“শয়তানের হাতে পড়েছে ক্রিকেট”- ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের অনেক সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল এমনটাই। তখন অনেকের মনেই ভাবনা ছিল- “এই বুঝি ক্রিকেটের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে”। ক্রিকেটের ঐতিহ্য এবং ভাবাদর্শকে এক ব্যক্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। তার বৈপ্লবিক চিন্তা, আধুনিকতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ক্রিকেটের সেই সময়ের বড় বড় নেতারা। তাদের সেই গোঁ ধরা কথা, ক্রিকেটের সনাতন ধারা কিছুতেই নষ্ট করা যাবে না। সবুজ গালিচায় সাদা পোশাক পরিহিত যোদ্ধাদের গায়ে রঙিন পোশাক কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না এসব প্রাচীনপন্থীরা। সব প্রাচীনত্বকে এক লহমায় ধুয়েমুছে ভোল পাল্টে দিলেন এক ব্যক্তি, যার ছোঁয়ায় ক্রিকেট পেল নব যৌবন। এ যেন ইতিহাসের পাতায় ‘শয়তান’কেই ‘দেবতা’ হিসেবে পরবর্তীতে মেনে নেয়া। তিনি আর কেউ নন- অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ধনকুবের এবং চ্যানেল নাইনের প্রতিষ্ঠাতা ক্যারি প্যাকার। বিপ্লবী ও দূরদর্শী ভাবনার মানুষ হিসেবে তিনি ক্রিকেটে জন্ম দিয়েছিলেন এক নব অধ্যায়ের।
১৯৩৭ সালের ১৭ ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া ক্যারি ফ্রান্সিস বুলমোর প্যাকার তার বাবা স্যার ফ্রাঙ্ক প্যাকারের মতোই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী এবং সমঝদার ব্যবসায়ী। ফ্রাঙ্ক প্যাকার ছিলেন অস্ট্রেলীয় প্রচার মাধ্যমের স্বত্বাধিকারী। তিনি পরিচালনা করতেন অস্ট্রেলিয়ান কনসোলিডেটেড প্রেস ও নাইন নেটওয়ার্ক।
৩৯ বছর বয়সেই ক্যারি প্যাকার নিজেকে মিডিয়া টাইকুন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্রিকেট যে বিপন্নের মাধ্যম হতে পারে তা আগাম টের পেয়ে গিয়েছিলেন প্যাকার। আর সে লক্ষ্যেই ১৯৭৬ সালে চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্কের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট খেলার একক টিভি স্বত্ব নিতে এক বিশাল অংকের অর্থ নিয়ে নামেন প্যাকার। কিন্তু তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড চ্যানেল নাইনের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এ.বি.সি.) খেলার স্বত্ত্বাধিকার পায়। অথচ চ্যানেল নাইন কিন্তু এ.বি.সি. প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বহুগুণে যোগ্য প্রার্থী। তদুপরি ক্যারি প্যাকারের পক্ষ হতে করা প্রস্তাবের জোর বেশি হওয়া সত্ত্বেও খেলার স্বত্ত্বাধিকার না পাওয়া এবং অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন প্যাকার অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডকে একটি শিক্ষা দেওয়ার জন্য এক নতুন পরিকল্পনা হাতে নেন।
নেমে পড়লেন গোপন এক মিশনে। আইসিসি সহ বিশ্বের সব ক্রিকেট বোর্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক প্রতিযোগিতা চালুর উদ্যোগ নেন চ্যানেল নাইনের স্বত্ত্বাধিকারী ক্যারি প্যাকার। তার দুই ব্যবসায়ীক পার্টনার জন কর্নেল ও অস্টিন রবার্টসনকে দিলেন বিপ্লবী এক ক্রিকেট সিরিজ চালু করার প্রশাসনিক দায়িত্ব। বিখ্যাত ক্রিকেট ধারা ভাষ্যকার রিচি বেনোকে এই সিরিজের আইন-কানুন গড়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।
ইংল্যান্ডের তৎকালীন অধিনায়ক টনি গ্রেগকে দায়িত্ব দিলেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিখ্যাত সব পারফরমার জোগাড় করার। বিশ্ব একাদশের নেতৃত্ব দেয়ার ভারও পরে টনি গ্রেগের উপর। তারপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত প্যাকারের অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে হলো বিশ্ব একাদশের ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপ। এরপর গড়া হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলও।
প্যাকারের সেই সিরিজে খেলোয়াড়দের তালিকা ছিল সত্যিই ঈর্ষণীয়। এদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন অধিনায়ক ‘টনি গ্রেগ’, ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ‘ক্লাইভ লয়েড’, অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ‘গ্রেগ চ্যাপেল’, ‘ইয়ান চ্যাপেল’, সাবেক অধিনায়ক ‘ববি সিম্পসন’, ‘মাইকেল হোল্ডিং’, ‘অ্যান্ডি রবার্টস’, ‘রোহান কানহাই’, বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ‘স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস’, ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুই ফাস্ট বোলার ‘জেফ টমসন’, ‘ডেনিস লিলি’, পাকিস্তানের ‘ইমরান খান’, ‘আসিফ ইকবাল’, ‘জাভেদ মিয়াঁদাদ’ সহ আরও অনেক শীর্ষ ক্রিকেটার।
প্যাকারের এই সিরিজ নিয়ে আইসিসি সহ সব ক্রিকেট বোর্ডের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেলো। এই সিরিজকে বিভিন্ন বোর্ড ‘প্যাকার সার্কাস‘ হিসেবে অভিহিত করলেও খেলোয়াড়দের এই সিরিজে নাম লেখানোর উৎসাহে কোনোরকম কমতি ছিল না। তার কারণও ছিল বটে। ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট খেলে খেলোয়াড়রা যে অর্থ আয় করেছিলেন তা তাদের জীবনে নিয়ে এসেছিল আমূল এক পরিবর্তন। ১৯৭৭ সালে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের সাথে ২০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের যে চুক্তি হয় তা তখনকার সময়ে দেশটির গড় আয়ের ৪০ গুণ বেশি। আধুনিক ক্রিকেটে পেশাদারিত্ব বা অর্থবিত্তের হাতছানির শুরুটাও হয়েছিল এই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে। ক্রিকেটাররা আর্থিকভাবে নিজেদেরকে সাবলম্বী ভাবতে শুরু করেন এরপর থেকেই।
যদিও অনুমোদনহীন এই প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর কারণে টনি গ্রেগসহ প্রায় সব খেলোয়াড়কেই আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু পরে অবশ্য ইংল্যান্ড ছাড়া বাকি সব দেশই তাদের ক্রিকেটারদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
আই.সি.সি.’র শত বাধা অতিক্রম করে যখন এই মাঠে নামার সময় হলো তখনই ঘটলো আরেক বিপত্তি। এই সিরিজের জন্য কোনো ক্রিকেট মাঠ পাওয়া যাচ্ছিল না। অদম্য প্যাকার তখন একটি ফুটবল মাঠকে ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত হিসেবে তৈরি করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। তবে শর্ত হলো ফুটবল মাঠের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। ব্রিসবেনের গাব্বার অভিজ্ঞ কিউরেটর জন ম্যালেকে বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পিচ তৈরির দায়িত্ব দেয়া হলো। তৈরি করা হলো ‘ড্রপ ইন পিচ‘। পিচটি তৈরি করা হয় অন্যত্র।
খেলা শুরুর আগে ক্রেনের সাহায্যে পিচটি মাঠে স্থাপন করা হতো। দর্শকদের কথা বিবেচনা করে আর ক্রিকেটে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত হয় দিনের বেলা খেলা আয়োজনের পরিবর্তে দিবা-রাত্রি ম্যাচ আয়োজনের, ক্রিকেটারদের সাদা পোশাকের পরিবর্তে রঙিন পোশাকের সাথে যুক্ত হলো রঙিন বল, কালো সাইট স্ক্রিন, ব্যাটসম্যানের হেলমেট, আর ১৩টি ক্যামেরা দিয়ে জমকালো টিভি সম্প্রচার ।
এসব কিছুই ছিল ক্রিকেটের প্রাচীনত্বকে ভেঙে ফেলে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করার এক নব আয়োজন। প্রথম দিকে দর্শক টানতে না পারলেও খেলোয়াড়দের অসাধারণ সব পারফরম্যান্স ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ। তার ফলে ঢল নামতে থাকে দর্শকদের। মাত্র দু’বছর অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল ঐ ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট, পরবর্তীতে যা নাড়িয়ে দেয় পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। ক্রিকেটের পরিবর্তন মেনে নিতে না পারা আইসিসি ও বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাদের স্তম্ভিত করে দেয় ওয়ার্ল্ড সিরিজের ব্যবহৃত ক্রিকেটের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এ প্রসঙ্গে টনি গ্রেগ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ৮০-এর দশকে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচ খেলে ইংলিশ ক্রিকেটাররা পেতেন মাত্র ২১০ পাউন্ড। এই ব্যাপারটা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর ছিল। বোর্ডের অনেকেরই মানসিকতা ছিল এরকম যে, দেশের হয়ে খেলাটাই অনেক সম্মানের ব্যাপার। টাকা-কড়ি কোনো ব্যাপার না। সেই প্রচলিত মানসিকতায় একটা আঘাত দেয়ার দরকার ছিল। ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে আয় করা আর তার বিভিন্ন উৎসমূলের খোঁজ করার জন্য দরকার ছিল এক বিপ্লবের। ক্যারি প্যাকার আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ ছিল তেমনি এক বিপ্লব।
কেরি প্যাকার নিজেও বলেছিলেন, তার এই বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়ে উঠবে আরো আকর্ষণীয়। সত্যিই কি তা-ই হয়েছে?
সাংবাদিক প্যাট মার্ফি বলছিলেন, ক্রিকেটাররা এখন অনেক বেশি ফিট, এ্যাথলেটিক এবং দারুণ ফিল্ডার। তারা এখন অনেক বেশি ধনী। বিপণনও এখন অনেক উন্নত। গিডিয়ন হেইগের কথায়, অবশ্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এখন অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। টেলিভিশনই এখন ক্রিকেটের চালিকাশক্তি। ১৯৭৭ সালের আগে কেউই্ এ সম্ভাবনার কথা উপলব্ধি করেনি। এটা ঠিক যে কেরি প্যাকার এর সুবিধা নিয়েছেন – কিন্তু এরপর থেকে ক্রিকেট খেলা চিরতরের জন্য বদলে গেছে।
১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু অ্যাশেজ। দুর্বল অস্ট্রেলিয়া দল সিরিজ হারলো ইংল্যান্ডের কাছে। একদিকে দল দুর্বল হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে প্যাকার সিরিজের জনপ্রিয়তায় অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট এবং বোর্ডের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নেমে পড়লেন সন্ধি প্রস্তাবে। ১৯৭৯ সালে দুই পক্ষের সমঝোতায় শেষ হলো সিরিজ, কেরি প্যাকার পেলেন টিভি স্বত্ব।
ওয়ার্ল্ড সিরিজ শেষ হয়ে গেলেও বিপ্লব কিন্তু ঘটে গেছে তত দিনে। পুরনো মানসিকতায় ক্রিকেটকে আর আটকে রাখা যাবে না। দিন-রাতের খেলা, রঙিন পোশাক-এসবই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর নিয়ামক। কেরি প্যাকারের দারুণ উদ্ভাবনী ক্ষমতায় আমূল বদলে গেল ক্রিকেট, যার সুবাদেই ক্রিকেটের আজকের এ ঝলমলে চেহারা। আর এভাবেই এ ব্যবসায়ী অমরত্ব পেয়ে গেলেন ক্রিকেট ইতিহাসে।
ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার ইতিহাস বলতে হলে ক্যারি প্যাকারকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বর্তমান ক্রিকেটের এই যে বাণিজ্যিক সাফল্য, সাদা বল ও রঙিন পোশাকের ওয়ানডে ম্যাচ, দিবারাত্রির ম্যাচ, বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট লিগের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তার সবই ক্যারি প্যাকারের অসাধারণ ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে উদ্ভূত।
আর তাই তো, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে ক্রিকেটকে বদলে দেয়া কেরি প্যাকার যখন এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তখন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তার শোকে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছিল। আর এ উদ্যোগ ছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কর্তৃপক্ষেরই। এভাবে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব না হয়েও ক্রিকেটের যুগ পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো এক প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবসায়ীকে।
ফিচার ইমেজ: The Cricket Monthly