্ডের গোলমাল হয়। শেষ অবধি চান্দিকার চুক্তি বাতিল করা হয়। চান্দিকাও কম যান না, তিনি রীতিমতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে এসএলসির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছেন।
আশার কথা হলো, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে এখন কোচ হিসেবে আছেন মিকি আর্থার। কোচিংয়ের দিক থেকে তিনি হাতুরুসিংহের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। তিনি খেলোয়াড়দের মানসিকতা বোঝেন। সেটা দিয়ে মাঠে পারফরম্যান্স ফিরলে, বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান আপনা-আপনিই হয়ে যাবে।
গ্রীক পুরানের সেই প্যান্ডোরার কোনো ‘আশা’ ছিল না। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে সেটা অন্তত টিকে আছে!