সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হয়েছেন প্রায় মাস পাঁচেক। অক্টোবর ২৯ থেকে গুনে গুনে দেখলে হবে ১৪৮ দিন। হিসেবে ভুল হতে পারে, অংকে কাচা হওয়াটা অপরাধ নয় নিশ্চয়ই। সাকিব নিষিদ্ধ হবার পর থেকে বাংলাদেশ ম্যাচ খেলে ফেলেছে ১৪টি, ১৫টি হবার কথা ছিলো, পাকিস্তানের সাথে একটি টি-২০ ভেসে যাওয়ায় সংখ্যাটা সামান্য কমেছে।
এর মধ্যে জিম্বাবুয়েকে ধবলধোলাই, বাকি আট ম্যাচ? মাত্র এক জয়। টেস্ট তিনটির তিনটিতেই ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়, সোজা বাংলায় বললে, গো-হারা। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার পর ভারতের সাথে প্রথম ম্যাচ জিতবার পর দলের ভেতর যে আত্মবিশ্বাসের স্ফূরণ দেখা গিয়েছিলো, জিম্বাবুয়ে দেশে আসবার আগপর্যন্ত সেটি পর্দার আড়ালেই লুকিয়ে ছিলো।
জিম্বাবুয়ের সাথে ওয়ানডে সিরিজে মাশরাফি মর্তুজা ওয়ানডে অধিনায়কত্বকে বিদায় বলেছেন, শেষ ওয়ানডেতে অভিনব উপায়ে তাকে বিদায় দিয়েছেন বোর্ড ও খেলোয়াড়েরা। সেই বিদায়বেলায় অশ্রুসজল চোখ নিয়ে বৃষ্টিভেজা সেই রাতের চেয়েও আর্দ্র কণ্ঠে ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক বলেছেন,
সাকিব, আই মিসড ইউ বয়, আই মিসড ইউ…
ওহ অধিনায়ক, আপনি কী করে এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের গভীর অন্ধকার কোণে আশ্রয় নিয়ে থাকা অব্যক্ত কিংবা আক্ষেপ মেশা কথাটুকু বলে ফেলেন?
ইশ! যদি সাকিব থাকতো…
প্রতিবার প্রতিপক্ষের একটা জুটি জমে যাবার পর কিংবা হুট করে ওপেনারদের বিদায়ের পর ভক্তদের মনে কেন যেন মনে হয়, সাকিব আল হাসান আছেন, কিছু একটা হয়ে যাবে। নাহ, সাকিব ম্যাজিশিয়ান নন, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার নন। হুডিনির ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’ অ্যাক্ট সাকিব ক্রিকেট মাঠে ফুটিয়ে তোলেন না, বরং সাকিবের ব্যাটিং কিংবা বোলিং দেখলে যে কেউ বলে উঠবেন, অর্ডিনারি! আসলেই কি তা-ই? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে ক্রিকেটপাগল এক জাতির কাছে মাগুরা থেকে উঠে আসা এই মানুষটার প্রতিশব্দ বিশ্বাস কেন? জুয়াড়ির প্রস্তাবের কথা না জানানোর পর এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হবার পরও কেন এই মানুষটির তুমুল জনপ্রিয়তায় কোনো ছেদ পড়েনি?
হরেক প্রশ্ন, হরেক উত্তর। কিন্তু শেষ প্রশ্নটায় লুকিয়ে আছে অনেকগুলো প্রশ্ন, ফিক্সিং সংক্রান্ত কারণে নিষিদ্ধ হবার পরও কেন সাকিব বাংলাদেশে ঠিক এতটাই জনপ্রিয়? বরং জনপ্রিয়তা কমার বদলে বাড়ছেই কেন? উত্তর দেবার চেষ্টা করা যায় বড়জোর।
ফিক্সিং কাণ্ডে জড়িয়ে গায়ে কলঙ্কের কালিমা লেগেছে, এমন মানুষ নেহায়েত কম নয়। হ্যান্সি ক্রনিয়ে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ কিংবা বাংলাদেশেরই মোহাম্মদ আশরাফুল। স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং ক্যামেরন ব্যানক্রফট বল ট্যাম্পারিং করেছিলেন, তাকে ক্রিকেটীয় নৈতিকতার অবক্ষয় বলা চলে, অপরাধ নয়। কিন্তু তারপরও, এই তিনজনকে রীতিমতো জেলখাটা আসামীর মতো থাকতে হয়েছে এক বছর। সেখান থেকে ফিরেও রীতিমতো ‘চোর’ অপবাদ শুনতে হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে সাকিবের জনপ্রিয়তার নব্য বিস্ফোরণ কেন হলো তবে? এই প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তর দেওয়া দুরূহ কাজ, তবে অনেকগুলো কারণ বলা যায়, প্রথমটি অবশ্যই, সাকিবের নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা না বুঝতে পারাটা।
অধিকাংশের মতেই ফিক্সিং করাটা দোষের, এর আগে যতজন ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করেছেন, ফিক্সিং করবার জন্যই সেই শাস্তি পেয়েছেন। সাকিব ফিক্সিং করেননি। বরং, তাকে প্রস্তাব দেবার পরও করেননি। ক্রিকেটীয় আইনে এই প্রস্তাবের কথা না জানানোটাও বিরাট অপরাধ, সে কথা অনেকেই জানেন না। সাথে দলের ক্রান্তিকালে সাকিবের সাম্প্রতিক অবিশ্বাস্য পারফরমেন্স, এই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মনে হয়েছে, সাকিব ফেঁসে গেছেন, দোষ করেননি। এবং এই প্রচণ্ড আবেগের জোয়ারে যে সহানুভূতির জলোচ্ছ্বাস, তাতেই সাকিবের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। অথচ ক্রিকেট ভালোমতো বোঝেন এমন অনেকের মতেই, সাকিব মাত্র এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন, শাস্তি আরও বেশিও হতে পারতো।
আবেগের তীব্র জোয়ারে সাকিবের ক্যারিয়ারে আসা কলঙ্কের দাগ ধুয়ে-মুছে একাকার হয়ে গিয়েছে। সেটি আরও প্রবলভাবে উপলব্ধি হয় তার সাথে কোনো স্পন্সর চুক্তিচ্ছেদ না করায়, কারণ জনগণের কাছে সাকিব নায়কের চেয়ে বেশি কিছু, তার সঙ্গে চুক্তিচ্ছেদ করে লোকসানের ঝুঁকি কে নেবে?
কারণ ধরা যায় আরেকটি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা। অনুর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ জিতে আসলেও জাতীয় দলের খেরোখাতায় জিম্বাবুয়ে ব্যতিরেকে জয় স্রেফ একটি, বাকি ম্যাচগুলোতে করুণ পরাজয়। স্রেফ খেলোয়াড় সাকিব নয়, অধিনায়ক সাকিবকেও মিস করছে বাংলাদেশ, এসব অনুমেয়। অনেকের মতেই, সাকিব থাকলে অন্তত লজ্জার মুখে পড়তে হতো না, অন্তত মুখ বাঁচানো যেত।
মূল কারণগুলোর আরেকটি অবশ্যই সাকিব নিষিদ্ধ হবার ঠিক আগে আগে তার নেতৃত্বে হওয়া খেলোয়াড় ধর্মঘট। বিসিবির খেলোয়াড়দের প্রতি অবিচার কিংবা অনিয়মের বিরুদ্ধে সাকিবের নেতৃত্বে যখন খেলোয়াড়েরা দাঁড়িয়ে গেলেন, সাকিব এক লাফেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘বেয়াদব’ থেকে দৃঢ়চেতা নেতার আসনে। সাকিব নিষিদ্ধ হবার পর গুঞ্জন উঠেছিলো সাকিব বিসিবির ষড়যন্ত্রের শিকার, সাকিবের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবিকে ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেবার ফসল। এসব সত্যি নয় অবশ্যই, কিন্তু সাকিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠবার আরেকটি ফ্যাক্টর বৈকি।
এসবের সঙ্গে আরেকটি কারণ যোগ করা যায় সাম্প্রতিক আরেকটি কারণ, সেটি মাশরাফির অধিনায়কত্ব ত্যাগ। মাশরাফি বিদায় নিলে সাকিব অধিনায়ক হবেন, সেটিই অবশ্যম্ভাবী ছিলো। নিষেধাজ্ঞা সেই দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে তামিম ইকবালের ঘাড়ে, যার অধিনায়কত্ব কিংবা অধিনায়ক হিসেবে পারফরমেন্স, কোনোটাই সুবিধের না। আর সেখানেই সাকিবের পুনরাবির্ভাব আলোচনায়, সাকিব থাকলে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানের উপর চাপ প্রয়োগের ব্যাপারটি হাজির হতো না।
তবে এসব প্রশ্ন এবং উত্তর দেবার চেষ্টাটা বাতুলতা, কারণ সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে অবদান রেখেছেন, তাতে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে না থাকলেই বরং প্রশ্ন করা উচিত, অন্য কেউ কেন?
বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা তো বটেই, তার সময়ে অলরাউন্ডার হিসেবে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তার জেনারেশনের আর কোনো অলরাউন্ডারের সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১০ হাজার রানের সঙ্গে ৫০০ এর বেশি উইকেট নেই। এবং বিশ্বের আর কোনো দলের হাতে এমন একজন নেই, যিনি দশ ওভার বল করবেন, আবার দলের সেরা ব্যাটসম্যানদেরও একজন হবেন। সাকিব আল হাসান বাস্তবিক অর্থেই বাংলাদেশ দলের জন্য পরশ পাথর, যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশ দল প্রাণ ফিরে পেয়েছে বহুবার।
অন্ধকার ২০১৪ সালের কথাই মনে করুন না। অনাপত্তিপত্র না নিয়ে সিপিএল খেলতে যাবার জন্য ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হলেন, কিন্তু তার অভাবে দল হাসফাস করলো রীতিমতো, যেন পানি থেকে কোনো এক মাছকে উঠিয়ে আছড়ে ফেলা হয়েছে মাটির বুকে। এর আগে টিভি ক্যামেরায় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবার জন্য তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন, সেই তিন ম্যাচের ভেতর বাংলাদেশ হেরেছিলো আফগানিস্তানের সাথে। সাকিব সেবার ফিরেই করেছিলেন ১৬ বলে ৪৪, বাংলাদেশ সেই ম্যাচ হেরেছিলো, কিন্তু সাকিব বুঝিয়েছিলেন তিনি ঠিক কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।
সেই ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনা হয়েছিলো তিন মাসে, সাকিব জিম্বাবুয়ের সাথে ফিরেছিলেন, সেই ফেরাকে রাজসিক বললেও কম হবে। ঢাকায় প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে উইকেট নিয়েছিলেন ছয়টি, বেশ ভালো প্রত্যাবর্তন, তাই না?
সব ছাপিয়ে গেলেন খুলনায়, দ্বিতীয় টেস্টে। প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে এক টেস্টে দশ উইকেট ও সেঞ্চুরি তুলে নিলেন, ক্রিকেট ইতিহাসে তৃতীয়। বাকি দুজন? ইয়ান বোথাম ও ইমরান খান, যাদের নামের প্রতিশব্দ কিংবদন্তি।
ওয়ানডেতে প্রত্যাবর্তনেও সেঞ্চুরি এবং চার উইকেট, সাকিবকে তখন ইয়ান বোথামকে করা প্রশ্নটা করাই যেত,
তোমার চিত্রনাট্য কে লিখে দেয়?
বাস্তবে, কেউ দেয় না, সাকিব নিজেই লেখেন। নিজেই লেখেন বলেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওজন কমিয়ে বিশ্বকাপে যান, দল অষ্টম হবার পরও ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট নিয়ে সেরা খেলোয়াড় হবার দৌড়ে থাকেন, হন না, ঠিক ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালের মতো একটুর জন্য। কিন্তু তাতে আক্ষেপ সাকিব আল হাসানের সামান্যই, দলের জন্যই তিনি খেলেন। ভাঙা আঙুল নিয়েও এশিয়া কাপ খেলে যান, কারণ দলের তাকে প্রয়োজন। কিংবা ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সুস্থ না হবার পরও নিদাহাস ট্রফিতে খেলতে চলে যান দলের মনোবলের যোগান দিতে, সাকিব আল হাসানকে আপনি একগুঁয়ে, অহংকারী কিংবা উদ্ধত বলতেই পারেন, আপনার বলার উপর কারও হাত নেই। কিন্তু এরকম উদ্ধত বিশ্বসেরাই বা ক’জন পায় বলুন?
বাংলাদেশের জয়ে সাকিবের অবদান নিয়ে কথা বলতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ফুরোবে, একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান তবু দেওয়া যাক। সাকিবকে নিয়ে বাংলাদেশ ওয়ানডে জিতেছে ৯৪টি, সেখানে সাকিব উইকেট পাননি, এমন ম্যাচ মাত্র ২০টি। আর সেই ২০ ম্যাচে ৩০ এর চেয়ে কম রানে সাকিব আউট হয়েছেন, এমন ঘটনা মাত্র ৯টি। অর্থাৎ, পরিসংখ্যান আপনাকে যতবারই মিথ্যে বলে থাকুক না কেন আগে, এবার অন্তত আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সাকিব আল হাসান আসলে কে। আবারও আগের কথা বললে, সাকিবের গুরুত্বটা ঠিক ঠিক টের পাওয়া যায় সাকিব না খেললেই।
সে যা-ই হোক, সে অনেক কথা, সে কথা তুলে রাখা যাক, সাকিব আল হাসান ফিরে আসবেন, আবার বীরদর্পে তার বাম হাতকে তরবারি বানিয়ে প্রতিপক্ষের রক্তরাঙা পরাজয়ে হেসে উঠবেন। আবারও স্যালুট ঠুকবেন বেন স্টোকস কিংবা অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে, কিংবা পাখির মতো উড়ে বেড়াবেন ২২ গজ ছাড়িয়ে আকাশপানে, অমরত্বের পথে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা, “ইশ! যদি সাকিব থাকতো…” বলে বেড়ানো।
সেই অপেক্ষায় এবং এই রোগাক্রান্ত মহামারির সময়ে সাকিব আল হাসানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন সাকিব আল হাসান, সময়ের সেরা, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা!