ক্লাসিক্যাল দাবার ১৪তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির বরিসোভিচ ক্রামনিক ২০১৯ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্লাসিক্যাল দাবা থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। দুই দশক ধরে ফর্মের চূড়ায় থাকা অবস্থায় গ্যারি ক্যাসপারভ, পিটার লেকো, ভেসেলিন তোপালভ, এবং বিশ্বনাথন আনন্দের সাথে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে লড়েছেন ‘দ্য বিগ ভ্লাদ’। নিজের সেরা দিনগুলোতে ক্রামনিক ছিলেন প্রায় অজেয়, কিন্তু তার অর্জনগুলো বাকিদের থেকেও একটু বেশিই অনন্য।
কেননা তাকে যে লড়তে হয়েছে তার শারীরিক নানান জটিলতার সাথেও, মাসের পর মাস খাবার খেতে পারেননি এমন সময়ও কেটেছে এই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিল ভ্লাদের সময়কাল, কদর্য দাবা রাজনীতির ছোবলও সামাল দিতে হয়েছে তাকে। চেস ডট কমের ডেভিড কক্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্লাদ এই সবকিছু নিয়েই কথা বলেছেন। আজ থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
ডেভিড কক্স: ২০০৫ সাল থেকে আপনি অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস নামক এক প্রকার আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন, এটা ক্যারিয়ারে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
ভ্লাদিমির ক্রামনিক: পিটার লেকোর সাথে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের পর আমার শরীর একবারে বাজে যাচ্ছিল, এরপর আর্থ্রাইটিস আক্রমণ করল ২০০৫-এ, সব মিলিয়ে দাবার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বদলে দিয়েছে। রোগটা ছিল জেনেটিক, আমার ভাই এবং মায়েরও ছিল এই রোগ। অস্থিসন্ধিতে অস্বাভাবিক ব্যথার সৃষ্টি করত, দিনে চারটা পর্যন্ত পেইনকিলার নিতে হয়েছে আমার। পায়ের পাতা, হাঁটু, কনুইয়ের সাথে চোয়ালে পর্যন্ত তীব্র যন্ত্রণা হতো। এমনকি ১৫ কেজি ওজন হারিয়েছিলাম, কেননা কোনো শক্ত খাবার খেতে পারতাম না। পাউরুটি পর্যন্ত চিবোতে পারতাম না, শুধু তরল খাবার আর ফলের জুসের উপর জীবন কাটাচ্ছিলাম।
আমাকে এমনও কিছু ওষুধ দেয়া হয়েছিল যা ক্যান্সারের রোগীকে দেয়া হয়। ইমিউন সিস্টেমকে জাগ্রত করার জন্য এসব করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল, এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর রক্ত পরীক্ষা করতে হতো এটা নিশ্চিত করতে যে অন্যান্য অঙ্গে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েনি। সপ্তাহে একদিন ওষুধ নিতে হতো, সেদিন মনে হতো আমার শরীরে কেউ হাতুড়ি চালাচ্ছে। তবে সৌভাগ্যজনকভাবে ছ’মাস পর আমি বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই সুস্থ হয়ে উঠি।
সুস্থ হবার মুহূর্তে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করেছিল। যখন সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম, জীবনের অন্য এক অর্থ ধরা দিলো। অবচেতন মস্তিষ্কেই মনে হলো, দাবা জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। এখন আমি রুটি-সালাদ খেতে পারছি, চিবোতে পারছি – জীবনটা অর্থপূর্ণ হওয়া শুরু করলো আবার। এখানে-সেখানে হালকা ব্যথা ছিল, কিন্তু সেই ২০০৫-এর পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বড় সমস্যা আর হয়নি।
কক্স: ২০০৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ভেসেলিন তোপালভের সাথে আপনার ম্যাচটি বিতর্কিতভাবে শেষ হয়েছিল। আজ এতদিন পরে সেই ম্যাচের দিকে ফিরে তাকালে আপনি কী দেখতে পান?
[কোনো প্রমাণ না পাওয়া স্বত্বেও তোপালভের ম্যানেজার দাবি করেন, ক্রামনিক গেম চলাকালীন সময়ে বাইরের কারও সহায়তা নিয়েছিলেন টয়লেটে গিয়ে। এটি তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে এতটা বাজে প্রভাব ফেলে যে, এরপর থেকে তারা কখনও করমর্দন করেননি!]
ক্রামনিক: হ্যাঁ, আমরা এখনও হাত মেলাই না। সে আসলে নিজের ভাবমূর্তিই নষ্ট করেছে, আরও বৃহদার্থে বলতে গেলে দাবার মর্যাদাই কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে আমার দিক থেকে আমি কোনো ভুল করিনি, না আইনত, না নৈতিকভাবে। যদিও অভিযোগটা সে নয়, তার ম্যানেজার করেছিল। তবুও আপনি সাবালক হলে আপনার টিমের কাজের দায় নিজের ঘাড়ে নিতে হবে। সে যদি একবার বলত, “যাই হোক কাজটা আমরা ঠিক করিনি এবং আমরা দুঃখিত” – তবে বিষয়টা হয়তো এখনকার মতো এতটা তিক্ত হতো না। কিন্তু না, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হবে কিছুই হয়নি এবং সে ঐ বিষয়ে খুশিই।
সৌভাগ্যবশত, তার কৌশল কাজে লাগেনি এবং ম্যাচটা আমিই জিততে পেরেছিলাম শেষ পর্যন্ত। একটা বিষয় পরিষ্কার করি, ব্যক্তি তোপালভের সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তবে একটা মানুষ যে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এমন কাজও করতে পারে তার প্রতি পেশাগত কোনো শ্রদ্ধাবোধ রাখা যায় না। সে অসাধারণ দাবাড়ু কোনো সন্দেহ নেই, আমি অস্বীকারও করি না। কিন্তু আমি শুধু তাকে মন থেকে শ্রদ্ধাটা করতে পারি না এত সব ঘটনার পর।
কক্স: ২০০৮ চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বনাথন আনন্দের সাথে হেরে আপনার চ্যাম্পিয়নশিপকালের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেবার কী ঘটেছিল আপনার সাথে?
ক্রামনিক: সেবার আনন্দ ছিল বলতে গেলে সবদিক থেকে আমার থেকে ভালো। আমি ছিলাম স্লো, আমি বুঝতে পারছিলাম যে দাবা নিয়ত বদলাচ্ছে। আনন্দ প্রিপারেশনে অনেক জোর দেন, বিশেষ করে কম্পিউটার প্রিপারেশনে। কম্পিউটার প্রিপারেশনে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি। এবং ম্যাচের মাঝ বরাবর গিয়ে আমি বুঝতে পারি, খেলা শেষের পথে।
ভিশি (বিশ্বনাথনকে সংক্ষেপে ভিশি) আসলেই একজন অসাধারণ খেলোয়াড়, তদুপরি তখন সে ছিল ফর্মের চূড়ায়। পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিলেও তার সাথে আমি জিততাম কি না সন্দেহ। তবে আমার অন্তত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো, যে হার্ড ফাইটটা আমি দিতে পারিনি। এ কারণে টুর্নামেন্টের মাঝে গিয়ে একবার আমার মনে হয়েছিল আয়োজক আর ভক্তদের সাথে আমি এক প্রকার প্রতারণাই করে ফেলেছি। তবে একদিন না একদিন তো আমার সময় শেষ হবারই ছিল, সারাজীবন কেউ চ্যাম্পিয়ন থাকে না। রাজমুকুট হস্তান্তরের জন্য আনন্দের থেকে উপযুক্ত কেউ ছিল বলে আমার মনে হয় না!
কক্স: বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে অনেক টালমাটাল দিন কাটিয়েছেন আপনি, বিশেষ করে দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ এক করতে (রি-ইউনিফিকেশন) বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেসব ভাবলে কি এখন কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগেন?
ক্রামনিক: এটা কঠিন এক সময় ছিল, তখন আমি ছিলাম সদ্য তরুণ। ভাবতে অবাক লাগে এতদিন পর এসে সেই দিনগুলোর কথা। তবে অহংকারী শোনাতে পারে, কিন্তু আজকের যে স্থিতাবস্থা, চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেল থেকে শুরু করে সবকিছু যে নিয়মের মধ্যে চলছে, এটার অন্যতম কৃতিত্বও আমার। কোনো ব্যক্তিবিশেষকে দোষ দিতে চাই না, তবে নব্বইয়ের দশক থেকেই দাবার দুনিয়ায় বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব ঘটেছিল। বছরে মাত্র চারটা মেজর হতো, চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেল ভেঙে পড়েছিল, ইত্যাদি। আর তখন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমার জন্য জরুরি ছিল সবকিছু একটা কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসা। হ্যাঁ, অবশ্যই কাজটা সহজ ছিল না, এত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে যা বলার মতো না। তবে এত কিছুর পরও আমি খুশি, কারণ আমার কাজটা আমি করতে পেরেছি। কালকে যদি দশটা পত্রিকাও ছাপে যে ‘ক্রামনিক নির্বোধ’, তাতেও আমি বিন্দুমাত্র টলে যাব না। কারণ, আমার পজিশন থেকে ঠিক কাজটাই আমি করেছি।
কক্স: দাবা-দুনিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন মনে হয় আপনার? আগামী বছর ম্যাগনাস কার্লসেন তার টাইটেল ডিফেন্ড করবেন, আর ড্র নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে যে প্রচুর ড্র হয় ক্লাসিক্যাল গেমে। সে হিসেবে ম্যাচের গেমসংখ্যা ১৮-২০ পর্যন্ত বাড়ানো যায় কি না, এ ব্যাপারে কথা বেশ চাউর। আপনার কী মনে হয়?
ক্রামনিক: এখনকার দিনের দাবা আদতেই অনেক বদলেছে, অনেকটা। সে হিসেবে ম্যাচে গেমসংখ্যা বাড়ানো অনেক কঠিন, কারণ প্রিপারেশনে অনেক ঘাম ঝরাতে হয় দাবাড়ুদের। আমার প্রথম লিনারেস টুর্নামেন্টের কথা মনে পড়ে, তখন চেস ইঞ্জিন ডেভেলপই করেনি। আমার প্রিপারেশন ছিল ১.৫-২ ঘণ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর এখন প্রতিযোগীদের দিনে ১৬-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটতে দেখা যায়। সেই নিরিখে ২০ গেম হলে তো আমার মনে হয় শেষমেশ তারা প্রিপারেশনের চাপে হসপিটাইলাইজড হতে বাধ্য হবে!
খেলা চলে গেছে চেস ইঞ্জিনগুলোর হাতে, প্রচুর মুভ মেমোরাইজ করতে হয় দাবাড়ুদের। তবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপকে চমকপ্রদ করার একটা উপায় কিন্তু ইতঃমধ্যেই সামনে এসেছে। তা হলো: পুরো ম্যাচের আগেই একটা টাইব্রেক হবে। তারপর ম্যাচটা যদি ড্র হয়, তবে জয়ী নির্ধারণ করবে সেই শুরুতে খেলা টাইব্রেক। এতে হবে কি, ম্যাচের প্রতিটা গেমেই উভয় পক্ষই জয়ের পাল্লা ভারি করতে চাইবে। দারুণ এই আইডিয়াটা ফিদে পরবর্তী ম্যাচেই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তবে কোনো একটা কারণে তা থেকে সরে এসেছে।
কক্স: প্রিপারেশনের অমানবিক পরিশ্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়েই কি এত দ্রুত দাবা ছাড়লেন?
ক্রামনিক: না, আসল কারণটা অন্য। ২০১৮ ক্যান্ডিডেটসে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলি। কিছু সাহসী মুভ, কিছু অসাধারণ চেষ্টা, নিজের সবটুকু নিংড়ে দেয়া – এসবের পরও যখন জিততে পারলাম না, আমার মনে হল খেলাটার প্রতি আসলে আমার আর দেয়ার কিছু অবশিষ্ট নেই। এটা খুব ইমোশনাল একটা সিদ্ধান্ত ছিল। আর দাবার সাথে আমার দর্শনটাই এমন ছিল যে, যদ্দিন মন টিকবে ততদিন খেলে যাব। শুধু টাকার জন্য খেলবো – এটা আমার সাথে কখনই যায় না। সেজন্যই মুভ অন করে ফেললাম।
কক্স: এখন আগামীর জন্য কী ভাবছেন?
ক্রামনিক: সবসময়ই আমি এমন সময়ে দাবা ছাড়তে চেয়েছি যখন অন্য কিছু করার শক্তি, ধৈর্য্য, আর মনোযোগ অবশিষ্ট থাকে। সে কারণেই ষাটে গিয়ে অবসর নিইনি, যখন শুধুই অখণ্ড অবসর নেবার সময়। এখন নতুন করে পুর্ণোদ্যমে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনে আগাবার অপেক্ষা। দাবা ক্যারিয়ারে অনেকের সাথেই আমার যোগাযোগ ছিল, সেসব নিয়ে এখন কাজ করার ইচ্ছা আছে। অনেক সম্ভাবনাময় প্রোজেক্ট, ব্যস্ত শিডিউলে পড়ে যাব – যা দেখছি। বলা যায় না, ভূতপূর্ব দাবার ক্যারিয়ার থেকে এখনকার ক্যারিয়ারই বেশি ব্যস্ত হয় কি না!