ট্রেবলজয়ী অধিনায়ক হিসেবে ম্যানচেস্টার সিটিকে বিদায় জানিয়েছেন ইলকায় গুন্দোয়ান। বিদায়ের আগে প্লেয়ারস ট্রিবিউনের মাধ্যমে ম্যানচেস্টার সিটির উদ্দেশ্যে লিখেছেন আবেগময় এক চিঠি।
প্রিয় ম্যানচেস্টার সিটি,
আমি যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম, আমি ছিলাম একজন স্বপ্নবাজ তরুণ। সাত বছর পর যখন আমি বিদায় নিচ্ছি, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমার প্রতিটা স্বপ্নই সত্যি হয়েছে।
আজকের দিনটা আমার জন্য অম্লমধুর। বিদায় বলা কখনোই সহজ নয়, আর এই অসাধারণ দলটাকে বিদায় বলা আমার জন্য আরো কঠিন। গ্রুপচ্যাটে যখন সবাইকে প্রথমবারের মতো বললাম আবার বিদায় নেওয়ার কথা, বললাম যে এই গ্রুপচ্যাট ছাড়তে চলেছি আমি, খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলছি, আমি ওদের প্রত্যেককে মিস করবো। তবে হ্যাঁ, একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিদায় নিতে পেরে আমি যারপরনাই খুশি, আর এই ক্লাবটার প্রতি আমার হৃদয়ে থাকবে শুধুই অনিঃশেষ ভালোবাসা। ট্রেবলজয়ী দলের বাহুবন্ধনী পরে বিদায়ের ঘোষণা দেওয়ার সৌভাগ্য কয়জন খেলোয়াড়ের হয়?
আমরা যা যা অর্জন করেছি, তাকে অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। সাত বছরের মধ্যে পাঁচটা প্রিমিয়ার লিগ, দুটো এফএ কাপ, একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটা ট্রেবল। কিন্তু সত্যি বলতে, দিনশেষে এগুলো শুধুই একেকটা শিরোপা। মাঠের এই সাফল্যের বাইরেও আমি খুব বেশি করে মনে রাখবো দলের ভেতরের সমন্বয়ের কথা, বিনিময় করা অনুভূতিগুলোর কথা, বিশেষত এই মৌসুমে। আমি আমার ফুটবলীয় জীবনে কখনোই এমন কিছু উপভোগ করতে পারিনি।
মানুষ হিসেবে আমি একটু গুরুগম্ভীর প্রকৃতির। সবার সাথে মিশতে, নিজেকে প্রকাশ করতে একটু সময় লেগে যায় আমার। তবে এই দলের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, যত চাপেই আমরা থাকতাম না কেন, নিজেদের নিয়ে করা সবসময়েই টুকটাক কৌতুক করেছি, এবং অবশ্যই তাতে কারো আপত্তি ছিল না। ট্রেনিংয়ে ৫ বনাম ২ খেলতাম আমরা, আর এসসময়ে আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছিল রুবেন ডিয়াজের সাথে মজা করা। আমি খেলোয়াড় হিসেবে খুব উঁচুমানের ছিলাম না, আর সেজন্যই বোধ হয়, ট্রেনিংয়ে একটু ভালো করলেই সতীর্থরা আমাকে ‘জিদান’ বলে ডাকতো। বিশেষ করে রুবেন এই কাজটা করতো। আর আমিও হয়তো পাল্টা কৌতুক করতাম, “না না, আজ আমি ছিলাম পিরলো। কাল আবার জিদান হয়ে যাবো।”
আমাদের এসব হাসি-তামাশা প্রতিদিনই চলতো। সাধারণত ফুটবলে আপনি এমনটা দেখবেন না। এজন্য আমাদের স্ত্রী-প্রেমিকাদেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। তাদের কল্যাণে, বিশেষ করে এই মৌসুমে, অনেকগুলো বারবিকিউ পার্টি আয়োজিত হয়েছে। আর এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই দলের আবহ পরিবর্তন করে দেয়, দলের মধ্যে বন্ধনটা জোরদার করে, আর দিনশেষে এটাই পার্থক্য গড়ে দেয়। আমি আমার জীবনে যতগুলো দলে খেলেছি, নিঃসন্দেহে এই দলটার অভ্যন্তরীণ বন্ধনই সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। আর এজন্যই হয়তো মৌসুম শেষে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাটা উঠেছে আমাদের হাতে।
আমার ক্ষেত্রে, গত দশ বছর ধরেই চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল একটা ‘অবসেশন’-এর মতো। না, ভুল বললাম। ‘অবসেশন’-এর মতো না, ‘অবসেশন’-ই। ২০১৩ তে যখন ডর্টমুন্ডের হয়ে বায়ার্নের বিরুদ্ধে ফাইনাল হারলাম, আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। ফাইনাল হারার অনুভূতির সাথে কোন কিছুরই তুলনা হয় না আসলে। পুরো দশ বছর ধরে এই ব্যাপারটা আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। এরপর থেকে আমি আমার ক্যারিয়ারে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সবগুলোর পেছনে এই একটাই চিন্তা ছিল, ওই রুপোলি শিরোপাটা আমার চাই। গত মৌসুমের সেমিফাইনালে, ইতিহাদে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে, আমি ছিলাম বেঞ্চে, আর এই ব্যাপারটা আমার জন্য আরো বেশি কঠিন ছিল। পেপ যখন দল ঘোষণা করলেন, আমি আমার রুমে চলে গিয়েছিলাম, একা। হ্যাঁ… আমি পুরো ভেঙে পড়েছিলাম। আমি ঐ শিরোপাটা খুব করে চেয়েছিলাম, বুঝতেই পারছেন।
এই মৌসুমে আমি নিজের মধ্যে একটা অন্যরকম তাড়না অনুভব করেছি। আমার কেন যেন মনে হতো যে এবারই সে মৌসুম, যে মৌসুমে আমাদের আক্ষেপ ঘুচবে। শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগের কথা বলছি না, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, সবই। সপ্তাহর পর সপ্তাহ, আমার মনে হচ্ছিল যে সব ধীরে ধীরে আমাদের পক্ষে আসতে ছুরু করেছে। আমাদের দলের ভিত্তিটা খুব মজবুত ছিল। কেভিন ডি ব্রুইনা, কাইল ওয়াকার্ জন স্টোনস, ফিল ফোডেন, বার্নার্দো সিলভা আর এডারসন ছিল এই দলের ভিত্তি, এর সাথে যুক্ত হয়েছিল আর্লিং হাল্যান্ড আর জ্যাক গ্রিলিশের মতো দারুণ কিছু চরিত্র। এই ব্যাপারটা আমাদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল।
জ্যাক গ্রিলিশের কথাই যদি ধরি, আমি বলতে চাই, কিছু কিছু গণমাধ্যম তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। ফুটবলে আমার দেঝা সবচেয়ে ভালো কয়েকজন মানুষের মধ্যে সে একজন। তার উপস্থিতিই পরিবেশকে হালকা করার জন্য যথেষ্ট, একই সাথে সে খুবই বিনয়ী। এই মৌসুমে তাকে সাফল্য পেতে দেখে আমি সত্যিই খুব খুশি, কেননা আমি জানি, বড় অঙ্কের ট্রান্সফার ফি দিয়ে একটা বড় ক্লাবে খেলতে আসার পর ঠিক কী ধরনের চাপ থাকে। গ্রিলিশ অনেক পরিশ্রম করেছে, নিজেকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে গেছে, আমাদের দলও তাতে সুফল পেয়েছে।
এবার আসি আর্লিং হাল্যান্ডের কথায়। সত্যি বলতে, আমি ওকে নিয়ে একটু বিভ্রান্ত ছিলাম শুরুতে। ডর্টমুন্ডে সে প্রচুর গোল পেত, একই সাথে থাকতো সব মনোযোগের কেন্দ্রে, কিন্তু আমাদের দলে ও ঠিক কীভাবে মানিয়ে নেবে, বা আদৌ মানিয়ে নিতে পারবে কিনা, এটা নিয়ে আমার একটু সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সে অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান, আর প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। নিজেকে নিয়ে সে কখনোই সন্তুষ্ট থাকে না। সে যে পর্যায়ে পৌঁছানোর সামর্থ্য রাখে, শুধু মেসি আর রোনালদোই ওই পর্যায়ের সাথে তুলনীয়।
আরো একজনের নাম না বললেই নয়। এই মানুষটা আমার ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক সাহায্য করেছেন, অনেক পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। স্টেফান ওর্তেগা, আমাদের দ্বিতীয় গোলরক্ষক। জার্মান হিসেবে, আমাদের জীবনের অনেক বিষয়েই মিল ছিল। আর প্রতিদিন আমরা একসাথে কফি পান করতাম, সেই ব্যাপারটা আমাকে অনেক সাহায্য করতো, আমি নিজের মনের ভাবগুলো প্রকাশ করতে পারতাম। সে না থাকলে আমি হয়তো এমন একটা মৌসুম কাটাতে পারতাম না। ফুটবলে এই ধরনের কিছু মানুষকে আসলে খুব প্রয়োজন, যারা হয়তো পাদপ্রদীপের আলো খুব বেশি পান না, কিন্তু দলে একটা বড় ভূমিকা রাখেন। এই মৌসুমে কেভিন ডি ব্রুইনার সাথে আমার বোঝাপড়াও অনেক ভালো ছিল। তার সাথে যেকোন বিষয় নিয়েই আমি কথা বলতে পারি, আর সতীর্থদের প্রতি যখন এই বিশ্বাসটা একবার জন্মে যায়, তারা আর শুধুই সহকর্মী থাকেন না। আর এই ব্যাপারগুলোই দিনশেষে মাঠে পার্থক্য গড়ে দেয়।
ড্রেসিংরুমে এই চরিত্রগুলোর উপস্থিতি আপনাকে অন্যরকম একটা আত্মবিশ্বাস দেয়, পরিবার মাঠে নামার সময়ে আপনি জয় ব্যতীত অন্য কিছু ভাবেন না। সতীর্থদের প্রতি বিশ্বাস আপনার ভয়কে দূর করে দেবে, আপনার দুশ্চিন্তাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিবে, আর তখনই জাদুকরী সব ঘটনা ঘটবে। হয়তো এই কারণেই আমি এই মৌসুমে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোল করতে পেরেছি।
(যারা এখনো বুঝতে পারছেন না, হ্যাঁ, এভারটনের বিরুদ্ধে আমার ঐ ফ্লিকের কথাই আমি বুঝাচ্ছি। আমার টেকনিকগুলো কিন্তু নিতান্ত খারাপ নয়, চাইলে রুবেনকে জিজ্ঞেস করতে পারেন!)
এই পুরো মৌসুমই ছিল একটা চলচ্চিত্রের মতো, এর চেয়ে সুন্দর সমাপ্তি আমার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। ইস্তাম্বুলের ফাইনাল শেষে শিরোপাটা উঁচু করছি আমি, এর চেয়ে মধুর দৃশ্য আর কী হতে পারে! আমার আর আমার পরিবারের জন্য ব্যাপারটা অনেকটা ‘হোমকামিং’য়ের মতোও ছিল। প্লেনটা ভূমি স্পর্শ করার আগমুহূর্তে যখন জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলাম শহরের দিকে, মনে পড়ছিল যে এটাই আমার দাদার পৈতৃক নিবাস, আর সাথে ভাবছিলাম যে এই মাটিতেই আমি ম্যানচেস্টার সিটির অধিনায়ক হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা উঁচিয়ে ধরবো।
বাসে করে যখন হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম, আমি বসেছিলাম স্কট কারসনের পাশে। ২০০৫ এর চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মিলানের বিপক্ষে ঐ মহাকাব্যিক ম্যাচে জয়ী লিভারপুল দলের সদস্য ছিল এই কারসন। আমাদের অভয় দেওয়ার জন্যই হয়তো ও বলছিলো, “চিন্তা করো না তোমরা। ইস্তাম্বুলে এসে আমি কখনোই খালি হাতে ফিরিনি, চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফিটা সাথে নিয়েই ফিরেছি।”
হা হা হা! স্কট কারসন যদি আমাদের দলে থাকে, তবে আমাদের আর ভয় কীসের!
একটা ছোট্ট সমস্যাই ছিল শুধু। ফাইনাল ম্যাচটা শুরু হওয়ার কথা রাত দশটায়। তার মানে সারাদিন হোটেলে বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই। আমি আমার ফোনটা অফ করে রেখেছিলাম, কেননা আমি টেক্সট মেসেজগুলো পড়তে চাইছিলাম না। আমি ঘুমাতে পারছিলাম না, টিভি দেখতে পারছিলাম না। খুব নার্ভাস লাগছিলো। ওই হোটেল রুমে বসেই আমার মাথার মধ্যে এই ফাইনাল ম্যাচটা অন্তত ৫০০ বার খেলা হয়ে গিয়েছিল। আর ওই শিরোপাটা আমি খুব করে চাইছিলাম। খুব খুব খুব করে, সত্যি বলছি।
একটা ব্যাপার আমি কখনো ভুলবো না। ওয়ার্ম আপের পর ড্রেসিংরুমে পেপ আমাকে ডেকে নিলেন। এরপর আমাকে বললেন একটু সময় বের করতে, কেননা কাইল ওয়াকার দলের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চান, যে কাইল ওয়াকার ঐ ম্যাচের শুরুর একাদশে ছিলেন না। আমার মনে হয় আমাদের দলকে বোঝানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট, আমরা প্রত্যেকেই বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলাম।
আমার শুধু মনে পড়ে, ম্যাচ শুরুর আগে ওয়াকার বললেন যে আমাদের প্রত্যেককে তিনি কতটা ভালোবাসেন, এরপর বললেন, “এই শিরোপা জেতাটা আমার স্বপ্ন। মাঠে যাও, আর আমার এই স্বপ্নকে সত্যি করে তোলো।”
ম্যাচ সম্পর্কে আসলে তেমন কিছু বলার নেই আমার। পুরোটাই আমার স্মৃতিতে আছে আবছারূপে। আমরা আমাদের সেরা ফুটবলটা খেলতে পারিনি, মেনে নিতেই হবে। সবার মধ্যেই হয়তো একটু জড়তা ছিল। তবে আমরা ঠিকই জেতার একটা পথ বের করে নিয়েছিলাম, আর চ্যাম্পিয়নরা সেটাই করে।
তবে ম্যাচের স্মৃতি তেমন মনে না পড়লেও শেষ বাঁশি বাজার পরের অনুভূতিটা আমার মনে পড়ে খুব ভালোভাবে। আমাদের গোলপোস্টের সামনে আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। পুরো ব্যাপারটা তখনো বুঝে উঠতে পারিনি বোধ হয়। আমার মাথা ঠেকেছিল সবুজ ঘাসে। ঐ অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
মাথা উঠিয়েই প্রথমে আমি দেখলাম আমার আশেপাশে বসে আছে ইন্টার মিলানের খেলোয়াড়রা, প্রত্যেকের চোখে পানি। এই অনুভূতিটা আমি জানি। তাই আমি উঠে তাদের কাছে গেলাম, সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম যে দারুণ একটা মৌসুম কাটানোর জন্য তাদের গর্বিত হওয়া উচিত। আসলে এই ফাইনালে দুই দলের পার্থক্য খুবই কম ছিল, একটু এদিকসেদিক হলেই তো জয়ের পাল্লাটা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারতো।
তবে কষ্টের ফল সবসময়ই সুমিষ্ট হয়। বছরের পর বছরের ব্যর্থতাই সাফল্যকে আরো মধুর করে তোলে।
আমি ধীরে ধীরে মাঠের অপরপ্রান্তে হেঁটে গেলাম, ওদিকে ছিল আমাদের দলের ছেলেরা। আমার প্রথমেই চোখ পড়লো স্টেফানের দিকে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে আলিঙ্গণে বেঁধে রাখলাম। ওই মুহূর্তটাই আমাকে যেন পুরোপুরি ভেঙে ফেললো, আমি কাঁদতে শুরু করলাম। স্টেফানও কাঁদতে থাকলো। আনন্দ আর স্বস্তি মিলেমিশে এক হয়ে গেল আমাদের অশ্রুজলে।
পেপ একটা কথাই বলতে পারছিলো, “আমরা পেরেছি! আমরা পেরেছি!”
আমি গ্যালারিতে থাকা আমার স্ত্রী আর পরিবারের কাছে গেলাম। তারাও বললো, “তুমি পেরেছো! তুমি পেরেছো!”
না। আমি একা পারিনি। পেপ যেমনটা বলেছিলেন, “আমরা পেরেছি!”
প্রতিটা স্বপ্নের পেছনে একটা পরিবার থাকে, আর তাদের ভূমিকা খেলোয়াড়দের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। আমার বাবা মা আমাকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। আমার বাবা ছিলেন একটা বিয়ের কোম্পানির ট্রাক ড্রাইভার। আমার মা ছিলে একটা সুইমিং-হল ক্যাফের বাবুর্চি। আমার দাদা প্রথম জার্মানিতে এসেছিলেন খনিতে কাজ করার উদ্দেশ্যে। আর সেই আমি, ইলকায় গুন্দোয়ান, যখন পুরো পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়েছি চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, ঐ আবেগটা আসলে বর্ণনাতীত।
এর কোনো কিছুই সম্ভব ছিল না পেপকে ছাড়া। অনেক সময়ই মনে হতো, আমাদের কাছে তার চাওয়ার পরিমাণটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবেও হয়তো চাপ বোধ হতেই পারে সেই সময়ে। কিন্তু যখনই আমাদের সমন্বয়টা ঠিকঠাক হয়ে গেল, তার সিস্টেমের কার্যকারিতা প্রমাণ হয়ে গেল। সবই যেন না চাইতেই ঘটতে শুরু করলো।
পেপের সাথে আমার বন্ধনটা সবসময়েই বিশেষ, অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমার খুব ইচ্ছা, আমি এগারোজন মিডফিল্ডার নিয়ে খেলি, কেননা তোমরা প্রত্যেকেই খুবই দূরদর্শী, খেলাটাকে খুব ভালো পড়তে পারো তোমরা।”
পেপকে যখন আমার বিদায়ের কথাটা বলতে গিয়েছি, সেটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম কঠিন কাজ। আম্মি শুধু তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে পেরেছিলাম, এবং সেটা অবশ্যই শুধু এই মৌসুম বা সব শিরোপার জন্য নয়, বরং আমাকে এই দলে যুক্ত করার জন্য। ডর্টমুন্ডের হয়ে আমার শেষ মৌসুমের শেষ দিকে আমি হাঁটুর চোটে পড়েছিলাম। আমার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। আমি ভেবেছিলাম যে সিটি হয়তো আমাকে দলে ভেড়াবে না, চোটগ্রস্ত খেলোয়াড়কে কে দলে ভেড়াতে চায়! কিন্তু পেপ নিজে আমার সাথে কথা বললেন, “দুশ্চিন্তা করো না, কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আমরা তোমাকে এখানে চাই। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, যাই হোক না কেন।”
আমি জানি না, যখন অনেক টাকার বিনিময়ে আমার মতো একটা চুপচাপ গোছের ছেলে ম্যানচেস্টার সিটিতে এলো, এবং অবশ্যই এলো ক্রাচে ভর করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, সমর্থকদের মনে তখন কী চলছিল।
আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি।
এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমি ম্যানচেস্টারে এসেছি, আর আমি বিদায় নিচ্ছি যেন উড়ন্ত মেঘের ভেলায় ভেসে।
ট্রেবল জয়ের পরে, ম্যানচেস্টারের ওই ঐতিহাসিক প্যারেডের পরে, আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, ”এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারতো? এর বেশি আমি আর কী-ই বা অর্জন করতে পারতাম? এর চেয়ে সুন্দর করে আর কোনো চিত্রনাট্য কি লেখা সম্ভব ছিল?”
উত্তরটা আমি জানতাম, “না।”
আমার কেন যেন মনে হয়, পেপ হয়তো আশা করেছিলেন যে আমরা যেহেতু একসাথেই ম্যানচেস্টার সিটিতে এসেছি, একসাথেই বিদায় নেবো। তবে আমার বিশ্বাস যে, আমার সিদ্ধান্তটা তিনি বুঝবেন। এবং আমি নিশ্চিত, তাঁর শৈশবের ক্লাবে আমার যাওয়াটা তাঁকে খুশিই করেছে। আশা করি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে আবার আমাদের দেখা হবে।
তবে হ্যাঁ, আমি যদি ম্যানচেস্টার সিটি ছাড়তাম, আমি একটা ক্লাবেই যেতাম। এবং আমি সেই ক্লাবেই যাচ্ছি। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা। ছোটবেলা থেকেই এই মেরুন-নীল জার্সিটা পরার স্বপ্ন দেখেছি আমি। আরো কয়েক বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলার ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী, আর বার্সেলোনার সোনালী দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে তাদের সাহায্য করতে চাই আমি। আমার পুরনো বন্ধু রবার্ট লেওয়ানডস্কির সাথেও আমার পুনর্মিলনী ঘটবে। আর বার্সাতে আমি খেলবো একজন দারুণ ম্যানেজারের অধীনে। জাভি হার্নান্দেজের সাথে যখন প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলছিলাম, সবকিছু খুব সহজ ঠেকছিলো আমার কাছে। তাঁর আর আমার মধ্যে অনেক মিল আছে, চরিত্রগত, এবং খেলার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
আমি জানি, বার্সেলোনায় খেলা মানেই অনেক চাপ। কিন্তু চাপ ভালোবাসি। আমি নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে ভালোবাসি। সহজে সব কিছু পেয়ে যাওয়াটা আমার স্বভাবে নেই, আমি চাই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। আর আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের নাম এটাই, “চ্যালেঞ্জ”।
বার্সার জার্সিতে খেলার জন্য আমার তর সইছে না। তবে আপাতত, ম্যানচেস্টার সিটির উদ্দেশ্যে আমি একটা শেষ কথা বলতে চাই। আমি সরাসরি আমার সব সতীর্থ, সকল স্টাফ, এবং বিশেষ করে সকল সমর্থকের উদ্দেশ্যে বলতে চাই…
আমি সবসময়ই একজন ‘সিটিজেন’ থাকব। এই বন্ধনকে কেউ ভাঙতে পারবে না। এই বন্ধনটা তৈরি হয়েছে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভালোবাসা দিয়ে।
আমি শুধু আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই।
আপনাদের কারণেই আমি আমার স্বপ্নের জগতে বাস করতে পেরেছি (হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে কোচেরা একটু বাড়াবাড়ি করেছেন বটে!), আপনারা আমাকে পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমার সতীর্থরা এমন সুন্দর ফুটবল খেলার জন্য নিজেদের অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। আমাদের সমর্থকেরা আমাদেরকে সমর্থন দেওয়ার জন্য হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন। এই ক্লাবটা আমাকে একটা অসাধারণ প্রজেক্টের অংশ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রত্যেক ডাক্তার আর ফিজিও আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করেছেন। আপনাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ।
আমি জানি, বেশিরভাগ মানুষ হয়তো এই পুরো জার্নির গোল-অ্যাসিস্ট বা ফাইনালগুলোই বেশি মনে রাখবেন। কিন্তু আমি মনে রাখবো একটু আলাদা একটা ব্যাপার।
হ্যাঁ, ফুটবল সবসময়েই অসাধারণ। কিন্তু মানুষ তার চেয়েও বেশি অসাধারণ।
আমি আপনাদের মনে রাখবো, সারাজীবন।
ইতি,
আপনাদেরই একজন,
ইলকায় গুন্দোয়ান