২৪ মার্চ ২০১৮। কেপ টাউনে চলছে অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজের ৩য় টেস্টের ৩য় দিন। টিভি পর্দায় ক্যামেরন ব্যানক্রফট। ক্রিকেট সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, এমন সবারই এই গল্পটা জানা থাকার কথা। স্মিথ-ওয়ার্নাররা এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ, ব্যানক্রফট ৯ মাস। কোচ পরিবর্তিত হলো, দল পেলো নতুন অধিনায়কও। বিশ্বকাপের ঠিক আগের বছর এত বড় ধাক্কা সামলাতে হলো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে। নতুন করে দল সাজাতে হবে। দলের দুই সেরা ব্যাটসম্যান, নিয়মিত অধিনায়ককে ছাড়া নতুন করে দল সাজানো মোটেও সহজ না। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বাধ্য হলো তাই করতে, করলোও।
৭ অক্টোবর ২০১৮। আরব আমিরাতে চলছে অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ। অজি দলকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে এই ম্যাচে অভিষেক হলো মারনাস ল্যাবুশেন নামের এক লেগস্পিনিং অলরাউন্ডারের। দলে মূলত ঢুকেছিলেন মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই। অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ ওভার বল করে উইকেট নিয়েছেন একটি। মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেও সুবিধা করতে পারলেন না অভিষিক্ত ল্যাবুশেন। প্রথম ইনিংসে ২য় বলেই শূন্য রানে আর পরের ইনিংসে ২৪ বলে ১৩ রান করে ফিরেছেন প্যাভিলিয়নে।
পরের ম্যাচের দুই ইনিংসে দলের দলগতভাবে খারাপ করার ম্যাচে ল্যাবুশেন ততটাও খারাপ করেননি। প্রথম ইনিংসে ৪৩, যা ইনিংস-সর্বোচ্চ; আর পরের ইনিংসে ২৫, যা ইনিংসের ৩য় সর্বোচ্চ। পরের ভারত সিরিজে খেলেছেন মাত্র ১ ম্যাচ।
অ্যাশেজ ২০১৯। ২য় টেস্টে নিজেদের ১ম ইনিংসে ৮০ রানে অপরাজিত থাকা স্মিথ আছেন ব্যাটিং প্রান্তে। বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত জোফরা আর্চার। ৭৭তম ওভারের ২য় বল।
“Archer to Smith, no run. Oh dear! He’s been clattered here by the short ball. He’s down. This is nasty. Took him on the unprotected part of the neck. The medics are out there straightaway, from both sides, and the England players have immediately gone to Smith. These are not scenes you want to see. Smith is lying on his back in the crease as he gets seen to by medical staff. Everyone will take the utmost care here with Smith.” – ESPNcricinfo
আর্চারের করা বল গিয়ে আঘাত করেছে স্মিথের ঘাড়ে। মাটিতে শুয়ে পড়েছেন স্মিথ। আতঙ্ক সবার চোখে মুখে, ইংলিশ ক্রিকেটাররা দৌড়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন শুয়ে থাকা স্মিথের। যারা সরাসরি দেখেছিল, তাদের মনে পড়ে গিয়েছিল ফিলিপ হিউজের কথা। উৎকণ্ঠা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন স্মিথ। প্রথম ইনিংসে আবারও ব্যাট করলেও ২য় ইনিংসে আর সম্ভব হয়নি।
ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম কনকাশন ক্রিকেটার হিসেবে স্মিথের জায়গায় মাঠে নামলেন মারনাস ল্যাবুশেন। কে জানত, প্রাপ্ত সেই সুযোগকে শুধু নিজের জন্যই লুফে নেবেন না তিনি, বরং ক্রিকেট বিশ্বকে দিতে থাকবেন নতুন নতুন সব রূপকথা! ব্যাট হাতে নেমেই সেই আর্চারের বলে আঘাত পেলেন ল্যাবুশেনও, বসেও পড়লেন, এবং উঠে দাঁড়ালেন। অতঃপর?
নিজের উপর দারুণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যাট হাতে বোলারের করা বলগুলোকে খেলতে থাকলেন দারুণভাবে। ১০০ বল খেলে ৫৯ করে আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার আগেই ক্রিকেট বিশ্ব অবাক চোখে দেখেছে ল্যাবুশেনকে, অজিরা দেখেছে বিস্ময়ের সাথে, এ যেন নতুন এক ল্যাবুশেন। পরের ম্যাচের দুই ইনিংসে রান ৭৪ এবং ৮০। সিরিজের ৪র্থ ম্যাচে ফিরে এলেন স্মিথ, বাদ পড়লেন উসমান খাজা, ল্যাবুশেন পেলেন দলের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৩ নম্বর পজিশন। সেখান থেকেই নতুন শুরু মারনাস ল্যাবুশেনের, নতুন এক আত্মবিশ্বাসী, এক পরিশ্রমী, এক বিস্ময় যুবকের।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের এই ভবিষ্যৎ – যার হাত ধরে লেখা হবে নতুন সব মহাকাব্য, যা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদী বিশ্ব ক্রিকেটের সমর্থকেরা, সেই ল্যাবুশেনের জন্মটা কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় না, তিনি জন্মগতভাবে অজিও নন। ১৯৯৪ সালের ২২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের ক্লার্কসডর্প নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন মারনাস ল্যাবুশেন। তার বয়স যখন দশ, তখন পুরো পরিবার চলে আসে অস্ট্রেলিয়ায়।
ঘরোয়ায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ল্যাবুশেনের শুরুটা কুইন্সল্যান্ডের হয়ে ২০১৪ সালে। শুরুটা টপ অর্ডারেই ছিল; শুধু টপ অর্ডার নয়, রীতিমতো ওপেনার। অভিষেক ম্যাচে অ্যাডিলেডে সেদিন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৮৩ রান করেন ল্যাবুশেন, দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য। এখানেই তিনি বিকশিত হতে থাকেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আসর শেফিল্ড শিল্ডে ২০১৭-১৮ সিজনে ল্যাবুশেনের সংগ্রহ ছিল ৪০ গড়ে ৭৯৫ রান, হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকের ৪ বছরের মধ্যেই ডাক পান জাতীয় দলে।
অ্যাশেজের আগ পর্যন্ত ল্যাবুশেন
৭ অক্টোবর ২০১৮তে অভিষিক্ত ল্যাবুশেন মূলত লাইমলাইটে আসেন অ্যাশেজের ২য় টেস্ট দিয়ে, যা শুরু হয় ১৪ আগস্ট ২০১৯ থেকে। এর মধ্যবর্তী সময়টুকুতে জাতীয় দলে কেমন ছিল মারনাস ল্যাবুশেনের পারফরমেন্স? একেবারেই ফেলনা, নাকি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়ী? পরিসংখ্যান না দেখেই বলে দেয়া যাবে, সম্ভাবনাময়ই ছিলেন ল্যাবুশেন। নয়তো অ্যাশেজের স্কোয়াডে তো আর আসা যায় না। এবার না হয় উত্তরটা পরিসংখ্যানের সাগরে ডুব দিয়ে খুঁজে নেয়া যাক।
ওই সময়ে মারনাস ল্যাবুশেন টেস্ট ক্রিকেটে খেলেছেন মোট ৫ ম্যাচ। ব্যাট হাতে নেমেছেন ৮ ইনিংসে। মোট রান ছিলো মাত্র ২১০, সর্বোচ্চ শ্রীলংকার বিপক্ষে ৮১ রানের এক ইনিংস। অর্ধশত ওই একটাই, শতক নেই কোনো। শূন্য রানে আউট হয়েছেন ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত একবারই, সেটাও ওই সময়কালের মধ্যেই। ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬০-এর উপরে গড়ের মালিক ল্যাবুশেনের সে সময় গড় ছিল মাত্র ২৬.২৫।
এ সময়ে ল্যাবুশেন নির্দিষ্ট কোনো পজিশনও পাননি। ৫ ম্যাচে খেলেছেনও ৫টি আলাদা পজিশনে, ওয়ান-ডাউন থেকে ৭ম পর্যন্ত। ম্যাচের ১ম আর ৩য় ইনিংসে তার গড় ছিল ৬.০০ আর ৪.০০। স্বাভাবিকভাবেই ল্যাবুশেনের পরিসংখ্যান দেখে তাকে নিয়ে অনেক বেশি উচ্চাশা করার সুযোগ ছিল না। তবে খেলা দেখে অনেকেই যে একেবারেই এমনটা ভেবেছে, সেটা বলা মুশকিল। ব্যতিক্রম ভেবেছেন এমন মানুষ পাওয়া যাবে অনেক।
অ্যাশেজ থেকে এ পর্যন্ত
২০১৯ এর অ্যাশেজের ২য় টেস্টের ২য় ইনিংসের পর ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ল্যাবুশেন খেলেছেন আরও ১৩ ম্যাচে ২২ ইনিংস, যে ২২ ইনিংসে তিনি ১০-এর কম রান করে আউট হয়েছেন মাত্র ১ বার। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে পেয়েছেন ডাবল হান্ড্রেডের স্বাদও। তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারে গিয়েছেন আরও ৪ বার। ১০৮, ১৪৩, ১৬২ আর ১৮৫ রানের ইনিংসগুলো খেলেছেন ভারত, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। অর্ধশতক এই সময়ে ৯টি। মাত্র ৯টি ইনিংসে আউট হয়েছেন ৫০ রানের কম করে, এর মধ্যে আছে আবার একটি ৪৭ আর দু’টি ৪৮ রানের ইনিংসও।
ল্যাবুশেনের জ্বলে উঠার উপর এখন অনেকটাই নির্ভর করে অস্ট্রেলিয়া দলের জেতা বা ড্র করা। ল্যাবুশেনের খেলা ৭ ম্যাচ জিতেছে অজিরা, আর এই ৭ ম্যাচে ল্যাবুশেনের গড় ৮৫.৫৮। ড্র করা ২ ম্যাচে তার গড় ৭৪-এর উপরে। গড়পড়তাভাবে তার গড়টা যখন ৫৩.১২, তখন সেই ৪ ম্যাচ হেরেছে অস্ট্রেলিয়া।
হোম-অ্যাওয়ের তুলনা করতে গেলে দেখা যাবে ল্যাবুশেনের হোম ম্যাচ পারফরম্যান্স অ্যাওয়ে ম্যাচের থেকে খারাপ, তবে যা আছে সেটাও অনেক বেশিই ভালো। ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত তার খেলা ৯টি হোম ম্যাচে গড় ৮২.৬২, আর ৪ অ্যাওয়ে ম্যাচে সেটা নেমে ৫০.৪২। হ্যান্ডসাম ফিগার বলা যায় অনায়াসেই। অ্যাশেজের পর থেকে এ পর্যন্ত হোমে খেলা ১৬ ইনিংসে তার মোট সংগ্রহ ২,৩০৭ রান, আর দেশের বাইরে খেলা ৭ ইনিংসে সেটা ৬৯২। দেশের বাইরে বলতে খেলেছেনই শুধু যে অ্যাশেজ থেকে হিসাব করছি সে অ্যাশেজটাই। অর্থাৎ নতুন ল্যাবুশেনের শুরুটাই হয়েছিল ভিনদেশে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ ইনিংসে ৫০.৪২ গড়ে ৬৯২ রান করে। এই ৪ ম্যাচে করেছিলেন ৪টি অর্ধশতক। সেখান থেকে নতুনের পানে পথচলা শুরু।
২০২০ এর শুরুতে ভারতের বিপক্ষে ভারতের মাটিতে পঞ্চাশ ওভার ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ল্যাবুশেনের। শুরুর ম্যাচে ব্যাট হাতে নামতে পারেননি। বাকি ২ ম্যাচে সংগ্রহ ৪৬ আর ৫৪। পরের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ক্রিকেটের এই সংস্করণে দেখা পান প্রথম শতকের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০৮ বল খেলে রানটাও করেন ১০৮। ঠিক এর আগের ইনিংসে দেখা পান এই ফরম্যাটের একমাত্র শূন্য রানের। ১২ ইনিংসে ২০-এর নিচে ল্যাবুশেনের রান আছে মাত্র ৩টি। ৯১-এর উপরে স্ট্রাইকরেট আর প্রায় ৪০ ছোঁয়া গড়ে মোট রান ৪৭৩। শতক ১টি আর অর্ধশতকের সংখ্যাটা ৩।
লেগ স্পিনার পরিচয়টা ওডিআই ক্রিকেটে এখন অব্দি খুব একটা নেই তার। মাত্র ৪ ওভার বল করেছেন ৯ ইকোনমিতে। টেস্টে ৩.৬৪ ইকোনমি আর ৪১.৬৬ গড়ে উইকেট শিকার করেছেন এখন পর্যন্ত ১২টি, এই ১২ জনের মধ্যে আছে ফখর জামান, সরফরাজ আহমেদরাও।
ক্যারিয়ারে মাত্র ১২ টেস্ট খেলেই টেস্ট ব্যাটসম্যানদের সেরা দশে ঢুকে যাওয়া ল্যাবুশেন ২৩ ম্যাচ শেষ করে ৯৩৫ রেটিং নিয়ে আছেন ১ নাম্বার পজিশনে। অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল ল্যাবুশেনের সাথে তুলনা করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন শুধু রিকি পন্টিং আর মাইকেল ক্লার্ককে। এভাবেই চলতে থাকলে একদিন যে তিনি তাদেরও ছাড়িয়ে যাবেন, সেটা আশা করাই যায়। ক্রিকেটীয় হিমালয়ের চূড়ায় উঠার ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন তিনি। বোলারের ভালো বলকে যেমন সম্মান দেখাতে ভুল করেন না ল্যাবুশেন, তেমনি একদিন তাকেও সম্মান দেখাবে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের আগামীর ক্রিকেটাররা সেটাও আশা করাই যায়।
স্মিথ, কোহলি, উইলিয়ামসনের যুগে ক্রিকেট খেলে সবটুকু আলো তাদের থেকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়া ল্যাবুশেন এভাবেই উজ্জ্বল থাকবেন, এটাই তো ক্রিকেট বিশ্বের চাওয়া। তার সেই উজ্জ্বল আলোতে তাকিয়ে মুগ্ধ হতে চাইবেন যেকোনো ক্রিকেট সমর্থক। মুগ্ধ হতে থাকুক তারা, মুগ্ধতা ছড়িয়ে যেতে থাকুন বিস্ময়-যুবক মারনাস ল্যাবুশেন।