গ্রোনিনজেন, চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ ও বায়ার্নের মতো তিন মহীরূহ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ক্যারিয়ারে। পেয়েছেন অনেক বলার মতো পুরষ্কার ও জয় করেছেন অনেক ট্রফি। নেদারল্যান্ডসের হয়ে আছে আবার হতাশা।
ক্যারিয়ারের পাওয়া, না পাওয়া, দল বদল, অর্জন, হতাশা; সবকিছু নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ডাচ তারকা আরিয়েন রোবেন
আপনার সবচেয়ে পুরোনো ফুটবল বিষয়ক স্মৃতি কী?
আমার মনে হয়, ফুটবল নিয়ে আমার সবচেয়ে ছোটবেলার স্মৃতি হলো, আমি রাস্তায় ফুটবল খেলছি। স্কুলের মাঠে খেলছি, এটাও মনে পড়ে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার গ্রামের দলে খেলতাম; তবে সপ্তাহে এক বা দুই দিন খেলতাম। আমি মূলত স্কুলের পর বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলে খেলেই নিজেকে তৈরি করেছি।
আপনার একটা ট্রেডমার্ক হলো গতি। আপনি কী ছোটবেলায় ভালো অ্যাথলেট ছিলেন?
স্কুলে থাকতে একটুআধটু অ্যাথলেটিক্স তো করতাম। আর গতিটা আমার সবসময় ছিলে। অবশ্য এর মানে এই না যে, আমি পেশাদার হতে পারতাম ওদিকে। এটা একটু বিস্ময়কর। কারণ, আমার বাবা-মা কেউ খুব গতিশীল মানুষ ছিলেন না। আমার মা তো বাবার চেয়ে দ্রুত চলতেন।
আপনার যখন গ্রোনিনজেনে অভিষেক হলো, তখনও আপনি স্কুলে পড়ছেন। আপনার বন্ধুরা নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত ছিলো?
আমার মনে আছে, আমি ক্লাসে থাকতে মা আমাকে দুই তিন বার কল করেছিলেন। পরে আমি যখন পাল্টা ফোন করলাম, উনি বললেন যে, গ্রোনিনজেন থেকে আমাকে কল করেছিলো। আর সেই সপ্তাহ শেষেই আমি ওদের স্কোয়াডে ঢুকে গেলাম। এটা একেবারে কোনো সংকেত ছাড়া ঘটেছিলো। আমি মোটেও এরকম আশা করিনি। আমি কখনো প্রথম একাদশের সাথে ট্রেনিং করিনি। অথচ কোচ আমাকে বদলীদের সাথে বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন। আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে খুব খুশি ছিলো। ওদের জন্য আমাকে টিভিতে খেলতে দেখাটা খুব বিস্ময়কর অনুভূতি ছিলো।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অনেক ইনজুরিতে পড়েছেন। কখনো ভয় হয়েছে যে, ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারটা বড় না-ও হতে পারে?
বাচ্চা থাকতে বা যুব দলে আমি কখনো ইনজুরিতে পড়িনি। আমি প্রথম ইনজুরিতে পড়ি চেলসিতে থাকতে। যখন একটা প্রাক-মৌসুম ম্যাচে আমার পা ভেঙে যায়। এরপর কিছু মাংসপেশির ইনজুরি হয়। এর ফলে আমি আমার শরীরকে ভালো চিনতে পারি, ভালো যত্ন নিতে পেরেছি।
ইয়োহান ক্রুইফ বলেছিলেন, ‘ও একটা অসাধারণ প্রতিভা এবং ওর দারুন একটা বাম পা আছে। কিন্তু ওর ডান পা মনে হয় চকলেটের তৈরি।’ আপনি কী এ নিয়ে ওনাকে কিছু বলবেন?
কখনো না। কারণ, উনি একা নন, এরকম কথা অনেকেই আমাকে বলেছে। আসলেই আমার ডান পা দিয়ে আমি তেমন কিছু করতে পারি না। কিন্তু এই নিয়েই আমি সর্বোচ্চ স্তরে খেলছি। আজকালকের কোচরা তরুণ ছেলেদের দুই পা-ই সমান চান। কিন্তু আমি নিশ্চিত না, এটা ভালো কি না। কারো এক পা ভালো হলে আমি প্রশ্ন করবো, তুমি কি ওই পা-কে বিশেষ কিছু বানাতে চাও, নাকি দুটো মাঝারি মানের পা চাও?
২০০৪ সালে আপনি ২০ বছর বয়সে চেলসিতে যোগ দেন। হোসে মরিনহোর অধীনে খেলাটা কেমন অভিজ্ঞতা?
খুবই বেশি চাহিদা ওনার। তবে আমার মনে হয়েছে, আমার ওই বয়সে উন্নতির জন্য এটা ভালো ছিলো। আমি তখনও একটা ছাত্র ছিলাম; যে কি না শিখতে চায় এবং কঠোর পরিশ্রম করতে চায়। ফলে আমাদের ওই সময় ভালো মানিয়ে গিয়েছিলো। মরিনহো একজন ভালো ‘ম্যান-ম্যানেজার’।
মরিনহো আপনার ইনজুরি নিয়ে খুব ঠোটকাটা ছিলেন। আপনার অনেক সমালোচনা করেছেন তিনি।
না, আমি কোনো সমালোচনা হিসেবে দেখিনি ওগুলোকে। একজন কোচের জন্য তার একজন খেলোয়াড়ের ইনজুরিতে পড়ে থাকা মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ, আপনি তাকে হিসেবে নিতে পারছেন না। আমি তার অবস্থানটা বুঝি। হোসে একজন চ্যাম্পিয়ন মানুষ এবং তিনি শক্ত খেলোয়াড় চাইতেন। আমি যখন সুস্থ হয়ে ফিরেছি। তার কাছ থেকে অনেক সমর্থন পেয়েছি।
আপনি একবার বলেছিলেন, ইংল্যান্ডে জন টেরির চেয়ে বেশি আপনাকে কেউ শেখায়নি। কী শিখেছিলেন তার কাছ থেকে?
আমি যত অধিনায়কের অধীনে খেলেছি, সে তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছিলো। যে যেভাবে অন্যের সাথে ব্যবহার করতো এবং মাঠে নিজেকে উপস্থাপন করতো, সেটা যে কারো জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
চেলসি থেকে রিয়াল মাদ্রিদে চলে এলেন কেন?
এটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিলো। যদিও ততদিনে চেলসিতে সিস্টেমটা একটু বদলে গিয়েছিলো। আমার প্রথম দুই মৌসুমে চেলসিতে আমরা দুই উইঙ্গার নিয়ে খেলেছি। এরপর হোসে ‘ডায়মন্ড’ ফরমে খেলা শুরু করলো। সেখানে একজন মিডফিল্ডার ছিলো এবং দুজন ফরোয়ার্ড ছিলো। আমি হয়তো স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে পারতাম। কিন্তু আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো ও দিদিয়ের দ্রগবা প্রথম পছন্দ ছিলো। এই অবস্থায় রিয়াল প্রস্তাব নিয়ে এলো। তাদের ‘না’ বলাটা কঠিন ছিলো। কারণ, এটা আমার ক্যারিয়ারে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিলো।
রিয়ালের সমর্থকদের সন্তুষ্ট করাটা খুব কঠিন কাজ। আপনি সেটা পেরেছিলেন?
আমার সবসময় তাদের (সমর্থকদের) সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমার প্রথম মৌসুমে আমরা লিগ জিতি এবং বার্সেলোনাকে ৪-১ গোলে হারাই। সেটা অবিশ্বাস্য একটা রাত ছিলো। পরের বছর আমার ধারণা আমি আমার ক্যারিয়ারের সেরা ফুটবলটা খেলেছি। অনেক গোল করেছি। আপনি যখন অনেক গোল করবেন, ট্রফি জিতবেন; সমর্থকদের সাথে সম্পর্ক ভালো হবেই।
আপনি বলেছিলেন, ২০০৯ সালে রিয়াল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আপনার সাথে কি ক্লাব বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো?
এটা আজগুবি একটা সময় ছিলো। আমি প্রাক-মৌসুমেও ভালো খেলছিলাম। কিন্তু রিয়াল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, জাবি অলোনসো, করিম বেনজেমা ও কাকাকে আনতে প্রচুর টাকা খরচ করছিলো। বোর্ড আমাকেত, ওয়েসলি স্নেইডার ও ক্লাস-জাঁ হান্টেলারকে বললো, তাদের কিছু খেলোয়াড় বিক্রি করতে হবে টাকা আনতে গেলে। আমার কোচ ম্যানুয়েল পেলিগ্রিনির সাথে কোনো সমস্যা নেই। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমাকে ছাড়তে চান না। কিন্তু বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ শেষ সিদ্ধান্ত নিলেন। এটা কঠিন ছিলো মেনে নেওয়া। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, চলে যাবো। আর বায়ার্নে চলে এলাম। এটা অবশ্য আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।
রোবেন ও রিবেরি, অনেকে ‘রবেরি’ বলেন; আপনারা দুজন বায়ার্নে এক দশকের মতো সময় জুড়ে প্রতীক হিসেবে ছিলেন। আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?
আমি মনে করি, আমরা দুজন একই মানসিকতার মানুষ। এর ফলে আমরা মাঠে বিস্ময়কর একটা সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলাম। প্রথমত আমরা দুজনই খেলাটাকে খুব ভালোবাসি। আমরা দুজনই বিশেষ করে ওয়ান-বনাম-ওয়ান পরিস্থিতি পছন্দ করি। সেই সাথে দুজনই গোল তৈরি করা এবং গোল করা পছন্দ করি। আমরা খুব খুব একরকম। আমরা যখন এক হই ফলে সাফল্য আসাটা আর বিস্ময়ের কিছু থাকে না।
২০১২ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে আপনি পেনাল্টি মিস করলেন। এটা কি আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত?
অবশ্যই এটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হতাশার মুহূর্তগুলোর একটা। সবার জন্যই খুব হতাশার সময়। আমরা নিজেদের মাঠে খেলছিলাম। আমরা সাত মিনিট বাকি থাকতেও ১-০ গোলে এগিয়েছিলাম। এরপর ওরা সমতা আনলো। আর আমি পেনাল্টি মিস করলাম। আপনি যখন একটা খুব প্রয়োজনীয় সময়ের পেনাল্টি মিস করবেন, এটা খুব খুব কঠিন হয়ে আসে। কিন্তু তারপরও ওখান থেকে ঘুরে দাড়াতে হয়। আমরা ওখান থেকে ঘুরে দাড়িয়ে পরের বছর ওয়েম্বলিতে (আবার ফাইনালে) প্রমাণ করেছি, আমরা একটা গ্রেট দল।
বায়ার্ন ২০১০ ও ২০১২ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারলো। তখন কি আপনার মনে হয়েছে যে, আপনার নিয়তিতে এই ট্রফিটা নেই?
অবশ্যই। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ২০১৩ সালে তৃতীয় ফাইনালের আগে তাই অবিশ্বাস্য একটা চাপ ছিলো। যদিও আমার মানসিকতা খুব ইতিবাচক ছিলো। আমি মনে করছিলাম, এবার আমরা জিতবো। আমি নিজেকে একটা কথা বলছিলাম যে, আমি তিনটে ফাইনাল খেলে সবগুলো হারতে পারি না। এটা হতে পারে না। এভাবে কেউ ক্যারিয়ার শেষ করতে পারে না।
ফাইনালে এসে একেবারে শেষ বেলায় আপনি যখন জয়সূচক গোলটা করলেন, তখন কী মনে হলো? কাঁধ থেকে সেই পেনাল্টি মিসের বোঝাটা নেমে গেলো?
মনে হচ্ছিলো, এটা কোনো বই বা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। আগের বছর আগে চেলসির বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেছিলাম। এরপর ১২ মাস পার করে এসে আমিই জয়সূচক গোলটা করলাম। আমি মনে করি, খেলাধুলায় আমাদের কী ধরনের চরিত্র দেখানো উচিত, তার একটা বড় উদাহরণ এটা। আপনার জীবনে যদি ভয়াবহ দুঃসময়ও আসে, ঘুরে দাঁড়ান এবং লড়াই করুন।
আপনি এমন একটা সময় নেদারল্যান্ডসে খেলেছেন, যখন রবিন ফন পার্সি, রাফায়েল ফন ডার ভার্ট ও ওয়েসলি স্নেইডাররাই এসেছেন। এরকম একটা যুগেও নেদারল্যান্ডস কিছু না জিতে কিভাবে পারলো?
আমার ধারণা, একটা ছোট্ট দেশ হিসেবে দেখলে আমরা কিছু সাফল্য পেয়েছি। ২০১০ বিশ্বকাপে আমরা দ্বিতীয় হয়েছি, ২০১৪ সালে আমরা তৃতীয় হয়েছি। একেবারে খারাপ না। অবশ্যই আমরাও ট্রফিটাই জিততে চেয়েছি। কিন্তু মাত্র ১৬ মিলিয়ন লোকের একটা দেশ থেকে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়াটাকে খারাপভাবে দেখার কিছু নেই।
নেদারল্যান্ডস ২০১৬ ইউরো ও ২০১৮ বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব পার হতে পারেনি। ডাচ ফুটবলে কী চলছে?
আমাদের সবসময় একটা অনন্য স্টাইলের ফুটবল ছিলো। কিন্তু খেলাটার বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন হয়েছে, আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। আপনাকে আসলে অন্যের উন্নতি দেখে কিছু শিখতে হবে। গত ১০-১৫ বছর ধরে আমাদের ফুটবলটা অন্যরা এসে দেখেছে, শিখেছে, আমরা কী করি। কিন্তু আমরা কখনোই অন্যদের দিকে চেয়ে কিছু শেখার চেষ্টা করিনি।
ইকার ক্যাসিয়াসের বুটে লেগে ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে আপনার গোলটা হলো না। এটা কী এখনও পোড়ায়?
অন্য সব ট্রফি তো আমার আছে। কিন্তু ওই হতাশা আমার সারাজীবন সঙ্গে থাকবে। আমি বিশ্বকাপ জয়ের খুব বড় একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি যখন ইকার ক্যাসিয়াসকে ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে পেলাম, বলটা আর তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পাঠালে গোল হয়ে যেত। পরে আমি অনেকবার ওই সময়টার ভিডিও দেখেছে। আমার মনে হয়েছে, আমি সঠিক শটই করেছিলাম। আমি আরেকবার ওই ম্যাচটায় ওরকম সুযোগ পেলে ওরকম শটই করবো, তবে তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে!
আপনার ক্যারিয়ারকে এক শব্দে বর্ণনা করুন।
আমি বলবো, গ্রেট। আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত এসেছে, অনেক ট্রফি জিতেছি। জীবনে অনেক কঠিন সময় এসেছে, অনেক হতাশা এসেছে। কিন্তু আমি আমার শক্তভাবে ফিরে এসেছি। আমার জীবনে হতাশার চেয়ে ভালো সময়ই বেশি এসেছে। আশা করি, অবসরের আগে আরও কয়েকটা বছর ফুটবলটা উপভোগ করে যেতে পারবো।