লেসলি হিলটনের নামটা ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদাভাবে লক্ষ্য করার কোনো কারণ নেই। ব্যাপারটা যে খুব অস্বাভাবিক, তা-ও নয়। খুবই সাধারণ একজন বোলার ছিলেন তিনি, ৬ টেস্টে নিয়েছেন মাত্র ১৬ উইকেট। এর চেয়ে ভালো বোলার কতজনই তো এসেছেন ক্রিকেটে! হিলটনের নামটা তাই ইতিহাসের পাতায় খোদাই করা থাকলেই বরং বাহুল্য হতো!
কিন্তু তারপরেও হিলটন স্মরণীয় হয়েই আছেন!
মানুষ স্মরণীয় হয় তিনভাবে। প্রথমত, নিজের কোনো কীর্তির কারণে। যেমন: ডন ব্র্যাডম্যান। এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে বোধহয় কিছু না বললেও চলে। দ্বিতীয়ত, অন্যের কীর্তির সাথে নিজের নাম জড়িয়ে যাওয়ার কারণে। এই ক্যাটাগরিতে পড়বেন এরিক হলিস, ম্যালকম ন্যাশ, স্টুয়ার্ট ব্রড। স্টুয়ার্ট ব্রডকে পাঠক অনায়াসেই চিনে ফেলবেন যুবরাজ সিংয়ের হাতে এক ওভারে ছয় ছক্কার কারণে। এরিক হলিস আর ম্যালকম ন্যাশকে হয়তো চিনবেন না। চেনানো যাক সেক্ষেত্রে।
হলিসের মতো অখ্যাত এক বোলার যে স্মরণীয় হয়ে আছেন, এখানেও ব্র্যাডম্যানের অবদান। গড় ঠিক ১০০ করতে শেষ ইনিংসে ডনের দরকার ছিল মাত্র ৪ রান। সারা জীবন ধরে যার ব্যাট থেকে রান বেরিয়েছে ফল্গুধারার মতো, সেই তিনিই কি না হলিসের বলে শেষ ইনিংসে আউট হলে ০ রানে! আর ম্যালকম ন্যাশের পেছনে আছেন গ্যারি সোবার্স। ন্যাশকে এক ওভারে ছয়বার ছক্কা যে তিনিই মেরেছিলেন!
আর তৃতীয়ত স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে, নিজের কোনো কুকীর্তির কারণে। এই ক্যাটাগরিতে পড়বেন আজহারউদ্দীন, হ্যান্সি ক্রনিয়ে প্রমুখ। এদের সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই। ফিক্সিং, ম্যাচ গড়াপেটা করে নিজেরাই নিজেদের নামকে কলঙ্কিত করেছেন।
লেসলি হিলটন কোন ক্যাটাগরিতে পড়বেন? তিনি পড়বেন তিন নাম্বার ক্যাটাগরিতে। তবে ফিক্সিং বা ম্যাচ পাতানো নয়, তার অপরাধ ছিল আরও বড়। নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন তিনি। শাস্তি হিসেবে ফাঁসিও হয় তার।
ফাঁসিতে ঝোলা একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার তাই লেসলি হিলটন!
১৯০৫ সালের ২৯ মার্চ জ্যামাইকাতে জন্ম হয় লেসলি জর্জ হিলটনের। টেস্ট অভিষেক ৩০ বছর বয়সে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। শুরুটা হলো স্বপ্নের মতো, প্রথম ৩ টেস্টে নিলেন ১৩ উইকেট। চতুর্থ টেস্টে উইকেটই পেলেন না, সেই সাথে ছিটকে গেলেন দলের বাইরেও। চার বছর পরে ইংল্যান্ড সফরের দলে ডাক পেলেন আবার, সেই সিরিজের প্রথম ২ টেস্টে নিলেন মাত্র ৩ উইকেট। বাকি সিরিজের জন্য তো বাদ পড়লেনই, জাতীয় দলের দরজা পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেল তার জন্য।
তার অভিষেক টেস্টে এমন একটা ঘটনা ঘটে, যেটা হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসের পাঠকরা জানেন না। ব্যাটিং অর্ডার ঘুরিয়ে দেয়ার কথা বললেই সবার প্রথমে আমাদের মাথায় আসে ব্র্যাডম্যানের নাম, ১৯৩৭ সালের অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে এই কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার দুই বছর আগেই এই কাজ করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন জ্যাকি গ্রান্ট! প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, মাঠের অবস্থা ছিল জঘন্য। টসে হেরে প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করলো মাত্র ১০২ রান। ৭ উইকেটে ৮১ রান তুলে ইনিংস ডিক্লেয়ার করলো ইংল্যান্ড। আর তখনই জ্যাকি গ্রান্টের সেই মাস্টারস্ট্রোক! ভাই রলফ গ্রান্টের সাথে তিনি ওপেন করতে পাঠালেন পিউর বোলার হিলটনকে।
তার অভিষেক টেস্টে এমন একটা ঘটনা ঘটে, যেটা হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসের পাঠকরা জানেন না। ব্যাটিং অর্ডার ঘুরিয়ে দেয়ার কথা বললেই সবার প্রথমে আমাদের মাথায় আসে ব্র্যাডম্যানের নাম, ১৯৩৭ সালের অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে এই কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার দুই বছর আগেই এই কাজ করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন জ্যাকি গ্রান্ট! প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, মাঠের অবস্থা ছিল জঘন্য। টসে হেরে প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করলো মাত্র ১০২ রান। ৭ উইকেটে ৮১ রান তুলে ইনিংস ডিক্লেয়ার করলো ইংল্যান্ড। আর তখনই জ্যাকি গ্রান্টের সেই মাস্টারস্ট্রোক! ভাই রলফ গ্রান্টের সাথে তিনি ওপেন করতে পাঠালেন পিউর বোলার হিলটনকে।
তবে এরপরেও ম্যাচ বাঁচাতে পারেননি জ্যাকি। ৫১ রানে ষষ্ঠ উইকেট হিসেবে যখন জর্জ হেডলি আউট হন, সাথে সাথেই ডিক্লেয়ার করে দেন তিনি। হেডলি আউট হন ০ রানে, এরপরেই জ্যাকি বুঝে যান, এই পিচে ব্যাটিং করা রীতিমতো অসম্ভব। প্রথম ইনিংসের ২১ রানের লিড মিলিয়ে ইংল্যান্ডের টার্গেট দাঁড়ায় ৭৩ রানের।
তবে জ্যাকি ভুল ভেবেছিলেন। তার উচ্চাভিলাষী এই সিদ্ধান্তের খেসারত দল দেয় ৪ উইকেটে পরাজয়ের মাধ্যমে। অসম্ভবকে সম্ভব করলেন ওয়ালি হ্যামন্ড আর প্যাটসি হেনড্রেন; হ্যামন্ডের ২৯ আর হেনড্রেনের ২০ রানের উপরে ভর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড। এর পেছনে হিলটনের দায়ও কম নয়। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮ রানে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট, তার এই পারফরম্যান্স জ্যাকিকে উৎসাহ দিয়েছিল দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করতে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে খুব বাজে বল করলেন হিলটন, ৮ ওভারে ৪৮ রান দিয়ে নিলেন মাত্র ১ উইকেট। ম্যাচ তো ওখানেই শেষ!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই ম্যাচ জিততে পারলে জ্যাকির এই ব্যাটিং অর্ডার ঘুরিয়ে দেয়া নিয়েও মহাকাব্য লেখা হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু দিনশেষে মানুষ সফলতারই জয়গান গায়, ব্যর্থতা তো সেখানে অনাহুত অতিথি মাত্র।
ক্রিকেট ছাড়ার পরে ফোরম্যান হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেন হিলটন। এ সময়ই তার পরিচয় হয় লার্লিন রোজের সাথে। লার্লিন ছিল জ্যামাইকার পুলিশ ইন্সপেক্টরের মেয়ে, দুই পরিবারের মধ্যে ব্যবধান ছিল বিস্তর। হিলটনের সাথে মেয়ের বিয়েতে একেবারেই রাজি ছিলেন না লার্লিনের বাবা, এমনকি হিলটনের বিপক্ষে কোনো পুলিশ কেস আছে কি না, সেই খোঁজ নিতেও ভুল হয়নি তার।
কিন্তু তারপরেও বিয়েটা হয়েই যায় লার্লিন আর হিলটনের, সেটা ১৯৪২ সালের কথা। ১৯৪৭-এ গ্যারি নামে এক সন্তানও হয় তাদের।
গল্পটা এরকম ‘অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ ভাবেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু যেমনটা ভাবা হয়, সেরকমটা হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। লার্লিন আর হিলটনের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ এর বদলে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হলো তাদের জীবন। আর হিলটন হয়ে গেলেন ট্র্যাজিক হিরো।
পোশাক ডিজাইন করার একটা ব্যবসা শুরু করে লার্লিন, এ কারণে নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হতো তাকে। সেখানে ১৯৫৪ সালে তার সাথে পরিচয় হয় রয় ফ্রান্সিস নামের একজন লম্পটের। খুব তাড়াতাড়িই তার সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায় লার্লিন। বাকি গল্পটা হৃদয়হীনতার, বাকি গল্পটা বিশ্বাসঘাতকতার, বাকি গল্পটা প্রতিশোধের।
হিলটনের কাছে একটা চিঠি আসে একদিন। চিঠিতে রয় ফ্রান্সিসের সাথে তার স্ত্রীর গোপন প্রেমের ব্যাপারে লেখা ছিল। চিঠিটা পেয়ে সরাসরি স্ত্রী লার্লিনকে জিজ্ঞেস করেন হিলটন, এরকম কিছুর কথা অস্বীকার করেন লার্লিন। স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করেন হিলটন।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই তার সেই বিশ্বাস ভেঙে খানখান হয়ে যায়, যখন জানতে পারেন, জনৈক রয় ফ্রান্সিসকে চিঠি লিখেছে লার্লিন, একজন চাকরকে দিয়ে সেই চিঠি পোস্ট অফিসে পাঠিয়েছে সে। সাথে সাথে পোস্ট অফিসে ছুটে যান হিলটন, কিন্তু পোস্ট অফিস থেকে জানানো হয়, চিঠিটা এখন ক্রাউনের সম্পত্তি বিধায় তার হাতে দেয়া সম্ভব নয়। ক্রাউন মানে ইংল্যান্ড, ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার আগপর্যন্ত জ্যামাইকা ইংল্যান্ডের অধীনে ছিল।
সেদিন রাতে আরেকবার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন হিলটন। এবার ফুঁসে ওঠে লার্লিন, চিঠি পাঠানোর ব্যাপারটা লুকানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে পুরো ব্যাপারটা স্বীকার করে নেয় সে। স্বীকার করে নেয় রয় ফ্রান্সিসের সাথে তার প্রেম আর শারীরিক সম্পর্কের কথা, সেই সাথে এটা জানিয়ে দিতেও ভোলে না, হিলটনের মতো নিচু শ্রেণীর একজনকে বিয়ে করাটা ছিল অনেক বড় ভুল।
এরপরে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন হিলটন। পিস্তল টেনে নিয়ে খালি করে ফেলেন লার্লিনের উপরে। পরে দেখা যায়, সর্বমোট ৭টি গুলি করেছেন, গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় রিলোডও করেছেন একবার।
স্ত্রীকে খুন করার পরে খুব শান্তভাবে পুলিশকে ফোন দেন তিনি। পুলিশ এসে গ্রেফতার করে তাকে।
এর পরের গল্পটা খুব সংক্ষিপ্ত। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে বিচার শুরু হয় হিলটনের। হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো সংশয়ই ছিল না জুরিদের। তবে জুরিরা তাকে ক্ষমা করার সুপারিশও রাখেন বিচারকের কাছে। বিচারকের কাছে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। দোষী সাব্যস্ত হন হিলটন, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাকে।
আপিলের পর আপিল হয়। কিন্তু আগের রায়ই বহাল থাকে সব জায়গায়। শেষ ভরসা ছিলেন জ্যামাইকার গভর্নর, তিনিও ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানালে নিশ্চিত হয়ে যায় ফাঁসিতেই ঝুলতে যাচ্ছেন হিলটন।
১৯৫৫ সালের ১৭ মে, এক সুন্দর সকালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায় লেসলি হিলটনের! সেদিন বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে টেস্ট চলছিল অস্ট্রেলিয়া আর স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার জন হোল্টের ফর্ম খারাপ যাচ্ছিল খুব, ব্যাটে রান ছিল না, স্লিপেও ক্যাচ ফেলেছিলেন বেশ কয়েকবার। গ্যালারিতে নাকি সেদিন ‘হোল্টকে ঝোলাও, হিলটনকে বাঁচাও’ এই রকম ব্যানারও দেখা গিয়েছিল!
কে জানে! বেঁচে থাকলে হয়তো হিলটনকে নিয়ে আরেকটা ‘ওথেলো’ লিখলেও লিখতে পারতেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার!