দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে এসে গেলো ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুম। রাশিয়ায় চলতি বছরের ১৪ জুন পর্দা উঠতে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসরের। রাশিয়ার ১১টি শহরের ১২টি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো, যেখানে শুধুমাত্র মস্কোতে রয়েছে ২টি স্টেডিয়াম।২০১৮ সালের বিশ্বকাপটি ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ২১তম আসর। বিগত ২০টি বিশ্বকাপের সবগুলোই জিতেছে ইউরোপিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো। ইউরোপের রয়েছে ১১টি এবং লাতিন আমেরিকার রয়েছে ৯টি শিরোপা। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে শুরু হওয়ার পর, ৮৮ বছরে প্রথমবারের মতো রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা ও আলোড়নের মাত্রা। বিশ্বকাপের আলোচিত কিছু রেকর্ড ও তথ্য নিয়ে আজকের আয়োজন।
হুমকির মুখে ব্রাজিলের রেকর্ড
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি শিরোপাজয়ী দেশটি হলো ব্রাজিল (৫টি), ইতিহাসের ২৫% শিরোপা গিয়েছে তাদের ঘরে। একইসাথে, ব্রাজিলই একমাত্র দেশ যারা সবগুলো বিশ্বকাপ আসরে অংশগ্রহণ করেছে। ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি শিরোপাজয়ী দল দুটি হলো জার্মানি ও ইতালি। দুই দেশেরই রয়েছে ৪টি করে বিশ্বকাপ শিরোপা। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সবগুলো বিশ্বকাপে ব্রাজিল অংশগ্রহণ করলেও, জার্মানি ও ইতালি ব্রাজিলের চেয়ে দুটি বিশ্বকাপ আয়োজন কম খেলেছে। রাশিয়া বিশ্বকাপ বাছাইয়ে জার্মানি উয়েফার একমাত্র দল যারা সবগুলো ম্যাচ জিতেছে। তাছাড়া শেষ ৩টি আসরেই সর্বোচ্চ গোল করেছে জার্মানি; ২০০৬ সালে ১৪টি, ২০১০ সালে ১৬টি এবং ২০১৪-তে ১৮টি। জার্মানির সাম্প্রতিক পার্ফরম্যান্স বিবেচনায় বলা যায়, দলটি এই বিশ্বকাপের অন্যতম দাবীদার।
২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপ যদি জার্মানির ঘরে ওঠে, তাহলে শিরোপার দিক দিয়ে ব্রাজিলের রেকর্ড শিরোপা জয়ের আধিপত্যে ভাগ বসাবে দেশটি। ২০০৬ সালে শিরোপা জয়ের পর ইতালির সামনে একই রেকর্ডের সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত দলটি তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু এবারের বিশ্বকাপে ইতালি অংশগ্রহণ করতে পারছে না, সেহেতু এবারে জার্মানিই একমাত্র দল যাদের সামনে রয়েছে নতুন রেকর্ডের হাতছানি।
১৯৫৮ সালে সুইডেনে ও ১৯৬২ সালে চিলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের শিরোপা দুটিই গিয়েছিলো লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে ব্রাজিলই একমাত্র দেশ যারা টানা দুটি বিশ্বকাপ জিতেছিলো। ব্রাজিলের অসাধারণ এই অর্জনের অংশীদার হওয়ারও সুযোগ রয়েছে জার্মানির সামনে।
পরাজিত গ্ল্যাডিয়েটর ইতালি
প্রথম বিশ্বকাপে ইতালি অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপের পর এই প্রথম ইতালি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপই একমাত্র আসর, যেখানে ইউরোপে অনুষ্ঠিত কোনো বিশ্বকাপে ইউরোপের বাইরের দেশ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে। ইউরোপে আয়োজিত বিশ্বকাপের সবগুলো শিরোপাই গিয়েছে কোনো না কোনো ইউরোপিয়ান দলের হাতে।
বিশ্বকাপজয়ী দেশগুলোর মধ্যে এবারে ইতালিই একমাত্র দল যারা রাশিয়া-বিশ্বকাপে নেই। ইউরোপীয় অঞ্চলের বাছাইপর্বে সুইডেনের সাথে দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলে পরাজিত হয়ে ছিটকে পড়ে ইতালি। ৪ বার শিরোপাজয়ী ইতালি ব্যতিত আরো কিছু জনপ্রিয় দল রয়েছে যারা রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো নেদারল্যান্ডস, ইউএসএ, ঘানা এবং চিলি।
শিরোপাবিহীন সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকারী দেশ
বিশ্বকাপ শিরোপা না জিতেও সবচেয়ে বেশিবার এই আসরে অংশগ্রহণকারী দেশটি হলো মেক্সিকো (১৫)। শিরোপাজয়ী অন্য তিন দেশ স্পেন (১৪), ইংল্যান্ড (১৪) ও ফ্রান্সের (১৪) চেয়ে বেশি বিশ্বকাপ খেলেছে মেক্সিকো। অবশ্য মেক্সিকো তাদের বিগত ৬টি বিশ্বকাপের সবগুলোতেই বাদ পড়েছে শেষ ১৬ থেকে। কিন্তু গ্রুপ পর্বের ১৭টি ম্যাচের মধ্যে তারা হেরেছিলো মাত্র ২টি ম্যাচ। বিশ্বকাপ ইতিহাসে মেক্সিকো নিজেদের ৫৩টি ম্যাচের মধ্যে জিতেছে মাত্র ১৪টি ম্যাচে।
সর্বোচ্চ কার্ড
সুন্দর ফুটবলের দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ব্রাজিল। যদিও বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড গিয়েছে ব্রাজিলের (১১) ঘরেই। ব্রাজিলের নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটিও লাতিন আমেরিকার, আর্জেন্টিনা (১০) ও উরুগুয়ে (৯)। অবশ্য হলুদ ও লাল কার্ডসহ সর্বমোট কার্ডের হিসেবে সবচেয়ে বেশি কার্ড দেখতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। বিশ্বকাপে ৭৭ ম্যাচ খেলে মোট ১২০টি কার্ড নিয়ে প্রথম স্থানে থাকা আর্জেন্টিনার পরই দ্বিতীয় অবস্থানে জার্মানি (১১৭, ম্যাচ ১০৬) এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল (১০৮, ম্যাচ ১০৪)।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে ম্যাচ হিসেবে সবচেয়ে কম লাল কার্ড হজম করেছে স্পেন। সর্বমোট ৫৯টি ম্যাচে দলটির রয়েছে মাত্র ১টি লাল কার্ড। ১৯৯৪ ফিফা বিশ্বকাপে প্রথম পর্বের খেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের ২৬ মিনিটে স্পেনের হয়ে একমাত্র এই লাল কার্ডটি দেখেছিলেন মিগুয়েল অ্যানহেল নাদাল।
বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ গোলদাতা
বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের (১০) ও অ্যাসিস্টের (৬) রেকর্ড জার্মানির থমাস ম্যুলারের। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ১৬ গোল নিয়ে শীর্ষে রয়েছেন আরেক জার্মান মিরোস্লাভ ক্লোজা, ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো (১৫ গোল) রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। ম্যুলারের সামনে দারুণ সুযোগ রয়েছে ক্লোজা কিংবা রোনালদোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রতিটিতে ম্যুলার গোল করেছেন ৫টি করে। রাশিয়া বিশ্বকাপ হবে ২৮ বছর বয়সী ম্যুলারের তৃতীয় বিশ্বকাপ। নিজের স্বভাবজাত ফর্ম ধরে রাখলে রাশিয়া বিশ্বকাপেই নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ম্যুলারের।
অন্যদিকে মিরোস্লাভ ক্লোজা, পেলে ও উযো জিয়েলা ৪টি বিশ্বকাপে গোল করার দুর্দান্ত কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, রাফায়েল মারকুয়েজ, টিম কাহিল ও ডেভিড ভিয়ার।
সর্বোচ্চ ৫টি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ
মেক্সিকান অ্যান্তোনিও কারভাহাল, জার্মানির লোথার ম্যাথিউস ও ইতালির জিয়ানলুইজি বুফন ৫টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে এই রেকর্ডের অংশীদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে শুধুমাত্র মেক্সিকোর রাফায়েল মারকুয়েজের। মেক্সিকোর হয়ে ২০০২ সালে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নেন মারকুয়েজ, এরপর টানা ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছেন এই কিংবদন্তি।
রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় মারকুয়েজের বয়স হবে ৩৯ বছর। শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে এবং ইনজুরি মুক্ত থাকলে রাশিয়া বিশ্বকাপে মেক্সিকোর দলে হয়তো জায়গা করে নিতে যাচ্ছেন তিনি। মেক্সিকোর হয়ে এই বিশ্বকাপে খেললেই ইতিহাসের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে ৫টি বিশ্বকাপ খেলার অনবদ্য কৃতিত্ব গড়তে যাচ্ছেন মারকুয়েজ। ৪টি বিশ্বকাপে মারকুয়েজের গোল সংখ্যা ৩। প্রায় ২০ বছর মেক্সিকোর জাতীয় দলের হয়ে খেলা এই কিংবদন্তির অর্জনে রয়েছে দুটি কনকাকাফ গোল্ড কাপ (২০০৩ ও ২০১১) ও একটি কনফেডারেশন কাপ (১৯৯৯)।
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ
টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী ৩২টি দেশের মধ্যে বিশ্বকাপে নতুন মুখ হিসেবে যোগ দিচ্ছে আইসল্যান্ড ও পানামা। ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ আইসল্যান্ড, তাদের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৩,৩৬,৮০৭। এবারেই প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে আইসল্যান্ড। ফুটবলে আইসল্যান্ডের নান্দনিক উত্থান সাড়া ফেলেছে গোটা ফুটবল বিশ্বে।
জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলো ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো (১.৩ মিলিয়ন)। বিশ্বকাপ ইতিহাসে জনসংখ্যার বিচারে অন্যতম ছোট দেশগুলো হলো নর্দান আয়ারল্যান্ড (১.৮৫ মিলিয়ন), স্লোভেনিয়া (২.০৮ মিলিয়ন), জ্যামাইকা (২.৮৯ মিলিয়ন) এবং ওয়েলস (৩.১ মিলিয়ন)।
ফিচার ইমেজ: time.com