ম্যাথু সিনক্লেয়ারের কথা মনে আছে? যদি না থাকে, তাহলে ইউটিউবে গিয়ে ‘Best catches in cricket history‘ টাইপ করুন, পেয়ে যাবেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের একটা ৫৩ সেকেন্ডের ভিডিও। নিউজিল্যান্ডের একজন সুঠামদেহী ফিল্ডারকে বাউন্ডারিতে এক হাতে দুর্দান্ত একটি ক্যাচ নিতে দেখবেন এবং অজান্তেই আপনি বলে ফেলবেন “অবিশ্বাস্য!”
ডকল্যান্ডসের দর্শকদের সেদিন অবাক হওয়ার পালা ছিল যখন বল তালুবন্দি করে ওঠামাত্রই দর্শকদের দিকে ইশারা করে কিছু একটা বললেন সিনক্লেয়ার। নিউজিল্যান্ডের নেপিয়ারে বড় হওয়া, শান্তশিষ্ট বলে পরিচিত একজন ক্রিকেটারের থেকে এমন আগ্রাসন অপ্রত্যাশিতই ছিল বটে। কিন্তু দর্শকরা এমন আগ্রাসনের অর্থ বুঝে ওঠার আগেই সিনক্লেয়ার তার সতীর্থদের সাথে উদযাপনে যোগ দিলেন আর দৃষ্টিগোচর হলো তার স্বভাবসুলভ প্রশস্ত হাসি।
সেই ঘটনার পর কেটে গেছে ১৭ বছর। টেমস-রিপলের পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। সবকিছু পাল্টে গেছে। ক্রিকেট থেকে প্রায় সাত বছর আগে অবসর নিয়েছেন সিনক্লেয়ার। জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিছু সময় পার করেছেন। ক্রিকেটের বাইরেও যে এক কঠিন জীবনসংগ্রাম রয়েছে, এই ক’বছরে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি।
টেস্ট অভিষেকে দ্বিশতক করা, পরের মৌসুমে পাকিস্তানের বিপক্ষে একই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করা, কিংবা ক্ষণে ক্ষণে দল থেকে বাদ পড়ে যাওয়া, আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ফিরে আসা- সিনক্লেয়ারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল একটা রোলার কোস্টারের মতো।
আমার টেস্ট ক্যারিয়ারটা ছিল উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ। কিন্তু আমার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার খুবই ভালো ছিল। আমার মনে হয় ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মনোনিবেশ করাটা কঠিন ছিল আমার জন্য। তার উপর, অভিষেকের পারফরম্যান্সের পর আমার উপর বাড়তি প্রত্যাশার চাপ মানসিকভাবে আমাকে কিছুটা পেছনে ঠেলে দিয়েছে।
– বলেন ম্যাথু সিনক্লেয়ার
অভিষেকের কথা যখন বলা হলো, তখন ফিরে যাওয়া যাক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৯৯৯-এর বক্সিং ডে টেস্টে। গ্যারি স্টেড আউট হওয়ার পর তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন সিনক্লেয়ার। গ্যারি স্টেডকে চেনেন তো? বর্তমান নিউজিল্যান্ড দলের কোচ। কোর্টনি ওয়ালশ, রেয়ন কিং ও ফ্র্যাংকলিন রোজত্রয়ীর সামনে আনকোরা অভিষিক্ত সিনক্লেয়ার। একাদশে জায়গা পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকা সিনক্লেয়ার অভিষেকেই খেললেন ৪৪৭ বলে ২১৪ রানের অসাধারণ ইনিংস।
আমি আসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দলে ছিলাম না। ভাগ্যক্রমে জায়গা হয়। আগের টেস্টে ম্যাট হর্ন আঙুলে চোট পেয়েছিল। তাই তার জায়গায় একজন ব্যাটসম্যান প্রয়োজন ছিল। আমি তখন বেশ ভালো ফর্মে ছিলাম, ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক রান করছিলাম এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ-দলের বিপক্ষেও ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। ব্যাটে বলে হয়ে গিয়েছিল আর কী সব।
স্টিফেন ফ্লেমিং ফোনে আমার অভিষেকের সংবাদ দেন। খবর পেয়ে আমি সোজা ওয়েলিংটনে উড়ে আসি। ফ্লেমিংয়ের হাত থেকে টেস্ট ক্যাপ পেয়েছিলাম আমি। সে ছিল এক গর্বের মুহূর্ত।
অভিষেকে যে সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তা ধরে রাখতে পারেননি সিনক্লেয়ার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর জীবিকা উপার্জন করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে পড়ে তার জন্য। সত্যি বলতে, নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা ক্রিকেটপ্রেমীদের স্নেহধন্য হলেও নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেট একটা গ্রীষ্মকালীন খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ২০১৩ এর জুলাইয়ে ক্রিকেট ছাড়ার পর সিনক্লেয়ারের প্রথম কাজ ছিল একটা চাকরি জোগাড় করা। নেপিয়ারে সেলস অ্যাসিস্টেন্টের কাজ নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেননি এখানে।
আমার জন্য ক্রিকেটের বাইরে অন্য কোনো কাজ করে জীবিকার্জন করা সত্যিই খুব কঠিন ছিল। ১৭ বছর বয়স থেকে ৩৭ বছর পর্যন্ত টানা ২০ বছর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছি। ক্রিকেট ছাড়া কোনো কিছুর কথা ভাবিনি এবং প্রতি মুহূর্তে একজন ভালো ক্রিকেটার ও ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছি। একটা সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে খেলাটাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সেই ক্রিকেটই জীবনের শেষ কথা নয়।
– সিনক্লেয়ার বলেন
কিছুদিন পর তিনি এক রেডিও অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারেন। স্থানীয় এক রেডিও স্টেশনের এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন সাবেক কিউই ব্যাটসম্যান ও বর্তমান ধারাভাষ্যকার মার্ক রিচার্ডসন। সেদিন অনুষ্ঠানের শ্রোতারা ফোনকলে তাদের চাকরিজীবনের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। একজন শ্রোতা হঠাৎ বললেন, “আমি টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলাম।” কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর হতচকিত রিচার্ডসন প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি ম্যাথু সিনক্লেয়ার?“
উত্তর আসল, “হ্যাঁ, আমিই ম্যাথু সিনক্লেয়ার। আমাকে কি একটা কাজ খুঁজে দিতে পারো, মার্ক?“
সিনক্লেয়ার একটা কাজের জন্য এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, একটা পাবলিক ফোরামের শরণাপন্ন হয়ে নিয়োগদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে ডাকেননি। সত্যি বলতে, দলে আসা-যাওয়ার থেকেও এটা অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছিল তাকে।
সাথে সাথে তার পারিবারিক জীবনও হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। দ্রুতই হতাশার সাগরে ডুবে যান সিনক্লেয়ার। পূর্বে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। দিশেহারা হয়ে যান। উপায়ান্তর হয়ে সরকারি অনুদানের খাতায় নাম লেখান একসময়। সিনক্লেয়ার ভাষায় এটা ছিল তার জীবনের নেয়া সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। একজন সাবেক ক্রিকেটার, যিনি সম্মানের সাথে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তার জন্য এর থেকে কঠিন আর কী হতে পারে!
সারাজীবন তার ধ্যান-জ্ঞানই ছিল ক্রিকেট। সেলস অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে হক’স বে-তে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসেবে যখন কাজ করার একটা সুযোগ পেলেন, তখন সাত-পাঁচ না ভেবেই সুযোগটা লুফে নিলেন তিনি। প্রথম কাজ পেয়ে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত সিনক্লেয়ারের ইচ্ছা হয়েছিল একটা পার্টি দিতে। কিন্তু অর্থ যে ছিল না হাতে!
আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল এটা। যখন আপনি ক্রিকেট খেলেন, তখন আপনি সব হাতের কাছে পেয়ে যান। কিন্তু যখন আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ, তখন আপনার জন্য কিছু তৈরি থাকবে না। নিউজিল্যান্ডে ব্যাপারটা এমনই। রাগবি এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট সম্ভবত তালিকায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়তে থাকবে, মূলত এটা একটা গ্রীষ্মকালীন খেলা। এখানে ক্রিকেট একটা চাকরির মতো। অবসরের পর আপনি একজন সাধারণ মানুষ।
জীবন নিয়ে কোনো আফসোস নেই। সবকিছুর সাথেই মানিয়ে নিয়েছেন। জীবিকা উপার্জন করছেন এখন হক’স বে-তে বাচ্চাদের ক্রিকেট শিখিয়ে। ভারতের ব্যাঙ্গালোর ও পুনেতে কিছু কোচিং ক্যাম্পও করাচ্ছেন। অবশেষে ক্রিকেটের মাঝেই সিনক্লেয়ার খুঁজে নিতে পেরেছেন জীবিকা; বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাচ্চাদের অন্তত শেখাতে পারছেন কীভাবে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।
সরকারি অনুদানের তালিকায় নাম লেখানো, রেডিও অনুষ্ঠানে কল করে কাজ চাওয়া কিংবা নালা পরিষ্কার করার মতো কাজে রাজি হয়ে যাওয়া- সিনক্লেয়ারের সামান্যই ধারণা ছিল যে তার ভালোবাসার ক্রিকেটই তাকে নতুন জীবন দেবে। সকল হতাশা, সকল প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে আবারও স্মিতহাস্যে প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। ভাগ্য কতভাবেই না খেলেছে তার সাথে!