প্রিয় ৮ বছর বয়সী রোনালদিনহো,
কাল তুমি মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে দেখবে, ঘরভর্তি নানান মানুষের আনাগোনা। রান্নাঘর অব্দি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছাড়াও এমন সব অপরিচিত মুখ, যাদের আগে কখনোই দেখনি।
প্রথমে হয়তো ভাববে, বড় ভাই রবার্তোর ১৮তম জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে পার্টি ছিল, আর তুমি ফিরতে দেরি করে ফেলেছো।
রোজ খেলা থেকে বাড়ি ফিরে দেখো মায়ের সদাহাস্য মুখ। কিন্তু কাল তুমি দেখবে তার অশ্রুসিক্ত চোখ।
তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে দেখে রবার্তো এগিয়ে আসবে। একান্তে কিছু কথা বলার জন্য জড়িয়ে ধরে বাথরুমের কাছে নিয়ে সে যা বলবে, তার কিছুই তোমার মাথায় ঢুকবে না।
“একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের বাবা আর নেই”।
ভাইয়ের কথাগুলোর কোনও অর্থ খুঁজে পাবে না তুমি, নেই মানে কী! কবে ফিরবেন! এভাবে কোথায় গেলেন তিনি!
এই বাবাই তোমাকে বলতেন, মাঠে ফুটবল পায়ে তুমি অনন্য। বলতেন- নিজের খেয়াল খুশিমতো খেলতে, শুধু বলটার সাথে খেলতে। তোমার উপর মানুষটার অনেক আস্থা ছিল। গত বছর রবার্তো যখন গ্রেমিওতে পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করলো, তিনি তখন বলেছিলেন,
“রবার্তো ভালো খেলে, তবে ওর ছোটটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।”
বাবা ছিলেন একজন সুপারম্যান। তিনি ফুটবল এতটাই ভালোবাসতেন যে, সপ্তাহজুড়ে জাহাজের কারখানায় হাড়ভাঙা খাটনির পর ছুটির দিনটাতেও গ্রেমিও’র স্টেডিয়ামে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব নিতেন। এরকম একটা মানুষ আবার নেই হয়ে যায় কীভাবে? রবার্তোর কথাগুলো তোমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে।
প্রিয়জন হারানোর বেদনা সেদিন তোমাকে ছুঁতে পারবে না, সেগুলো ঝাঁক বেঁধে পরে আসবে। তবে কয়েক বছর পর ব্যাপারটি তুমি মেনে নিতে শুরু করবে। বাবা আর কখনো ফিরবেন না বটে, তবে যখনই তোমার পায়ে বল আসবে, মনে রেখো তিনি তোমার সাথেই আছেন।
যতক্ষণ তোমার পায়ে বল থাকবে, ততক্ষণ তুমি মুক্ত পাখির মতো। তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। অনুভূতিটা ঠিক পছন্দের গান শোনার মতো। আর সেই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে তুমি চাইবে, নিজের ভেতরের সুখটুকু বাকি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে।
ভাগ্য ভালো যে, রবার্তোর মতো ভাই ছিল তোমার। একে তো বয়সে ১০ বছরের বড়, তার উপর গ্রেমিওতে খেলে; তবুও সে তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকবে। স্রেফ বড়ভাই নয়, সে তোমাকে বাবার মতো করে আগলে রাখবে। একসময়, সে-ই হবে তোমার হিরো।
তুমি তার মতো খেলতে চাইবে, তার মতো হতে চাইবে। গ্রেমিওতে তুমি যুবদলের হয়ে খেলবে আর রবার্তো খেলবে মূল দলে। রোজ সকালে তোমার সুপারস্টার বড় ভাইয়ের হাত ধরে লকার রুমে ঢুকবে। এবং রাতে ঘুমোনোর আগে ভাববে, “আমি আমার আইডলের সঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকি।”
ছোট একটি টিভি ছাড়া তোমাদের দুই ভাইয়ের রুমে কোনো পোস্টার নেই। টিভি থাকা বা না থাকাতে অবশ্য কিছু যায় আসবে না, কারণ তোমাদের একসাথে টিভি দেখার সময়ই মিলবে না। রবার্তোর যখন শহরের বাইরে কোনো ম্যাচ থাকবে না, সে তোমাকে নিয়ে ফুটবল খেলতে বেরিয়ে পড়বে।
পোর্তো অ্যালেগ্রের যে এলাকায় তোমার বাড়ি, ড্রাগ আর গ্যাং সেখানকার নিত্যদিনের সঙ্গী। যত কষ্টই হোক, মনে রেখো, যতক্ষণ তুমি ফুটবল খেলছ, হোক সেটা মাঠে কিংবা রাস্তায় অথবা তোমার কুকুরের সাথে, ততক্ষণ ওসব ঝঞ্ঝাট তোমাকে ছুঁতে পারবে না।
হ্যাঁ, ভুল পড়োনি। তোমার কুকুরের কথাই লিখেছি। সে একজন অক্লান্ত ডিফেন্ডার।
তুমি রবার্তোর সাথে খেলবে। পার্কে ছেলেবুড়ো সবার সাথে খেলবে। একসময় সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু তোমার খেলার শখ তখনো মিটবে না। তাই বমবমকে সবসময় সাথে রাখবে। বমবম হলো খাঁটি ব্রাজিলিয়ান কুকুর, আর ব্রাজিলিয়ান কুকুররাও ফুটবল ভালোবাসে। ড্রিবলিং আর স্কিল প্র্যাকটিসের জন্য বমবম হবে দারুণ একজন প্রতিপক্ষ, আর খুব সম্ভবত ইলাস্টিকোর প্রথম শিকার।
কয়েক বছর পর যখন ইউরোপে খেলতে যাবে, তখন কয়েকজন ডিফেন্ডার তোমাকে বমবমের কথা মনে করিয়ে দেবে।
তোমার শৈশবটা হবে সবার থেকে আলাদা। বয়স ১৩ হতে না হতেই দেখবে, সবাই তোমাকে নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। চমৎকার স্কিল আর বল পায়ে তোমার ক্যারিশমা নিয়ে কথা বলবে। ফুটবল তখনও পর্যন্ত তোমার কাছে নিছক একটি খেলা। কিন্তু ওই বয়সেই সেবারের বিশ্বকাপ এসে তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে, ফুটবল স্রেফ খেলার চেয়েও বেশি কিছু।
বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের ১৭ জুলাই, যে দিনটার কথা প্রতিটি ব্রাজিলিয়ানের মনে গেঁথে আছে। সেদিন যখন তুমি গ্রেমিও যুবদলের সাথে হরিজন্টেতে খেলতে যাবে, টিভিতে তখন ব্রাজিল বনাম ইতালির বিশ্বকাপ ফাইনাল চলছে। ২৪ বছর পর ক্যানারিনহোরা আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে। গোটা দেশটা যেন থমকে ছিল, চারিদিক নিস্তব্ধ। শহরের আনাচেকানাচে সবখানে জড়ো হওয়া মানুষের উপচে পড়া ভিড়, সবাই খেলা দেখতে ব্যস্ত।
সতীর্থদের সাথে তুমিও সেই খেলা দেখায় মগ্ন থাকবে। গোলশূন্য অবস্থায় শেষ বাঁশি বাজার পর, খেলা গড়াবে টাইব্রেকারে।
ইতালি আর ব্রাজিল, দুই দলই তাদের প্রথম পেনাল্টি মিস করে। পরের শটে ইতালির গোল। তারপর শট নিতে এলেন রোমারিও। তার শটটা বাঁ দিকে বাঁক খেয়ে প্রথমে বারে লাগে, তারপর শাঁই করে জালে জড়ায়। সাথে সাথে কানফাটা চিৎকার দিয়ে ওঠেন সতীর্থরা।
তবে ইতালির গোলে চারদিকে আবার শুনশান নীরবতা নামে।
তারপর, ব্রাঙ্কো গোল করলেন… তাফারেল ইতালির পরের শট ঠেকিয়ে দিলেন… দুঙ্গা গোল করেন…।
তারপর এলো সেই চির আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত! যা শুধু তোমার নয়, বদলে দিয়েছিল লাখো ব্রাজিলিয়ানের জীবন। ইতালির হয়ে শট নিতে আসেন, বাজ্জিও… এবং মিস! ব্রাজিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
পাগলের মতো উদযাপনের সময়ই তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসবে, বাকি জীবনে কী করতে চাও। এতদিনে বুঝতে পারবে, ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ফুটবল, খেলার চেয়েও বেশি কিছু। সেদিনই পুরোপুরি অনুভব করবে যে, ফুটবল সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা সুখ এনে দিতে পারে।
নিজেকে অস্ফুটে বলে উঠবে, “আমি ব্রাজিলের জন্য খেলবো!”
কিন্তু তোমার খেলার ধরনে হয়তো কেউ সেদিন কথাটি বিশ্বাস করবে না। কিছু কোচ থাকবেন, আসলে একজন কোচ থাকবেন, যিনি তোমাকে বলবেন, খেলার ধরন পাল্টাতে। তিনি ভাববেন, তোমাকে আরো সিরিয়াস হতে হবে, অযথা ড্রিবলিং বন্ধ করতে হবে। এমনটাও বলবেন যে, “তুমি জীবনেও ফুটবলার হতে পারবে না।”
কথাগুলোকে অনুপ্রেরণা হিসেবেই মাথায় গেঁথে নিও। নিজের লক্ষ্য স্থির রাখতে সেগুলোকে কাজে লাগাবে। এবং তারপর মনোমুগ্ধকর ফুটবল খেলে যাওয়া দেনের, ম্যারাডোনা, রোনালদোর কথা চিন্তা করবে।
বাবার বলে যাওয়া সেই কথাগুলো মনে রেখো,
“নিজের ইচ্ছেমত খেলে যেও, শুধু বলটার সাথে খেলো। এই বিষয়গুলো সব কোচের মাথায় ধরবে না। মাঠে যখন খেলবে, তোমার এত কিছু হিসেব করার দরকার নেই। যা হবার এমনিতেই হবে। ভাবার আগেই তোমার পা সিদ্ধান্ত নিবে। এই সৃজনশীলতাই তোমাকে নিয়ে যাবে হিসেব-নিকেশের ঊর্ধ্বে।”
ঐ যেদিন, রোমারিও ‘৯৪-এর বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছিলেন… তার কয়েকমাস পরই ট্রেনিং শেষে গ্রেমিওর কোচ তোমাকে টেনে তার অফিসে নিয়ে যাবেন। তার হুট করে বলবেন বলবেন, তুমি ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ডাক পেয়েছ। টেরেসপোলিসের ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর, এর ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকার পরের দৃশ্য তোমার আজীবন মনে থাকবে। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলে আছে পেলে, জিকো, বেবেতোদের পোস্টার।
যে হল ধরে তুমি হাঁটবে, সেখান দিয়ে একদিন হেঁটে গেছেন এই কিংবদন্তিরা। এই ক্যাফেটেরিয়ারই টেবিলগুলোতে একসময় বসতেন রোমারিও, রোনালদো, রিভালদোরা। তোমার মতো একই খাবার খেয়েছেন তারা এখানে, ঘুমিয়েছেন সেখানকারই কোনো এক ডর্মেটরিতে। শুতে গিয়ে বালিশে মাথা রাখার পর ভাবতে থাকবে… আমার কোনো হিরো এই একই বালিশে মাথা রেখেছিলেন!
পরের চার বছর তোমার কাজ শুধু ফুটবল খেলা। জীবন কাটবে বাস আর ট্রেনিং পিচে। যত কষ্টই হোক না কেন, ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ এই সময়টাতে তোমার জন্য ছুটি বলে কিছু থাকবে না।
কিন্তু মাত্র ১৮ বছরে বয়সে তুমি এমন কিছু অর্জন করবে, যা দেখে গর্বে বাবার বুকটা গর্বে ফুলে উঠতো। গ্রেমিও’র মূল দল থেকে ডাক আসবে তোমার। কিন্তু শত আনন্দের মাঝেও গ্রেমিওতে রবার্তোর অনুপস্থিতি হাহাকার করে উঠবে। হাঁটুর ইনজুরি তাকে বেশিদিন সেখানে টিকতে দেয়নি, খেলার জন্য সে চলে যাবে সুইজারল্যান্ডে। নিজের হিরোর সাথে একই দলে, একই মাঠে খেলাটা আর হয়ে উঠবে না। কিন্তু ততদিনে রবার্তোকে দেখে তুমি শিখে গেছো, কোথায় কী করা যাবে আর কী করা যাবে না।
ম্যাচের দিনগুলোতে তুমি সেই গাড়ি পার্কিং ধরে হেঁটে যাবে, যেখানে বাবা ছুটির দিনে সিকিউরিটির কাজ করতেন। ছোটবেলায় রবার্তোর সাথে ঘুরতে আসা সেই ড্রেসিংরুমে ঢুকবে। গ্রেমিওর নীল আর কালো জার্সি গায়ে জড়াতেই মনে হবে, নিজের শহরের ক্লাবের হয়ে খেলার সৌভাগ্য যার আছে, তার জীবনে এর চেয়ে সুখকর আর কিছু হতে পারে না।
তোমার গল্প হতে শেষ হতে কিন্তু তখনও অনেক দেরি।
পরের বছরই তুমি ব্রাজিলের জার্সি গায়ে মাঠে নামবে, এবারে মূল দলের হয়ে। সেখানে ঘটবে মজার এক ঘটনা। প্রথম দিনের ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে তুমি দেখবে, সতীর্থরা আগেরদিনই চলে এসেছে। কী ব্যাপার? ঘটনা কী? কারণ ক্যাম্পিওনাতো গাউচো টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচে ইন্টারন্যাসিওনালের বিপক্ষে তোমাকে মাঠে নামতে হবে গ্রেমিওর হয়ে।
ইন্টারন্যাসিওনালের হয়ে সেদিন মাঠে নামবেন ‘৯৪ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক দুঙ্গা।
ম্যাচটিতে অসম্ভব ভালো খেলবে তুমি। তাই প্রথমদিন ব্রাজিল দলের সাথে ট্রেনিং করতে যাবে, তোমার নতুন সতীর্থরা, যাদের ‘৯৪ এর বিশ্বকাপ জিততে দেখেছে, সবার মুখে তখন একজন খেলোয়াড়ের গুণগান; ১০ নাম্বার জার্সি সেই ছোট্ট ছেলেটির।
হ্যাঁ, সবাই তোমাকে নিয়েই কথা বলবে।
চমৎকার ড্রিবলে দুঙ্গাকে পাশ কাটানোর কথা। শিরোপা জেতানো গোলের কথা। এই মুহূর্তগুলো তোমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু, ভুলেও অতি আত্মবিশ্বাসী হতে যেও না। এরা কেউই অল্পতে তুষ্ট হবার পাত্র নন। এই পর্যায়ে আসলে প্রত্যাশার পরিমাণটা একটু বেশি।
এখন কথা হচ্ছে- তুমি কি তোমার মতোই খেলে যাবে? নাকি বুঝে-শুনে এগোবে?
তোমার জন্য আমার একটাই উপদেশ: সবকিছু করবে নিজের মতো করে। মুক্ত হয়ে, সুরের সাথে তালমিলিয়ে! তোমার জীবনেই সেটিই একমাত্র উপায়।
ব্রাজিলের হয়ে খেলাটা তোমার জীবনই পাল্টে দেবে। হঠাৎ করেই এমন সব সম্ভাবনার দ্বার খুলতে শুরু করবে, যেগুলোর অস্তিত্বের কথাই তুমি জানতে না!
যেখানে তোমার হিরোরা ইতিহাস গড়ে গেছেন, সেই ইউরোপে খেলার কথা ভাববে। রোনালদো তোমাকে বার্সেলোনার গল্প বলবে। তার জেতা পুরস্কার, ব্যালন ডি’অর, ক্লাব শিরোপা দেখার পর হঠাৎ করে তোমার মনেও ইচ্ছে জাগবে ইতিহাস গড়ার। তোমার স্বপ্ন গ্রেমিওকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০০১ সালে তোমার ঠাঁই হবে প্যারিস সেইন্ট-জার্মেই।
ফাভেলার এক কাঠের ঘরে যে শিশুটির জন্ম হয়েছে, তাকে আমি ইউরোপের জীবন সম্পর্কে কীভাবে বোঝাবো? এ অসম্ভব। যদিও বলি, মনে হয় না তুমি বুঝবে। প্যারিস থেকে বার্সেলোনা, তারপর মিলান, সময়টা খুব দ্রুত চলে যেতে থাকবে। ইউরোপের কিছু গণমাধ্যম বুঝতেই পারবে না তোমার খেলার ধরন। ওদের মাথাতে কখনোই ঢুকবে না- কেন তুমি সারাক্ষণ হাসছো!
তুমি হাসো, কারণ ফুটবল থেকে আনন্দের কিছু নেই! লক্ষ্যই যখন সেই আনন্দটা ছড়িয়ে দেয়া, তখন এত সিরিয়াস হয়ে কী হবে? আবারো বলছি, সৃজনশীলতা সব হিসেব-নিকেশের ঊর্ধ্বে।
এই সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত রেখ। ব্রাজিলের হয়ে বিজয়ের মুকুট তুমি ছিনিয়ে আনবেই।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা কিংবা সিরি আ! কোনোকিছুই তোমার অধরা থাকবে না
এভাবেই খেলে যেও, একদিন ব্যালন ডি’অরও ওঠবে তোমার হাতে।
তোমার সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়ে হবে, নিজের খেলার ধরন দিয়ে বার্সেলোনাকে বদলে দেয়া। তুমি যখন স্পেনে পৌঁছাবে, সেখানে তখন রিয়াল মাদ্রিদের একতরফা রাজত্ব। আর যখন ক্লাব ছেড়ে আসবে, বাচ্চারা তখন ‘বার্সেলোনার মতো’ খেলার স্বপ্ন দেখবে।
মনে রেখো, বার্সেলোনার মাঠে তোমার ভূমিকাটা স্রেফ একজন খেলোয়াড় থেকে অনেক বড় কিছু।
একদিন, বার্সেলোনার যুবদলের এক কিশোরের কথা তোমার কানে আসবে। তোমার মতোই ১০ নাম্বার জার্সি পরে ছেলেটা। দেখতেও তোমার মতোই ছোটখাট। এবং তোমার মতোই বল নিয়ে খেলে। সতীর্থদের নিয়ে প্রথমবার যখন যুবদলে তার খেলা দেখতে যাবে, সেদিনই বুঝে যাবে, এই ছেলেটা অন্যরকম এবং একদিন একজন ‘গ্রেট ফুটবলারে’র চাইতেও বড় কিছু হবে। ওর নাম লিও মেসি।
সেদিন ফিরে তুমি কোচদের বলবে, তাকে তোমার সাথে খেলার জন্য মূল দলে নিয়ে আসতে। আর সে যখন আসবে, সবার মাঝে তাকে নিয়ে গুঞ্জন উঠবে, ঠিক যেমন ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের মাঝে তোমাকে নিয়ে হয়েছিল।
আমি চাই, তুমি তাকে শুধু একটি উপদেশ দাও।
তাকে বলবে, “মনে আনন্দ নিয়ে খেলো। নিজেকে মুক্ত করে খেলো। শুধু বলটার সাথে খেলো।”
তোমার খেলার ধরনটা বার্সেলোনায় টিকে থাকবে। এমনকি তুমি চলে যাওয়ার পরেও। এবং সেটা মেসির মাধ্যমেই।
ভালো-মন্দ অনেক কিছুই ঘটবে তোমার জীবনে। কিন্তু মনে রেখ, তোমার জীবনে সবকিছুর পেছনে অবদান এই ফুটবলের। লোকে যখন তোমার খেলার ধরন নিয়ে কথা বলবে, ম্যাচ হারার পরেও তোমার হাসিমুখ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তখন শুধু একটি স্মৃতি মনে করতে বলবো।
বাবা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তোমার কাছে তার কোনো ভিডিও ছিল না। কোত্থেকে থাকবে, ক্যামেরা কেনার সামর্থ্যই যে ছিলো না। না পারবে একটিবার তার কথা শুনতে, তা পারবে তার মুখের হাসি দেখতে।
অন্য সবকিছুর মাঝে একটি জিনিসই তোমাকে বারবার তার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। দুজনের ফুটবল খেলার একটি ছবি। বল পায়ে তোমার হাসিমুখের দৃশ্য। আর সেই হাসিতে সংক্রমিত বাবাও। তোমাকে খেলতে দেখাতেই ছিল তার সব সুখ।
জীবনে যখন অর্থ আসতে থাকবে, চাপ বাড়তে থাকবে, সমালোচনা চলতে থাকবে- তখনও নিজেকে মুক্ত রেখো।
তিনি যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই খেলো।
বলটির সাথে খেলো।
– রোনালদিনহো
ফুটনোট: মূল লেখাটি ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে “লেটার টু মাই ইয়ঙ্গার মাইসেলফ” নামে ইংরেজি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় পাবলিশ করা হয়েছিল। রোর বাংলার পাঠকদের জন্যে লেখাটি বাংলায় উপস্থাপন করে হয়েছে।