ফলাফলের বিচারে গ্যারেথ সাউথগেট ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অন্যতম সফল ম্যানেজার। তার অধীনে সর্বশেষ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল, ইউরোর ফাইনাল খেলেছে ‘তিন সিংহ’রা, ১৯৬৬ সালের পর যা সবচেয়ে বড় সাফল্য। তবে মাঠের ফুটবলের বিচারে তাকে প্রায়ই অভিহিত করা হয় ‘অতি রক্ষণাত্মক’, অথবা ‘একটু বেশিই সতর্ক’ হিসেবে। আক্রমণভাগের প্রতিভার পুরোটা ব্যবহার করতে না পারার দোষেও দোষী হতে হয় তাকে। যদিও এই বিশ্বকাপের শুরুটা হয়েছে ইরানকে ছয় গোলে উড়িয়ে দিয়ে, তাতেও কি সেই সমালোচনাটা মুছে ফেলতে পারছেন সাউথগেট? সেই বিশ্লেষণটাই থাকছে আজকের আলোচনাতে।
প্রথমত, কাতার বিশ্বকাপের জন্য সাউথগেটের ঘোষিত দলটার দিকে তাকানো যাক, যেখানে ২৬ জনের দলে রক্ষণভাগের খেলোয়াড় নেওয়া হয়েছে নয়জন। বেশিরভাগ দলের জন্যই সংখ্যাটা এমনই, নয় অথবা দশ। পূর্বের টুর্নামেন্টগুলোতে সাউথগেটও দশজন ডিফেন্ডার নিয়ে দল সাজিয়েছিলেন, সেই হিসেবে এবার সংখ্যাটা একজন কম।
সাউথগেট সবসময়েই বলে আসছেন, ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজারের পদটা কোনো ‘ফ্যান্টাসি ফুটবল নয়’, তাই আক্রমণভাগে অনেক অনেক বিকল্প থাকা সত্ত্বেও সবাইকে একসাথে দলে জায়গা করে দেওয়া সম্ভব হয় না। কথাটা অবশ্যই সত্য। ফিল ফোডেন, জ্যাক গ্রিলিশ, রাহিম স্টার্লিং, বুকায়ো সাকা, মার্কাস রাশফোর্ড, ম্যাসন মাউন্ট – এতজন খেলোয়াড়কে, যাদের প্রত্যেকেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা ফরোয়ার্ডদের তালিকায় থাকার যোগ্য, তাদের প্রতিভা অনুসারে গেম-টাইম দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এবং এই সাতজনের সবাই-ই মূলত উইঙ্গার, কেউই প্রথাগত সেন্টার ফরোয়ার্ড নন। আর তাই সবাইকে একসাথে সুযোগ দেওয়া সম্ভব না, এই বোধটা জেগে ওঠার সাথে সাথে জনমনে একটা প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক: সাউথগেট তবে কেন রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলান? উত্তরটা আছে প্রশ্নের মধ্যেই, সাউথগেটের খেলানোর ধরন রক্ষণাত্মক, কিন্তু ‘নেগেটিভ’ নয়।
ইংল্যান্ডের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে গ্যারেথ সাউথগেট এবং তার সহকারী স্টিভ হল্যান্ড – দু’জনে বিশ্লেষণ করেছিলেন, ঠিক কোন কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বড় মঞ্চে ব্যর্থ হচ্ছিল ইংল্যান্ড। বাছাইপর্বে দুর্দান্ত খেলা ইংরেজরা কী কারণে চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই গলদঘর্ম হতে হয়েছিল তাদের। কী সেই উত্তর, সেটা জানতে সময়ের পথ ধরে আরেকটু পেছনে যেতে হবে আমাদের।
২০১৪ সালে সাউথগেট ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলের ম্যানেজারের পাশাপাশি আরেকটা পদেও ছিলেন। এফএ-এর তৎকালীন পরিচালক ড্যান আশওয়ার্থের পাশাপাশি সাউথগেট ছিলেন ‘দ্য ইংল্যান্ড ডিএনএ’ নামক একটা পরিকল্পনার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি। এই পরিকল্পনাটার মূল উদ্দেশ্য এর নাম থেকেই পরিষ্কার, ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্য নতুন নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করা। তবে ইংল্যান্ডের পাশাপাশি তারা গবেষণা করেছিলেন জার্মানি আর ইতালি দলকে নিয়েও, যারা বড় টুর্নামেন্টে সাফল্যের দিক দিয়ে সবসময়ই ইংল্যান্ডের পুরো বিপরীতে অবস্থান করে। গবেষণা করে তারা এই উপসংহারে আসেন যে, বড় টুর্নামেন্টে সফল হয় সেই সব দল, যারা গোল হজমের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি কৃপণ। বিশেষত নকআউট পর্বে আপনি গোল হজম না করার অর্থ, আপনি অপরাজিত। সাউথগেট তখনই ঠিক করে ফেলেন, তার ইংল্যান্ডের ভিত্তি হবে জমাট রক্ষণ।
রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম পাঁচ ম্যাচে ইংল্যান্ড হজম করে চারটা গোল, আর এরপর তো ক্রোয়েশিয়ার কাছে সেমিফাইনালে পরাজয়। এই পুরো যাত্রায় তারা রাখতে পেরেছিলেন মাত্র একটা ক্লিনশিট। টুর্নামেন্ট-পরবর্তী বিশ্লেষণে সাউথগেট আর হল্যান্ড তাই একটা সিদ্ধান্ত নেন, ইংল্যান্ডের রক্ষণ হতে হবে আরো বেশি জমাট।
ঐ সিদ্ধান্তের ফলাফল দেখা যায় ২০২০ এর ইউরোতে। সেমিফাইনালে ডেনমার্কের মুখোমুখি হওয়ার আগের পাঁচ ম্যাচে একটা গোলও হজম করেননি ইংরেজরা, পাঁচ ম্যাচে পাঁচটা ক্লিনশিট। আর বাকিটা তো সবারই জানা, ৫৫ বছরের মধ্যে প্রথম বড় কোনো শিরোপা জয় থেকে টাইব্রেকারের মাত্র দুটো পেনাল্টি কিক দূরে পৌঁছে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত শিরোপা না জিতলেও সাউথগেট প্রমাণ করেছিলেন, তার সিদ্ধান্তটা ছিল যথেষ্ট যৌক্তিক। তাই এত শ্রম আর সময় ব্যয় করে গবেষণার যে ফলাফল তিনি পেয়েছেন, সেটা তিনি রাতারাতি বদলে ফেলবেন, সেই আশা করাটাই বোধহয় বোকামি।
রক্ষণের সামনে দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে একসাথে খেলানোর জন্যও সমালোচিত হয়েছেন সাউথগেট। ডেক্লান রাইসের সাথে ক্যালভিন ফিলিপস বা জুড বেলিংহামকে খেলানোর এই পরিকল্পনা কাতারেও অব্যাহত আছে, এবং এর যথোপযুক্ত কারণও আছে। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, প্রথাগতভাবে রক্ষণের জন্যই ইংল্যান্ডকে ভুগতে হয় বড় টুর্নামেন্টে। আর এবার টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সাউথগেট হারিয়েছেন তার ভরসার দুই উইংব্যাক রিস জেমস আর বেন চিলওয়েলকে। কাইল ওয়াকারও লড়ছেন ফিটনেস ফিরে পাওয়ার জন্য, হ্যারি ম্যাগুয়ের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেরা একাদশ থেকে এখন আলোকবর্ষ দূরে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সাউথগেট চাইবেন তার দলের রক্ষণকে বাড়তি প্রতিরক্ষা দিতে। আর ইরানের বিপক্ষে তার রক্ষণের পারফরম্যান্স যাচাইয়ের আগে দেখে আসা যাক সর্বশেষ বছরগুলোতে তার ব্যাক-থ্রি অথবা ব্যাক-ফোর খেলানোর ট্যাকটিকাল সিদ্ধান্তগুলোর পেছনের কারণ।
দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেলানোর মতোই সাউথগেটের তিন সেন্টারব্যাক খেলনোর সিদ্ধান্তও যথেষ্ট সমালোচিত। স্বাভাবিক, কদাচিৎ বিশ্বমঞ্চে পা রাখা এশিয়ার কোনো দেশ রক্ষণাত্মক পরিকল্পনা নিয়ে নামলে সেটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তি কেন এই ৩-৫-২ ফরমেশনে নামবে? সাউথগেটের উত্তরটা পরিষ্কার, ইংল্যান্ড খাতায় কলমে যে ফরমেশন নিয়েই নামুক, মাঠে তাদের পাঁচজন রক্ষণে সাহায্য করবেন, আর পাঁচজনের দায়িত্ব থাকবে আক্রমণ করা। তাহলে কেন ব্যাক-থ্রি, অথবা কেন ব্যাক-ফোর নয়?
প্রিমিয়ার লিগের বেশিরভাগ দলই খেলে চারজনের রক্ষণ নিয়ে। এই সিস্টেমে ফুলব্যাকদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সাধারণত যখন একজন আক্রমণে ওঠেন, আরেকজন রক্ষণে অবস্থান করেন এবং প্রতিপক্ষের যেকোন প্রতি-আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব পালন করেন। অপরদিকে, তিনজন সেন্টারব্যাক নিয়ে খেললে উইংব্যাকদের ওপর রক্ষণে সাহায্য করার চাপ কমে যায়, তারা মাঠের ওয়াইড অংশগুলোতে আরো বেশি বিচরণ করতে পারেন এবং আক্রমণে সাহায্য করার পর্যাপ্ত সুযোগ পান। ফলে এ দুটোর মধ্যে যেকোনো সিস্টেমেই যদি দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেলানো হয়, সেক্ষেত্রে আক্রমণ-রক্ষণে ঐ পাঁচ-পাঁচের ভারসাম্যটা বজায় থাকে।
তাহলে সাউথগেট ব্যাক-থ্রি আর ব্যাক-ফোরের সিদ্ধান্তটা নেন কীভাবে? উত্তরটা হলো, প্রতিপক্ষকে বিশ্লেষণ করে। যদি প্রতিপক্ষের দুই উইংয়ে দুর্বলতা থাকে, তাহলে ঐ দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর জন্য সাউথগেট তিনজন সেন্টারব্যাকের সাথে খেলান দুই উইংব্যাককে, সাথে থাকেন দুইজন উইঙ্গারও। আর যদি প্রতিপক্ষের ফুলব্যাকরা রক্ষণে ভালো হন, সেক্ষেত্রে সাউথগেট মাঠের মাঝ দিয়েই সিংহভাগ আক্রমণ করতে চান, আর সেক্ষেত্রে ব্যাক-ফোরই হয় তার প্রথম পছন্দ। পাশাপাশি আক্রমণভাগে একজন বাড়তি খেলোয়াড় পাওয়ায় গোল করার ব্যাপারেও চিন্তা কমে যায় তার।
এবার আসা যাক চলতি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রথম ম্যাচে। ৪-২-৩-১ ফরমেশনে নামা ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ডের সামনে ছিলেন দুই সেন্টারব্যাক হ্যারি ম্যাগুয়ের আর জন স্টোনস, দুই ফুলব্যাক ছিলেন কিয়েরান ট্রিপিয়ের আর লুক শ। ডাবল পিভটে ছিলেন ডেক্লান রাইস আর জুড বেলিংহাম, তাদের সামনে রাহিম স্টার্লিং, ম্যাসন মাউন্ট আর বুকায়ো সাকা; সবার সামনে সেন্টার ফরোয়ার্ড হ্যারি কেন। ইরানের মতো রক্ষণাত্মক মানসিকতার দলের বিপক্ষে দুইজন সেন্টারব্যাককেই যথেষ্ট মনে হয়েছিল সাউথগেটের। প্রয়োজনে কিয়েরান ট্রিপিয়ের নিচে নেমে তৃতীয় সেন্টারব্যাকের ভূমিকা পালন করছিলেন, তখন লেফটব্যাক লুক শ কার্যত হয়ে যাচ্ছিলেন লেফট উইঙ্গার। মাঝমাঠের রক্ষণের ভাগটা সামলেছেন ডেক্লান রাইস, তবে তার পাশে ক্যালভিন ফিলিপসের বদলে যুক্ত হওয়া জুড বেলিংহাম ছিলেন এই ম্যাচের অন্যতম সেরা পারফরমার এবং সাউথগেটের সিস্টেমের বিশেষ সংযোজন। বক্স-টু-বক্স এই মিডফিল্ডার আক্রমণের সময়ে প্রতিপক্ষের বক্সে হয়ে উঠেছিলেন বাড়তি একজন খেলোয়াড়, আর দারুণ ফিনিশিং দক্ষতায় ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের গোলস্কোরিং ফর্মটা টেনে এনেছিলেন দেশের জার্সিতেও। দ্বিতীয় ডিফেন্সিভ মিডফল্ডার হিসেবে ফিলিপসের উপস্থিতি যদি এতদিন কম আক্রমণ করার কারণ হয়ে থাকে, পরিশ্রমী বেলিংহামের উপস্থিতি আক্রমণের ধার বাড়াবে বহুগুণে। উপরে স্টার্লিং-সাকা ছিলেন দুই উইংয়ে, মাঝে কেনের সাথে তারা জায়গা পরিবর্তন করে প্রতিপক্ষকে ধন্দে ফেলার কাজটা করছিলেন ভালোভাবেই।
ফলাফল? ৬-২ এ জিতে বিশ্বকাপে উড়ন্ত সূচনা, এবং অবশ্যই, বাকি দলগুলোর উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী ছুঁড়ে দেওয়া।
সব মিলিয়ে সাউথগেটকে হয়তো কিছুটা রক্ষণাত্মক বলা যেতে পারে, তবে ‘অতি সতর্ক’, অথবা ‘নেগেটিভ’ নয়। আর ষোল মাস আগেই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার সেরা দুইয়ে থাকা দলটা কেন-ই বা বিশ্বমঞ্চে তাঁদের পরিকল্পনা পাল্টাবে?