ইউরোপীয়ান ফুটবলের চূড়ায় ওঠা ক্লাবগুলোর মাঝে বার্সেলোনা বরাবরই ছিল অন্যতম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সময়ের সাথে সাথে বার্সেলোনা তার অকল্পনীয় উচ্চতা হারিয়েছে। আর্নেস্তো ভালভার্দে, কিকে সেতিয়েন এবং রোনাল্ড ক্যোমান – সকলেই বার্সেলোনাকে পেপ গার্দিওলা-লুইস এনরিকে যুগের স্বর্ণশিখরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন; শেষ পর্যন্ত তারা কেউই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। বার্সেলোনা দিনদিন নিমজ্জিত হয়েছে ব্যর্থতার অতল গহ্বরে। সেতিয়েন থেকে ক্যোমানের পর যিনি বার্সেলোনার স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন, তিনি আর কেউ নন, ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে বার্সেলোনার ট্রেবল জয়ের অন্যতম পথিকৃৎ জাভিয়ের হার্নান্দেজ।
এই স্প্যানিয়ার্ড অবশ্য ‘জাভি’ নামেই সকলের কাছে পরিচিত। তিনি বার্সেলোনার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন, আর অবসরের পর কোচ হিসেবেও সমানভাবে তার দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছেন। কাতারের আল-সাদ ক্লাবে ম্যানেজার থাকাকালীন সাতটি ট্রফি জিতেছেন, অর্জন করেছেন ২০২০-২১ মৌসুমের লিগ শিরোপা।
রোনাল্ড ক্যোমানের অধীনে টানা ব্যর্থতার পর ২০২১ সালের ৫ নভেম্বর বার্সেলোনার বোর্ড নতুন কোচ হিসেবে জাভিকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বার্সেলোনার কোচ হওয়ার পর থেকেই এই তরুণ কোচ রোমাঞ্চকর ফুটবলের ডালা নিয়ে ভক্তদের কাছে হাজির হয়েছেন; খাদের কিনার থেকে তুলে আবারও বার্সেলোনাকে ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে নিতে চেষ্টা করছেন।
জাভি যখন বার্সেলোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ উভয় টুর্নামেন্টেই কাতালান এই ক্লাবটির অবস্থা ছিল তথৈবচ। জাভি যদিও বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বে নিয়ে যেতে পারেননি, তবে তার অধীনে অল্প সময়েই লা লিগার টপ ফোরে ফিরে এসেছে বার্সেলোনা। ইউরোপা লিগে দুর্দান্ত দু’টি অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেছে তারা, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ জার্মান ক্লাব ফ্রাঙ্কফুর্ট।
দায়িত্ব পাওয়ার চার মাসের মধ্যেই জাভি বার্সেলোনার যা পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তা এককথায় অকল্পনীয়! আজ আমরা জাভির অধীনে বার্সেলোনার খেলার ধরন এবং বার্সেলোনার উত্থানের কৌশলগত কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
খেলার ধরন
জাভির খেলার ধরনকে তার প্রাক্তন কোচ পেপ গার্দিওলার খেলার ধরনের সাথে অনেকাংশেই তুলনা করা যায়। জাভির ক্যারিয়ারে গার্দিওলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ইউরোপে অভিজ্ঞতার ঝুলি শূন্য থাকা সত্ত্বেও জাভির অধীনে বার্সেলোনাকে দেখে দলের মধ্যে পেপের প্রভাব অনুভূত হয় বেশ ভালোভাবেই। জাভির টাচলাইন থেকে দেখার চোখ কিংবা তার পর্যবেক্ষণের মাঝে গার্দিওলার প্রছন্ন প্রভাব দেখা যায়। বলা যেতেই পারে, গার্দিওলার মধ্যে যেমন আমরা ক্রুইফের প্রভাব দেখতে পাই, ঠিক তেমনভাবেই জাভির মধ্যেও গার্দিওলার সেই ছায়া লক্ষ্য করা যায়।
জাভি তার খেলার কৌশলে বল পায়ে রাখার পাশাপাশি ‘জুয়েগো ডি পজিশন’ (পজিশনাল প্লে)-এর মূল নীতিগুলো বজায় রাখতে আগ্রহী। ২০১৯ সালে ফিফার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে কথা বলার সময় জাভি তার দলকে কিভাবে খেলতে চান সে সম্পর্কে বলেছিলেন:
“আমি নিজেকে এমন একজন হিসাবে বর্ণনা করবো যে বল পায়ে রাখতে পছন্দ করে। আমার দলের কাছে বল না থাকলে আমি ডাগআউটে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
আমি যখন খেলতাম, তখনও ব্যাপারটা প্রায় একই ছিল; আমি বলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পছন্দ করতাম। আমি যা চাই, তা হলো আমার দলের বলের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকুক। আর আমি মনে করি খেলার নিয়ন্ত্রণ তখনই থাকবে, যখন বলের নিয়ন্ত্রণ আমার কাছে থাকবে।
এটাই আমার দর্শন; প্রতিপক্ষের অর্ধে বলের দখল ধরে রাখা। শুধুমাত্র বল পায়ে রাখাটাই যথেষ্ট নয়, ক্রমাগত আক্রমণ করে যেতে হবে। কারণ আপনি যত বেশি সুযোগ তৈরি করবেন, তত বেশি জেতার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
জাভি তার নীতিতে অটল থেকেছেন। যদিও একটু আগেই বলেছি বর্তমান বার্সেলোনার খেলার ধরনে গার্দিওলার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে, তারপরও জাভি এবং গার্দিওলার স্টাইলে বিস্তর ফারাক পর্যবেক্ষণ করা যায়। পেপ গার্দিওলা যেখানে ধীরগতির বিল্ডআপনির্ভর ফুটবল খেলাতে পছন্দ করেন, সেখানে জাভির বার্সেলোনা অনেক বেশি গতিশীল ফুটবল খেলে থাকে।
রোনাল্ড ক্যোমানের অধীনে বার্সেলোনা ৪-৩-৩, ৪-২-৩-১, ৩-৫-২ এবং ৩-৪-৩ ফর্মেশনে খেললেও জাভি আবার বার্সেলোনার ঐতিহ্যবাহী ৪-৩-৩ ফর্মেশন ফিরিয়ে এনেছেন। ক্যোমানের অধীনে খেলোয়াড়দের পজিশনগত সমস্যা প্রকট ছিল, যে কারণে প্রতিপক্ষের লো ব্লক ডিফেন্সলাইন ভেঙে বার্সেলোনা আক্রমণে যেতে পারত না। জাভি এসেই মাঠের প্রত্যেকটা পজিশনে ‘ত্রিভুজ’ তৈরি করেছেন, যা আমরা গার্দিওলা কিংবা এনরিকের সময়ে দেখতে পেতাম। মাঠের প্রতিটা পজিশনে ‘ত্রিভুজ’ তৈরি হওয়ায় প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ের সামনে একাধিক পাসিং অপশন তৈরি হচ্ছে এবং খুব সহজেই নিউমেরিক্যাল সুপিরিওরিটি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।
বিল্ডআপ
বার্সেলোনার খেলার ধরন অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিল্ডআপ। ক্যোমানের অধীনে হাই প্রেসিং করা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বার্সেলোনার বিল্ডআপ কৌশল বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল; যে কারণে জাভি বার্সেলোনার বিল্ডআপ কৌশলে অনেকখানি পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
ক্যোমানের অধীনে বার্সেলোনা গোলকিপার থেকে ছোট ছোট পাসের মাধ্যমে বিল্ডআপ শুরু করত। বার্সেলোনার সেন্টারব্যাকদের মধ্যে পিকে বল পায়ে দক্ষ হলেও আরাউহো বল পায়ে বেশ দুর্বল। এজন্য বিল্ডআপে সহায়তা করার জন্য মিডফিল্ডার বুসকেটস তার পজিশন থেকে অনেকটা নিচে নেমে বাড়তি পাসিং অপশন তৈরি করত। বিল্ডআপের সময় দুই ফুলব্যাক রক্ষণভাগ থেকে অনেকটা উপরে অবস্থান করত, যে কারণে বেশিরভাগ সময়ই লম্বা পাসের মাধ্যমে বল সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হতো এবং বার্সেলোনা বলের দখল হারাত।
বিল্ডআপের সময় একটা বড় দুর্বলতা ছিল বুসকেটসের গতি; তার পক্ষে অতি দ্রুত ডিফেন্স এবং মিডফিল্ডে ওঠানামা করা বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল, যে কারণে জাভি বিল্ডআপে বুসকেটসকে নিচে নামানোর পরিবর্তে লেফটব্যাক আলবাকে নিচে রেখে দুই সেন্টারব্যাকের সাথে ব্যাক-থ্রি তৈরি করেন।
সাধারণত বার্সেলোনার মিডফিল্ডে মূল বল ডিস্ট্রিবিউটরের ভূমিকায় বুসকেটসকে খেলতে দেখা যায়। বেশিরভাগ ম্যাচেই প্রতিপক্ষের একজন মিডফিল্ডার বুসকেটসকে সরাসরি ম্যান মার্ক করে রাখায় তার পক্ষে আক্রমণভাগে বল সরবরাহ করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সমস্যায় এর আগে ভালভার্দে, সেতিয়েন, এমনকি ক্যোমানও পড়েছেন, কিন্তু তাদের কেউই এ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। প্রতিপক্ষ যদি বুসকেটসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারে, তবে বার্সেলোনার স্বাভাবিক খেলা অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এজন্য জাভি সর্বপ্রথম মনোযোগ দিলেন এই সমস্যা সমাধানে। কী ছিল সেই সমাধান?
দানি আলভেজ রাইটব্যাক পজিশনে খেললেও তার পাসিং এবং ভিশন দুর্দান্ত। বুসকেটসের উপর থেকে চাপ কমাতে আলভেসের এই বৈশিষ্ট্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন জাভি। কাগজে-কলমে আলভেস রাইটব্যাক পজিশনে খেলতে নামলেও মাঠের খেলায় তিনি তার পজিশন ছেড়ে অনেকটা উপরে এবং মাঝের অংশে চলে আসেন, বুসকেটসের সাথে মিলে ডাবল পিভট গঠন করেন। আবার আলভেজের দুর্বলতা হচ্ছে বয়সের ভারে তার গতি অনেকটাই কমে গিয়েছে, প্রতিপক্ষের স্পিডি উইঙ্গারদের সাথে গতির লড়াইয়ে এখন আর পেরে ওঠেন না। পেছনে তিনজন ডিফেন্ডারের কভার থাকায় আলভেসকে সরাসরি প্রতিপক্ষের প্রতিআক্রমণের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে না, যে কারণে তিনি মিডফিল্ড থেকে বল সরবরাহকারীর ভূমিকায় আরো মনোযোগী হতে পারছেন।
এই মৌসুমে আলভেজ সতীর্থদের দিকে ম্যাচপ্রতি ১৪.৩টি লং পাস দিয়েছেন, যা নিয়মিত খেলোয়াড়দের মধ্যে পিকে, বুসকেটস এবং স্টেগানের পর সর্বোচ্চ৷ দানি আলভেজের মিডফিল্ড থেকে ক্রমাগত বল সরবরাহের কারণে প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডাররা বুসকেটসকে সরাসরি মার্ক করে সুবিধা করতে পারছেন না। আবার উপরে খেলায় বুসকেটসও আরো ভালোভাবে তার স্বাভাবিক খেলা বজায় রাখতে পারছেন।
এতক্ষণ কথা বললাম তিন সেন্টারব্যাক এবং দুই পিভট ব্যবহারের কৌশল নিয়ে। কিন্তু প্রতিপক্ষের মিড ব্লক প্রেসিংয়ের বিপক্ষে এই কৌশল খুব একটা কার্যকরী হয় না। জাভি তখন তার বিল্ডআপ কৌশলে খানিকটা পরিবর্তন আনেন। প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডারদের ক্রমাগত প্রেসিংয়ের বিপক্ষে বুসকেটস-আলভেজ পিভট ডুয়ো অনেক সময়ই পেরে ওঠে না।
আলভেসের পাশাপাশি বার্সেলোনার অপর ফুলব্যাক জর্দি আলবাও বল পায়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। এজন্য এসময় তিনি অপর দুই সেন্টারব্যাকের সাথে অবস্থান না করে মিডফিল্ডে উঠে এসে ‘ফলস নাম্বার এইটের’ ভূমিকা পালন করেন এবং আলভেজ-বুসকেটসের জন্য বাড়তি পাসিং অপশন তৈরি করেন। ফলে প্রতিপক্ষের জন্য তিন মিডফিল্ডারকে প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে সবসময় বার্সেলোনাকে ধীরগতির বিল্ডআপ কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায় না। বিশেষ করে হাই ব্লক প্রেসিং করা দলগুলোর বিপক্ষে এই ধরনের বিল্ডআপ কৌশল খুব একটা কার্যকরী হয় না। এ ধরনের ম্যাচগুলোতে টের স্টেগান কিংবা পিকে বাড়তি সময় পায়ে বল রেখে প্রতিপক্ষকে প্রেস করতে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের প্রেস করতে প্রতিপক্ষ তখন রক্ষণ ছেড়ে অনেকটা উপরে উঠে যায়। তখন স্টেগান কিংবা পিকে প্রতিপক্ষের অর্ধে লং বল বাড়ায়। বার্সেলোনার আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের পেছনের ফাঁকা জায়গা কাজে লাগিয়ে দ্রুত সময়ে আক্রমণে উঠে গোল করার চেষ্টা করে।
উপরের ছবিটি নাপোলির বিপক্ষে ইউরোপা লিগ ম্যাচের। এখানে বিল্ডআপের শুরুতে বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা বেশি সময় পায়ে বল ধরে রাখছিল যাতে করে নাপোলির খেলোয়াড়রা বাধ্য হয়ে প্রেস করতে উপরে উঠে আসে। তখন একদম নিচ থেকে ফেরান তোরেস বরাবর স্টেগানের লং বল থেকে নাপোলির রক্ষণভাগ একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, এবং এখান থেকেই বার্সেলোনা তাদের দ্বিতীয় গোলটি পেয়ে যায়।
আক্রমণ
রোনাল্ড ক্যোমানের অধীনে যেখানে বার্সেলোনা প্রতিপক্ষের রক্ষণদেয়াল ভেদ করতেই খাবি খাচ্ছিল, সেখানে জাভির বার্সেলোনা গোলের পর গোল করে যাচ্ছে। জাভির অধীনে ইতোমধ্যেই বার্সেলোনা ২৪ ম্যাচে করে ফেলেছে ৪৬ গোল৷ জাভির অধীনে বার্সেলোনার আক্রমণভাগের এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে শীতকালীন দলবদলে দলে ভেড়ানো আদামা ট্রাউরে, অবামেয়াং এবং ফেরান তোরেসের দুর্দান্ত ফর্ম। এবারের দলবদলে সব ট্রান্সফার জাভির চাহিদামাফিকই হয়েছিল; তার সুফল বার্সেলোনা পাচ্ছে হাতেনাতেই।
বার্সেলোনার আক্রমণভাগে মেম্ফিস ডিপাই এবং লুক ডি ইয়ং থাকলেও তারা খুব একটা ভালো করতে পারছিলেন না। তাদের কেউই প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের পেছনের ফাঁকা জায়গা কাজে লাগাতে পারছিলেন না। ডিপাই মূলত একজন সেকেন্ড স্ট্রাইকার; তিনি প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের পেছনে রান নেওয়ার পরিবর্তে রক্ষণভাগের সামনে বল পায়ে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। লুক ডি ইয়ং প্রায়শই ডিফেন্সের পেছনে রান নিলেও তার ধীরগতির কারণে পেরে উঠছিলেন না৷ এজন্য জাভি দ্রুতগতির অবামেয়াংকে নিয়ে আসেন, যিনি নিজের গতি দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণদেয়াল গুড়িয়ে দিতে বেশ কার্যকর। জাভির অধীনে দেখা মিলছে এক নতুন অবামেয়াংয়ের। আর্সেনালে গোল করতে ভুলে যাওয়া অবামেয়াং বার্সেলোনায় এসে ১০ ম্যাচেই করে ফেলেছেন ৭ গোল!
তবে অবামেয়াং কিন্তু শুধুমাত্র ‘বিহাইন্ড দ্য ডিফেন্সের’ ফাঁকা জায়গা কাজে লাগিয়ে গোল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিল্ডআপের সময় তিনি মিডফিল্ডে নেমে প্রতিপক্ষের একজন সেন্টারব্যাককে তার সাথে টেনে নিয়ে আসছেন৷ এতে করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের পেছনে প্রচুর ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে৷ সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং কিংবা ফেরান তোরেস আড়াআড়ি রান নিচ্ছেন, যার মাধ্যমে ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে গোলের সুযোগ।
উলভস থেকে লোনে আদামা ট্রাউরেকে নিয়ে আসায় জাভি কম সমালোচনার স্বীকার হননি। এই মৌসুমে উলভসের হয়ে ২৩ ম্যাচে মাত্র ১ গোল এবং কোনো অ্যাসিস্ট না করা খেলোয়াড় নিয়ে সমালোচনা হওয়াটাও স্বাভাবিকই বৈকি। তবে সকল সমালোচনার জবাব দিতে আদামা একেবারেই সময় নেননি, ইতোমধ্যে বার্সেলোনার হয়ে তার অ্যাসিস্টের খাতায় যোগ হয়ে গেছে ৪টি অ্যাসিস্ট।
তবে আদামার এই দুর্দান্ত ফর্মে ফেরার রহস্য কী, সেটা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। জাভি কী এমন পরিবর্তন ঘটালেন যাতে করে আদামার পারফরম্যান্সে এমন পরিবর্তন?
আদামা বর্তমানে ইউরোপের সেরা ড্রিবলারদের মধ্যে একজন। কিন্তু তার ড্রিবলিং সামর্থ্য মেসি-নেইমারদের মতো আঁটসাঁট জায়গায় দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল নয়৷ তিনি বরং একজন গতিশীল ড্রিবলার, যে কি না ফাঁকা জায়গায় ওয়ান-ভার্সাস-ওয়ান কিংবা ওয়ান-ভার্সাস-টু লড়াইয়েও প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে বল পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন৷ লা লিগার দলগুলো বেশ আঁটসাঁট রক্ষণ বজায় রাখায় জাভির মূল চ্যালেঞ্জ ছিল আদামার জন্য ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দেওয়া, এবং জাভি তা খুব ভালোভাবেই পেরেছেন।
দানি আলভেজ রাইটব্যাক পজিশন থেকে পিভটের ভূমিকায় চলে আসায় প্রতিপক্ষের লেফট উইঙ্গার তাকে মার্ক করে মাঠের অনেকটা মাঝের অংশে চলে আসেন। আবার বিল্ডআপের শুরুতেই পেদ্রি প্রতিপক্ষে বক্সের বাইরে ডানপাশের হাফস্পেসে অবস্থান করেন৷ এ সময় আদামা ডানপাশের টাচলাইন এরিয়ে ঘেঁষে অবস্থান করেন। ফলে প্রতিপক্ষের লেফটব্যাক আদামাকে সরাসরি মার্ক না করে পেদ্রিকে মার্ক করতে শুরু করে৷ বিল্ডআপের সময় বার্সেলোনার বেশিরভাগ ফুটবলার মিলে মাঠের বামপাশে ওভারলোড তৈরি করায় ডানদিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। ফলে দুই সেন্টারব্যাক কিংবা বুসকেটস বামপাশ থেকে আদামা বরাবর বল সুইচ করলে আদামার সামনে পুরো ওয়াইড এরিয়া ফাঁকা থাকে। প্রতিপক্ষের লেফটব্যাক এবং লেফট উইঙ্গার তাকে মার্ক করতে আসার আগেই তিনি দ্রুতগতিতে ড্রিবল করে বক্সে ঢুকে পড়ার সুযোগ পান।
এবার মাঠের বামপাশে বার্সেলোনাল আক্রমণের কৌশল নিয়ে আলোচনা করা যাক। ডানপাশ দিয়ে আক্রমণের প্রায় পুরোটাই আদামা অথবা দেম্বেলের গতি এবং ড্রিবলিংয়ের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বামপাশ দিয়ে বার্সেলোনার আক্রমণগুলো গড়ে উঠে খেলোয়াড়দের কম্বিনেশন এবং ক্রমাগত পজিশন অদলবদলের মাধ্যমে। এই মৌসুমে বার্সেলোনার ৪৩ শতাংশ আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে মাঠের বামপাশ দিয়ে।
বিল্ডআপের সময় লেফটব্যাক আলবা লেফট সেন্টারব্যাক পজিশনে খেললেও তার মূল শক্তির জায়গা আক্রমণে, সেটা কোনোভাবেই জাভির অজানা নয়। এজন্য আক্রমণে ওঠার সময় আলবা ওভারল্যাপ করে উপরে উঠে যান। তখন আলবার ফেলে যাওয়া স্পেস কভারের জন্য ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং মিডফিল্ড থেকে নিচে নেমে আসে। আলবা টাচলাইন ধরে আক্রমণে উঠলে লেফট উইঙ্গার পজিশনে থাকা গাভি কিংবা ফেরান তোরেস হাফস্পেসের দিকে সরে আসে। তখন অবামেয়াং তার লাইন থেকে নিচে প্রতিপক্ষের একজন সেন্টারব্যাককে টেনে নিয়ে আসে, সেই জায়গা ধরে ফেরান কিংবা ডি ইয়ং রান নিলে আলবা উইং থেকে বক্সের ফাঁকা জায়গায় ক্রস করে।
প্রতিপক্ষ আঁটসাঁট ডিফেন্স ধরে রাখলে বার্সেলোনার পক্ষে গোলের সুযোগ তৈরি করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ডানপাশে ফাঁকা জায়গা বের করতে না পারায় আদামা কিংবা দেম্বেলের ড্রিবলিং খুব একটা কার্যকরী হয় না। তখন বার্সেলোনা বামপাশ দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করে। আলবা-ফেরান-ডি ইয়ং-অবামেয়াং মিলে বামপাশে ওভারলোড তৈরি করার চেষ্টা করেন। তাদের ক্রমাগত পজিশন অদলবদলের কারণে প্রতিপক্ষের পক্ষে ম্যান-টু-ম্যান মার্ক করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রেসিং
জাভির বার্সেলোনা আগের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। বেশি আক্রমণাত্মক খেলার কারণে বলের দখল হারিয়ে গোল হজম করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এজন্য জাভি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন প্রেসিং কৌশলে। জাভির অধীনে বার্সেলোনার বিল্ডআপ এবং আক্রমণের কৌশল অনেকটা পেপ গার্দিওলা এবং লুইস এনরিকের অনুরূপ হলেও প্রেসিংয়ের ক্ষেত্রে জাভি বিখ্যাত কোচ মার্সেলো বিয়েলসার কোচিং দর্শন অনুসরণ করেছেন।
জাভির আগমনের পর বার্সেলোনা ম্যাচপ্রতি ৩৪.৪ বার প্রেস করে প্রতিপক্ষের থেকে বল কেড়ে নিয়েছেন, যে পরিসংখ্যানে লা লিগার অন্যান্য সব টিমের চেয়েই বার্সেলোনা এগিয়ে। যদিও তারা ফাইনাল থার্ডে প্রতিপক্ষের উপর খুব বেশি চড়াও হয় না, তারপরও বর্তমান সময়ে প্রেসিংয়ের দিক দিয়ে বার্সেলোনাই স্পেনের সেরা দল।
প্রেসিংয়ের মাধ্যমে যেমন প্রতিপক্ষের থেকে বলের দখল কেড়ে নেওয়া যায়, তেমনি প্রেসিংয়ে সফল না হলে রক্ষণভাগ উন্মুক্ত হয়ে পড়ারও ঝুঁকি থেকে যায়। এজন্য অতিমাত্রায় প্রেস করলেও জাভি সবসময় এমন একজন খেলোয়াড় ব্যবহার করেন, যে সরাসরি প্রেসিংয়ে অংশ না নিয়ে প্রেস করতে যাওয়া খেলোয়াড়ের ফেলে যাওয়া ফাঁকা জায়গা কভার করবে।
জাভির বার্সেলোনা সাধারণত ম্যান-টু-ম্যান প্রেসিং করে থাকে। প্রতিপক্ষের বিল্ডআপের শুরুতে অবামেয়াং সরাসরি বল বাহককে প্রেস করতে শুরু করেন৷ এসময় দুই ‘নাম্বার এইট’ পেদ্রি এবং ডি ইয়ংয়ের যেকোনো একজন প্রতিপক্ষের অপর সেন্টারব্যাককে সরাসরি ম্যান মার্ক করেন এবং অপরজন বল বাহকের সাথে মিডফিল্ডের পাসিং অপশন বন্ধ করতে চেষ্টা করে৷ দুই উইঙ্গার আদামা এবং ফেরান প্রতিপক্ষের দুই ফুলব্যাককে সরাসরি ম্যান মার্ক না করে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখেন, যাতে করে বল বাহক ফুলব্যাকের কাছে পাস দিতে বাধ্য হয়৷ তখন ফুলব্যাকের হাতে দু’টি অপশন থাকে; হয় সামনে উইঙ্গারের কাছে পাস দেওয়া, অথবা দলের মূল স্ট্রাইকার বরাবর লং পাস বাড়ানো। প্রথম ক্ষেত্রে বার্সেলোনার ফুলব্যাক সরাসরি প্রেস করে বল কেড়ে নিতে চেষ্টা করে।
যদি স্ট্রাইকার বরাবর পাস বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে বুসকেটস বলের লাইনে এসে বল ইন্টারসেপ্ট করার চেষ্টা করেন। এই মৌসুমে লিগে বুসকেটস মোট ১০৫ বার ট্যাকল এবং ইন্টারসেপশন করেছেন, যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জর্দি আলবার প্রায় দ্বিগুণ। তবে বুসকেটস যদি এরিয়াল লড়াইয়ে ব্যর্থও হন, তার আশেপাশে বার্সেলোনার একাধিক খেলোয়াড় থাকায় খুব সহজেই সেকেন্ড বল জিতে নেয়া সম্ভব হয়।
তবে বার্সেলোনার এই হাইলাইন প্রেসিং কৌশলে অনেকটা ঝুঁকি থেকে যায়। প্রেসিংয়ের সময় বুসকেটস তার পজিশন ছেড়ে অনেকটা উপরে উঠে যান। ফলে, প্রতিপক্ষ যদি কোনোভাবে বার্সেলোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় উভয় প্রেসিং লাইন অতিক্রম করে ফেলতে পারে, তবে বার্সেলোনার রক্ষণভাগ একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে; যা প্রতিনিয়তই বিপদের কারণ হচ্ছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে জাভির বার্সেলোনা তার ছন্দ ধরে ম্যাচ-বাই-ম্যাচ এগিয়ে যাচ্ছে, ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে একের পর এক সামনে আসা প্রতিপক্ষকে। সর্বোপরি, জাভির অধীনে বার্সেলোনা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বার্সেলোনার ইউরোপ-শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট খুব শীঘ্রই ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশাও বাড়াবাড়ি বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। শর্ত কেবল একটাই, জাভি আর তার দলকে সে ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বার্সেলোনাও তবে ফিরে পাবে তার সোনালী অতীত, যেখানে সমর্থকরা খুঁজে পাবে ভয়ঙ্কর সেই বার্সেলোনাকে। সেই দিনের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে গ্যালরির সিট কিংবা টিভি সেটের সামনে রোমাঞ্চ নিয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ বসে আছে বার্সেলোনার সমর্থকরা।