মিরাকল অফ বার্ন: ফুটবলের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি

১.

১৯৫৪ সালের ৪ জুন। সুইজারল্যান্ডের বার্নে অবস্থিত ওয়াঙ্কড্রফ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৫ম আসরের ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনাল। ধারে ভারে পশ্চিম জার্মানি থেকে হাঙ্গেরি অনেক এগিয়ে থাকায় মোটামুটি একপেশে ম্যাচ দেখার অপেক্ষাতেই ছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। তবে কে জানতো যে বিধাতা পুরো ম্যাচের চিত্রনাট্যটি লিখেছেন অন্যভাবে! রোমাঞ্চ, বিতর্কি আর বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক অধ্যায়- সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ম্যাচ হয়ে আছে বার্নের সেই ফাইনাল। ম্যাচটিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে মিরাকল অফ বার্ন নামে।

২.

দুই দলের ফাইনাল পর্যন্ত আসাটা ঠিক বিপরীত। যেখানে প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছায় ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়র্স খ্যাত হাঙ্গেরিয়ান টিম, সেখানে গোল ব্যবধানে তুরস্ককে পিছে ফেলে নক আউট রাউন্ডের টিকিট কাটে জার্মান বাহিনী। গ্রুপপর্বেও এই দুই দলের দেখা হয়। সেখানে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দেয় ককসিস, পুস্কাসের হাঙ্গেরি।

১৯৫৪ সালের হাঙ্গেরি দল; Image Source: Fifa Wallpaper

কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালে মোটামুটি ভাগ্যের জোরে সহজ প্রতিপক্ষকেই পায় ডাই ম্যানশ্যাফটরা। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে ২-০ গোলে হারানোর পর সেমিফাইনালে অস্ট্রিয়াকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে ফাইনালে পৌঁছায় জার্মানি। অন্যদিকে গ্রুপ টেবিলে প্রথম হওয়ার পরও নক আউটে কঠিন প্রতিপক্ষের সামনে পড়তে হয় হাঙ্গেরিকে। কোয়ার্টারে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে পরাস্ত করে তৎকালীন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দল হাঙ্গেরি। সেমিফাইনালে হাঙ্গেরির সামনে পড়ে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে, যে দলটি দুবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে দুবারই চ্যাম্পিয়ন। অর্থাৎ সেই ম্যাচের আগপর্যন্ত বিশ্বকাপে উরুগুয়ের কোনো হারের রেকর্ড ছিলো না। ৯০ মিনিট শেষে ২-২ থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ককসিস আর জিবরের কল্যাণে উরুগুয়ে বাঁধা পার করে ফাইনালে পৌঁছায় হাঙ্গেরি। ম্যাচটি তারা জিতে নেয় ৪-২ গোলে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের চার ম্যাচেই পুস্কাসরা করে বসেন ২৫ গোল। গড়ে প্রতি ম্যাচে ৬ গোলের উপরে। বলা বাহুল্য, ফাইনালের আগে হাঙ্গেরি ৩১ ম্যাচ ধরে অপরাজিত ছিল। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপপর্বে তাদের কাছেই ৮ গোল খাওয়া জার্মানি।

১৯৫৪ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি দল; Image Source: Fifa Wallpaper

৩.

ম্যাচ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় ফাইনালের আগেই। সুইজারল্যান্ডের সোলোথার্নে তাবু গাড়ে হাঙ্গেরি টিম। সেমিফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ানোয় সেদিনের ফিরতি ট্রেন মিস করে ককসিসরা। তাতে করে নিজেদের হোটেলে ফিরে অনেক রাত করে। অতিরিক্ত খেলার ধকল সহ ভ্রমণ ধকলও সহ্য করতে হয় হাঙ্গেরিয়ান খেলোয়াড়দের। উপরি পাওনা হিসেবে জোটে পরেরদিনের গ্রাম্য মেলা, যার কারণে সোলোথার্নে টিম হোটেলের সামনে ফাইনালের আগের দিন বিকাল থেকে সারা রাত গানবাজনা চলে।

অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি টিম অবস্থান করে স্পিজ শহরের একটি শান্ত লেকের পাশে। আর জার্মান কোচ সেপ হারবার্গার তার সহকারী আলবার্ট সিংকে হাঙ্গেরি টিম হোটেলে পাঠান হাঙ্গেরির প্রস্তুতির খবরাখবর জানতে।

৪.

গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে গোড়ালির চোটে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দর্শক হয়ে থাকতে হয় দলের সেরা খেলোয়াড় ও অধিনায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসের। যার ফলশ্রুতিতে মাঠে ভালোভাবেই ভোগে হাঙ্গেরি। উরুগুয়ের সাথে কষ্টার্জিত জয় তারই প্রমাণ। তবে ফাইনালে হাঙ্গেরির কোচ সেবেস হাফ ফিট পুসকাসকে খেলানোর সিদ্ধ্বান্ত নেন। অ্যাটাকিং মিডে হিদেকুটিকে রেখে সামনে তিন সেরা প্লেয়ার ককসিস, জিবর আর পুসকাসকে রেখে আক্রমণাত্মক টিম সাজান তিনি। লেফট উইঙ্গার জিবরকে ফাইনালে তিনি খেলান রাইট উইঙয়ে। জার্মানির লেফট ব্যাক ওয়ের্নার কোলমেয়েরকে জিবরের গতি দিয়ে পূর্ণ সুবিধা আদায় করার জন্য এই সিদ্ধান্তটি নেন তিনি।

ম্যাচ শুরুর আগে দুই অধিনায়ক; Image Source: The Sun

অন্যদিকে জার্মানি তাদের ৪-১-২-৩ ফর্মেশনে ভরসা করেন হেলমুট রান আর ম্যাক্স মর্লকের উপর। আর ডিফেন্সকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় অধিনায়ক ফ্রিটজ ওয়াল্টারের উপর।

৫.

ফাইনালের দিন সুইজারল্যান্ডের বার্নে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়। খেলা গড়ায় বৃষ্টির মধ্য দিয়েই। কর্দমাক্ত মাঠের পাশাপাশি বৃষ্টি; খেলার জন্য যা মোটেও অনূকুল ছিলো না। কিন্তু জার্মান অধিনায়ক ফ্রিটজ ওয়াল্টার বলেন, এই মাঠই নাকি জার্মানদের সেরাটা দেওয়ার জন্য উপর্যুক্ত। যার পরবর্তীতে এই আবহাওয়াকে মিডিয়া নাম দেয় ‘ফ্রিটজ ওয়াল্টার আবহাওয়া।‘

তবে জার্মানি সবচেয়ে বড় সুবিধা পায় তাদের পায়ের বুট থেকে। এডি ডেসলার নামে এক জার্মান জুতা ব্যবসায়ী থেকে ফাইনালের আগে ২২ জোড়া বুট জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ডে আনেন জার্মান কোচ সেপ হারবার্গার। যে বুট কিনা যেকোনো আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। পরবর্তীতে এই এডি ডেসলারই প্রতিষ্ঠা করেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা ক্রীড়াসামগ্রীর প্রতিষ্ঠান এডিডাস।

৬.

ম্যাচ শুরু হওয়ার মাত্র ছয় মিনিটের মাথায় হাঙ্গেরিকে এগিয়ে দেন ইনজুরি নিয়ে খেলতে নামা পুসকাস। ২ মিনিট পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন জিবর। সবাই যখন ধরেই নিয়েছে আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে যাচ্ছে হাঙ্গেরি, ঠিক তখনই দ্রুত খেলায় ফিরে আসে জার্মানি। ফ্রিটজ ওয়াল্টারের লো ক্রসে ১০ মিনিটে গোল করেন ম্যাক্স মর্লক। ১৮ মিনিটে ওয়াল্টারের কর্নার থেকেই দলকে সমতায় ফেরান হেলমুট রান।

ছয় মিনিটের মাথায় প্রথম গোল করেন পুস্কাস; Image Source: The Daily Mail

এরপর নড়েচড়ে বসে হাঙ্গেরি। খেলায় দখল নিয়ে অনেকগুলো সুযোগ তৈরি করে তারা। কিন্তু প্রতিকূল মাঠের জন্য গোলের দেখা পাচ্ছিলো না ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স। বরং ধারার বিপরীতে ৮৪ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোল করে পশ্চিম জার্মানিকে এগিয়ে দেন হেলমুট রান। পুরো ম্যাচে ২৬টি শটের মাঝে ১৬টি অন টার্গেট রেখেও ম্যাচের ৮ মিনিটের পর থেকে আর গোলের দেখা পায়নি হাঙ্গেরি। যার ফলস্বরুপ ৪ বছর পর, ৩১ ম্যাচ শেষে প্রথম হারের তিক্ত স্বাদ নিতে হয় হাঙ্গেরির সোনালি প্রজন্মকে। ব্যর্থ হয় তারা জুলে রিমে ট্রফি জিততে।

হেলমুট রানের এই গোলেই বধ হয় হাঙ্গেরি; Image Source: Pinterest

৭.

পুরো ম্যাচ জুড়েই রয়েছে অসংখ্য বিতর্ক। হাঙ্গেরি ম্যাচ হারার পর সেই বিতর্কে আরো জোরে হাওয়া লাগে। চলুন দেখে আসা যাক ম্যাচের প্রধান প্রধান বিতর্কগুলো।

· জার্মানির দ্বিতীয় গোলটি নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ফ্রিটজ ওয়াল্টারের কর্নার হাঙ্গেরি গোলকিপার গ্রোসিক্স ক্লিয়ার করতে গেলে তিনি ছয় গজ বক্সের মধ্যে ফাউলের শিকার হন, যার ফলে ফাঁকায় বল পেয়ে যান রান। যে গোলটি করে দলকে সমতায় ফেরান তিনি।

· ৮৭ মিনিটে পুসকাসের ন্যায্য গোল বাতিল হয়ে যায় অফসাইডের ফ্ল্যাগে। প্রথমে ইংলিশ রেফারি লিংগ গোল দিতে চাইলেও পরে লাইন্সম্যানের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।

· ৮৯ মিনিটে ককসিসের কল্যাণে পেনাল্টি পেতে পারতো হাঙ্গেরি। ডি বক্সের মধ্যে ককসিসকে ফেলে দিলে স্পট কিকের আবেদন জানায় হাঙ্গেরির খেলোয়াড়েরা। তবে তাদের কথায় সাড়া দেননি রেফারি।

· ম্যাচ শেষে গুঞ্জন ওঠে জার্মান খেলোয়াড়দের ম্যাচের আগে ডোপ নেওয়া নিয়ে। জার্মান চিকিৎসক যদিও বলেছেন, ইনজেকশনের মাধ্যমে তাদের ভিটামিন সি দেওয়া হয়েছিলো। তবে ২০১০ সালে একটি গবেষণায় বলা হয়, পারভিটিন নামক একটি ড্রাগ জার্মান খেলোয়াড়েরা ম্যাচের আগে নিয়েছিলেন। যদিও ১৯৫৪ সালে ডোপ নিষিদ্ধ ছিলো না।

জুলে রিমে শিরোপা হাতে জার্মান অধিনায়ক; Image Source: Getty Image

ম্যাচ শেষে হাঙ্গেরির ক্ষুব্ধ দর্শকেরা বুদাপেস্টে ভাংচুর করে। কোচ সেবেস তার ট্যাকটিকস নিয়ে অনেক সমালোচিত হন। যদিও এই হাঙ্গেরি পরবর্তী দুই বছর তাদের জয়ের ধারা অক্ষুণ্ন রাখে। ১৯৫০-৫৬ সালের মধ্যে ৪১টি জয় তুলে নেয় তারা। সাতটি ড্রয়ের সাথে একটিমাত্র হার। তবুও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ নিতে পারেনি ম্যাজিকাল ম্যাগিয়র্স। অলিম্পিক গোল্ড, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেও শ্রেষ্ঠত্বের সবচেয়ে বড় স্মারক বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরা হয়নি পুসকাসের। মিরাকল অফ বার্ন শুধুমাত্র হাঙ্গেরি না, বরং এই ভূত তাড়িয়ে বেড়াবে সকল ফুটবলপ্রেমীকেই।

This Bangla article is about the miracle of bern where tragically Hungery lost against Germany in world cup final. Necessary sources are hyperlinked in the article.

Feature Image: Getty Image

 

Related Articles

Exit mobile version