রবার্ট মিলার, নাম শুনেই ভদ্রলোককে আপনার চিনতে পারার কোনো কারণ নেই। জাতে ব্রিটিশ এই ভদ্রলোক এমন কিছু করেননি যে, আপনার তাকে চিনতেই হবে। তবে, আপনি যদি ফুটবল ভক্ত হয়ে থাকেন, আরও নির্দিষ্ট করে ব্রাজিল ফুটবল দলের ভক্ত, আপনার কাছে তার একটি স্যালুট পাওনা রইল। যে দেশে বসেছে কোপা আমেরিকার ৪৬-তম আসর, সে দেশে ফুটবল নামক খেলাটিকে চিনিয়েছিলেন রবার্ট মিলারই, ১৮৯৩ সালে।
ব্রাজিলে কোপা আমেরিকার আসর বসেছে বলেই ওনার কথা এল, নইলে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ইতিহাস তো আরও কয়েক বছর পুরনো। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ইতিহাসের সে গল্প নাহয় আরেকদিন হবে। যে শিরোনাম দেখে আপনি এই লিংকে ক্লিক করেছেন, আজ শুধু সেই গল্পই হোক, দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, কোপা আমেরিকার আদ্যোপান্ত জানা হোক।
১.
দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম ফুটবল ক্লাব ‘লিমা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা পায় ১৮৫৯ সালে, শহরের ইংরেজদের হাতে৷ পেরু থেকে ফুটবলটা সে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতই, আর্জেন্টিনায় ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৭ সালে, ওই ব্রিটিশদের হাতেই। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ইতিহাসে যাকে দেখা যেতে পারে এক মাইলফলক হিসেবে। কেননা, ফুটবলটা আর্জেন্টিনায় এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে, ১৮৯৩ সালে এক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনই প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে হয় আর্জেন্টিনার ফুটবল সংশ্লিষ্টদের। দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে যা ছিল প্রথম কোনো ফুটবল সংগঠন। সে বছরই আর্জেন্টিনায় মাঠে গড়ায় প্রথম ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। ফুটবলের দর্শকপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে, কেবল খেলার গণ্ডি ছাপিয়ে ফুটবল তখন আর্জেন্টাইনদের জীবনেরই এক অংশ।
২.
সালটা ছিল ১৯০৯। উপলক্ষ হিসেবে হাজির হয় ‘মে-বিপ্লবের’ শতবর্ষপূর্তি। ফুটবলকে জীবনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জুড়ে দিতে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবেশী দেশ উরুগুয়ে আর চিলিকে নিয়ে আয়োজন করে এক ফুটবল টুর্নামেন্টের, যার নাম দেয়া হয় ‘কোপা সেন্টেনারিও রেভ্যুলেশন ডি মায়ো’। কেবল দক্ষিণ আমেরিকা নয়, বিশ্ব ফুটবলেই এমন প্রতিযোগিতা এর আগে দেখেনি। ১ শহরের ২ মাঠে অনুষ্ঠিত, ইতিহাসের প্রথম সেই আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে শিরোপা জয় করে আর্জেন্টিনা, যদিও পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল সংগঠন ‘কনমেবল’ ওই প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।
স্বীকৃতি না দিলে কী হবে! যে উদ্দেশ্যে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ওই টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিল, সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। জনমানুষের মাঝে ফুটবল ছড়িয়ে গিয়েছিল আরও ব্যাপকভাবে, আর্জেন্টিনাও সাহস পেয়েছিল আরও বড় পরিসরে টুর্নামেন্ট আয়োজনে।
ওই টুর্নামেন্টের সাত বছর পরে আবারও আয়োজন করা হয় আরেকটি ফুটবল টুর্নামেন্টের, আয়োজক ছিল আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনই; উপলক্ষ, স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন। বিগতবারের তিন দলের সাথে নতুন দল হিসেবে যুক্ত হয় ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের নামটিও রাখা হয় বাহারি, Campeonato Sudamericano de Football, পরবর্তীতে যে টুর্নামেন্টই স্বীকৃতি পায় কোপা আমেরিকার প্রথম আসর হিসেবে।
৩.
২ জুলাইয়ের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিলো উরুগুয়ে বনাম চিলি, যে ম্যাচে ৪-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল উরুগুয়ে। শুরুর মতো শেষ হাসিটাও হেসেছিল উরুগুয়ে। রাউন্ড রবিন লিগের সে আসরে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল উরুগুয়ে। সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন উরুগুয়েরই ইসাবেলিনো গ্রাডিন। স্বাগতিক দেশ আর্জেন্টিনা হয়েছিল রানার্সআপ।
৪.
এক বছরের ব্যবধানে আবারও আয়োজিত হয় কোপা আমেরিকা। আর্জেন্টিনার বদলে দ্বিতীয় আসর বসে উরুগুয়েতে, শিরোপাভাগ্যে অবশ্য বদল আনতে পারেনি কোনো দলই, উরুগুয়েই পরে বিজয়ের মালা, ২য় বারের মতো।
পরের বছর ব্রাজিলে কোপা আমেরিকা অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে তা পিছিয়ে যায় এক বছর, আয়োজিত হয় ১৯১৯ সালে। প্রথম দুই আসরে চলা রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতির সাথে সাথে প্রথমবারের মতো ফাইনালের প্রবর্তন করা হয় সেবারের আসরে। রিও ডি জেনিরোর এস্তাদিও দাস ল্যারেঞ্জাইসে অনুষ্ঠিত হওয়া সে ফাইনালে উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্বাগতিক ব্রাজিল। তবে ব্রাজিলের শিরোপা জয় ছাপিয়ে আলোচিত হয় উরুগুয়ের গোলরক্ষক রবার্তো চেরির মৃত্যুর খবর। সে আসরেই চিলির বিপক্ষে ম্যাচে পাওয়া ইনজুরিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই গোলরক্ষক।
৫.
মাঝের ১৯১৮ সালটাই যা ব্যতিক্রম, নয়তো ১৯২৯ সাল অব্দি কোপা আমেরিকার আয়োজন করা হয়েছিলো প্রতি বছরই। প্রতিবারই দলও ছিল চারটি। প্রথম আসরের চার দলের বাইরে তখন অব্দি কোপা আমেরিকা খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল প্যারাগুয়ে, পেরু আর বলিভিয়া। ১৯২৯ সালের পর প্রথমবারের মতো দীর্ঘ বিরতিতে যায় কোপা আমেরিকা, ১৯৩০ বিশ্বকাপ ফুটবলের সূত্র ধরে আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের দ্বন্দ্বের জেরে। উরুগুয়ের কাছে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে ৪-২ ব্যবধানে পরাজয়ের পর আর্জেন্টিনা দাবি করে, উরুগুয়ের ফুটবল সংশ্লিষ্টরা তাদের খেলোয়াড়দেরকে ফাইনালের আগে হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন। দুই দেশের ফুটবলীয় সম্পর্কও তাই স্থবির হয়ে পড়ে বেশ কয়েক বছরের জন্যে।
ছয় বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৩৫ সালে পেরুতে আবার আয়োজন করা হয় কোপা আমেরিকার, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোপা আমেরিকা চালু হতে সময় লেগেছিল আরও চার বছর। মাঝে ১৯৩৭ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত হওয়া কোপা আমেরিকায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিলো ছয় দেশ।
৬.
১৯৪১ সালের কোপা আমেরিকা আয়োজিত হয়েছিল চিলিতে, চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপনে। অবশ্য কোনো বিশেষ উপলক্ষে কোপা আমেরিকার আয়োজনের সেটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। কোপা আমেরিকার শুরুটাই তো আর্জেন্টিনার স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করতে। ১৯৪১ সালের পরও বিশেষ উপলক্ষে কোপা আমেরিকা আয়োজিত হয়েছে বেশ ক’বার। যার সর্বশেষ উদাহরণ, ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার শতবর্ষ উদযাপনের জন্যই এক কোপা আমেরিকার আয়োজন করা।
৭.
এমন মর্জিমাফিক আয়োজনের দায়স্বরূপ দুই কোপা আমেরিকার মাঝে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধান রক্ষা করা হয়েছে খুব কমবারই। ১৯৪১ সালের পরবর্তী আসর বসেছিলো এর পরের বছরই। আবার ১৯৪২ পরবর্তী আসর বসেছিল ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৫, ১৯৪৬, ১৯৪৭ সালে আয়োজিত কোপা আমেরিকায় প্রতিবারই জয়ী দলের নাম ছিল আর্জেন্টিনা, কিন্তু ট্রফি ক্যাবিনেটে পাওয়া যাবে কেবল ১৯৪৭ কোপা আমেরিকার ট্রফি, বাকি দুই আসরকে যে কনমেবল প্রথমে স্বীকৃতিই দিতে চায়নি! কোপা আমেরিকাও সে সময়টায় হয়ে পড়েছিলো অনিয়মিত, আবার কখনো বা এক বছরে দু’বার আয়োজনেরও কীর্তি হয়েছিল তখন। আবার আয়োজন করলেই যে সবগুলো দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, তেমনও ছিল না। ভেনেজুয়েলা ব্যতীত বর্তমানে কনমেবলভুক্ত বাকি নয় দেশ কনমেবলের আওতায় এসেছিল ১৯৩৬ সালের মাঝেই, কিন্তু কনমেবলের অধীন মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসর কোপা আমেরিকায় অংশ নিতে যেন তাদের ছিল ঘোর আপত্তি। কখনো বা দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েও তারা দায় সেরেছে। প্রথমবারের মতো কোপা আমেরিকায় সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। সেটাও বোধহয় সম্ভব হয়েছিল টুর্নামেন্টের ফরম্যাটের কারণে। কোনো নির্দিষ্ট দেশে টুর্নামেন্ট আয়োজন না করে সেবার খেলা হয়েছিলো হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। ১৯৭৫ সালের কোপা আমেরিকাকেই অবশ্য সত্যিকার অর্থে কোপা আমেরিকা বলা যায়৷ এর আগের ২৯ আসরের নাম ছিল সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ। ৩০তম আসরেই যার নাম বদলে হয় ‘কোপা আমেরিকা।’
৮.
সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা না থাকায় টুর্নামেন্টের ফরম্যাটেও পরিবর্তন এসেছে বারবারই, কোনোবার খেলা হয়েছে লিগভিত্তিক, কোনোবার বা রাউন্ড রবিন লিগের সঙ্গে রাখা হয়েছিল ফাইনাল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৭ সালের মাঝে হওয়া চার আসরে তো বিগতবারের চ্যাম্পিয়নরা সরাসরি খেলেছে সেমিফাইনালে। দক্ষিণ আমেরিকার দর্শকদের যে এমন অব্যবস্থাপনায় কোনো আপত্তি ছিল না, সে তো ওই অঞ্চলে ফুটবলের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে।
৯.
১৯৮৭ সালের আসরেই কনমেবল প্রথমবারের মতো দলগুলোকে গ্রুপে ভাগ করে, সেবারের আসরে অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল না। বিগতবারের চ্যাম্পিয়নদের পাওয়া অতিরিক্ত সুবিধাও কেটে নেয়া হয় সে টুর্নামেন্টের পরই। ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকায় প্রথমবারের মতো দেখা যায় মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রকে, যারা আদতে কনমেবলের অধীনে নয়। সেই থেকে প্রতিবারই কোপা আমেরিকার নিয়মিত সদস্য হিসেবে পাওয়া গিয়েছে মেক্সিকোকে, সাথে সুযোগ পেয়েছে আরও বেশ কিছু দেশ। সেই থেকে এখন অব্দি চলছে বারো দলের কোপা আমেরিকাই। এর মাঝেও অবশ্য ব্যত্যয় ঘটেছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত শতবর্ষের কোপা আমেরিকায় দল বেড়েছিল আরও চারটি।
১০.
এক আসরে সবচেয়ে বেশি ৯১ গোল হয়েছে গত আসরেই। দা রোজা পিন্টো, হামবার্তো মাসচিও আর হাভিয়ের আম্ব্রোইস, এক আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি অবশ্য তিনজনের দখলে। শেষোক্ত দু’জন আর্জেন্টাইন, ১৯৫৭ সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে যৌথভাবে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের রেকর্ডটিও আর্জেন্টিনার দখলে। কোপা আমেরিকার ৫০০ গোল ছোঁয়ার ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ১২-০ গোলে। এমন গোলবন্যার ম্যাচের পরও ম্যাচপ্রতি গোলসংখ্যায় অবশ্য ১৯২৭ সালের আসরকে ছাড়াতে পারেনি ১৯৪২ সালের কোপা আমেরিকা। ১৯২৭ সালের আসরে ৬ ম্যাচেই গোল হয়েছিল ৩৭টি, ম্যাচপ্রতি ৬.১৭টি করে।
এবারের আগে হওয়া ৪৫ আসরের ২৯ বারই শিরোপা ভাগাভাগি করেছে উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনা। সবচেয়ে বেশি ৪৩ আসরে কোপা আমেরিকায় অংশ নিয়ে ১৫ বার শিরোপা জিতে উরুগুয়েই আছে সবার ওপরে, আর্জেন্টিনাও নিঃশ্বাস ফেলছে উরুগুয়ের ঘাড়ে। সর্বোচ্চ ২৮ বার ফাইনাল খেলে জিতেছে এর অর্ধেক ম্যাচে। ১৪ বার ফাইনাল হারলেও সর্বোচ্চ ১২৮ কোপা ম্যাচ জয় করেছে আর্জেন্টিনাই। সবচেয়ে বেশি ১০ বার কোপা আমেরিকা আয়োজন করার রেকর্ডটিও আছে আর্জেন্টিনার দখলে।
২০১৯ সালে ব্রাজিলে বসেছে কোপা আমেরিকার ৪৬তম আসর। অবশ্য বিজোড় বছরে এবারই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শেষ কোপা আমেরিকা, আগামী বছরেই আবার এক কোপা আমেরিকা আয়োজন করে যা বদলে ফেলা হবে জোড় সংখ্যায়। তবে অতীত ইতিহাস মনে রাখলে আয়োজকদের এমন ভাবনার ওপর খুব বেশি ভরসা রাখা যায় না।
তবে আয়োজনটা যখন লাতিন আমেরিকান ফুটবলের, বিগত বারগুলোর মতো ধ্রুপদী, নান্দনিক আর শৈল্পিক ফুটবলের প্রত্যাশা রাখাই যায়।